আঠারোশো বাষট্টি সালের জানুয়ারি মাসে রয়্যল জিয়োগ্রাফিক্যাল সোসাইটির সংসদভবনে একটা মস্ত সভার আয়োজন হয়েছিলো। প্রথম থেকেই শ্রোতারা অত্যন্ত কৌতূহলী ও উৎসুক হয়ে ছিলো, সভাপতির উদ্দীপ্ত বক্তৃতা শুনতে-শুনতে তারা ক্রমেই উত্তেজিত হয়ে উঠলো। হাততালির প্রবল আওয়াজ আর প্রশংসার একটানা গুঞ্জনে সভাঘর অল্পক্ষণের মধ্যেই মুখরিত হয়ে গেলো। বক্তৃতা শেষ করে বসবার আগে সভাপতি বললেন, ভৌগোলিক অভিযানে ইংরেজরাই পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে উঁচু আসন। দখল করেছে। ইংলণ্ডের সেই গৌরব শিগগিরই আরো বাড়িয়ে দেবেন ডক্টর ফার্গুসন। যে-কাজ সফল করে তোলার চেষ্টা তিনি করছেন, (শ্রোতাদের একজন চটপট বলে উঠলো, তা যে সফল হবে, তাতে কোনোই সন্দেহ নেই,) তা সফল হলে আফ্রিকার অসম্পূর্ণ মানচিত্র অচিরেই পূর্ণাঙ্গ হয়ে দেখা দেবে। আর যদি তার সকল চেষ্টাই বিনষ্ট হয়ে যায়, যদি তার সব উদ্যমই ব্যর্থতার অন্ধকারে তলিয়ে যায়, তাহলেও তার পরাজয় এ-কথাই আরেকবার প্রমাণ করে দেবে যে, দুঃসাহসে ভর দিয়ে যে-কোনো কাজেই রত হতে পারে বলে জীবকুলের মধ্যে মানুষ শ্রেষ্ঠ।
বক্তৃতা পুরোপুরি শেষ হবার আগেই ডক্টর ফার্গুসনের দীর্ঘ জীবন কামনা করে সকলে মুখর হয়ে উঠলো। তক্ষুনি অভিযানের খরচ জোগাবার জন্যে চাঁদা সংগৃহীত হতে লাগলো। দেখতে-দেখতে তার অভিযানের জন্যে সাঁইত্রিশ হাজার পাঁচশো তিন পাউণ্ড জোগাড় হয়ে গেলো। জিয়োগ্রাফিক্যাল সোসাইটির একজন সভ্য সভাপতিকে জিগেস করলেন, ডক্টর ফার্গুসন কি আমাদের সামনে একবারও বেরুবেন না?
কেন বেরুবেন না! সবাই যদি চান তো এক্ষুনি তিনি এখানে আসতে পারেন।
সভাঘরের চারদিকেই তুমুল শোরগোল উঠে গেলো, আমরা একবার ডক্টর ফার্গুসনকে চোখে দেখতে চাই!
একজন ছিলো একটু সেয়ানা গোছের চালিয়াৎ, সে তো বলেই দিলে, ধুর, ধুর–ফার্গুসন নামে কোনো লোকই নেই–ও-সব ধাপ্পা, নিছক বাজেকথা।
আরেকজন আবার সেইসঙ্গে ফোড়ন কাটলে, ঠিকই বলেছো। কেন তোমরা বুঝতে পারছে না যে এ-সবই বুজরুকি।
তখন সভাপতি বললেন, ডক্টর ফার্গুসন, আপনি যদি দয়া করে একবার মঞ্চে এসে দাঁড়ান তো ভালো হয়। এরা সবাই আপনাকে একবার দেখতে চাচ্ছেন।
তক্ষুনি গম্ভীর চেহারার এক ভদ্রলোক স্থির পায়ে মঞ্চের উপর এসে উঠে দাঁড়ালেন। শ্রোতারা সোল্লাসে হাততালি দিয়ে উঠলো। ফার্গুসনের বয়েস চল্লিশের কিছু কম, শক্ত সুঠাম শরীর, তীক্ষ্ণ্ণ নাকে বুদ্ধির ছাপ, আর চোয়ালের চৌকো হাড়ের রেখায় একধরনের দৃঢ়তা মিশে আছে। কোমল চোখে ঝলমল করছে বুদ্ধি, বাহুযুগল দীর্ঘ, আর কাঁধের হাড় মস্ত আর চওড়া। তার পা দেখেই দর্শকেরা আন্দাজ করে নিলে যে, হ্যাঁ, পায়ে হেঁটে দীর্ঘ পথ পর্যটন করার ক্ষমতা তার আছে বটে। ফার্গুসন সভাপতির পাশে এসে দাঁড়াবার সঙ্গে-সঙ্গেই ঘরের কোলাহল ভীষণ বেড়ে গেলো। হাত নেড়ে সবাইকে শান্ত হতে ইঙ্গিত করলেন ফার্গুসন, তারপর ডানহাতের তর্জনী শূন্যে তুলে বললেন, ঈশ্বরের ইচ্ছাই পূর্ণ হোক।
তার এই একটি কথায় শ্রোতারা যেমনভাবে উত্তেজিত হয়ে উঠলো, ক্যাডেন বা ব্রাইটের হাজার বক্তৃতাতেও তা কখনও হয়নি। এই-যে ফার্গুসন, যিনি পলকের মধ্যে সহস্রের হৃদয় জয় করে নিলেন, তার পরিচয় নানা কারণেই নিশ্চয়ই পাঠকদের অজ্ঞাত নেই।
ফার্গুসনের বাবা ছিলেন ইংরেজ নৌবহরের একজন সাহসী সেনাধ্যক্ষ। ছেলেবেলা থেকেই বাবার সঙ্গে-সঙ্গে সমুদ্রে দিন কাটিয়েছেন ফার্গুসন। এমনকী তুমুল লড়াই চলবার সময়েও ছেলেকে কাছোড়া করতেন না তার বাবা। তখন থেকেই ফার্গুসন সব বিপদ-আপদকে তুচ্ছ করতে শিখেছেন। একটু বয়েস হতেই ফার্গুসন দিনরাত অ্যাডভেনচারের বই নিয়ে সময় কাটাতে শুরু করে দেন। সে-সব অ্যাডভেনচারের বইয়ে গাজাখুরি ও আজগবি রোমাঞ্চকর উপ্যাখ্যান থাকতো না, থাকতত বিশ্ববিখ্যাত পর্যটকদের ভ্রমণ-বৃত্তান্ত। হাজার বিপদ-আপদকে তুচ্ছ করে অজ্ঞাতের সন্ধানে বেরিয়েছেন তারা, পদে-পদে নানারকম বিপত্তি ও দুর্দৈবের সঙ্গে সাক্ষাৎ হচ্ছে তাদের, তবু কেউ এক পাও পিছনে হঠে যেতে রাজি হননি; একবারে না-পারলে আবার বেরিয়েছেন তারা, শেষকালে হয়তো মৃত্যুকেই বরণ করে নিয়েছেন, কিন্তু সব সত্ত্বেও একটুও পেছিয়ে যাননি। এইসব বই বালক ফার্গুসনের কল্পনাকে চেতিয়ে দিতে, উসকে দিতে তার মন, আর তখন থেকেই ভেতরে-ভেতরে নিজেকে সেইসব নায়কদের সঙ্গে তিনি মিলিয়ে নিতেন। সেইসব বাধা-বিপত্তি বিপদ-আপদ তাঁকে উৎকণ্ঠা ও আশঙ্কায় ভরে দিতো সত্যি, কিন্তু সেইসব বিপদ-আপদের হাত থেকে তারা যেভাবে নিজেদের উদ্ধার করতেন, তা তাঁকে বিস্তর আমোদ ও আনন্দ দিতো। তবে মাঝে-মাঝে তাঁর মনে হতো এমন অবস্থায় পড়লে তিনি নিজে নিশ্চয়ই আরো সহজে উদ্ধার লাভ করতে পারতেন। ছেলের মনের ধাত বা চেহারা বাবার অজ্ঞাত ছিলো না। নানা ধরনের বিজ্ঞানশিক্ষায় ছেলে যাতে বুৎপত্তি লাভ করে, সেইজন্যে প্রথম থেকেই তিনি বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিলেন। ফলে, মৌমাছিরা যেমন করে বহুকিছু থেকে মধু সংগ্রহ করে একটু-একটু করে মৌচাক গড়ে তোলে, তেমনিভাবে নানা বিদ্যা থেকে মানসিক খাদ্য নিষ্কাশন করে ফার্গুসনের বিদগ্ধ মানস গড়ে উঠেছিলো।
পিতার মৃত্যুর পর সেনাবাহিনীতে কাজ নিয়ে ফার্গুসন ভারতবর্ষে বাংলাদেশে এলেন, কিন্তু অল্প দিনের মধ্যেই সেনাবাহিনীর রুটিন-বাঁধা, একঘেয়ে, কাজ তাকে বিষম অরুচিতে ও বিতৃষ্ণায় ভরে দিলে। তরবারি পরিত্যাগ করে অচিরেই তিনি পর্যটক হয়ে উঠলেন, তারপর গোটা ভারতবর্ষ ভ্রমণ করতে তাঁর আর খুব-বেশি দিন লাগলো না। দেশ ঘোরার ইচ্ছেটা তার এতই প্রবল ছিলো যে একদিন সকালে কলকাতা থেকে পায়ে হেঁটে সরাসরি সুরাটের দিকে রওনা হলেন। ভারতবর্ষ ভ্রমণ সাঙ্গ করে ক্রমেক্রমে রুশদেশ, আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়াও ঘুরে এলেন তিনি। কোনো কিছুতেই তার কোনো অসুবিধে হতো না। অনেকদিন অনাহারে কাটাতে হয়েছে, তবু হাল ছেড়ে দিয়ে পেছ-পা হননি। ঘুম তো ছিলো যেন তার হুকুমের চাকর, তার কথাতেই যেন ওঠ-বোস করতো। সময়ে-অসময়ে সুবিধেয়-অসুবিধেয় সংকীর্ণ স্থানে কি প্রশস্ত জায়গায় যখন যতটুকু দরকার ততটুকু ঘুমুতে পারতেন তিনি-ঠিক নাপোলিয়র মতো।
বিশেষ-কোনো সমিতির সভ্য না-হওয়া সত্ত্বেও ডেইলি টেলিগ্রাফে নিয়মিত ভ্রমণবৃত্তান্ত লিখতেন বলে জনসমাজে ফার্গুসন সুপরিচিত ছিলেন। কিন্তু লোকে তার নাম জানলেও খুব কম লোকের সঙ্গেই তার সাক্ষাৎ পরিচয় ছিলো। কোনো সভা-সমিতিতে যোগ দিয়ে, কি বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে, তিনি একটুও সময় নষ্ট করতেন না। ভাবতেন, যতক্ষণ সভায় বসে তর্কাতর্কি করে খামকা সময় নষ্ট করবো, ততক্ষণ কোনো-একটা তথ্য আবিষ্কারের চেষ্টা করলে ঢের বেশি কাজ দেবে। পর্যটক ফাণ্ডসন যা দেখতেন, তার একেবারে অন্তঃস্থল পর্যন্ত না-দেখে ছাড়তেন না। সেই কারণে সাধারণ পর্যটকদের সঙ্গে তার দৃষ্টিভঙ্গির বিস্তর পার্থক্য ছিলো।
একদিন ডেইলি টেলিগ্রাফ লিখলে :
এতদিনে নির্জন আফ্রিকার কালো অবগুণ্ঠন খুলে যাবে, এতদিনে নীরবতা ভেঙে কথা কয়ে উঠবে উষ্ণ জঙ্গলের মৌন অন্ধকার। ছ-হাজার বছর ধরে অবিশ্রান্ত চেষ্টা করেও যার সন্ধান মেলেনি, এবারে, এতদিনে, সত্যিই, তা সব আবরণ উন্মোচিত করে দেখা দেবে। নীলনদের উৎস আবিষ্কার করার চেষ্টা এতকাল শুধু অসম্ভব ও বাতুল কল্পনা বলেই পরিচিত ছিলো। বহুকালের চেষ্টায় মাত্র তিনটে প্রবেশপথ মুক্ত হয়েছিলো কালো আফ্রিকার। ডেনহ্যাম ও ক্ল্যাপারটনের আবিষ্কার-করা পথে মাত্র সুদান পর্যন্ত গিয়েছিলেন ডক্টর লিভিংস্টোন; ক্যাপ্টেন গ্র্যান্ট ও ক্যাপ্টেন স্পীক ভিন্ন একটি পথ দিয়ে আফ্রিকার কয়েকটি হ্রদ আবিষ্কার করেছিলেন। যেখানে এসে পথ তিনটে মিলেছে, সেটাই আফ্রিকার মধ্যখান বলে সকলের ধারণা। শিগগিরই আফ্রিকার এই ত্রিবাহুসংগমে যাত্রা করছেন ডক্টর ফার্গুসন। তিনি স্থির করেছেন, পূর্বআফ্রিকা থেকে পশ্চিম আফ্রিকা পর্যন্ত গোটা এলাকাটাই তিনি আকাশযানে করে যাবেন। আমরা যতদূর জানতে পেরেছি তার মোদ্দা কথাটা এই যে, ফাসন ঠিক করেছেন তিনি জাজিবার থেকে বেলুনে করে বরাবর পশ্চিমমুখো যাবেন। এই যাত্রা যে কোথায় এবং কীভাবে শেষ হবে, তা একমাত্র ঈশ্বরই বলতে পারেন। আমরা সর্বান্তঃকরণে এই বীর পর্যটকের সাফল্য কামনা করছি।
ডেইলি টেলিগ্রাফে এ-খবরটা বেরুবার সঙ্গে-সঙ্গেই সারা দেশে দস্তুরমতো হৈচৈ পড়ে গেলো। অনেকেই বললে, এ একেবারে অসম্ভক কথা। অমন করে কি বেলুনে চড়ে একটা আস্ত মহাদেশে যাওয়া যায় নাকি কখনও! আসলে ফার্গুসন বলে কেউ নেই, ওটা কারু ছদ্মনাম, ডেইলি টেলিগ্রাফে সে প্রবন্ধ লিখতে। এই সুযোগে কাগজের কাটতি বাড়াবার জন্যে ডেইলি টেলিগ্রাফে সে এই বুজরুকি তুলে দিয়েছে। সম্পাদক মশাইকে তো চিনি, একবার অমনি একটা হুজুগ তুলে তিনি আমেরিকার মাথা খেয়েছিলেন, এবার দেখছি ইংলণ্ডেরও মাথা খেতে বসেছেন। অন্যান্য খবরের কাগজও একটা সুযোগ পেয়ে গেলো, তারা ডেইলি টেলিগ্রাফকে ঠাট্টা-বিদ্রপ করে নানা ধরনের প্রবন্ধ ও ব্যঙ্গচিত্র প্রকাশ করতে শুরু করে দিলে। ফার্গুসন অবশ্য যথারীতি চুপচাপই থাকলেন, এই ব্যাপারে কোনো উচ্চবাচ্যই করলেন না।
কিছুকাল পরে সবাই যখন শুনতে পেলে যে, সত্যিই সুবিখ্যাত লায়ন কম্পানি ফার্গুসনের বেলুন তৈরির ভার নিয়েছে আর ইংরেজ সরকার রেজোলিউট নামে আস্ত একটি জাহাজ ফার্গুসনের ব্যবহারের জন্যে নিযোজিত করেছে, তখনই সকল সন্দেহ দূর হয়ে চারদিকে তুমুল সাড়া পড়ে গেলো। এই খবরটাও প্রথম প্রকাশ করেছিলো ডেইলি টেলিগ্রাফ; খবরটার যথার্থতা নিয়ে কেননা প্রশ্নই যখন করা গেলো না, তখন হু-হু করে তার কাটতি বেড়ে গিয়ে কাগজের মালিকরা রীতিমতো কেঁপে উঠলেন।
সারা ইংলণ্ডে এই নিয়ে বাজি ধরা শুরু হয়ে গেলো। সত্যিই ফার্গুসন নামে কেউ আছেন কি না, প্রথমে বাজি ধরা হলো তা নিয়ে; দু-নম্বর বাজির বিষয় হলো, এমন একটি অসম্ভব ও দুঃসাহসী অভিযানে সত্যিই কেউ শেষ পর্যন্ত প্রবৃত্ত হবে কি, এই প্রশ্ন; পর্যটন সফল হবে কি না, ফার্গুসন আর ইংলণ্ডে ফিরতে পারবেন কি, এইসব নিয়েও বাজি ধরা হতে লাগলো।
প্রত্যেকদিন দলে-দলে লোক এসে ফার্গুসনকে প্রশ্নে-প্রশ্নে ব্যতিব্যস্ত ও উত্ত্যক্ত করে তুললে। অনেকে আবার নানা প্রশ্ন করেই ছেড়ে দিলে না, তারা আবার তার সঙ্গে যাবার জন্যেও আব্দার ধরতে লাগলো। ফার্গুসন যদিও স্থিরভাবে সকল প্রশ্নের যথাসাধ্য উত্তর দিলেন, তবু একটি ব্যাপারে একেবারে অবিচল থেকে গেলেন-কাউকেই তিনি সঙ্গে নিতে রাজি হলেন না।