অর্থাৎ তস্য তস্য!
কে বললেন?
না, শ্রীঘনশ্যাম দাস নয়, মর্মরের মতো মস্তক যাঁর মসৃণ, ইতিহাসের অধ্যাপক সেই শিবপদবাবুই উক্তিটি করলেন ঈষৎ ব্যঙ্গের সুরে।
এ উক্তির প্রতিবাদ স্বয়ং শ্রীঘনশ্যাম দাসের কণ্ঠেই শোনা গেল উদার সহিষ্ণুতার সুরে।
না, তস্য তস্য নয়, ইনি সেই অনন্য অদ্বিতীয় ঘনরাম!
ঘনরাম! মেদভারে হস্তীর মতো যিনি বিপুল সেই সদাপ্রসন্ন ভবতারণবাবু বিস্ফরিত চক্ষে জিজ্ঞাসা করলেন মানে আপনার সেই আদিপুরু:, ঘনরাম দাস, যিনি সেই পৃথিবীর প্রথম ট্যাঙ্ক আবিষ্কার করেছিলেন—
আর ছেলেবেলাতেই ভারতবর্ষের পশ্চিম উপকূলের সমুদ্রে পোতুর্গিজ বোম্বেটেদের লুঠ করা, জ্বালিয়ে দেওয়া তাম্রলিপ্তির সদাগরি জাহাজ থেকে রক্ষা পেয়েও ধরা পড়ে প্রায় অর্ধেক যৌবন পর্যন্ত পোর্তুগালে স্পেনে এবং পরে এখন যা আমরা কিউবা আর মেক্সিকো বলে জানি, সেই দুই দেশে ক্রীতদাস হয়ে কাটিয়ে ওই মাষ্টা আবিষ্কারের পুরস্কারস্বরূপ দাসত্ব থেকে মুক্তি পেলেও নিজের বংশের ধারায় ওই চরম গ্লানি ও পরম গৌরবের অধ্যায় চিরস্মরণীয় করে রাখবার জন্যে দাস পদবিই গ্রহণ করেছিলেন।—সদাপ্রসন্ন ভবতারণবাবুর অসমাপ্ত বাক্যটি একদমে ময়দানের মনুমেন্ট-মুখো মিছিলের মতো এই বাক্যস্রোতে পূরণ করে শ্রীঘনশ্যাম দাস যখন থামলেন তখন উপস্থিত আর সকলের বিশেষ্য বিশেষণ ক্রিয়া ক্রিয়ার বিশেষণ কনজাংশন প্রিপোজিশন কা কর্ম ক্রিয়া ইত্যাদির জট থেকে গদ্যাংশ উদ্ধার করে তাৎপর্যে পৌঁছোতে হিমসিম খাওয়া গলদঘর্ম অবস্থা।
মর্মর-মসৃণ শিরোদেশের শিবপদবাবুই প্রথম বোধহয় চরকি-পাক থেকে মাথাটি স্থির করতে পেরে জিহ্বা সঞ্চালনে সক্ষম হলেন। বললেন, কিন্তু আপনার সে ঘনরাম দাস তো টেনচটিটলান-বিজয়ে কর্টেজ-এর কীর্তিকেও কানা করে আতলান্তিকের এপারে ওপারে বাহাদুরকা খেল দেখিয়ে স্বাধীনতার সনদ নিয়ে দেশে ফিরে গেছলেন?
শিবপদবাবুর গলার সুরে ঠাট্টার খোঁচাটা আগের চেয়েও একটু বেশি তীক্ষ্ণ।
তা তীক্ষ্ণ হওয়ার আর দোষ কী!
অমন মোক্ষম সময়ে মুখের কথা কেড়ে নিলে কার মেজাজ আর ঠিক থাকে!
এমনিতেই শ্রীঘনশ্যাম দাস উপস্থিত থাকলে আর কারও কোনও মৌ-কা বড় একটা মেলে না। তাতে অমনভাবে আসরটা জমিয়ে তোলার পর ওই একটা বিদঘুটে ফোড়ন কেটে সব ফাঁসিয়ে দেওয়া।
না, শিবপদবাবু আজ সত্যিই মনে মনে খুব বেশিরকম চটেছেন।
ঘনশ্যাম দাসের ফোড়নে যদি ঝাঁঝ থাকে, তাহলে তাঁর টিপ্পনিতেও কী জ্বালা শিবপদবাবু বুঝিয়ে দেবেন।
আজকের বেয়াদপিটা কিছুতেই তিনি ক্ষমা করতে রাজি নন। দাসমশাই রোজ তো নিজেই আসর মাত করেন, আজ একটু ধৈর্য ধরে তিনি শুনতে পারতেন না!
শিবপদবাবু আজেবাজে গল্প তো ফাঁদেননি। শুরু করেছিলেন নীল নদের উৎস আবিষ্কারের আশ্চর্য রোমাঞ্চকর কাহিনী। একদিনে সে উৎস তো আবিষ্কার হয়নি, আবিষ্কারের অভিযান সাফল্যের আনন্দে এক একবার যেখানে এসে থেমেছে, দেখা গেছে নীল নদের উৎপত্তির রহস্য তারও চেয়ে দূর দুর্ভেদ্য যবনিকার আড়ালে গোপন।
সে রহস্য-যবনিকা সরিয়ে দিতে কত রকমের মানুষই না এগিয়ে এসেছে।
নেহাত মূৰ্থ গোঁয়ার বেপরোয়া গোছের বাউণ্ডুলে যেমন তেমনই আবার এমন জ্ঞানী-গুণী-পণ্ডিত-গোছের বিচক্ষণ মানুষও এসেছে যাদের কাছে এই অজানা উৎস-সন্ধান আধ্যাত্মিক সাধনারই শামিল।
এই সন্ধানী পর্যটকদের মধ্যে রিচার্ড বার্টন-এর মতো বিচিত্র অদ্ভুত মানুষেরও দেখা মেলে। অসামান্য পণ্ডিত, জীবন-রসিক, সকল রকম নকল গণ্ডি-ভাঙা যে বিদ্রোহী, এক হিসেবে নেহাত মুখ গরিব ইতরদের জমায়েত থেকে সভ্য আরব জগতেরই ভুলে-যাওয়া, হেলায় পায়ে-ঠেলা, কল্পনার উধাও-ডানা-মেলা আরব্য উপন্যাসের মতো গল্প-সাহিত্যের একটি বিরল মুকুটমণি চিনে উদ্ধার করে এনেছিলেন, আসল জহুরির চোখ আর খাঁটি জীবন-পিপাসীর কলজের জোরের বিশেষত্বে, নিজের যুগের মাথা-ছাড়ানো সেই রিচার্ড বাটন-এর মতো মানুষ ভেতরকার কী প্রেরণায় কী তাগিদে অজানা আফ্রিকার অন্ধকার গভীরে অতবড় দুঃসাহসী অভিযানে বেরিয়ে টাঙ্গানায়িকা হ্রদ আবিষ্কারের উপলক্ষ হয়েছিলেন, শিবপদবাবু নাটকীয়ভাবে জবাব দেবার জন্যে নিজেই সে প্রশ্নটা তুলে ধরেছিলেন।
হয়তো দেনার দায়ে!
এতক্ষণের বক্তৃতার ফুয়ে ফাঁপানো-ফোলানো রংবাহারদার বেলুনটাকে যেন চোখের ওপর ওই বিদ্রূপের আলপিনের খোঁচায় ফুস করে ফেঁসে চুপসে যেতে দেখা গেল।
কে বললে কথাটা?
কে আর! ওই পাকাকাঠে করাত-চালানো অদ্বিতীয় গলা একমাত্র শ্রীঘনশ্যাম দাসের ছাড়া আর কারওই হতে পারে না।
তাঁকে সশরীরে ঠিক শিবপদবাবুর পিছনেই মুখে তাঁর সেই মার্কামারা করুণা আর অবজ্ঞা-মেশানো হাসিটি আর হাতে চিরন্তন অবিচ্ছেদ্য ছড়িটি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল।
কখন তিনি এসে দাঁড়িয়েছেন, কেউ যে লক্ষ করেননি, শিবপদবাবুর গল্প জমাবার সূর্য কাঁদলে সো না
আংশিক সাফল্য তা থেকে অন্তত প্রমাণিত হয়।
এখন তাঁকে দেখে সবাই কেমন একটু লজ্জিত হয়ে তাঁকে জায়গা দেবার জন্যে ব্যস্ত হয়ে উঠলেন।
কুম্ভের মতো উদরদেশ যাঁর স্ফীত, সেই ভোজন-বিলাসী রামশরণবাবু কেমন করে অমন ত্বরিৎবেগে তাঁর পাশে দাসমশাইকে জায়গা দেবার ব্যবস্থা করে ফেললেন সেটি একটি দর্শনীয় বস্তু।
শ্রীঘনশ্যাম দাস কর্তৃক অলংকৃত এই সান্ধ্য-সভাটি আমাদের করুণ আত্মছলনায় একদা হ্রদ নামে অভিহিত ও বর্তমানে সরোবরে সংকুচিত হয়েও সম্মানিত একটি জলাশয়ের এক প্রান্তে বেদিকা-বেষ্টিত নাতি-বৃহৎ একটি বৃক্ষের তলায় প্রায় নিয়মিতভাবে যে বসে, এ সংবাদ দাসমহাশয়ের অনুরক্ত মহলের কারও বোধহয় অজানা নয়।
দাসমশাই আসন গ্রহণ করাতে মস্তক যাঁর মর্মর-মসৃণ, সেই শিবপদবাবু আর সকলের মতো অমন কৃতার্থ বোধহয় হতে পারলেন না। তাঁর কণ্ঠের ঈষৎ ক্ষুব্ধ তিক্ততাতেই তা বোঝা গেল।
দেনার দায়ে মানে? শিবপদবাবু রুদ্ধস্বরে জিজ্ঞাসা করলেন।
মানে, দাসমশাই নিজের সংক্ষিপ্ত উক্তি বিস্তারিত করলেন, সহজ সরল অর্থে যা হয় তা-ই। খাতক হয়ে উত্তমর্ণের ভয়ে দেশান্তরী হতে গিয়ে ভূগোলের সীমা বিস্তৃত করার দৃষ্টান্ত অতীতে একেবারে বিরল নয়। তা ছাড়া দেনার দায় না থাকলে প্রৌঢ় এক পর্যটক চার শতাব্দী আগেকার সংকীর্ণ পৃথিবীকে মরণ-পণ দুঃসাহসে প্রসারিত করে সে-যুগ এ-যুগ নিয়ে বোধহয় সর্বকালের সমৃদ্ধতম দেশ আবিষ্কারে উৎসাহী হতেন কি না বলা যায় না। অন্তত কল্পনার স্বর্ণলঙ্কাকেও হার মানানো সত্যিকার সোনায় বাঁধানো এক বাস্তব রূপকথার দেশ আবিষ্কারের গৌরব একজন দেনদারের। সে দেনদার আবার দেনার দায়ে কারারুদ্ধও হয়েছিলেন সেভিল-এ। সেদিন কারাগার থেকে তাঁকে উদ্ধার করবার জন্য একজন যেন ভোজবাজিতে সেভিল-এ উদয় হয়েছিল। তা না হলে পৃথিবীর হয়তো কল্যাণই হত, কিন্তু যোড়শ শতাব্দীকে বিদ্যুৎ-চকিত করা একটি আবিষ্কার তখনকার ইউরোপীয় সভ্যজগতের হৃদস্পন্দন অত দীর্ঘকাল অমন দ্রুত করে তুলত না।
মেদভারে যিনি হস্তীর মতো বিপুল সেই সদাপ্রসন্ন ভবতারণবাবু যেন দাসমশাই-এর কথা শেষ হবার জন্যে মুখ বাড়িয়ে ছিলেন। দাসমশাই থামতেই তিনি নিজেই যেন ধন্য হবার ব্যাকুল উৎসাহে গদগদ স্বরে জিজ্ঞাসা করলেন, সেই ভোজবাজিতে যিনি উদয় হয়েছিলেন, তিনি কে? আপনার কেউ নিশ্চয়ই? ঠাকুরদার ঠাকুরদা তস্য ঠাকুরদা গোছের কেউ, কেমন?
না, পিতামহ কি অতিবৃদ্ধ প্রপিতামহও নয়-বলে সহিষ্ণুভাবে শুরু করে দাসমশাই আর বক্তব্যটা শেষ করতে পারলেন না।
শিবপদবাবু তাঁকে সে সুযোগ না দিয়েই ব্যঙ্গভরে বলে উঠলেন, বুঝেছি বুঝেছি! অর্থাৎ তস্য তস্য!
এর পর এ সভায় উত্তর প্রত্যুত্তর কীভাবে কোথায় গিয়ে থেমেছে তা আগেই বলা হয়েছে।
তাঁর আদিপুরুষ ঘনরাম দাসের দাসত্বশৃঙ্খল থেকে মুক্তি পেয়ে দেশে ফিরে যাওয়ার বৃত্তান্ত যে দাসমশাই-এর মুখ থেকেই শোনা একথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে শিবপদবাবু যদি তাঁকে একটু বিব্রত করতে চেয়ে থাকেন সে আশা তাঁর কিন্তু পূর্ণ হল না।
আদি পুরুষের দুঃখ স্মরণ করেই যেন বিষণ্ণ সুরে দাসমশাই বললেন, না, স্বাধীন হয়ে আর দেশে ফিরতে পারলেন কই? দাসত্ব থেকে মুক্তি আর দেশে ফেরা তখনও তাঁর ভাগ্যে নেই।
তার মানে, আপনার আদিপুরুষ সেই ঘনরাম দাস ক্রীতদাস হয়েই রইলেন? স্ফীতোদর রামশরণবাবু নীল নদের উৎস-আবিষ্কারকদের জীবনের রহস্য রোমাঞ্চের কথা অনায়াসে ভুলে গিয়ে ঘনরাম দাসের জন্য উদ্বিগ্ন ও কাতর হয়ে উঠলেন—কিন্তু তিনি তো স্বয়ং কর্টেজ-এর ছাড়পত্র পেয়েছিলেন!
স্পেনের সম্রাট বুঝি তা মানলেন না? এ ক্রুদ্ধ সমালোচনা শোনা গেল সদাপ্রসন্ন ভবতারণবাবুর কণ্ঠে। ভবতারণবাবুর বিপুল মেদবহুল হাতের কাছে থাকলে স্পেনের সে সম্রাটের কী দুর্দশাই যে হত তা পরের কথাতেই বোঝা গেল—এ সব সম্রাটের কী হওয়া উচিত, জানেন?
দাসমশাইকে তাড়াতাড়ি ভবতারণবাবুকে শান্ত করতে হল তাঁর ভ্রান্ত ধারণাটুকু সংশোধন করে।
না, না, সম্রাটের কোনও দোষ নেই। বোঝালেন দাসমশাই, সম্রাটের হাতে পড়লে তাঁর নিজের হুকুমনামা দেওয়া কর্টেজ-এর ছাড়পত্র নিশ্চয়ই তিনি স্বীকার করতেন। কিন্তু ঘনরাম তাঁর ছাড়পত্র সম্রাটকে দূরে থাক, সেভিল-এর বন্দরের কাউকেও দেখাবার সুযোগ পাননি!
কেন? কেন? সে ছাড়পত্রের হল কী? প্রায় সমস্বরে প্রশ্ন করলেন রামশরণ ও ভবতারণবাবু। শিবপদবাবু শুধু তখনও নীরব।
যা হল তা বড় জঘন্য, দার্শনিক নির্লিপ্ততা রাখার যেন বৃথা চেষ্টা করে বললেন শ্রীঘনশ্যাম দাস, মানুষ সম্বন্ধে তাতে হতাশই হতে হয়। কল্পনার নয়, বাস্তবের স্বর্ণলঙ্কা আবিষ্কারের কাহিনী কিন্তু সে কুৎসিত ঘটনার বিবরণটুকু ভূমিকা হিসেবে আগে না জানালে দুর্বোধ অসম্পূর্ণই থেকে যাবে।
তার মানে ঘনরাম দাস স্বাধীন থাকলে ওই আপনার সত্যিকার স্বর্ণলঙ্কা আর মুখের ঘোমটা খুলত না?
শিবপদবাবুর কথাগুলো এখনও বেশ বাঁকা। কিন্তু দাসমশাই সহিষ্ণুতার অবতার। পিন-ফোটানোেটা যেন পালক-রোলানোর মতো নিয়ে হাসিমুখে বললেন, স্বর্ণলঙ্কা কত দিনে কীভাবে তাহলে আবিষ্কৃত হত তা হয়তো ঠিক বলতে পারব না। কিন্তু স্বাধীন থাকলে ঘনরাম দাস সেভিল-এর বন্দরে জাহাজের গারদ ভেঙে বেরিয়ে সমুদ্রে নিশ্চয় ঝাঁপ দিতেন না, একদিন পশ্চিমের নতুন মহাদেশে বন্ধুত্বের আদর্শ হিসেবে যাঁর নাম লোকের মুখে মুখে ফিরবে সেই দিয়েগো দে আলমাগলোর জাহাজে লুকিয়ে তাঁকে আবার আতলান্তিক পার হতে হত না, তখনকার সবচেয়ে আজগুবি এক অভিযানে লোকসানের পর লোকসানেও টাকা ঢেলে যাবার মন্ত্র নতুন মহাদেশের সবচেয়ে বড় গুপ্ত মহাজন গ্যাস্পার দে এসপিনোসার কানে দেবার কেউ থাকত না, আসল হর্তাকর্তাদের মন বিষিয়ে দিয়ে অভিযান মূলেই মুড়িয়ে দেবার জন্যে সব কিছুই কালিমেড়ে দেখানো বিবরণ গোপনে পাঠাবার সত্যিকার শয়তানি চালাকি তাহলে কেউ ধরে সাবধান করে দিত না, দশ বছরের মধ্যে স্পেনকে ঐশ্বর্য আর গৌরবের শিখরে যে তুলবে, তখনও অজ্ঞাত অখ্যাত দেনার দায়ে দেউলে আধবুড়ো একটি মানুষকে যেমন কারাগার থেকে উদ্ধার তেমনই এ যুগের স্বর্ণলঙ্কার ভবিষ্যতের চরম সংকটের দিনে ভাগ্যের পাশার দান উলটে দিতে ক্লান্টুর ওপর কোরাকেন্ধুর পালক গোঁজার ফন্দি কারও মাথায় আসত না।
কী বললেন? শিবপদবাবুই প্রথম তাঁর সন্দিগ্ধ বিস্ময় জ্ঞাপন করলেন, লাটুর ওপর কার কেন্ধু না কী!
লাট্ট নয়, ক্লান্টু! ধৈর্য ধরে বোঝালেন ঘনশ্যাম দাস, উচ্চারণটা জিভে আনা একটু শক্ত। ক্লান্টু হল একরকম নানারঙের ভাঁজ-দেওয়া পাগড়ি গোছের উষ্ণীষ, বাস্তবের স্বর্ণলঙ্কার অধীশ্বররা যা পরতেন।
আর, ওই কার কী কেঁউকু যা বললেন? মেদভারে বিপুল ভবতারণবাবু উদগ্রীব হয়ে জানতে চাইলেন।
কার কী কেঁউকু কি কেংকু নয়,, করুণাভরে সংশোধন করে দিলেন দাসমশাই, কথাটা হল কোরাকেন্ধু। কোরাকেন্ধু ছিল দুনিয়ার দুষ্প্রাপ্যতম পাখি। বোখারা সমরকন্দের সন্দিগ্ধ সমৃদ্ধতম বাদশার হারেমের সেরা সুন্দরীর চেয়ে কড়া পাহারায় সকলের চোখের আড়ালে তাদের পালন করা হত। সত্যিকার স্বর্ণলঙ্কার অধীশ্বরের মাথার উষ্ণীষ ক্লান্টু-তে গোঁজা হত তার দুটি পালক।
আপনার আদিপুরুষ ঘনরাম ওই কোরাকেন্ধু-র পালক গ্লান্টুর ওপর খুঁজে ভাগ্যের পাশা উলটে দিয়েছিলেন? কেন? কী করে? বিস্ময়-বিস্ফারিত চোখে ভক্তিভরে জিজ্ঞাসা করলেন কুম্ভোদর রামশরণবাবু।
তা বলতে গেলে ওখানেই তো থামা চলবে না! হাসলেন দাসমশাই, যে বিষ-ফলের গাছ পোঁতার ব্যাপারে কিছু ভাগ তাঁর ছিল, একদিন তা বেড়ে উঠে আকাশ-বাতাস বিষিয়ে তুলে ন্যায়ধর্মের টুটি যখন চেপে ধরে, তখন গোড়ায় কোপ দিয়ে তা শেষ করার চেষ্টায় কী ভূমিকা ঘনরামের ছিল তা পর্যন্ত বলতে হয়। কিন্তু সে যখনকার কথা তখনই বলা যাবে। ঘনরামের জীবনের নতুন পালার যা থেকে সূত্রপাত, ক্রীতদাস হওয়ার অভিশাপ থেকে মুক্তি পেয়েও ঘনরাম তাঁর স্বাধীনতা আবার কী করে খোয়ালেন, সেই করুণ বৃত্তান্তেই আগে ফিরে যাওয়া যাক। , এবার শিবপদবাবুরও কোনও আপত্তি দেখা গেল না।
ঘনরাম ঘটা করেই স্পেনে ফিরছিলেন। শুরু করলেন দাসমশাই। কর্টেজ সত্যিকার ভালবাসায় আর কৃতজ্ঞতায় তাঁর মুক্ত ক্রীতদাসকে উপহার হিসাবে যা দিয়েছিলেন, খানদানি স্প্যানিশ হিড্যালগোদেরও তা ঈর্ষার বস্তু।
সেই ঈর্ষাই জেগেছিল এক স্পেনের সৈনিকের মনে। ঘনরামের সঙ্গে একই জাহাজে সে দেশে ফিরছিল। কর্টেজ-এর আদি বাহিনীর নোক সে নয়। কর্টেজ-এর বিরুদ্ধে পাঠানো নার্ভেজ-এর দলেই মেক্সিকোতে এসে সে কর্টেজ-এর পক্ষ নেয়। বেশির ভাগ ট্রাসকালায় অন্য বাহিনীতে ছিল বলে ঘনরামকে আগে সে দেখেনি। সে নিজের উন্নতিও মেক্সিকোয় এসে এ পর্যন্ত তেমন কিছুই করতে পারেনি। সত্যিকার লড়াই বেশির ভাগ সে ফাঁকিই দিয়েছে। ঠিক প্রমাণ না পাওয়া গেলেও কর্টেজ-এর বিরোধী দলের ষড়যন্ত্রে হয়তো আছে এই সন্দেহে তাকে এখন ফেরত পাঠানো হচ্ছে। যুদ্ধ না হোক, লুঠতরাজৈ সোরাবিয়ার উৎসাহ খুব। তাতে কিন্তু যা পেয়েছে সবই বলতে গেলে উড়িয়ে দিয়েছে জুয়া খেলে আর সাজপোশাকের বিলাসিতায়। সোরাবিয়ার ধারণা তার মত সুপুরুষ নেই। সুন্দরী মেয়েরা তাকে দেখলেই মূছা যায়।
জাহাজে ঘনরামের সঙ্গে ঠোকাঠুকি তার বেশি করে লেগেছে এই ব্যাপারে।
ঘনরামের সঙ্গে সোরাবিয়ার পরিচয় আগে ছিল না। জাহাজে একই যাত্রার সঙ্গী। হিসেবে দেখে চেহারায় সাজপোশাকে ঘনরামকে বেশ শাঁসালো কেউ বলেই মনে হয়েছে সোরাবিয়ার। সেই সঙ্গে জুয়ায় নামিয়ে ভাল করে নিংড়ে নেবার মতলবও মাথায় এসেছে।
ঘনরামকে স্পেনে ফেরার সে জাহাজে দেখলে কেউ-কেটা বলে ভুল করা খুব অস্বাভাবিক কিছু নয়। কর্টেজ-এর হুকুমে সম্মানিত অতিথির মর্যাদাই তাঁকে দেওয়া হয়েছে। সাজপোশাকে কথাবার্তায় চালচলনে ব্যবহারে সে মর্যাদার সম্পূর্ণ যোগ্য বলেই তাঁকে বোঝা গেছে। কর্টেজ ঘনরামকে বিদায় দেবার সময় পয়সাকড়ি ছাড়া যে সব সম্ভ্রান্ত সাজপোশাক সঙ্গে দিয়েছিল তাতে তাঁকে বেমানান লাগেনি।
সোরাবিয়া গোড়ায় একটু গায়ে পড়েই ঘনরামের সঙ্গে ভাব করেছে।
তখনকার দিনের পালতোলা মাত্র সত্তর টনের মাঝারি গোছের জাহাজ। একশো টনের জাহাজ হলেই সেকালে খুব বড় বলে গণ্য হবার যোগ্য হত। এখনকার তুলনায় মোচার খোলার মতো সে ছোট জাহাজের সংকীর্ণ খোলে যাত্রীদের পরস্পরকে এড়িয়ে চলাও শক্ত।
ঘনরাম এড়িয়ে যেতে যেমন চাননি তেমনই উৎসাহও দেখাননি কারও সঙ্গে নিজে থেকে আলাপ করার।
সোরাবিয়াই প্রথম একটা ছুতো বার করেছে তাঁর সঙ্গে আলাপ শুরু করার।
তখন সবে সকাল হয়েছে। ঘনরাম জাহাজের খোলা ডেকের নিচু রেলিং ধরে সামনের সমুদ্রের দিকে চেয়েছিলেন।
হঠাৎ একটু চমকে উঠেছেন কাছেই একজনের গলা পেয়ে। পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখেছেন জাহাজের আর এক যাত্রী এক স্প্যানিশ হিড্যালগো ছোকরা মাথার টুপিটা খুলে অভিবাদনের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে তাঁকেই কী যেন বলছে।
কথাগুলো প্রথমে বুঝতে একটু দেরি হওয়ার কারণ ছিল। হিড্যালগো ছোকরা একেবারে যাকে বলে রাজ-দরবারের কেতায় তাঁকে কুর্নিশ করে যা বলছে তা একটু অদ্ভুত ও অপ্রত্যাশিত।
হিড্যালগো ছোকরা কুর্নিশ সেরে হাতে একটা স্প্যানিশ সোনার মুদ্রা বাড়িয়ে ধরে বলছে—মহামান্য সেনর কিছু যেন মনে না করেন। তাঁকে বাধ্য হয়ে বিরক্ত করতে হচ্ছে। এই পেসো-দে-অরোটি যেন সেনরের জামা থেকেই গড়িয়ে পড়ল মনে হচ্ছে। সেনর যদি একটু কষ্ট করে দৃষ্টিপাত করে এটি তাঁর কি না বলেন।
ঘনরাম পেসোটা দেখেই চালাকিটা ধরতে পেরেছেন। তখনও তাঁর সঙ্গে এভাবে মিথ্যে অজুহাত বানিয়ে আলাপ করার কারণটা বুঝতে পারেননি।
তবু আলাপের ঔৎসুক্য, তা সে যারই হোক, অবজ্ঞায় উপেক্ষা করার শিক্ষা ঘনরামের নয়।
তিনি একটু হেসে বলেছেন, পেসোর গায়ে তো আমার নাম লেখা নেই। আছে স্বয়ং মহামান্য সম্রাটের ছাপ। সুতরাং ওটা আমার কি না বোঝবার মতো কোনও প্রমাণ পাচ্ছি না। এইটুকু শুধু বলতে পারি যে, আমার কোনও পেসো হারিয়েছে বলে এখনও আমি জানতে পারিনি।
আশ্চর্য তো! সত্যিই যেন বিব্রত হয়ে সোরাবিয়া এবার সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছে— আমার যেন স্পষ্ট মনে হল আপনি ওদিক থেকে চলে আসবার সময় ওটা গড়িয়ে পাটাতনের ধারে গিয়ে পড়ল।
তা সেটা আপনার থলি থেকেও তো পড়তে পারে? বলেছেন ঘনরাম সহজ পরিহাসের সুরে, আপনার নিজের পয়সাকড়ি গুনে দেখেছেন?
দেখিনি! সোরাবিয়াও সহজ হয়ে বলেছে, তবে দেখবার দরকার নেই। কারণ আমার কাছে স্পেনের এরকম কোনও মুদ্রাই নেই।
তাহলে আমার বা আপনার কারওই যখন নয়, তখন পেসোটা আমাদের পাইলট সানসেদোর কাছেই জমা দিন না। তিনি কার সম্পত্তি খোঁজ করে দিয়ে দেবেন।
তা-ই দেবেন, না নিজের থলে মোটা করবেন কে বলতে পারে? সোরাবিয়া হেসে উঠে আরও ঘনিষ্ঠ হবার চেষ্টা করেছে তার চেয়ে আপনার আমার কারওই যখন নয়, এটা নিয়ে একটা বাজিই ধরা যাক। ওই যে সাগরবাজটা আমাদের জাহাজের মাথার ওপর ডানা মেলে ভাসছে ওটা মাছ ধরতে কোন দিকে জলে ছোঁ মারবে, জাহাজের বাঁয়ে না ডাইনে, বলতে হবে। ঠিক যে বলতে পারবে এ পেসো-দে-অরো তার।
হিড্যালগো জোয়ানের স্বরূপটা বুঝে ফেলতে ঘনরামের আর দেরি হয়নি। তবু তাকে একেবারে নিরাশ না করে তালে তাল দিয়ে তিনি বলেছেন, ভালো কথা। কিন্তু পেসোটা যখন আপনিই কুড়িয়ে পেয়েছেন তখন প্রথম সুযোগটা আপনিই নিন।
আমাকেই নিতে বলছেন? সোরাবিয়া এরকম প্রস্তাব ঠিক বোধহয় আশা করেনি।
বেশি আপত্তি করলে ধরা পড়ার ভয় আছে বলেই বোধহয় একটু দ্বিধার ভাব দেখিয়েই সে নিজের অনুমান জানিয়েছে।
সেটা ভুল প্রমাণ হওয়ায় খুশিটা প্রায় চাপতে না পেরে বলেছে, এবার আপনার পালা সেনর।
আমার পালাটা বোধহয় বৃথাই গেল। ঘনরাম মুখে একটু আশাভঙ্গের ভাব ফুটিয়েছেন।
কেন? কেন? জিজ্ঞাসা করেছে সোরাবিয়া ব্যস্ত হয়ে।
কারণ আমাদের বাজি ধরার খবর বোধহয় ও পেয়েছে! মুখ টিপে একটু হেসে বলেছেন ঘনরাম, বিরক্ত হয়ে জুয়াড়িদের সংস্রব ছেড়ে বোধহয় চলেই যাবে তাই!
ঘনরামের গণনা নির্ভুল প্রমাণ হতে কয়েক মুহূর্ত দেরি হয়েছে মাত্র। সাগরবাজটা ভাসতে ভাসতে হঠাৎ সবেগে ডানা নেড়ে দূর আকাশে উড়ে চলে গেছে!
আশ্চর্য ব্যাপার তো সেনর!—সোরাবিয়ার চোখে সত্যিকার সম্ভ্রম আর বিস্ময় এবার ফুটি-ফুটি করেছে—আপিন কি জাদু-টাদু জানেন নাকি?
না, জাদু জানি না। হেসে বলেছেন ঘনরাম, শুধু চোখ-কান একটু ভোলা রাখতে জানি।
সোরাবিয়ার মুখটা তবু হাঁ হয়ে আছে দেখে বুঝিয়ে বলেছেন, আমাদের জাহাজের গলুই-এ জলের ঢেউ-এর সাদা ফেনা আর দেখছেন? লক্ষ করেছেন যে পালগুলো ঢিলে হয়ে ঝুলতে শুরু করেছে? হাওয়া গেছে বন্ধ হয়ে? আমাদের জাহাজ প্রায় অচল। সাগরবাজ আর কী আশায় আমাদের সঙ্গী হয়ে থাকবে। মাছের ললাভে সমুদ্রের এ সব পাখি আমাদের সঙ্গ দেয়। মে বাহবা! বাহবা! চমৎকার। সোরাবিয়া সত্যিই হাততালি দিয়ে তারিফ করে বলেছে, আমাকে রীতিমতো আহাম্মুক বানিয়ে ছেড়েছেন। এখন আমায় এমন শিক্ষা দেবার গুটি কে জানতে পারি? অধীন তার আগে নিজেই নিজের পরিচয় দিচ্ছে। এ অধমের নাম সোরাবিয়া। কর্টেজ-এর অধীনে লড়াই করে মহামান্য সম্রাটের সেবা করার সঙ্গে নিজের ট্যাঁকও ভারী করে ফিরব আশা ছিল। সে আশা পূর্ণ হয়নি। এবার কোন নৌ-সেনাপতির সঙ্গে পরিচয় হবার সৌভাগ্য আমার হল যদি জানান।
ঘনরাম সোরাবিয়ার ছ্যাবলামিতে একটু হাসলেও তার সঙ্গে সুর মেলাননি! গম্ভীর গলাতেই বলেছেন, আপনাকে একটু হতাশ হতে হবে, সেনর সোরাবিয়া। নৌ-সেনাপতি তো নয়ই, জাহাজের একজন মাঝি-মাল্লাও আমি নই। সত্যি কথা বলতে গেলে মানুষ হিসাবে আমায় গণ্য না করলেও আমি কিছু মনে করব না। কারণ তাই আমার অভ্যাস আছে।
সোরাবিয়া এ ঘোরালো কথার দু পিঠের মানে অবশ্য বুঝতে পারেনি, বিনয়ের আর-এক প্যাঁচ ভেবে ঘনরাম কোথাকার লোক এবং আসলে কে, সে পরিচয় জানতে আরও উদগ্রীব হয়ে উঠেছে।
মুখে সে ব্যাকুলতা প্রকাশ করতে সে দ্বিধা করেনি। বিনয়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বলেছে, সমুদ্র ও জাহাজের বিষয়ে আপনার অদ্ভুত হুশিয়ারি আর নজর দেখে আপনাকে নৌ-সেনাপতি ভাবা আমার যদি বেয়াদবি হয়ে থাকে মাপ করবেন। তবে আপনার সঙ্গে পরিচিত হবার সৌভাগ্যই যখন হল তখন আপনাকে সম্বোধন করতে পারাটা বড় দুঃখের হবে এটুকু না জানিয়ে পারছি না।
সৌজন্যের জিলিপি প্যাঁচ আর না বাড়িয়ে ঘনরাম বলেছেন, পুলকিত হয়ে সসম্রমে সম্বোধন করবার মতো কেউ আমি কিন্তু নই। আমার নাম ঘনরাম দাস।
ঘনরাম দাস! সোরাবিয়ার একে স্প্যানিশ, তায় বাকদেবীর সঙ্গে সম্পর্কহীন জিহ্বায় উচ্চারণটা লালাতেই যেন জড়িয়ে গেছে। স্পেনের এপার-ওপার মনের আঙুল বুলিয়েও এ ধরনের নামের উৎস খুঁজে না পেয়ে বেশ একটু বিমূঢ় হয়ে দাসকে দশ উচ্চারণ করে সে জিজ্ঞাসা করেছে, আচ্ছা দাস বললেন, কোথাকার দাস বলুন তো? ফার্নানদিনায় ওরকম পদবির একটি পরিবার আছে বলে যেন শুনেছি। কাস্তিল থেকে এসে তারা পদবিটা নাকি বেঁকিয়ে ওই রকম করেছে!
ফার্নানদিনা ছিল কিউবার তখনকার নাম। ঘনরাম ফার্নানদিনায় তাঁর বংশ চালনা। করবার চেষ্টা দেখে মনে মনে হেসে বলেছেন, না ফার্নানদিনায় আমাদের বংশধররা। স্পেন থেকে আসেনি। আমরা যেখানকার সেইখানেই আছি ও থাকব বলেই আমার। বিশ্বাস। আমাদের ঘরানা কোথাকার যদি জানতে চান তাহলে তাম্রলিপ্তির নামই করতে হয়।
তাম্রলিপ্তি শুনেই শব্দটা উচ্চারণ করবার বা বোকা বনবার ভয়েই বোধহয় আর কিছু জিজ্ঞাসা করতে সোরাবিয়া সাহস করেনি।
মনে যদি একটু বিরক্তি কি জ্বালা থাকে বাইরে সৌজন্যের বিনিময় করে সোরাবিয়া তখনকার মতো চলে গেছে। আলাপের ছুতো যা দিয়ে করেছিল বাজি ধরা সেই স্বর্ণমুদ্রাটা সঙ্গেই নিয়ে গেছে ভুলে।
ঘনরামও হাওয়ার অভাবে নিস্তরঙ্গ পুকুরের মতো স্থির সমুদ্রের দিকে খানিক চেয়ে থেকে পাইলট সানসেদো যেখানে টঙ-এ বসে আছেন জাহাজ চালাতে সেই দিকে পা বাড়িয়েছেন।
পা বাড়িয়েও হঠাৎ চমকে ঘনরামকে থামাতে হয়েছে। ওপরের ডেক থেকে নীচের খোলে যাবার সিঁড়িতে একটা চাপা হাসির তরল ঝংকার দ্রুত পদশব্দের সঙ্গে মিলিয়ে গেছে।
একটু চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে ঘনরাম আবার পাইলট সানসেদোর সন্ধানেই গেছেন। এ হাসিতে চমকে উঠলেও বিমূঢ় তিনি হননি। এ হাসি ও পদশব্দ কার তা তিনি জানেন। এই হাস্যময়ীকে তাক লাগাবার উদ্দেশ্যেই কার্তিক কিংবা তার ময়ূরটি সেজে সময়ে অসময়ে পেখম-তোলা ভঙ্গিতে ঘোরাফেরা করার দরুনই হিড্যালগো সোরাবিয়াকে প্রথম তিনি লক্ষ করেন।
মেয়েটি কে তা-ও ঘনরাম জানেন। ক্ল্যাভিহেরো নামে এক হিড্যালগো সেনানায়কের সদ্যবিধবা যুবতী স্ত্রী। সে হিসেবে তার এরকম হাস্যচপলতা বেশ বিসদৃশ বেহায়াপনা মনে হওয়ারই কথা। তবে মেয়েটির স্বপক্ষে এইটুকু বলা যায় যে, ক্ল্যাভিহেরো এক হিসেবে প্রায় বিয়ের পর দিনই স্ত্রীকে কিউবায় ত্যাগ করে পালিয়ে কর্টেজ-এর বাহিনীর সঙ্গে মেক্সিকো অভিযানে চলে আসে। মেক্সিকোয় যাবার পর স্ত্রীর কোনও খোঁজ সে তো করেইনি, সেদেশে বার বার বহু সুন্দরীকে ঘরণীও করেছে। ক্ল্যাভিহেরোর স্ত্রী স্বামীর প্রেমের টানে নয়, তার ওপর আক্রোশেই তার সত্যিকার স্বরূপ নিজের চোখে দেখবার জন্যে পরম দুঃসাহসে পাইলট সানসেদোকে বলে তাঁরই জাহাজে মেক্সিকো পর্যন্ত আসে। এসে সে জানতে পারে যে, যুদ্ধে নয়, মাতাল অবস্থায় টেনচটিটানের রাস্তায় নারীঘটিত ব্যাপারের দাঙ্গাতেই মারা গিয়ে ক্ল্যাভিহেরো সব সমস্যা মিটিয়ে দিয়ে গেছে।
মেয়েটি তাই আবার ফার্নানদিনায় নয়, স্পেনেই ফিরে যাচ্ছে। স্বামীর কাছে প্রতারণা ছাড়া কিছু যে পায়নি, স্বামীর মৃত্যুসংবাদে তার একেবারে ভেঙে পড়া খুব স্বাভাবিক বোধ হয় না। তার একটু আধটু তরল চাঞ্চল্যও তাই বোধহয় ক্ষমার যোগ্য।
কিন্তু সেদিনের হাসিটা কেমন একটু হিসেবের বাইরে বলে ঘনরামের মনে হয়। হাসিটা যেন ঝংকৃত হতে একটু দেরিও হয়ে গেছে।
সোরাবিয়া উপস্থিত থাকতে থাকতেই হাসির লহরীটা ওঠবার কথা নয় কি?