০১. অশুভ গ্রহ

০১.অশুভ গ্রহ

সবাই গোল হয়ে ঘিরে আছে বড় মনিটরটি, একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে গ্রহটির দিকে। অত্যন্ত নিখুঁত বিশ্লেষণ করার উপযোগী মনিটর, নব্বই হাজার কিলোমিটার দূরের আশ্চর্য গ্রহটিকে স্পষ্ট ফুটিয়ে তুলেছে। কিম জিবান, দলের ইঞ্জিনিয়ার, মনিটরের বিভিন্ন নবগুলি টিপে টিপে গ্রহটির ছবিটিকে আরো স্পষ্ট করার চেষ্টা করছিল। মনিটরে গ্রহটির আশ্চর্য রংগুলির বেশির ভাগই কৃত্রিম, কিম জিবানের দেয়া, খানিকটা দেখতে সুবিধা হওয়ার জন্যে, এবং খানিকটা ভালো দেখানোর জন্যে সে ব্যক্তিগত জীবনে শিল্পী, অন্তত নিজে তাই বিশ্বাস করে, তাই কোনো কাজ না থাকলে মনিটরের একঘেয়ে ছবিগুলিতে রং দিয়ে একটু বৈচিত্র্য আনার চেষ্টা করে। মহাকাশযানের নিয়মকানুনের ফাইল খুঁজে দেখলে হয়তো দেখা যাবে, কাজটা বা মাত্রার বেআইনি কাজ, কিন্তু সেটা নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না, সবাই একসাথে থাকলে শব্দ করে হাঁচি দেয়াও নাকি যষ্ঠ মাত্রার বেআইনি কাজ। কি জিবান আজ খুব সুবিধে করতে পারছে না, গ্রহটিতে এমন একটা কিছু আছে, যে, যতই রং দেয়ার চেষ্টা করুক, কিছুতেই সেটাকে দেখতে ভালো লাগানো যাচ্ছে না। খোঁচা খোঁচা দাড়ি ঘষতে ঘষতে কিম জিবান পুরো গ্রহটিতে এক পোঁচ নীল রং নিয়ে দেয়, নীল রংয়ে যে-কোনো গ্রহকে ভালো দেখায়, কিন্তু এবারে সেটা নিয়েও কোনো লাভ হল না। বড় বড় গোলাকার গর্ত, যেগুলি নাকি খুব ধীরে ধীরে আকার পরিবর্তন করছে, গ্রহটিকে একটি কুৎসিত সরীসৃপের রূপ দিয়েছে, নীল রংয়ের সরীসৃপ এমন কিছু সুদর্শন বস্তু নয়।

লু মহাকাশযান সিসিয়ানের দলপতি। দলপতির দায়িত্ব অন্যদের থেকে বেশি, কথাটা পুরোপুরি সত্যি নয়। যখনি কোনো সিদ্ধান্ত নিতে হয়, সিসিয়ানের মূল কম্পিউটার সিডিসি তাকে সাহায্য করে। সিডিসি চতুর্থ মাত্রার কম্পিউটার, পৃথিবীতে চতুর্থ মাত্রার কম্পিউটারের সংখ্যা হাতে গোনা যায়। তার স্মৃতিভাণ্ডারে শুধু যে অপরিমেয় তথ্য রয়েছে তাই নয়, প্রয়োজনে যে-কোনো মেমোরি ব্যাংকে যোগাযোগ করে প্রয়োজনীয় জিনিস জানার অধিকার এবং ক্ষমতা দুইই তার আছে। সিডিসি ছাড়াও মহাকাশযানে অন্যান্য বিজ্ঞানীরা রয়েছে, এটি একটি অনুসন্ধানী মহাকাশযান, এখানে সবাই কোনো-না-কোনো ধরনের বিজ্ঞানী। লুকে যখন সিদ্ধান্ত নিতে হয়, সে অন্য বিজ্ঞানীদের সাথে আলোচনা করে, যেটা সবাই ভালো মনে করে, সেই সিদ্ধান্তই নেয়া হয়। তবে তিন মাত্রা বা তার থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে হলে লুকে আনুষ্ঠানিকভাবে সেটি উচ্চারণ করতে হয়, শুধুমাত্র তার গলার স্বরই সিসিয়ানের চার হাজার ভিন্ন ভিন্ন কম্পিউটারে প্রোগ্রাম করা আছে, এবং শুধুমাত্র সেই তার গলার স্বর দিয়ে সিদ্ধান্তগুলি কার্যকর করতে পারে। এখন যদি গ্রহটিতে না গিয়ে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, সেটা হবে তিন মাত্রার সিদ্ধান্ত। মহাকাশযান সিসিয়ান ধ্বংস করে দেয়ার সিদ্ধান্ত হচ্ছে প্রথম মাত্রার সিদ্ধান্ত, সেটি আবার সে একা নিতে পারে না, আরো দু’জন বিজ্ঞানীকে একইসাথে নিতে হয়। মহাকাশযানের নিয়মকানুনের কোনো শেষ নেই, দৈনন্দিন জীবনে কখনো তার প্রয়োজন হয় না, তাই সেগুলি নিয়ে কারো মাথাব্যথা নেই।

লু নিজের ঠোঁট কামড়াতে কামড়াতে মনিটরটির দিকে তাকিয়ে ছিল, যখনই সে কোনো সমস্যায় পড়ে, সে নিজের অজান্তে নিচের ঠোঁট কামড়াতে থাকে। এই মুহূর্তে তাকে কী সমস্যায় ফেলেছে বলা মুশকিল। মাসখানেক আগে একটা মনুষ্যবিহীন মহাকাশযান প্রটোনিয়াম আকরিক নিয়ে এদিক দিয়ে যাওয়ার সময় এই গ্রহটির ছবি তুলেছিল। এই বিশাল বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে গ্রহ-উপগ্রহের কোনো সীমা নেই, কিন্তু মানুষের সংখ্যা সীমিত, কাজেই বিজ্ঞানীরা নিজের চোখে সব গ্রহ-উপগ্রহ দেখে আসতে পারে না। গুরুত্বপূর্ণ হলে বড়জোর একটা স্কাউটশিপ পাঠানো হয়। এই মহাকাশযানটির কথা ভিন্ন, কারণ প্রটোনিয়াম আকরিক নিয়ে যে-মহাকাশযানটি যাচ্ছিল, সেটি যেছবি তুলে এনেছে, সেটি দেখলে মনে হয় গ্রহটির আকার খুব আশ্চর্যভাবে পাল্টে যায়। এ-ধরনের গ্রহ খুব কম, কেন্দ্রীয় বিজ্ঞান আকাদেমির এজন্যে এটার উপর খুব কৌতুহল। লু মহাকাশযান সিসিয়ান নিয়ে একটি অভিযান শেষ করে ফিরে আসছিল, বিজ্ঞান আকাদেমি তাকে একটু ঘুরে এই গ্রহটা পর্যবেক্ষণ করে ফিরে আসতে বলেছে। লু নিজের ঠোঁট কামড়ে বিজ্ঞান আকাদেমির মুণ্ডপাত করে, কোনো যুক্তি নেই, কিন্তু ওর ভিতরে একটা অশুভ অনুভূতি হচ্ছে, কেন জানি মনে হচ্ছে এই গ্রহটার কাছে যাওয়া একটা দুর্ভাগ্যের লক্ষণ।

লু একটু ঝুঁকে পড়ে কিম জিবানকে বলল, কিম, তোমার দেয়া রংগুলি সরাও তো একট, দেখি জিনিসটা আসলে দেখতে কেমন।

কিম জিবান হাত নেড়ে লুয়ের কথা উড়িয়ে দিয়ে বলল, আসল জিনিস দেখে কী করবে? এটা দেখ, বেশ দেখাচ্ছে এখন।

বেশ দেখাচ্ছে? সুশান চোখ কপালে তুলে বলল, এটা তোমার কাছে দেখতে বেশ লাগছে? তোমার মাথা পরীক্ষা করানো উচিত, এত কুৎসিত জিনিস আমি আমার জনে দেখি নি।

সুশান মহাকাশযানের দু’জন জীববিজ্ঞানীর একজন। তাকে তার জীবনে অসংখ্য কুৎসিত জীবজন্তু এবং কীটপতঙ্গ দেখতে হয়েছে, সে যদি কোনো কিছুকে কুৎসিত দাবি করে, জিনিসটি কুৎসিত তাতে সন্দেহ নেই। সুশানের বয়স বেশি নয়, এই বয়সে সব মেয়ের চেহারাতেই একটা মাধুর্য এসে যায়, সুশানেরও এসেছে। কে জানে সে যদি পৃথিবীতে থাকা আর দশটি মেয়ের মতো চুল লম্বা করে চোখে রং দেয়া শুরু করত, তাকে হয়তো সুন্দরীই বলা হত। মহাকাশযানে চুল লম্বা করা চতুর্থ এবং চোখে রং দেয়া নাকি পঞ্চম মাত্রার অপরাধ।

লু আবার বলল, কিম, দেখি একবার জিনিসটা।

কিম জিবান অত্যন্ত অনিচ্ছার সাথে তার দেয়া কৃত্রিম রংগুলি সরিয়ে নেয়, সাথে সাথে গ্রহটি তার পুরো বীভৎসতা নিয়ে ফুটে ওঠে। কয়েক মুহূর্ত কেউ কোনো কথা বলতে পারে না, আটকে থাকা একটা নিঃশ্বাস সাবধানে বের করে দিয়ে রু-টেক বলল, চল, ফিরে যাই।

সবাই রু-টেকের দিকে ঘুরে তাকায়। রু– টেক মহাকাশযান সিসিয়ানের একমাত্র রবোট, তার কাজকর্মের কোনো জবাবদিহি করতে হয় না, কাজেই এধরনের কথাবার্তা শুধু সে-ই বলতে পারে। রু-টেক সবার দিকে তাকিয়ে বলল, কি, ভুল বললাম কথাটা? জিনিসটা দেখে কপোট্রনও গরম হয়ে উঠছে না? খামোকা ওটার কছে যাওয়ার দরকার কি?

রু–টেকের চমৎকার গলার স্বর তার যান্ত্রিক চেহারা এবং নিষ্পলক চোখের সাথে মোটেই খাপ খায় না, কিন্তু সে দীর্ঘদিন থেকে সিসিয়ানে আছে, আজকাল কেউ সেটি আর আলাদা করে লক্ষ করে না। লু রু–টেকের দিকে ঘুরে বলল, যাওয়ার আমার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা নেই, কিন্তু আমার ইচ্ছাই তো সবকিছু নয়।

তোমার ইচ্ছাই তো সবকিছু, রু–টেক তার সবুজাভ চোখের ঔজ্জ্বল্য বাড়িয়ে বলল, তুমি আমাদের দলপতি, তুমি শুধু মুখে একবার বলবে, আমরা ফিরে যাব, সিডিসি সাথে সাথে সিসিয়ানকে ঘুরিয়ে নেবে।

তোমার সব কিছুতে ঠাট্টা, কিম জিবান মনিটরে রংগুলি ফিরিয়ে দিতে দিতে বলল, এ রকম একটা ব্যাপার নিয়েও তোমার ঠাট্টা।

ঠাট্টা? ঠাট্টা কোথায় দেখলে?

আমরা কেন ফিরে যাব? একটা কারণ দেখাতে পারবে? কিম জিবান মুখে আলগা একটা গাম্ভীর্য এনে বলল, আমরা আছি এমন একটা মহাকাশযানে, যেটা প্রয়োজন হলে হাইপার ডাইভ দিতে পারে, সব মিলিয়ে এরকম মহাকাশযান তিরিশটাও আছে কি না সন্দেহ। এটা একটা অনুসন্ধানী মহাকাশযান, অথচ এখানে যে পরিমাণ ফিউসান বোমা আছে, সেটা দিয়ে একটা ছোটখাট মহাযুদ্ধ লাগিয়ে দেয়া যায়। উপরের ঐ লাল সুইচটাতে তিনবার টোকা দিলে চারটা আক্রমণকারী মহাকাশযান এক ঘন্টার ভিতরে এসে হাজির হয়ে আমাদের উদ্ধার করে নেবে। সিনিয়ানের কোনো ক্ষতি হলে এক মাইক্রোসেকেন্ডের ভিতর আমাদের শরীরকে তিন ডিগ্রি কেলভিন তাপমাত্রায় জমিয়ে নিয়ে ক্যাপসুলে ভরে নেবে। উদ্ধারকারীদল এসে আমাদের উদ্ধার করে নিয়ে যাবে সার্ভিস সেন্টারে, সেখানে তিন শ ডাক্তার আর চার হাজার যন্ত্রপাতি মিলে ধীরে ধীরে আম, শরকে উফ করে আমাদের রক্ষা করবে। আমরা হচ্ছি মানুষ, মানুষের সংখ্যা বেশি না, তাদের নিয়ে ছেলেখেলা করা হয় না। তুমি রবোট, তুমি এসব বুঝবে না—

রু-টেক কিম জিবানের মাথায় চাটি মেরে থামিয়ে দেয়, নাও নাও, বড় বড় বক্তৃতা শুনে কানের সার্কিট পুড়ে যাবার অবস্থা! মানুষ হলেই খালি বড় বড় বক্তৃতা দিতে হয়? আমাকে কখনো দেখেছ বক্তৃতা দিতে?

তাই তো বলছি, কিম জিবান সাবধানে মাথাটা রু-টেকের চাঁটি থেকে বাঁচিয়ে রেখে বলল, তুমি বুঝবে কি বক্তৃতা দেওয়ার মজা!

সুশান একটু এগিয়ে এসে বলল, ঠাট্টা নয় রু–টেক, তুমি অন্তত একটা যুক্তি দেখাও, কেন আমাদের গ্রহটিতে না গিয়ে ফিরে যাওয়া উচিত।

শুনবে, শুনবে তোমরা?

সবাই মাথা নাড়ে। সুশান তার ছেলেমানুষি চোখ বড় বড় করে বলল, কোনো একটা যুক্তি দেখিয়ে যদি ফিরে যাওয়া যায়, খারাপ কী?

রু-টেক গম্ভীর হয়ে বলল, যুক্তিটা খুব সহজ।

কি?

আমাদের ভালো লাগছে না।

সুশান খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ব্যস?

হ্যাঁ।

সে অনাদের দিকে তাকায়, রু- টেক ঠাট্টা করছে কি না এখনো বুঝতে পারছে।

পল কুম তার কফির মগে চুমুক দিয়ে বলল, মহাকাশযানের কী একটা ধারার কী একটা অংশে নাকি আছে যে সবার যদি একসাথে কোনো একটা কাজ অপছন্দ হয়—কোনো কারণ ছাড়াই, তাহলে নাকি সেটা না করলে ক্ষতি নেই।

রু– টেক এক হাতে অন্য হাতের উপর আঘাত করে একটা ধাতব শব্দ করে বলল, বললাম না। আমি ভুল বুলি কখনো? চল ফিরে যাই।

পল কুম কোমল দৃষ্টিতে রু-টেকের দিকে তাকিয়ে ছিল, সে দলের সবচেয়ে বয়স্ক সদস্য, জীববিজ্ঞানী দু’জনের আরেকজন। সারাজীবন পশু-পাখির জটিল মনস্তত্ত্ব নিয়ে কাজ করেছে, তাই মানুষের হাতে তৈরি রু-টেকের আশ্চর্য মানবিক অংশটুকু তাকে এত অভিভূত করে। কোনো একটা অজানা কারণে সবার ভিতরে একটা আশ্চর্য অস্বস্তির সৃষ্টি হয়েছে, রু-টেক সেটা বুঝতে পেরে চেষ্টা করছে সবাইকে ফিরিয়ে নিতে। পল কুম কোমল গলায় বলল, রু।

রু-টেক পলের দিকে তাকিয়ে বলল, কি হল?

আমি যতদূর জানি সেই ধারাটিতে আছে, দলের সব সদস্যের যদি কোনো কারণে অস্বস্তি হয়, তাহলে সেই অভিযান বাতিল করা সম্ভব।

রু-টেক সাথে সাথে বুঝে যায়, পল কুম কী বলতে চাইছে, কিন্তু তবু হাল ছেড়ে না দিয়ে সে শেষ চেষ্টা করে, আমিও তো তাই বলছি, সবার মনে হচ্ছে গ্রহটি অশুভ–

পল কুম বাধা দিয়ে বলল, সবার?

রু-টেক মাথা চুলকানোর ভান করে বলল, হ্যাঁ তাই তো দেখা যাচ্ছে।

পল কুম একটু হেসে বলল, তুমি এখনো ভালো করে মিথ্যা কথা বলা শেখ নি। আমার সাথে সাথে কয়দিন থাক, চোখের পাতি না ফেলে কিভাবে মিথ্যা কথা বলতে হয় শিখিয়ে দেব।

রু-টেক চোখ বারকয়েক সামনে-পিছনে নাড়িয়ে বলল, কেন, আমি আবার কী মিথ্যা কথাটা বললাম?

আমাদের সবার ভিতরে যে-রকম একটা অশুভ হয়েছে, তোমার ভিতরে তা হয় নি। মানুষ লক্ষ লক্ষ বছরের বিবর্তনের ফল, আমাদের কোনো এক পূর্বপুরুষ কী একটা দেখে ভয় পেয়েছিল, সেটা এখনো আমাদের রক্তের মাঝে রয়ে গেছে, তাই এখনো কিছু কিছু জিনিস কোনো কারণ ছাড়াই আমাদের অশুভ মনে হয়। মানুষ এখনো অন্ধকারকে সহজভাবে নিতে পারে না, গুহাবাসী মানুষের সব বিপদ অন্ধকারে ওত পেতে থাকত বলেই হয়তো। কিন্তু তুমি তো কোনো বিবর্তন দিয়ে আস নি, তোমাকে ফ্যাক্টরিতে তৈরি করা হয়েছে, তুমি কেন গ্ৰহটাকে অশুভ মনে করবে?

তা ঠিক। রু-টেক হার মানে, সত্যি কথা বলতে কি, গ্রহটাকে দেখতে খারাপ লাগছে, কিন্তু ঠিক অশুভ মনে হচ্ছে না। তার কারণ অশুভ বলতে তোমরা কী বোক্সাও, আমি ঠিক জানি না। কিন্তু খারাপ লাগাটাই কি যথেষ্ট নয়?

পল কুম মাথা নেড়ে বলল, না, যথেষ্ট নয়। কিম জিবান তার দেয়ালে যে-ছবি আঁকে, সেটা দেখতে তোমার আমার সবারই খারাপ লাগে, সুশান সেদিন যে-স্যুপটা বেঁধেছিল, সেটাও যথেষ্ট খারাপ ছিল—

সুশান আর কিম জিবান একসাথে পল কুমকে থামিয়ে দেয়। কিম জিবান গলার স্বরে একটা আহত ভাব ফুটিয়ে বলল, আমার আঁকা ছবি কি এত খারাপ যে, সেটাকে সুশানের স্যুপের সাথে তুলনা করতে হবে?

সবাই একসাথে হেসে ওঠে, সুশানও। কিম জিবানের বিমূর্ত ছবি নিয়ে মতভেদ আছে কিন্তু স্যুপটা আসলে এমন কিছু খারাপ হয় নি, ঠাট্টা করার জন্যে বলা হয়।

রু-টেক আবার আগের প্রসঙ্গে ফিরে আসে, তাহলে কী সিদ্ধান্ত নেয়া হল? আমরা গ্রহটাতে যাচ্ছি?

লু মাথা নাড়ে, হ্যাঁ, যাচ্ছি। তুমিও যদি বলতে গ্রহটাকে অশুত লাগছে, তাহলে ফিরে যাওয়ার একটা সুযোগ ছিল।

আমাকে কেন টালহু, রু-টেক বলল, আমি একটা যন্ত্র, তোমাদের ঐ ডিটেক্টর বা পাওয়ার জেনারেটরের মতো। পাওয়ার জেনারেটরের বক্তব্যের যদি কোনো মূল্য না থাকে, আমার বক্তব্যের মূলা থাকবে কেন?

পল কুম রু-টেকের ঘাড়ে থাবা দিয়ে বলল, কেন এখনো খামোকা চেষ্টা করে যাচ্ছ? তুমি জান তুমি দলের একজন, সত্যি কথা বলতে কি পুরো দলে একজন যদি স্বাভাবিক মানুষ থাকে, যার একটু জ্ঞানবুদ্ধি বা রসবোধ আছে, সেটা হচ্ছ তুমি। আর মহাকাশযানের এগার নম্বর ধারার চার নম্বর অংশে স্পষ্ট বলা আছে, মহাকাশযানে যদি ষষ্ঠ মাত্রার কোনো রৰােট থাকে, তাহলে তাকে মানুষের সমান মর্যাদা দিয়ে দলের সদস্য হিসেবে নিতে হবে।

রু-টেক চিন্তিতভাবে মাথা নেড়ে বলল, আমি দুঃখিত যে, আমার জনো তোমাদের সবার গ্রহটাতে যেতে হচ্ছে। কেউ একজন কি আমাকে আজ রাতের মাঝে শিখিয়ে দিতে পারবে কী ভাবে অশুভ অনুভব করতে হয়?

সুশান বলল, খুব ভালো আছ তুমি, খামোকা এই বয়সে মূতল একটা জিনিস শিখতে যেও না।

রবোটের হিসেবে আমার বয়স খুব বেশি নয় সুশান, আমাদের শৈশব শুরু হয় চল্লিশ বছরের পর!

বেশ, তাহলে অন্তত কৈশোরের জন্যে অপেক্ষা কর।

রু-টেক কাঁধ ঝাঁকিয়ে একটু সরে গিয়ে মনিটরটির দিকে তাকায়, নিজের অজান্তে তার সবুজ চোখের ঔজ্জ্বল্য বেড়ে যেতে থাকে।

 

পল কুম একটু এগিয়ে লুয়ের কাঁধে টোকা দিয়ে বলল, লু।

কি?

আমার কি মনে হয় জান?

কি?

এই গ্রহে খুব উন্নত একটা প্রাণী আছে।

লু ঘুরে তাকিয়ে বলল, কেন ওরকম ভাবছ?

পল কুম গলার স্বর নিচু করে বলল, রু-টেক ছাড়া সবার ভিতরে কেমন একটা চাপা ভয় দেখেছ? এরকম অনুভূতি শুধু একটা জীবিত প্রাণী আরেকটা জীবিত প্রাণীর ভিতরে সঞ্চারিত করতে পারে। ব্যাপারটা কীভাবে হয় ঠিক জানা নেই, পৃথিবীতে কয়েক জায়গায় এর উপরে কাজ হচ্ছে। জিনিসটাকে টেলিমরবিজম বলে। তুমি নিশ্চয়ই আগে লক্ষ করেছ, একজন মানুষের মনে যখন খুব কষ্ট হয়, তখন তার সাথে কথা না বলে, শুধু তার পাশে বসে সেটা অনুভব করা যায়?

লু অন্যমনক্কতাবে মাথা নাড়ে। মনোবিজ্ঞান সে ভালো বোঝে না, কোনটি বিজ্ঞান আর কোনটি কল্পনা সে এখনো ভালো ধরতে পারে না।

 

মহাকাশযান সিসিয়ানের কন্ট্রোল–ঘরটি হঠাৎ দেখলে মনে হবে সেখানে কেউ নেই। যে-মহাকাশযান চালানোর জন্যে প্রায় তিন হাজার ছোট-বড় কম্পিউটার কাজ করে, সেখানে কারো থাকার প্রয়োজন নেই, কিন্তু তবুও সবসময়েই সেখানে কেউ-না-কেউ থাকে। আজ সেখানে আছে কিম জিবান। কন্ট্রোল প্যানেলের সামনে আরামদায়ক চেয়ারটাতে সে প্রায় ডুবে আছে, পা তুলে দিয়েছে মনিটরটির উপরে, দুই পায়ের ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে আছে মনিটরটির দিকে। ঘরটিতে আবছা অন্ধকারে মনিটরটির রঙিন আলো ছাড়া আর কিছু নেই। সবাই বিশ্রাম নিতে গিয়েছে, তাদের মহাকাশযান সিসিয়ানের গ্রহটির মাধ্যাকর্ষণ শক্তির আওতার ভিতরে না আসা পর্যন্ত কারোরই বিশেষ দায়িত্ব নেই। সে যদিও মহাকাশযানের ইঞ্জিনিয়ার, কিন্তু গ্রহ-উপগ্রহ নিয়ে বাড়াবাড়ি কৌতূহল বলে নিজের উৎসাহে কন্ট্রোলরুমে সময় কাটানোর দায়িত্ব নিয়েছে।

যে-গ্রহটির দিকে তারা এগিয়ে যাচ্ছে, সেটির নাম ট্রাইটন। এটি অবশ্যি তার সত্যিকার নাম নয়, গ্রহটির সত্যিকার নাম হচ্ছে একটি বিদঘুটে সংখ্যা। সংখ্যাটি বিদঘুটে হলেও অর্থহীন নয়, প্রথম ছয়টি সংখ্যা দিয়ে তার অবস্থান, এবং পরের চারটি দিয়ে তার আকার-আকৃতি প্রকাশ করা হয়। অনুসন্ধানকারী কোনো দল যখন কোনো গ্রহে অভিযানে বের হয়, তখন তাদেরকে বিদঘুটে সংখ্যা ছাড়াও ব্যবহার করার জন্যে গ্রহটির একটি সাময়িক নাম দিয়ে দেয়া হয়। অভিযান শেষ হবার পর নামটিও শেষ হয়ে যায়, যারা অভিযানে অংশ নেয় তারা হয়তো আরো কিছুদিন মনে রাখে, কিন্তু তার বেশি কখনো কিছু নয়।

এই আশ্চর্য গ্রহ ট্রাইটনের দিকে যতই তারা এগিয়ে যাচ্ছে, আর সবার মতন তার ভিতরেও একটা বিতৃষ্ণা এবং চাপা ভয় জেগে উঠছে, কিন্তু সাথে সাথে তার ভিতরে জেগে উঠছে একটা আশ্চর্য কৌতূহল। গ্রহটির যতই কাছে আসছে ততই তার বিস্ময় বেড়ে যাচ্ছে, গ্ৰহতত্ত্বের প্রচলিত প্রায় সবগুলি নিয়ম এখানে অচল। প্রথমে ধরা যাক ঘনত্ব, এই আকারের একটা গ্রহের যে পরিমাণ ঘনত্ব থাকা দরকার, ট্রাইটনের ঘনত্ব তার থেকে অনেক কম, পুরো গ্রহটি যেন হালকা তুলো দিয়ে তৈরি। গ্রহ-উপগ্রহে মাধ্যাকর্ষণের জন্যে কেন্দ্রে ঘনত্ব বেশি হয়, কিন্তু আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় সেটি এই গ্রহের জন্যে সত্যি নয়। গ্রহটি ঘুরছে খুব ধীরে ধীরে, কিন্তু ঘূর্ণনটি কখনোই ঠিক নিয়মিত নয়। অবিশ্বাস্য মনে হয়, কিন্তু গ্রহটির ঘূর্ণন যেন মাঝে মাঝে পুরোপুরি থেমে যাচ্ছে, এ-ধরনের ব্যাপার ঘটতে হলে গ্রহের ভিতরে যে-রকম প্রলয়কাণ্ড ঘটা উচিত, বাইরে থেকে সেরকম কিছু দেখা যাচ্ছে না। ট্রাইটনের বায়ুমণ্ডল বলতে গেলে নেই, যা আছে সেটি অত্যন্ত বড় বড় পলিমার। ট্রাইটনের পৃষ্ঠে বড় বড় গোলাকার গর্ত, সিসিয়ানের রিপোর্ট সত্যি হলে সেগুলি শুধু যে আকার পরিবর্তন করছে তাই নয়, ক্রমাগত নাকি স্থানও পরিবর্তন করছে।

কিম জিবান ট্রাইটনের এ-ধরনের ব্যবহারের ব্যাখ্যা খুঁজে বের করার চেষ্টা করে করে কিছুক্ষণ হল হাল ছেড়ে দিয়েছে। মূল কম্পিউটার সিডিসি এত সহজে হাল ছাড়ার পাত্র নয়, সে তার সুবিশাল মেমোরি ব্যাংকের তথ্য থেকে ট্রাইটনের আশ্চর্য ব্যবহারের কাছাকাছি জিনিসগুলি ক্রমাগত পরীক্ষা করে দেখছে, কোনো কোনোটা তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হলে কিম জিবানকে জানাতেও দেরি করছে না। কিন্তু এত অল্প সময়ে এত বেশি গুরুত্বপূর্ণ জিনিস জানা হয়ে গেছে যে, কিম জিবানের আর অবাক হওয়ার ক্ষমতা নেই। সে এখন সম্পূর্ণ অন্যভাবে গ্রহটির আচার-আচরণ ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করছে, তার ব্যাখ্যা অবশ্যি কাউকে বলার মতো নয়, কারণ সেগুলি এরকম :

প্রথম ব্যাখ্যা : এটি আসলে কোন গ্রহ নয়, এটি হচ্ছে নরক। ধর্মগ্রন্থে নরকের যেবর্ণনা থাকে, তার সাথে খুব বেশি মিল নেই, কিন্তু থাকতে হবে সেটা জোর দিয়ে কে বলতে পারে? গোলাকার এই জায়গাটার ভিতরে সব পাপীদের আত্মাকে পুরে রাখা হয়, পাপীদের আর্তনাদ তারা ঠিক শুনতে পাচ্ছে না, কিন্তু সেজন্যে তাদের ভিতরে একটা চাপা ভয় আর অশুভ চিন্তা এসে বাসা বেঁধেছে।

তার এই ব্যাখ্যা যদি সত্যি হয় তা হলে ধরে নিতে হবে একটি স্বর্গও কোথাও আছে এবং সেই স্বর্গের কাছাকাছি গেলে সবার মনে আনন্দ হতে থাকবে। এই অভিযান শেষ হওয়ামাত্রই সে তাহলে স্বর্গের খোঁজে বের হবে। একটি মহাকাশযানে করে সে স্বর্গ খুঁজে বেড়াচ্ছে, জিনিসটা কল্পনা করেই কিম জিবানের হাসি পেয়ে যায়।

দ্বিতীয় ব্যাখ্যা : এটি আসলে একটি অতিকায় মহাকাশযান, এর ভিতরে রয়েছে আশ্চর্য সব প্রাণী, তাদের কিলবিলে মাকড়সার মতো পা। কেন এদের কিলবিলে মাকড়সার মতো পা, কিম জিবান ব্যাপারটির সদুত্তর দিতে পারে না, মহাকাশের প্রাণীর কথা চিন্তা করলেই কেন জানি তার চোখের সামনে কিলবিলে পা ভেসে ওঠে। টাইটনের উপরে যে গোল গোল গর্ত রয়েছে, তার ভিতর থেকে উকি মেরে সেই কিলবিলে মাকড়সাগুলি তাদের লক্ষ করছে, কাছে হাজির হওয়ামাত্রই সেগুলি তাদের উপর ঝাপিয়ে পড়ে কচকচ করে খেয়ে ফেলবে।

ব্যাখ্যাটির সমস্যা হচ্ছে যে, যদি এই কিলবিলে মাকড়সাগুলি এরকম একটা মহাকাশযান তৈরি করতে পারে, তাহলে অবশ্যি তারা সিসিয়ানের সাথে যোগাযোগ করতে পারত, কিন্তু সেরকম সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে, গ্রহটির সাথে কোনোরকম যোগাযোগ করা সম্ভব হয় নি।

তৃতীয় ব্যাখ্যা; সিসিয়ানে যেসব খাবারদাবার আছে ভুল করে তার সাথে কোনো একধরনের মাদকদ্রব্য মিশিয়ে দেয়া হয়েছে, কাজেই তাদের সবার একইসাথে বিভ্রম হচ্ছে। আসলে ট্রাইটনে আশ্চর্য কিছুই নেই, এটি একটি অত্যন্ত সাধারণ দ্বিতীয় শ্রেণীর গ্রানাইট গ্রহ।

ব্যাখ্যাটির সমস্যা হচ্ছে যে, কম্পিউটারের কখনো বিভ্রম হয় না, কিন্তু সিডিসি যেসব তথ্য জানাচ্ছে সেগুলিও বিভ্রম ছাড়া দেখা সম্ভব নয়।

চতুর্থ ব্যাখ্যা : আসলে সে এখন একটা বাজে স্বপ্ন দেখছে, ঘুম থেকে উঠেই দেখবে সে তার ঘরে ষোড়শ শতাব্দীর একটা রূপকথা পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়েছিল।

এই ব্যাখ্যাটি কিম জিবানের খুব পছন্দ হয়, সে ঘুমিয়ে নেই ব্যাপারটি প্রমাণ করাও সহজ ব্যাপার নয়। কিম জিবান তাই এতটুকু নড়াচড়া না করে চুপচাপ শুয়ে অপেক্ষা করতে থাকে ঘুম ভেঙে জেগে ওঠার জন্যে। অপেক্ষা করতে করতে সে ঘুমিয়ে পড়ে, ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখে, সে পৃথিবীতে ফিরে গেছে বাচ্চা একটা ছেলে হয়ে, ঘাসের উপর দিয়ে হাঁটছে সে একটি হ্রদের ধারে।

 

কেউ একজন আমার সাথে হাত লাগাও, সিসিয়ানকে অরবিটে নিয়ে আসি, লু ভুরু কুঁচকে কন্ট্রোল প্যানেলের অসংখ্য সুইচ এবং মিটারের দিকে তাকিয়ে থেকে গলা উচিয়ে বলল, হাজার কিলোমিটারে আপত্তি আছে কারো?

মাত্র হাজার কিলোমিটার? বেশি কাছে হয়ে গেল না? সুশান ভয়ে ভয়ে বলল, গ্রহটা থেকে যদি কোনো মিসাইল টিসাইল ছেড়ে আমাদের কিছু একটা করে?

রু-টেক হেসে বলল, মিসাইল ছেড়ে যদি আমাদের শেষ করতে চায় তাহলে তুমি হাজার কিলোমিটার দূরেই থাক আর মিলিয়ন কিলোমিটার দূরেই থাক, কোনো রক্ষা নেই।

তা হলে?

তা হলে কি?

এই গ্রহের লোকজন যদি আমাদের কিছু করে?

রু-টেক হাল ছেড়ে দেওয়ার ভঙ্গি করে বলল, অকারণে ভয় পেতে তোমার এত উৎসাহ কেন? এই গ্রহে কোনোরকম প্রাণী আছে, তুমি কী ভাবে জান? আর যদি থেকেও থাকে, সেটা উন্নত কোনো প্রাণী হবে কি না তার কি নিশ্চয়তা আছে? আর সত্যিই যদি মিসাইল ছেড়ে আমাদের উড়িয়ে দেওয়ার মতো উন্নত কোনো প্রাণী থাকে, তা হলে কথা নেই বার্তা নেই আমাদের উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবে কেন?

কী করবে তাহলে?

আমাদের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করবে।

পল কুম এক পাশে দাঁড়িয়ে কফিজাতীয় কোনো একটা জিনিস খাচ্ছিল, রু-টেকের কথা শুনে চিন্তিত স্বরে বলল, রু-টেক, তোমার সমস্যা কী জান, তুমি সবসময়ে মানুষের মতো চিন্তা কর। কোনো একটা উন্নত প্রাণীর কথা বললেই তোমার মনে মানুষের চেহারা ফুটে ওঠে। একটা প্রাণী যদি মানুষ থেকে অনেক উন্নত হয় তাহলে হয়তো তারা ইচ্ছা করলেও মানুষের সাথে যোগাযোগ করতে পারবে না। পিপড়ার তো তুলনামূলকভাবে অনেক বুদ্ধি, মানুষ কখনো পেরেছে পিপড়ার সাথে যোগাযোগ করতে? যদি পিপড়া সম্পর্কে কিছু জানতে ইচ্ছে হয়, আমরা একটা পিপড়া ধরে নিয়ে আসি, ঠিক সেরকম খুব উন্নত প্রাণী যদি আমাদের দেখে যোগাযোগ করার চেষ্টা না করে সোজাসুজি আমাদের ধরে নিয়ে যায় আমি একটু অবাক হব না।

লু গলা উচিয়ে বলল, তোমরা বক্তৃতা থামিয়ে আমার সাথে একটু হাত লাগাবে?

রু-টেক এগিয়ে এসে বলল, আমি বুঝি না, তুমি সিডিসির উপর ভার না দিয়ে নিজে নিজে এসব জিনিস করতে চাও কেন? মহাকাশযানকে অরবিটে আনা কিরকম ঝামেলার কাজ, তুমি জান?

মোটেই কোনো ঝামেলার কাজ না, কম্পিউটার করতে পারে বলেই ছোট-বড় সব কাজ কম্পিউটার দিয়ে করাতে হবে? মাঝেমধ্যে নিজে নিজে কিছু কাজ করতে হয়, তাতে স্নায়ু শক্ত হয়, মস্তিষ্কে রক্তসঞ্চালন হয়, মাংসপেশীর ব্যায়াম হয়, মন প্রফুল্ল হয়—

থাক থাক, আর বলতে হবে না, কিম জিবান এগিয়ে এসে বলল, সত্যিকার কাজকর্ম নেই বলে কিছু কাজ বের করার চেষ্টা করছ। গ্রহটার যেটুকু দেখেছি, তা দেখে পরিষ্কার বলে দিতে পারি, খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে আর কাজ বের করতে হবে না, কোনোমতে এখন এখান থেকে জান নিয়ে পালাতে পারলে হয়।

সুশান পাংশু মুখে বলল, কেন, কী হয়েছে গ্রহটার?

নূতন কিছু নয়, কিন্তু যা দেখেছ সেটার কোনো মাথা মুণ্ডু আছে? আমার কাছে তো মনে হচ্ছে পরিষ্কার নরক।

কেন খামোকা ভয় দেখাচ্ছ লোকজনদের, লু একটু বিরক্ত হয়ে বলল, এটা যদি সেনাবাহিনীর মহাকাশযান হত, তাহলে এতক্ষণে তোমার কোর্ট মার্শাল হয়ে যেত। সুশান, তোমার এত ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই, আমাদের এই মহাকাশযান গবেষণার জন্যে হতে পারে, কিন্তু দরকার হলে আমাদের হাজার মাইলের ভিতর যা কিছু আসে আমরা উড়িয়ে দিতে পারি। কাজেই যতবড় বুদ্ধিমান প্রাণীই আসুক, তোমার কোনো ভয় নেই।

লু মোটেই বাজে কথার মানুষ না, তা ছাড়া একটা অবস্থার গুরুত্ত্ব তার মতো ভালো করে কেউ বুঝতে পারে না, খামোকা তাকে এরকম একটা মহাকাশযানের দলপতি বানানো হয় নি। তাই লুয়ের কথা শুনে সত্যি সত্যি সুশানের চাপা ভয়টা কমে কেমন একটা সাহসের ভাব এসে যায়। সে একটু এগিয়ে মহাকাশযানটাকে কক্ষপথে আটকে ফেলার কাজে লুকে সাহায্য করতে গেল।

মহাকাশযানটিকে তার নির্দিষ্ট কক্ষপথে আবর্তন শুরু করাতে দু’জনের প্রায় দশ মিনিট সময় লেগে যায়। কাজটা খুব যে সুচারুভাবে করা হল সেরকম বলা যায় না, প্রথমত কক্ষপথ পুরোপুরি বৃত্তাকার না হয়ে খানিকটা উপবৃত্তাকার হয়ে গেল, দ্বিতীয়ত গ্রহ থেকে দূরত্ব পুরোপুরি এক হাজার কিলোমিটার না হয়ে প্রায় এক শ’ কিলোমিটার বেশি হয়ে থাকল। কম্পিউটার সিডিসিকে ব্যবহার না করে নিজে নিজে চেষ্টা করলে এর থেকে ভালো অবশ্যি কেউ আশা করে না। তবে আজ একটু বাড়তি মজা হল, যখন সুশান কৃত্রিম মহাকর্ষ তৈরি করতে ভুলে যাওয়ায় মিনিট দুয়েক সবাই খানিকক্ষণ বাতাসে ভেসে বেড়ায়। পল কুম তার ভেসে বেড়ানো গরম কফিটাকে মর্গে ঢোকানোর চেষ্টা করছে। দৃশ্যটি এত হাস্যকর যে, এই নিয়ে হাসাহাসি হৈচৈ করে সবার ভিতরের চাপা অশান্তিটা বেশ একটু কমে আসে।

সিসিয়ানকে নির্দিষ্ট কক্ষপথে এলে সবাই রুটিনবাঁধা কাজে লেগে যায়, নিজেদের দায়িত্ব কম, সিডিসি নিজেই সব করতে পারে; তবু কেউ-না-কেউ সেটা নিজের চোখে দেখে নিশ্চিত হয়ে নেয়। ছয় মিলিয়ন কিলোমিটার দূরে মহাকাশকেন্দ্রে যোগাযোগ করে সংবাদের আদান-প্রদান হতে থাকে, সিডিসি নতুন পরিবেশের উপযোগী প্রয়োজনীয় খবরাখবর নিয়ে আসতে থাকে। দেখা গেল কাছাকাছি একটা পালসার রয়েছে, সেটিতে ছয় ঘন্টা পরপর একবার করে বিস্ফোরণ ঘটে। তাদের নতুন অবস্থান এই পালসারটিকে কেন্দ্র করে দেয়া হল। নির্দিষ্ট সময় পরপর পালসারের বিস্ফোরণ ঘটে বলে সেগুলি কেন্দ্রীয় মহাকাশকেন্দ্রে অত্যন্ত নিখুঁতভাবে লিপিবদ্ধ রয়েছে। প্রয়োজনীয় কাজকর্ম গুছিয়ে নিতে নিতেই লু তাদের প্রথম আলোচনাসভা ডেকে বসে। কোনো আলোচনা শুরু করার আগে তার সবসময়েই একটা ছোটখাটো বক্তৃতা দেয়ার অভ্যাস, এবারেও তার ব্যতিক্রম হল না। সে এভাবে শুরু করে, সিসিয়ান সময় সকাল সাড়ে নয়টা, আমাদের আলোচনা শুরু হচ্ছে। আলোচনায় দলের সবাই ছাড়াও অংশ নিচ্ছে সিসিয়ানের মূল কম্পিউটার সিডিসি। আলোচনার বিষয়বস্তু হচ্ছে আমাদের ভবিষ্যৎ-কর্মপন্থা। তোমরা সবাই জান যে, আমরা একটা অস্বস্তিকর অবস্থায় এসে পড়েছি। ট্রাইটন নামের যে-গ্রহটাকে সিসিয়ান এখন পাক খাচ্ছে, সেটার কোনো বিশেষ দোষ আছে, যার জন্যে আমাদের সবার, বিশেষ করে যারা জৈবিক প্রাণী, তাদের ভিতরে একটা আশ্চর্য অস্বস্তির সৃষ্টি হয়েছে। অকারণ অস্বস্তি জিনিসটা ভালো না, আমার মোটেই পছন্দ হচ্ছে না, কিন্তু কিছু করার নেই। আমাদের দায়িত্ব শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমাদের এখানে থাকতে হবে। কারো কিছু বলার আছে?

সবারই কিছু-না-কিছু বলার আছে, তবে বিষয়বস্তু মোটামুটি এক। শুরু করল পল কুম, জিজ্ঞেস করল, আমাদের দায়িত্বটা কি?

যদি গ্ৰহটাতে কোনো প্রাণের বিকাশ না হয়ে থাকে, তা হলে আমাদের দায়িত্ব খুবই কম, সব রুটিনবাঁধা কাজ। ট্রাইটনের আকার, আকৃতি, ভর, তাপমাত্রা, বায়ুমণ্ডল, ঘনত্ব এইসব জিনিস জেনে যেতে হবে। আমাদের তা হলে কিছু করতে হবে না, সিডিসি এক দিনে শেষ করে ফেলতে পারবে। সিডিসি, ঠিক বলেছি কি না?

সিডিসি বিপবিপজাতীয় একটা শব্দ করল, যার অর্থ অনেক কিছু হতে পারে, কিন্তু দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা থেকে সবাই জানে এটা সিডিসির সম্মতিসূচক উত্তর।

আর গ্রহটিতে যদি প্রাণের বিকাশ হয়ে থাকে?

লু তার কফির মগে একটা চুমুক দিয়ে বলল, তা হলে আমাদের কাজ একটু জটিল। প্রথমে প্রাণীটি বুদ্ধিমত্তার কোন স্তরে সেটা বের করতে হবে। বুদ্ধিমত্তায় নিনিষ স্কেলে যদি আটের কম হয়, তা হলে আমাদের দায়িত্ব মোটামুটি সহজ, সেটিও রুটিনবাঁধা কাজ, সিডিসিকে নিয়ে আমরা এক দিনে শেষ করে দিতে পারব বলে মনে হয়। কিন্তু বুদ্ধিমত্তা যদি নিনিষ স্কেল আটের বেশি কিন্তু দশের নিচে হয়, যার অর্থ প্রাণীটি মানুষের সমপর্যায়ের, তা হলে আমাদের দায়িত্ব সবচেয়ে বেশি, গরুর মতো খেটেও কয়েক সপ্তাহে শেষ করতে পারব কি না সন্দেহ। কারণ তা হলে আমাদের প্রথম পর্যায়ের যোগাযোগ শেষ করে দ্বিতীয় পর্যায়ের যোগাযোগ শুরু করতে হবে। তৃতীয় পর্যায়ের যোগাযোগের দায়িত্ব আমাদের নয়, কেন্দ্রীয় মহাকাশকেন্দ্রের, তবে আমাদের তাদের সাথে সহযোগিতা করতে হবে—

কিম জিবান বাধা দিয়ে বলল, প্রথম পর্যায় দ্বিতীয় পর্যায় ব্যাপারগুলি একটু বুঝিয়ে দেবে?

লু পল কুমের দিকে তাকিয়ে বলল, পল, তুমি তো এসব ভালো জান, বুঝিয়ে দেবে সবাইকে?

পল কুম কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, এগুলি হচ্ছে ধোঁকাবাজি, বড় বড় হর্তাকর্তাদের কোনো কাজকর্ম নেই বলে এরা বসে বসে নানারকম নিয়মকানুন তৈরি করে।

সিডিসি বিবি শব্দ করে আপত্তি করায় সবাই বুঝতে পারে পল কুমের কথাটি অন্তত পঞ্চম মাত্রার অপরাধ। সেটা নিয়ে পল কুমের কোনো মাথাব্যথা দেখা গেল না, সে বলে চলল, সাদা কথায় বলা যায় মানুষের সমপর্যায়ের কোনো প্রাণী পাওয়া গেলে আমাদের দায়িত্ব তাদের সাথে যোগাযোগ করা, সংবাদ, ভাব, ভাষা, জ্ঞানবিজ্ঞান আর কালচার বিনিময় করা। এটা হচ্ছে প্রথম পর্যায়ের যোগাযোগ। দ্বিতীয় পর্যায়ের যোগাযোগ হচ্ছে তাদের সাথে সামনাসামনি দেখা করা, তখন একজন আরেকজনকে ছুঁয়ে পর্যন্ত দেখতে পারে। আমাদের সেটা শুরু করতে হবে, শুরু করা মানে কী, আমাকে জিজ্ঞেস করো না।

সুশান জিজ্ঞেস করল, তৃতীয় পর্যায়ের যোগাযোগ জিনিসটা কী?

জিনিসটা বেশি সুবিধের না, তখন আমাদের একজনকে ওদের কাছে রেখে ওদের একজনকে আমাদের সাথে নিয়ে যেতে হবে।

সুশান মাথা নেড়ে বলল, আমি থাকছি না এখানে, মরে গেলেও থাকছি না।

লু হেসে বলল, সেসবের অনেক ধরনের নিয়মকানুন আছে সুশান, তুমি না চাইলেই যে তোমাকে থাকতে হবে না, সেটার কোনো গ্যারান্টি নেই। তারা যদি তোমাকে পছন্দ করে ফেলে, তাহলে কী করবে? কি বল সিডিসি?

সিডিসি বিপবিপ শব্দ করে সম্মতি কিংবা অসম্মতি জানায়।

সুশান কী একটা বলতে গিয়ে থেমে যায়, লু তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল, এই গ্রহে আদৌ কোনো প্রাণী আছে কি না জানার আগে আমাদের যোগাযোগের মাত্রা নিয়ে মাথা ঘামানোর কোনো প্রয়োজন নেই সুশান।

রু-টেক সভ্য মানুষের মতো হাত তুলে কথা বলার অনুমতি চাইল। লু মাথা নেড়ে অনুমতি দিতেই সে বলল, যদি এখানে কোনো প্রাণী পাওয়া যায় যার বুদ্ধিমত্তা নিনিষ স্কেলে দশের বেশি তা হলে আমরা কী করব?

তা হলে আমরা এত বিখ্যাত হয়ে যাব যে আমাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে আর চিন্তা করতে হবে না।

ভবিষ্যৎ নিয়ে নাহয় চিন্তা করতে হবে না, কিন্তু এখন কী করব?

লু এক মুহূর্ত চিন্তা করে বলল, এখনো কোথাও মানুষ থেকে বুদ্ধিমান প্রাণী পাওয়া যায় নি, তাই ব্যাপারটি ঠিক পরিস্কার করে ব্যাখ্যা করা নেই। সিডিসি চেষ্টা করলে হয়তো আমাদের বলতে পারবে।

রু-টেক সিডিসিকে জিজ্ঞেস করল, সিডিসি, তুমি জান?

সিডিসি দু বার বিপবিপ শব্দ করে একটা কর্কশ ধাতব আওয়াজ করে। লু হাতের কাছের একটা ছোট সুইচ টিপে দিতেই সিডিসির একঘেয়ে যান্ত্রিক গলার ধাতব আওয়াজ শোনা যায়, মহামান্য লু, আপনাদের আলোচনায় আমার অংশ নেওয়ার সার্থকতা শতকরা নিরানব্বই দশমিক তিন ভাগ কমে যায়, যখন আপনারা আমাকে কথা বলার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করেন। মহামান্য রু–টেক যে প্রশ্ন করেছেন, তার সরাসরি কোনো উত্তর নেই। তবে নিরাপত্তাসংক্রান্ত দু শ নব্বইয়ের চতুর্থ ধারা এবং জ্ঞানবিকাশের সাতাত্তর দশমিক এক ধারার চতুর্থ পরিচ্ছেদ থেকে আমি বলতে পারি যে, আপনারা যদি কখনো এমন কোনো প্রাণীর সম্মুখীন হন, যার বুদ্ধিমত্তা নিনিষ স্কেলে দশের বেশি, আপনাদের প্রথম সুযোগ পাওয়ামাত্র তাদের আয়ত্তের বাইরে চলে যেতে হবে। এই প্রসঙ্গে মহামান্য পল কুম কেন্দ্রীয় মহাকাশকেন্দ্র সম্পর্কে যে অসৌজন্যমূলক উক্তি করেছিলেন–

লু সুইচ টিপে সিডিসির কথা বন্ধ করে দেয়। পল কুম নীষার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, নীষা, এই সিডিসির এত মাথামোটা কেন? সবসময়ে মহামান্য মহামান্য করে কথা বলে যে গায়ে একেবারে জ্বালা ধরে যায়।

নীষা দলের দ্বিতীয় মেয়েটি, বয়স সুশান থেকে এক দুই বছর বেশি হতে পারে। সে স্বল্পভাষী, তাই প্রথম পরিচয়ে লোকজন তাকে অমিশুক বলে সন্দেহ করে। সিসিয়ানের যাবতীয় কম্পিউটারের দায়িত্ব তার উপর। মহাকাশযানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ এটি, নীষা খুব দক্ষতার সাথে সেটা করে এসেছে। পল কুমের প্রশ্ন শুনে সে একটু হেসে বলল, সিডিসি হচ্ছে বর্তমানকালের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী কম্পিউটার, সে ইচ্ছা করলে এত সুন্দর করে কথা বলতে পারে যে তোমরা কাজকর্ম ফেলে দিনরাত শুধু তার কথাই শুনতে চাইবে। তাকে ইচ্ছা করে এভাবে কথা বলার জন্যে প্রোগ্রাম করা হয়েছে, দেখা গেছে তা হলে তার ক্ষমতা সবচেয়ে ভালোভাবে ব্যবহার করা যায়। তোমরা যদি চাও তা হলে আমি প্রোগ্রামটি পাল্টে দিতে পারি, তৃতীয় মাত্রার বেআইনি কাজ, কিন্তু–

লু হাত নেড়ে বলল, ওসব ঝামেলায় যেও না, শুধু শুধু সময় নষ্ট।

সুশান হাসি চেপে বলল, কোনটা সময় নষ্ট, কথা বলা, না কথা শোনা?

সবাই হেসে ওঠে, তার মাঝে কিম জিবান জিজ্ঞেস করে, লুল, তুমি যে কথার মাঝখানে সিডিসির মুখের উপর সুইচ টিপে বন্ধ করে দাও, সে রাগটাগ করে না তো আবার, পুরো সিসিয়ানের নিরাপত্তা ওর উপর।

রু-টেক শব্দ করে হেসে উত্তর দেয়, না কিম, ভয় পেয়ো না, রাগটাগ এসব হচ্ছে তোমাদের এবং আমার মতো একজন দু’জন সৌভাগ্যবান রবোটের বিলাসিতা, কম্পিউটারের ওসব নেই। মাঝে মাঝে অবাক হয়তো হয়, কিন্তু রাগ কখনোই হয় না।

রবোট, মানবিক অনুভূতি এবং যান্ত্রিক উৎকর্ষ নিয়ে একটা আলোচনা শুরু হতে গিয়ে থেমে গেল, আজকে সবারই তার থেকে গুরুত্বপূর্ণ জিনিস আলোচনা করার আছে। সবাই লু’য়ের দিকে তাকাল, সে তার কফিতে চুমুক দিয়ে বলল, কাজেই বুঝতেই পারছ, আমাদের কাজ সবচেয়ে সহজ হয় যদি দেখা যায় এই গ্রহে কোনো প্রাণের বিকাশ হয় নি, আর যদি হয়েও থাকে সেটার বুদ্ধিমত্তা বোধহয় খুব নিম্নশ্রেণীর।

রু-টেক হেসে বলল, কিংবা কোনো প্রাণী, যেটার বুদ্ধিমত্তা আমাদের থেকে বেশি।

লু হেসে বলল, হ্যাঁ, তাহলে আমাদের দায়িত্ব পালিয়ে যাওয়া।

কিম জিবান বাঁকা করে হেসে বলল, যদি তারা আমাদের পালাতে দেয়।

সেটা তুমি আমার উপর ছেড়ে দাও, লু হেসে বলল, পালিয়ে যেতে আমার কোনো জুড়ি নেই।

সুশান বলল, আমার কেন জানি মনে হচ্ছে, এখানে প্রাণের বিকাশ হয়েছে, আর বুদ্ধিমত্তা সম্ভবত আমাদের সমপর্যায়ের।

পল কুম বলল, সেটা নিয়ে এখন মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই। আর কিছুক্ষণেই সেটা সন্দেহাতীতভাবে জানা যাবে।

লু সবার দিকে তাকিয়ে বলল, পরের চরিশ ঘন্টায় তোমাদের দায়িত্ব আমাদের সব কাজ শেষ করে ফেলা। কার কি করতে হবে তোমরা আমার থেকে ভালো জান, আমি তবু একবার বলে নিই, কাগজপত্র ঠিক রাখার জন্যে। সবচেয়ে বড় দায়িত্ব পল কুম আর সুশানের, তোমাদের বের করতে হবে এখানে প্রাণের বিকাশ হয়েছে কি না, হয়ে থাকলে ঠিক কী ধরনের প্রাণ। সিডিসি এখানে পৌছানোর সাথে সাথে খবরাখবর নেয়া শুরু করে দিয়েছে, রুটিন-কাজ সে করে ফেলতে পারবে, কিন্তু শেষ কথাটি আসবে তোমাদের দু’জনের মুখ থেকে। সবচেয়ে ভালো হয়, যদি ট্রাইটনে কোনো স্কাউটশিপ নামাতে না হয়। স্কাউটশিপ নামানো মানে হচ্ছে এক হাজার নূতন ঝামেলা। ট্রাইটনে যদি বুদ্ধিমান প্রাণী থাকে, তাহলে নীষা, তোমাকে ওদের বুদ্ধিমত্তার স্তর বের করতে হবে। তুমি আগে থেকেই কাজ শুরু করে দিতে পার, বুদ্ধিমত্তার সেই বিশেষ বিশেষ কোড পাঠানো এবং ঐ ধরনের কাজ, তুমি নিশ্চয়ই আমার থেকে ভালো জান কী করতে হবে। কিম, তোমার যেহেতু গ্রহ-উপগ্রহ নিয়ে এত কৌতূহল, তাড়াতাড়ি বের করে ফেল এটা কী ধরনের গ্রহ, তা হলে তোমাকে অন্য কাজে লাগানো যাবে। রু–টেক, তুমি আমাদের অস্ত্রাগারটা একবার ঘুরে এস। বোমাটোমা যদি চুড়তে হয় আমরা যেন আগে থেকে প্রস্তুত থাকি।

কিম জিন জিজ্ঞেস করল, সবার কাজ তো ভাগ করে দিলে, তোমার নিজের জন্যে কি রেখেছ?

লু চোখ পাকিয়ে বলল, আমি দলপতি না? দলপতিরা আবার কাজ করে নাকি?

ঠাট্টা না, সত্যি বল না।

তোমরা হাসবে না তো?

সুশান বলল, না শুনে কথা দিই কেমন করে?

হাইপারডাইভের ম্যানুয়েলটা পড়ব, আর দেখব সার্কিটটা ঠিক আছে কি না।

কেউ হাসল না, হাসির কথাও না। হাইপারভাইভ ব্যাপারটা হাসি-তামাশার ব্যাপার না, এখনো সেটা পুরোপুরি মানুষের আওতায় নেই, মাঝে মাঝেই অসম্পূর্ণ হাইপারডাইভের গুজব শোনা যায়, মহাকাশযান তখন বিশ্বব্রহ্মাণ্ড থেকে নাকি পুরোপুরি অদৃশ্য হয়ে যায়। কোথায় যায় সেই মহাকাশযানগুলি, কে জানে!

সুশান শুকনো মুখে বলল, সত্যি আমাদের হাইপারভাইভ দিতে হতে পারে?

কিছুই আগে থেকে বলা যায় না সুশান, কিন্তু প্রস্তুত থাকতে দোষ কি?