আজকাল আর সুরজিৎ সন্ধ্যার কিছু পরেই ঠিক বাঁধা টাইমে আসছে না—আগে তো নয়ই বরং আধ ঘণ্টা তিন কোয়ার্টার কখনো কখনো এক ঘণ্টা পরেও আসে। তবে আসে ঠিকই। একদিনও আসা তার বাদ যায় না।
আর সেই কারণেই সন্ধ্যা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত মালঞ্চকে প্রস্তুত হয়েই থাকতে হয়–এই সময়টা কোথাও সে বেরুতে পারে না।
মালঞ্চ শোবার ঘরে বড় আয়নাটার সামনে একটা ছোট টুলের উপর বসে সাদা হাতীর দাঁতের চিরুনিটা দিয়ে চুল আঁচড়াচ্ছিল।
দীর্ঘ কেশ মালঞ্চর। এত দীর্ঘ যে কোমর ছাড়িয়ে যায়। একসময় কেশের দৈর্ঘ্য তার আরো বেশী ছিল—এখন অনেকটা কম। চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে অন্যমনস্কভাবে মালঞ্চ সামনের মসৃণ আরশির গায়ে প্রতিফলিত তার নিজের চেহারাটার দিকে তাকাচ্ছিল।
নিজের চেহারার দিকে তাকিয়ে দেখতে ভাল লাগে বেশ মালঞ্চর, বয়স তার যা-ই হোক—দেহের বাঁধুনি আজও তার বেশ আঁটসাঁটই আছে। গালে ও কপালে অবিশ্যি দুচারটে বক্ররেখা পড়েছে, তা সেগুলো ফেস্ ক্রিমের প্রলেপ পড়লে চট করে তেমন ধরা যায় না। মালঞ্চ অবিশ্যি বুঝতে পারে, তার বয়স হচ্ছে আর সেই কারণেই বোধ হয় নিজের দেহচর্চা সম্পর্কে সর্বদাই সজাগ থাকে।
কিছুক্ষণ আগে শহরের বুকে সন্ধ্যা নেমেছে তার ধূসর আঁচলখানি বিছিয়ে। জুন মাস শেষ হতে চলল–এখনও বৃষ্টির চিহ্নই নেই। সারাটা দিন ভ্যাপসা গরম। দুপুরে এখানে ওখানে খানিকটা মেঘ জমেছিল, মনে হয়েছিল বুঝি বিকেলে বা সন্ধ্যার দিকে বৃষ্টি নামতে পারে, কিন্তু নামল না।
সুরজিতের আজকাল আসার কোন সঠিক নির্দিষ্ট সময় নেই, তাহলেও সে আসবেই একবার, আর সেই কারণেই প্রতি সন্ধ্যায় মালঞ্চকে সেজেগুজে প্রসাধন করে প্রস্তুত থাকতে হয়।
অনেক সময় মালঞ্চর নিজেকে যেন কেমন ক্লান্ত লাগে।
আজকাল কিছুদিন ধরে মালঞ্চ যেন লক্ষ্য করছে সুরজিতের মধ্যে একটা পরিবর্তন। কেমন যেন একটু গম্ভীর-গম্ভীর মনে হচ্ছে—বালিগঞ্জের বনেদী পাড়ায় দোতলার একটা ঘরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ভেজা চুলের মধ্যে সাদা হাতীর দাঁতের চিরুনিটা চালাতে চালাতে ভাবছিল মালঞ্চ। একঝলক মিষ্টি গন্ধ নাকে এসে ঝাপটা দিল মালঞ্চর।
মালঞ্চর বুঝতে কষ্ট হয় না, ওটা বেলফুলের গন্ধ।
আর ঠিক সেই মুহূর্তে একটা ভীরু গলায় ডাক ভেসে এলো পশ্চাৎ থেকে মালা!
মালঞ্চ গলা শুনেই বুঝতে পেরেছে কার গলা। মালঞ্চ ফিরেও তাকাল না। যেমন চিরুনিটা দিয়ে চুল আঁচড়াচ্ছিল তেমনি আপন মনে আঁচড়াতেই লাগল।
মালা! আবার সেই ভীরু ডাক।
এবারও মালঞ্চ ফিরে তাকাল না এবং আগের মতই আরশির সামনে চুলে চিরুনি চালাতে চালাতে সাড়া দিল, কি চাই?
যে লোকটি একটু আগে হাতে একটা বেলফুলের মালা নিয়ে ঘরে ঢুকেছিল সে এবার কুণ্ঠিত ভাবে বললে, খুব ব্যস্ত, না?
না, বল কি বলবে? মালঞ্চ বললে।
তোমার জন্যে একটা বেলফুলের মালা এনেছি, গলায় পরবে!
পিছনে ফিরে না তাকিয়েই মালঞ্চ নিরাসক্ত কণ্ঠে বলল, রেখে যাও ঘরের মধ্যে।
কোন সাড়া এলো না অন্য দিক থেকে।
দরজার ওপরেই দাঁড়িয়ে লোকটি, বয়স ৪৫ থেকে ৫০-এর মধ্যে। সমস্ত শরীরটাই মানুষটার কেমন বুড়িয়ে গিয়েছে, চুলে পাক ধরেছে। ভাঙা গাল, সরু চোয়াল, কোটরগত দুটি চক্ষু! পরিধানে একটা ময়লা পায়জামা, গায়ে একটা হাফ-হাতা সস্তা দামের শার্ট, মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, দুতিন দিন বোধ হয় লোকটা ক্ষৌরকর্ম করে নি।
লোকটা নিঃশব্দে অল্পদূরে দাঁড়িয়েই আছে।
কি হল, দাঁড়িয়ে রইলে কেন। মালঞ্চ বলল, বললাম তো মালাটা ঘরে রেখে যাও।
দাও না গলায় মালাটা, মোড় থেকে দু টাকা দিয়ে কিনে নিয়ে এলাম!
কে বলেছিল তোমাকে দুটাকা খরচ করে বেলফুলের মালা আনতে?
কেউ বলেনি, আমারও তো ইচ্ছা যায়—
তাই নাকি! ফিরে তাকাল মালঞ্চ এতক্ষণে।
হ্যাঁ, তাছাড়া সে-সব দিনগুলো ভুলতে পারি কই, রোজ অফিস থেকে ফেরার পথে তোমার জন্যে এমন দিনে মালা নিয়ে আসতাম, তুমি খোঁপায় জড়াতে।
দেখ সুশান্ত, বাজে কথা রেখে তোমার আসল কথাটা খুলে বল তো এবার।
আসল কথা আবার কি—সুশান্ত মৃদু গলায় বলল।
কি ভাবো তুমি যে, আমি এতই বোকা, কিছু বুঝি না?
নির্লজ্জর মত হাসতে থাকে সুশান্ত।
বোকার মত হেসো না, তোমার ঐ হাসি দেখলে আমার গা জ্বলে যায়-ঘেন্না করে—ভনিতা রেখে আসল কথাটা বলে ফেল।
সুশান্ত কোন জবাব দেয় না।
আমি জানি তুমি কেন এসেছ, কেন ঐ মালা এনেছ।
কেন?
টাকা চাই, তাই না?
না, মানে—
পরশু চল্লিশ টাকা দিলাম, এর মধ্যেই শেষ হয়ে গেল? আমার আজ স্পষ্ট কথা, টাকা তুমি পাবে না।
পাবো না! কেমন যেন একটা করুণ আর্তি সুশান্তর কণ্ঠে বেজে উঠল। হাসিটা নিভে গেল।
না, তোমার মদের খরচা রোজ রোজ আমি দিতে পারব না। লজ্জা করে না। তোমার, এ বাড়িতে নিচের তলায় চাকরের মত পড়ে আছ, আর একজনের দুমুঠো কৃপার অন্নে ক্ষুন্নিবৃত্তি করছ, গলায় দড়ি জোটে না তোমার
দড়ি জুটলে সে দড়ি গলায় দেবার সাহস হত না—তা না হলে সুরজিতের। রক্ষিতার কাছে আমি হাত পাতি—
ঘেন্না পিত্তি বলে একটা সাধারণ বস্তু, যা প্রত্যেক মানুষের মধ্যে থাকে, তাও কি তোমার নেই?
সব—সবই ছিল মালা, ঐ যে তোমার ঘেন্না, পিত্তি, লজ্জা, সবই ছিল কিন্তু তুমিই আমার বস্ত্রহরণ করেছ—
আমি?
হ্যাঁ, তুমি—তুমি ছাড়া আর কে?
থাম! ঘৃণা-মিশ্রিত একটা গর্জন করে ওঠে মালঞ্চ।
একটু আগে গলায় দড়ি দেবার কথা বলছিলে না মালা—অন্য কেউ হলে হয়তো এতদিনে দিত, কিন্তু আমি–
তুমি দিতে পারলে না। তাই না?
প্রশ্নটা যে নিজেকেও নিজে অনেকবার করিনি তা নয়। জানি সব দোষ আমারই।
সেটা বোঝ?
হয়তো বুঝি বা ঝবার চেষ্টা করি, ভাবি।
আর বুঝবার চেষ্টা করো না! বুঝেছ?
একটা কথা বলব মালা?
জানি কি বলবে, আমি শুনতে চাই না।
আচ্ছা–আবার কি আমরা আমাদের পূর্বের জীবনে ফিরে যেতে পারি না?
কি বললে?
জানি তা আর কোন দিনও সম্ভব নয়—আজকের মালঞ্চ আর মালা হতে পারে না। অনেক পথ হেঁটে আমরা দুজন দুজনার থেকে অনেক দূরে চলে গিয়েছি। আজ তোমায় দেওয়া সুরজিৎবাবুর এই বাড়িটা, এর সব দামী দামী আসবাব-পত্ৰ, এই প্রাচুর্য জানি আমার ঘরে থাকলে এসব কিছুই তোমার হত না, কিন্তু–
বল। থামলে কেন?
সেদিনও বোধহয় আমি তোমাকে স্বাচ্ছন্দ্যের মধ্যেই যথাসাধ্য রাখার চেষ্টা করেছি—
কি বললে, স্বাচ্ছন্দ্য! একটা ভাল কাপড়—একটা গয়না কখনো তুমি দিতে পেরেছ?
তবু তুমি একদিন আমার সবকিছু জেনে শুনেই আমার ঘরে এসে উঠেছিলে—
ভুল—ভুল করেছিলাম। নিত্য ভাত ডাল আর চচ্চড়ি-মাসান্তে একটা মিলের শাড়ি–
তুমি তো জানতে আমার মাইনে কি ছিল—কিছুই তোমার অজ্ঞাত ছিল না কিন্তু তাহলেও বোধহয় তোমার সম্মান ছিল, ইজ্জত ছিল। সেদিন কারো রক্ষিত হতে হয়নি তোমাকে।
জোঁকের মুখে যেন নুন পড়ল, আর কোন কথা বলতে পারে না মালঞ্চ।
তুমি বুঝবে না মালা, মানুষ কত বড় অপদার্থ হলে তার নিজের স্ত্রীকে অন্য এক পুরুষের রক্ষিতা হয়ে থাকতে দেয়,-কথাগুলো বলে মালাটা সামনের টেবিলের ওপর রেখে সুশান্ত ঘর থেকে বের হয়ে যাবার জন্যে দরজার দিকে এগিয়ে যায়।
দাঁড়াও, কত টাকার দরকার তোমার। শদুই হলে চলবে?
সুশান্ত থমকে তাকায় স্ত্রীর মুখের দিকে। হাত পেতে চাইলেও যে কখনো চল্লিশ-পঞ্চাশটার বেশী টাকা দেয় না, সে কিনা আজ দুশো টাকা দিতে চায়।
শোন, আমি তোমাকে আরো বেশি টাকা দিতে পারি, তবে একটি শর্তে–
শর্তে?
হ্যাঁ। এ বাড়ি ছেড়ে তুমি চলে যাবে, আর কখনো এ বাড়িতে আসবে না। লেখাপড়া তো শিখেছ, একটা কাজ জুটিয়ে নিতে পারো না আবার–
একবার চাকরি ছেড়ে দিয়েছি, তাও আজ পাঁচ বছর, তাছাড়া বয়সও হয়েছে, এ বয়সে আর কে চাকরি দেবে!
বল তো আমি সুরজিতকে বলে দেখতে পারি। সে অত বড় অফিসের ম্যানেজার–
জানি মালা, সুরজিতবাবু হয়তো চেষ্টা করলেই তার রক্ষিতার প্রাক্তন স্বামীকে যে কোন একটা কাজ জুটিয়ে দিতে পারে, কিন্তু না, থাক মালা, তোমাকে আমার জন্যে কাউকে কিছু বলতে হবে না, আমি চললাম।
টাকা নেবে না—এই যে টাকা চাইছিলে?
না মালা, আচ্ছা চলি। সুশান্ত ঘর থেকে বের হয়ে এলো।
বারান্দা পার হয়ে মোজেইক করা সিঁড়ির ধাপগুলো অতিক্রম করে নিঃশব্দে নেমে এলোর কোনদিকেই আর তাকাল না, সোজা গেট দিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ল।
হাঁটতে শুরু করে সুশান্ত। সন্ধ্যার তরল অন্ধকার আরো গাঢ় হয়েছে, পথের দুপাশে আললাগুলো যেন সেই অন্ধকারকে যতটা তরল করা উচিত ততটা পারছে না।
তবে কি আকাশে মেঘ নামছে? সত্যি কি মেঘ জমছে, এবার বৃষ্টি নামবে বাতাসে একটা ঠাণ্ডা ভাব, ভিজে ভিজে ভাব!
নামে—নামুক বৃষ্টি।
হঠাৎ যেন যে ঘেন্না বা লজ্জা এতদিন তার মনের মধ্যে জাগেনি সেটাই যেন তার সারা মনকে এই মুহূর্তে আচ্ছন্ন করে ফেলছে।
সত্যিই তো—সে কি মারা গেছে? একটা মৃত মানুষ সে? নচেৎ নিজের স্ত্রী আর একজনের রক্ষিতা হয়ে যেখানে আছে সেখানে সে কেমন করে পড়ে আছে! শুধু পড়ে থাকাই নয়—দুবেলা আহার করছে আর নেশার টাকা হাত পেতে নিচ্ছে। হ্যাঁ, মালঞ্চ ঠিকই বলেছে–তার গলায় দড়ি দেওয়াই উচিত ছিল।
বৃষ্টিটা বোধ হয় সত্যি সত্যিই নামবে। নামলে ভিজতে হবে—যে বাড়ি থেকে এই মাত্র সে বের হয়ে এলো সেখানে বোধ হয় আর সে ফিরতে পারবে না।
একটু মদ হলে বোধ হয় সে অনেকটা সুস্থ বোধ করতে পারত।
আগে কোন দিন মদ স্পর্শ করেনি সুশান্ত, কিন্তু ঐ মালঞ্চই একদিন তার হাতে মদের গ্লাস তুলে দিয়েছিল।
—না। সুশান্ত বলেছিল।
—খাও, দেখ তোমার মাথার ভূতটা নেমে যাবে। নিজেকে অনেকটা হালকা মনে করতে পারবে।
-তোমার ইচ্ছা আমি খাই?
–হ্যাঁ, খাও।
–বেশ, দাও—
সেই শুরু–তারপর চলেছে—এখন আর না হলে চলে না।
আবার ভাবে সুশান্ত, আর সে হিন্দুস্থান রোডের বাড়িতে ফিরে যাবে না। পাঁচ পাঁচটা বছর সে কেমন করে ছিল বালিগঞ্জের হিন্দুস্থান রোডের ঐ বাড়িটায়? সত্যিই তার মনে কোন ঘৃণা নেই, লজ্জা নেই।
সুরজিতের রক্ষিতার বাড়িতে একতলার একটা ঘরে কেমন করে কাটাল সুশান্ত এত দীর্ঘ দিন ও রাত্রিগুলো? মধ্যে মধ্যে সন্ধ্যা হলে মালঞ্চর কাছ থেকে পঁচিশ-তিরিশটা টাকা নিয়ে বের হয়ে পড়ত; এরপর ঢাকুরিয়া ব্রীজের নিচে যে লিকার শপটা খুলেছে সেখান থেকে একটা রামের বোতল কিনে লেকের কোন নির্জন জায়গায় গিয়ে বসত।
বোতলটা শেষ হলে অনেক রাত্রে টলতে টলতে সুরজিতের রক্ষিতার বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াত। নীচের তলার জানালাটার সামনে মৃদুকণ্ঠে ডাকত-রতন, এই রতন, দরজাটা খো বাবা।
–দাঁড়াও খুলছি। বলে রতন দরজাটা খুলে দিত। তারপর প্রতি রাতের মতন বলত, বাবু, মানদা তোমার খাবার তোমার ঘরে ঢাকা দিয়ে রেখে গিয়েছে। বলেই রতন তার ঘরে চলে যেত। আর সেও তার ঘরে গিয়ে ঢুকত।
বেশীর ভাগ রাত্রেই খেত না সুশান্ত, কেন যেন গলা দিয়ে ভাত, ডাল, মাছ, দুধ, মিষ্টি নামতে চাইত না।
প্রথম প্রথম রতনের কেমন যেন কৌতূহল হত সুশান্ত সম্পর্কে—কে লোকটা? কিন্তু পারত গিন্নীমাকে শুধোতে, না পারত বাড়ির অন্য কাউকে শুধাতে।
বাবু আসেন রোজ বিকেলে, রাত এগারোটা সাড়ে এগারোটা নাগাদ আবার তার গাড়িতে চেপে চলে যান। ঝকঝকে গাড়িটা ঠিক সন্ধ্যার কিছু পূর্বে বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ায়। উর্দি পরা ড্রাইভার নেমে গাড়ির দরজা খুলে দেয়। সুরজিৎ ঘোষাল গাড়ি থেকে নেমে কোন দিকে না তাকিয়ে সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে যান। জুতোর শব্দটা সিঁড়ির মাথায় মিলিয়ে যায়।
আবার রাত সাড়ে এগারোটা নাগাদ জুতোর শব্দ শোনা যায়। রতন বুঝতে পারে সুরজিৎ ঘোষাল বের হয়ে যাচ্ছেন। ড্রাইভার গাড়ির দরজা খুলে দেয়। সুরজিৎ ঘোষাল গাড়িতে উঠে বসলে গাড়িটা হুস করে বের হয়ে যায়।
তার প্রশ্নের জবাব একদিন গিন্নীমার ঝি মানদাই দিয়েছিল। রতন প্রশ্ন করেছিল, হ্যাঁ গা মানদা, রোজ রাত্রে বাবু চলে যান কেন বলতে পারো?
ফিক করে হেসে ফেলেছিল মানদা। বলেছিল ওসব লোকেরা তাদের মেয়েমানুষের ঘরে রাত কাটায় নাকি! আসে চলে যায়।
—কি বলছ! মেয়েমানুয! উনি তো বাবুর স্ত্রী, গিন্নীমা—
মৃদু হেসে মানদা বলেছিল, এ পাড়ার সকলে তাই জানে বটে, তবে উনি তো কর্তার বিয়ে করা ইস্ত্রী নন—
রতন কল্পনাও করতে পারেনি, যে, গিন্নীমা সুরজিৎ ঘোষালের বিয়ে করা স্ত্রী নয়। তাই সত্যিই অবাক হয়ে কিছুক্ষণ চেয়ে ছিল মানদার মুখের দিকে।
–সত্যি?
-তবে কি মিথ্যে!
—কি করে জানলে? কে বললেন?
-কে আবার বলবে, আমি জানি। উনি বাবুর রক্ষিতা, রক্ষিতাকেই বাবু এ বাড়ি করে দিয়েছেন।
—বল কি! ভদ্রপাড়ায় বাবু তার রক্ষিতাকে রেখেছেন! পাড়ার লোকেরা কেউ কিছু বলে না?
-এই কলকাতা শহরে পাশের বাড়ির লোকও পাশের বাড়ির খোঁজ রাখে না। আর রাখলেই বা কি, জানলেও কেউ উচ্চবাচ্য করে না। এনারা সব সভ্য ভদ্রলোক যে গো। তাছাড়া কে কার রক্ষিতা জানাটা এত সহজ নাকি! এ কি সেই সব পাড়ার মেয়েছেলে, একেবারে চিহ্নিত করা
সত্যি! রতনের যেন কথাটা শুনে বিস্ময়ের অবধি ছিল না প্রথম দিন। মানদা তখনো বলে চলেছে, এ শহরে কত ভদ্রলোকের মেয়েদেরকেই তো দেখলাম, কত যে অমন দেহ-ব্যবসা চালাচ্ছে তা জানবারও উপায় নেই
মানদার কথাগুলো শুনলেও কিন্তু সেদিন পুরোপুরি বিশ্বাস করে উঠতে পারেনি রতন। তবে তা নিয়ে আর বেশী মাথা ঘামায়নি। ঘামাতেই বা যাবে কেন, চাকরি করতে এসেছে সে, চাকরিই করবে। কত্তা-গিন্নীর হাঁড়ির খবর দিয়ে তার প্রয়োজন কি।
কিন্তু যেদিন রতন জানতে পেরেছিল নীচের তলার ঐ বাবুটিই গিন্নিমার স্বামী, রতন যেন একটা প্রচণ্ড ধাক্কা খেয়েছিল সেদিন। ঐ সংবাদটিও মানদাই পেশ করেছিল তার
কাছে।
—আচ্ছা মানদা, নীচের তলায় যে বাবুটি থাকেন, উনি কে? মধ্যে মধ্যে দেখি গিন্নীমার ঘরে যান
মুচকি হেসে মানদা বলেছিল, উনিই তো আমাদের গিন্নীমার স্বামী–
—উনিই গিন্নীমার স্বামী!
–হ্যাঁ।
–হ্যাঁ, সুরজিৎ ঘোষালই এ বাড়ির আসল মালিক হলেও গিন্নীমার স্বামী হচ্ছে ঐ নীচের তলার বাবুটি। এ পাড়ার সবাই জানে ওটা সুশান্ত মল্লিকের বাড়ি।
সুশান্ত মল্লিক ব্যবসা করেন। পাড়ার লোকেরা মধ্যে মধ্যে আসে, গল্পগুজবও করে। সুশান্ত মল্লিক হেসে হেসে তাদের সঙ্গে কথাও বলে। কিন্তু তারা কেউই অনুমান করতে পারে না ভিতরের ব্যাপারটা।