আজ সাতই আষাঢ়, বৃহস্পতিবার। কাল মাঝরাত থেকে ঝুপঝুপিয়ে বৃষ্টি নেমেছে। একসময় বৃষ্টির দিনরাতগুলো আমার ভাল লাগত। তখন বয়স কম ছিল। এখন বৃষ্টি পড়লে বিরক্ত লাগে। এ সময় আমি কোনও কাজ করতে পারি না। মুক্ত আকাশ না হলে আমার মেশিনগুলো অচল। অতএব এই ভোরবেলায় আমার দোতলার বারান্দায় বেতের চেয়ারে চুপচাপ বসে আছি।
ঠিক আমার পায়ের দুপাশে ওরা দুজন বসে আছে। একটার নাম সার, অন্যটার নাম মেয়। দুটো কুকুরের জন্মদিন এক, দেখতেও হুবহু একই রকম। এদের পূর্বপুরুষরা এদেশি। সেন্ট্রাল পার্কের কোণে জড়োসড়ো হয়ে পড়ে থাকা একদিনের বাচ্চাদুটোকে আমি নিয়ে এসেছিলাম। আজকাল নেড়িকুকুর কেউ বাড়িতে পোষে না, কিন্তু এদের দেখলে কে এখন নেড়ি বলবে? তিন বছর ধরে মুরগির মাংস আর ক্যাপসুল খেয়ে এখন বেশ তাগড়াই হয়ে গেছে। সার বসে আছে তার সামনের দুই থাবায় মুখ রেখে। চোখ দুটো সতর্ক ভঙ্গিতে খোলা। বারান্দায় রেলিংয়ে গড়িয়ে পড়া জলের ফোঁটাকেও ও বোধ হয় সন্দেহ করছে। এই কুকুরটার দেখেছি খুব সন্দেহ বাতিক। মেয় পাশ ফিরে শুয়ে দিব্যি ঘুমিয়ে আছে। এমন আরামপ্রিয় অলস কুকুর পৃথিবীতে আর আছে কিনা আমার জানা নেই। দুটোর স্বভাবে কোনও মিল নেই শুধু একটি ব্যাপার ছাড়া। আরশোলা দেখলে দুটিতেই ভয়ে ছুটে গিয়ে লুকোয় আমার ওয়ার্ডরোবের তলায়।
এই কুকুর দুটো আমায় ইদানীং চিন্তায় ফেলেছে। একদিনের বাচ্চাকে মানুষ করা যে কী ঝামেলার, তা যে করেনি সে বুঝতে পারবে না। তার ওপর একসঙ্গে দু-দুটো। তা ওরা যখন একটু বড় হল, তখন আবিষ্কার করলাম দুজনের কেউ ডাকাডাকি করে না। বাড়িতে কুকুর আছে দুটো, অথচ ঘেউ-ঘেউ শব্দ নেই। রাগিয়ে দিয়ে দেখেছি রাঙা চোখে তাকায়, দাঁত বের করে ভয় দেখায়, কিন্তু গর্জন করে না। শেষপর্যন্ত আমি সিদ্ধান্ত নিলাম এ দুটো বোবা। যমজদের ধরনধারণ একরকমের হয় বলে শুনেছি, কিন্তু দুটো কুকুর একসঙ্গে বোবা হবে, এমনটা শুনিনি। একসঙ্গে জন্মেছে, দেখতেও একই রকম বলে যমজ-যমজ ভাবা যেতে পারে।
সার এবং মেয় হুঙ্কার দেয় না, ডাকাডাকি করে না জানার পরও ওদের ফেলতে পারিনি। আসলে মেয়র চাহনি দেখে আমার মায়া পড়ে গিয়েছিল। ওকে রেখে সারকে বিদায় করা যায় না। কিন্তু এক বছরের মাথায় সার তার বিক্রম দেখিয়ে আমাকে মুগ্ধ করল! মধ্যরাতে চোর ঢুকেছিল বাড়িতে। ব্যাটা একটা ছিচকে চোর। ল্যাবরেটরি থেকে বেরিয়ে আমি সবে বিছানায় শুয়েছি, এই সময় পরিত্রাহি চিঙ্কার কানে এল। আলো জ্বালাতেই হেলতেদুলতে মেয় এল আমার ঘরে। আমার পাজামার ঢোলা কাপড় ধরে টানতে লাগল। ওকে অনুসরণ করে দেখলাম ভেতরের বারান্দায় একটি লোক চিত হয়ে পড়ে আছে আর সার তার বুকের ওপর থাবা রেখে বীভৎস দাঁতগুলো দেখিয়ে যাচ্ছে। অনেক ডাকাডাকি করে সারকে ওখান থেকে সরাতে পারলাম। লোকটা হাউমাউ করে কেঁদে আমার পায়ে লুটিয়ে পড়ল। পেটের জ্বালা সইতে না পেরে চুরি করতে এসেছিল বলে জানাল। তখন মাঝরাত। পুলিশকে ফোন করে ডেকে এনে তাদের হাতে তুলে দিতে পারতাম। কিন্তু তাতে লোকটা চড়চাপড় একটু বেশি পরিমাণে খেত, মাসখানেকের জেলও হয়তো হত, কিন্তু আরও চুরির জন্যে মরিয়া হত। লোকটা যে পেশাদার চোর নয়, তার প্রমাণ ওর সঙ্গে কোনও অস্ত্র ছিল না। থাকলে সারকে মেরে ফেলে পালিয়ে যেতে পারত।
লোকটার নাম গঙ্গাপদ। কিচেন খুলে ওকে খেতে দিলাম। জানলাম বাড়িতে বৃদ্ধা মা ছাড়া আর কেউ নেই। বাগানে মালীর কাজ করত। এখন বেশিরভাগ লোকই ফ্ল্যাটবাড়িতে থাকে। মালীর কাজটা গিয়েছে। কোনও বিকল্প না পেয়ে এই পেশায় নেমেছিল। খাওয়াদাওয়ার পর লোকটিকে বিদায় করে দিয়েছিলাম। কিন্তু পরদিন সকালেই সে ফিরে এল। বলল, সে বাঁচতে চায়। আমি যদি তাকে সাহায্য করি তা হলে চিরকৃতজ্ঞ থাকবে। একবার ভাবলাম। তারপর রাজি হয়ে গেলাম। সেই থেকে গঙ্গাপদ এবাড়ির কাজে লেগে গেছে। এর মধ্যে তার মা মারা যাওয়ার পর কোনও পেছনটান নেই। গঙ্গাপদর কাজকর্ম দেখে আমি মুগ্ধ। আমার কখন কী প্রয়োজন তা সে দুদিনেই বুঝে নিয়েছে। কিন্তু সার ওকে কিছুতেই স্বস্তিতে থাকতে দেয় না। মানুষের জীবনে যে পরিবর্তন আসতে পারে তা বোঝার মতো বুদ্ধি জন্ধুদের নেই। সারের স্বভাব হয়ে দাঁড়িয়েছে কিছুক্ষণ অন্তর-অস্তর গঙ্গাপদকে দেখে আসা। এই যেমন এখন বৃষ্টির ফোঁটা ছেড়ে সে ভেতরে চলে গেল। আমি জানি সে গঙ্গাপদকে দেখতে গেছে।
দুপুরের দিকে বৃষ্টি কমল। কিন্তু আকাশের দখল রাগী মেঘেরা ছাড়েনি। মেঘমুক্ত আকাশ না হলে আমার কাজকর্ম বন্ধ। তবু আমি ছাদের ঘরে গেলাম। ওই ঘরেই আমার সব যন্ত্রপাতি রয়েছে। ভারী দরজার তালা খুলে ভেতরে পা দিতেই বিরক্তিটা বাড়ল। একটা দিন মিছিমিছি নষ্ট হল মেঘের জন্যে। এই ঘরের ছাদ সিমেন্ট-পাথরের নয়। বিশেষ কায়দায় পাতলা ইস্পাতের চওড়া পাত রবারে মোড়া, সুইচ টিপলে যা মাঝখান থেকে সরে যায়। সরে গিয়ে আকাশটাকে দেখিয়ে দেয়। রবারে মোড়া বলে তেমন গরম হয় না দিনের বেলায়। ঘরটি বড় এবং প্রচুর যন্ত্রে ঠাসাঠাসি। মাঝে-মাঝে মনে হয় যেগুলো নিত্য লাগে না সেগুলো সরিয়ে ফেলে চলাফেরার সুবিধে করি। কিন্তু কখন যে কার প্রয়োজন হবে কে বলতে পারে। ঘরের মাঝখানে যে যন্ত্রটা অনেকটা টেকির মতো উঁচিয়ে আছে, সেটি আমার দীর্ঘ জীবনের সাধনার ফল শব্দ আলোর সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে না। আলো যে প্রচণ্ড শক্তিশালী তা নানাভাবে প্রমাণিত। এমনকী মানুষের শরীরের চিকিৎসার জন্যে নিয়ন্ত্রিত আলো ব্যবহৃত হচ্ছে। ছেলেবেলা থেকেই যা দুর্বল তার প্রতি আমার আকর্ষণ বেশি। হয়তো সেকারণেই শব্দ নিয়ে এককালে গবেষণা শুরু করেছিলাম। পৃথিবীতে যেসব শব্দ বাজে তার অনেকটা দূষণসীমার বাইরে হলেও, বলতে বাধ্য হচ্ছি, আকাশে বেজে যাওয়া শব্দমালার তুলনায় কিছুই নয়। সেইসব মহাশব্দের অতি সামান্যই পৃথিবী স্পর্শ করে। মেঘে-মেঘে ঘর্ষণ লেগে যে আওয়াজ, যা আমাদের কানে তালা লাগিয়ে দেওয়ার উপক্রম করে, তার শক্তিও তো কম নয়!
ওই মহাশব্দের সন্ধানে ছিলাম এতকাল! ওই শব্দ সংগ্রহ করে সুচের মতো সরু করে নিলে এই পৃথিবীতে যা ইচ্ছে তাই করে ফেলা যায়। আলো মানুষের শরীরে গজিয়ে ওঠা উৎপাদগুলো বিনা অস্ত্রোপচারে হেঁটে ফেলতে পেরেছে। চিকিৎসাবিজ্ঞানের এই উন্নতি আমাদের উপকার করেছে। কিন্তু আলোর তীক্ষ্ণতা শুধু ছেদন করতে পারে, ধ্বংস করতে পারে কিন্তু বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে না। মানুষের শরীরের গতিপ্রকৃতির সম্পূর্ণ আন্দাজ চিকিৎসকরা এখনও আবিষ্কার করতে পারেননি। শরীরের ভেতর গজিয়ে ওঠা কোনও-কোনও উৎপাদ সামান্য আঘাতে দ্রুত বিস্তৃত হয়ে মৃত্যুকে ডেকে আনে। তা অস্ত্রের আঘাত হোক অথবা আলোর। এই ক্ষেত্রে আবার শব্দকণা কাজ করতে পারে বলে মনে করছি। এই বিপুল শক্তিশালী শব্দকণাকে নিয়ন্ত্রণে রেখে শরীরের বাড়তি বিপজ্জনক উৎপাদের ভেতরে ঢুকিয়ে দিলে যে বিস্ফোরণ ঘটবে তা কল্পনা করে আমি শিহরিত হচ্ছি। যেভাবে ডিনামাইট একটি টিলাকে উড়িয়ে দিয়ে জায়গাটিকে সমতল করে দেয় নিমেষে, ঠিক সেইভাবে শরীর তার পূর্বাবস্থা ফিরে পাবে। এই আবিষ্কার শেষ হলে মানবজাতির বড় কল্যাণ হবে। এই আবিষ্কারের কোনও নামকরণ আমি এখনও করিনি। ওটা নিয়ে ভাবতে হবে।
মাসকয়েক আগে লন্ডনে যেতে হয়েছিল। আমার পরিচিত ব্রিটিশ বিজ্ঞানী বব উইলসের সৌজন্যে ব্রিটিশ বিজ্ঞান কনফারেন্সে কথা বলার সুযোগ পেয়েছিলাম। সে-সময় আমি আমার গবেষণা নিয়ে ধন্দে ছিলাম। এই মেশিনটা সম্পূর্ণ হয়নি তখন। আকাশের বিপুল শব্দমালার সন্ধান পাচ্ছি, কিন্তু তাদের সংগ্রহ করে পৃথিবীতে নিয়ে আসার পদ্ধতিটিতে গোলমাল হচ্ছে। বব আমার কাজকর্মের কথা জানত। সে-ই পরামর্শ দেয় লন্ডনে যাওয়ার। পৃথিবীতে কোনও-না-কোনও বিজ্ঞানী হয়তো একই বিষয় নিয়ে কাজ করছেন অথবা আমার বিষয়ের কথা জেনে কেউ নতুন আলোকপাত করতে পারেন, সম্মেলনে গেলে এরকম সম্ভাবনা থাকে। ববের পরামর্শ মেনে নিয়েছিলাম। তিনদিনের সম্মেলন। আমার কথা বলার সুযোগ হয়েছিল প্রথম দিনেই। আমার বক্তব্য শুনে সবাই বেশ অবাক বলে মনে হল। পরদিন কয়েকটা কাগজ খবরটা ছেপে মন্তব্য করল, বিজ্ঞান যেভাবে এগিয়ে চলেছে তাতে শব্দ নিয়ে এই গবেষণা একশো বছর পর পূর্ণতা পেলেও পেতে পারে। অর্থাৎ আমি এবং আমার পরের প্রজন্ম যখন থাকব না পৃথিবীতে, তখন কোনও গবেষক সফল হলেও হতে পারেন। এ যেন ভদ্রতা দেখিয়ে ঘুরিয়ে বোকা বলা।
তৃতীয় দিনের সকালবেলায় ববের সঙ্গে বেড়াতে বেড়াতে ট্রাফালগার স্কোয়ারে গিয়েছিলাম। এই জায়গাটা আমার খুব ভাল লাগে। ব্রিটিশদের এককালে সিংহ বলা হত। পৃথিবীর অনেকটাই তারা জয় করেছিল ছলে বলে কৌশলে। ট্রাফালগার স্কোয়ারের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করেছে দুদান্ত দেখতে পাথরের সিংহ। আর সেইসঙ্গে ছড়িয়ে থাকা পায়রার ঝাঁক।
চারপাশ দিয়ে লন্ডনের গাড়িগুলো ছোটাছুটি করছে, মাঝখানের বিরাট বাঁধানো চত্বরটা চমৎকার শান্ত হয়ে রয়েছে। এই সময় বব বলল, আরে দ্যাখো কাণ্ড, কার্ল সিংহের সওয়ার হওয়ার চেষ্টা করছে। হেই কার্ল, ওটা করতে যাচ্ছ কেন? পড়ে গেলে দেখতে হবে না?
আমি দেখলাম একজন প্রবীণ সাহেব অনেকটা উচুতে সিংজ্ঞে পায়ের কাছে পোঁছে ডাক শুনে আমাদের দিকে তাকিয়ে হাত নেড়ে হাসলেন। বব আরও কয়েকবার চেঁচামেচি করায় ভদ্রলোক হাত ছেড়ে দিয়ে কোনওমতে শরীর বাঁচিয়ে নীচে নেমে এলেন।
বব বলল, যাক, আমার কথা শুনেছ বলে ধন্যবাদ।
কার্ল বললেন, না হে! এই ভদ্রলোককে দেখে নেমে এলাম। আপনার গবেষণার বিষয় আমাকে উৎসাহিত করেছে। আমিও শব্দ নিয়ে সামান্য কাজকর্ম করছি। আমার নাম কার্ল বেকার।
পরিচয় হল। ভদ্রলোক থাকেন হামবুর্গে। নিজের গবেষণার ব্যাপারে কিছুই না বলে আমার ব্যাপারটা জানতে চাইলেন। এটাকে বিনয় বলে মনে হয়েছে আমার। আমার যে যন্ত্রটা শেষ পর্যন্ত সহযোগিতা করছে না, সেটার ব্যাপারে তিনি কৌতূহল দেখালেন। এই সময় বব আমাকে চোখ টিপে সতর্ক করল। আমি বুঝলাম নিজের সব গোপন তথ্য জানাতে সে নিষেধ করছে। আমি ভাসা-ভাসা বললাম। এভাবে বলতে আমার খারাপ লাগছিল।
ফিরে আসার তিন সপ্তাহ পরে কালের চিঠি পেলাম। আমার সঙ্গে আলাপ করে, তিনি রীতিমতো উত্তেজিত। আমার যন্ত্রটার ব্যাপারে তাঁর মতামত জানিয়েছেন। এই ব্যাপারটা নিয়ে ভাবলেই আমার হাসি পায়। বব ইশারা করায় আমি আমার যন্ত্রটার বিপরীত চিত্র কার্লের কাছে তুলে ধরেছিলাম। কার্ল লিখেছেন সেই কল্পিত বিপরীত যন্ত্র নিয়ে তাঁর মন্তব্য। অনেক সময় ছেলেবেলায় অঙ্ক কষতে গিয়ে আটকে গেলে উলটো দিক থেকে করতে করতে সেটা বুঝে ফেলতাম। খুব কম ক্ষেত্রেই এমনটা হয়। এবার হল। কালের একটা উপদেশ কাজে লাগিয়ে আমার যন্ত্রটাকে দারুণ শক্তিশালী করলাম। লন্ডনের সম্মেলনে গিয়ে এই বিরাট উপকার হল। তারপর কার্ল দুটো চিঠি লিখেছেন। শেষ চিঠি এসেছে মাসতিনেক আগে। তাঁকে জানিয়েছিলাম আমি তেমন এগোতে পারিনি। একথাটা সত্যি নয়। কিন্তু বব আমাকে অনুরোধ করেছে যতক্ষণ না আমি সম্পূর্ণ কৃতকার্য হচ্ছি ততক্ষণ ব্যাপারটা গোপন রাখাই মঙ্গল।
এই চিন্তাটা ববই আমার মাথায় ঢুকিয়েছে। বিজ্ঞান যেমন মানুষের উপকার করে, ঠিক তেমনই অপকার করতেও তার জুড়ি নেই। কোনও শক্তিমান দেশ যদি সংগৃহীত শব্দ যুদ্ধে ব্যবহার করে তা হলে ব্যাপারটা ভাবলেই শরীর হিম হয়ে যায়।
আজকের দিনটাই বেকার চলে গেল। আমার বয়স হয়েছে। এই সময় একটা দিন যদি নষ্ট হয়, তা হলে খুব ক্ষতি। বাঙালিদের তুলনায় আমি খুব লম্বা। ছফুট এক ইঞ্চি লম্বা মানুষেরা দীর্ঘজীবী হয় না। তা ছাড়া আমি বেশ মোটা। খেতে খুব ভালবাসি। এখন তো গঙ্গাপদ চমৎকার রাঁধছে। যখন একা ছিলাম তখন রোজ ঘি দিয়ে ভাত মেখে আলু সেদ্ধ করে কাঁচালঙ্কা আর সরষের তেলে চটকে খেতাম। পৃথিবীর যে-কোনও উপাদেয় খাবারের চেয়ে এই মেনু আমার কাছে হাজার গুণ আকর্ষক। গঙ্গাপদকে বলে দেওয়ায় আর যা কিছু হোক এটা রাখছে। মোটা মানুষেরা বেশিদিন বাঁচে না। নীরদচন্দ্র চৌধুরী একশো বছরে পা রেখেছেন। ওঁর শরীর খাটো এবং রোগা। আমার পিতৃদেব গিয়েছিলেন পঞ্চান্নতে, আমি তবু পনেরো বছর বেশি টানছি। অবশ্য আমার কোনও রোগবালাই নেই, এই রক্ষে।
সন্ধের মুখে অবনীমোহন এলেন। সময় পেলেই তিনি আসেন। জানবার কৌতূহল তাঁর খুব। ওঁর সঙ্গে কথা বলে বেশ আরাম পাই। অবনীমোহন লোক্যাল থানার ওসি। বাইশ বছর পুলিশে চাকরি করেও চমৎকার ভদ্রলোক হয়ে আছেন। ইদানীং পুলিশ সম্পর্কে আমাদের ধারণা বেশ বদলেছে। লালবাজারে অনেক আই পি এস অফিসার আছেন, যাঁরা ইচ্ছে করলে অধ্যাপনা করতে পারেন, রবীন্দ্রনাথের গান গীতবিতান না দেখে গাইতে পারেন, কথাবার্তায় শিক্ষার ছাপ আছে। অবনীমোহন অবশ্য আই পি এস নন তবু রীতিমতো ভদ্রলোক। সামনের চেয়ারে বসে অবনীমোহন জিজ্ঞেস করলেন, আপনার গঙ্গাপদ কীরকম কাজকর্ম করছে?
বললাম, চমৎকার।
বাঃ। ওকে আমাদের হাতে তুলে না দিয়ে আপনি একটি সামাজিক উপকার করেছেন। আমরা ওকে কয়েক মাসের জন্যে জেলে পুরতাম, ফিরে এসে আবার চুরিচামারি করত। লোকটা যদি চিরদিনের মতো শুধরে যায় তার চেয়ে ভাল আর কী আছে।
বুঝলাম। তা তুমি এই বাদলার দিনে উদয় হলে কোত্থেকে?
আর বাদলের দিন! এতকাল মানুষ-চোর ধরতাম, এখন জন্তু-চোর ধরতে হবে।
কীরকম?
প্রায়ই খবর আসছে, একটা বানর জাতীয় প্রাণী, সেটা হনুমান অথবা ওরাং ওটাংও হতে পারে, প্রায়ই কারও-কারও কিছু চুরি করছে। দোকান থেকে জিনিস তুলে উধাও হয়ে যাচ্ছে। এ-পাড়ায় গাছগাছালি বেশি। এত দ্রুত সেটা লুকিয়ে পড়ে, কেউ তার হদিস পায় না।
কোত্থেকে এল?
কেউ বলতে পারছে না। আমি তাকে চোখে দেখিনি।
কিন্তু বুনো জন্তুজানোয়ার তো চুরিবিদ্যায় এত দক্ষ হতে পারে না। অবনী।
ঠিকই বলেছেন। কোনও মতলববাজ লোক ওকে ট্রেনিং দিয়েছে। আজ দোকান থেকে জিনিস তুলছে, কাল ব্যাঙ্কের টাকা ছিনতাই করবে না তা কে বলতে পারে। আমি বিকেল থেকে এই এলাকায় পাক খাচ্ছিলাম এই ভেবে যে, সন্ধের মধ্যে ব্যাটা নিশ্চয়ই তার মালিকের কাছে ফিরে যাবে। ফিরে যেতে হলে ওকে দেখা দিতেই হবে। গাছপালার আড়াল তখন সে পাবে না। কিন্তু রাত নামল, তবু সে বেপাত্তা!
আমি হাসলাম। ব্যাপারটা ভাবতে মজা লাগছিল। বানর অথবা হনুমানের বুদ্ধি খুবই সীমায়িত। একমাত্র ওরাং ওটাংই মানুষের কাছাকাছি বুদ্ধি ধরতে পারে। অবনীমোহন চলে গেলে তাড়াতাড়ি খেয়ে নিলাম। টিভি বলছে আগামীকাল মেঘমুক্ত আকাশ পাওয়া যাবে। তাই ভোর চারটের মধ্যেই ঘুম থেকে উঠতে হবে।
খাওয়াদাওয়া শেষ করে গঙ্গাপদ বলল, বাবু, আপনি যদি অনুমতি দেন, তা হলে এখন থেকে এ বাড়িতেই আমি থেকে যেতে পারি। মা-বাবা নেই, বস্তিতে ঘরভাড়া করে থাকি, শুধু শুতেই তো যাই।
কয়েক বছর আগে হলে বিরক্ত হতাম। আমি একা থাকাই পছন্দ করি। একটা লোক নাকের ডগায় ঘুরঘুর করছে, এটা আমার ভাল লাগত না। কিন্তু ওই লন্ডন থেকে ফিরে আসার পর আমি যেন বেশ দুর্বল হয়ে গিয়েছি। গঙ্গাপদর কথা শুনে ভালই লাগল। বয়স হয়েছে, রাতবিরেতে প্রয়োজন হলে ও কাজে লাগবে। বললাম, বেশ। আমার আপত্তি নেই।
তা হলে সামনের রবিবার থেকে থাকব। সেদিন মাসপয়লা।
গঙ্গাপদ চলে গেলে দরজা বন্ধ করে শোয়ার ঘরে এলাম। আগে এসব প্রায়ই অগোছালো থাকত। গঙ্গাপদ আসার পর শ্রী ফিরেছে। বিছানায় শরীর এলিয়ে দিতেই ঘুম এসে গেল। ঈশ্বর এই আশীবাদটি আমাকে করেছেন, ঘুমের বড়ি খেতে হয়নি কোনওদিন।