প্রথম খণ্ড
দ্বিতীয় খণ্ড
তৃতীয় খণ্ড

০১. অধ্যাপক জর্জ টম্‌সন

অধ্যাপক জর্জ টম্‌সন

অবশ্যই, তিনি ভারততত্ত্ববিদ নন, বর্তমানে বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্রীক-এর অধ্যাপক। প্রাচীন গ্রীক বিষয়ে ব্যুৎপত্তির দিক থেকে আজকের ইয়োরোপে তাঁর সমকক্ষ পণ্ডিত সত্যিই মুষ্টিমেয়। এ-কথা যাঁরা অধ্যাপক টম্‌সনের সবচেয়ে বড়ো নিন্দুক তাঁরাও নিঃসংকোচে স্বীকার করেন। কিন্তু শুধু এইটুকু বললে তাঁর সম্বন্ধে কিছুই বলা হয় না।

কেননা, অধ্যাপক জীবনের প্রথমার্ধেই তিনি প্রাচীন গ্রীকতত্ত্বে অসামান্য ব্যুৎপত্তির পরিচয় দিয়েছিলেন। তখনই তিনি প্রাচীন গ্রীক পুঁথিপত্রের উপর য-সব টীকাভাষ্য রচনা করেছিলেন সেগুলি বিদগ্ধ সমাজে প্রামাণ্য বলে স্বীকৃত হয়েছিলো। অথচ, অমন প্রামাণ্য রচনার স্রষ্টা হয়েও উত্তর-জীবনে তিনি অনুভব করলেন, প্রাচীন পুঁথিপত্রগুলিকে সত্যিই ঠিকমতো বোঝা যাচ্ছে না। ইয়োরোপে বহুদিন ধরে গ্রীক-বিষয়ে উচ্চাঙ্গের গবেষণা হওয়া সত্ত্বেও যে-যুগের পুঁথিপত্রগুলির প্রকৃত তাৎপর্য উদ্ধার করবার সবচেয়ে মৌলিক কাজটি তখনো বাকি থেকে গিয়েছে। এই চেতনা তীব্র থেকে তীব্রতর হতে হতে শেষ পর্যন্ত তাঁর জীবনে এক গভীর সংকটের রূপ নেয়। দিনের পর দিন তিনি অম্বেষণ করে চলেন এমন কোনো পদ্ধতির যার সাহায্যে ওই সুদূর অতীতকে সম্যকভাবে চিনতে পারা সম্ভব হবে। শেষ পর্যন্ত সে-পদ্ধতি তিনি খুঁজে পেলেন। প্রাচীন গ্রীস তাঁর সামনে একেবারে নতুন আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠলো।

এ-বিস্ময় বড়ো কম নয়। তাঁর ওই আবিষ্কারের কাহিনী তাঁর মুখেই শুনেছিলাম।

 

সে-রাতটার কথা আমি কোনোদিন ভুলবো না। চোখ বন্ধ করলে পুরো দৃশ্যটি আজো স্পষ্ট দেখতে পারি।

রাত এতো গভীর হয়েছে যে কর্মমুখর বার্মিংহাম শহর নিস্তব্ধ, নিঝুম। আগুনের সামনে পা-দুটো এগিয়ে দিয়ে অধ্যাপক টম্‌সন কথা বলে চলেছেন। কথা বলতে বলতে একজন মানুষ কী তন্ময়ই না হয়ে যেতে পারেন! অথচ কল্পনা নয়, কবিত্ব নয়—বিজ্ঞানের ধারালো বিশ্লেষণ। যেন দুই আর দুই মিলে চার হচ্ছে, তারই হিসেব। এতো স্বচ্ছ, এতো তীক্ষ্ণ তাঁর প্রত্যেকটি কথা যে শুনতে শুনতে মনে হয়ে মাথার ভিতর একটার পর একটা কপাট খুলে যাচ্ছে। যে-সব কথার মানে থাকতে পারে বলে আগে কোনোদিনই ভাবতে পারি নি,—ভাববার মতো চিন্তার সঙ্গতি ছিল না,—সে-সব কথার সহজ তাৎপর্যটা তিনি যেন একেবারে চোখের সামনে তুলে ধরেন। বলেন, এই দিক থেকে ভেবে দেখো, দেখবে এতোটুকুও অস্পষ্ট নয়।

কথায় কথায় নিজের অভিজ্ঞতার কথাও তুললেন। নিজেকে বাদ দিয়ে নিজের অভিজ্ঞতাটিকে মানুষ কতো স্পষ্ট ভাবেই না বর্ণনা করতে পারে!

প্রাচীন পুঁথিপত্রে যা লেখা আছে তার মানে হয়, প্রতিটি কথার মানে হয়। সে-তাৎপর্য উদ্ধার করা সম্ভব,—এবং উদ্ধার বলতে একালের ধ্যানধারণাকে সেকালের লেখার ওপর চাপিয়ে দিয়ে আত্মপ্রবঞ্চনা করা নয়। তার বদলে কোনো-না-কোনো বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে, যার সাহায্যে বুঝতে পারবো সেকালের মানুষে ঠিক কেন, ঠিক কী ভেবে, সেকালের ওই সব পুঁথিপত্র রচনা করেছিলো। এই চেতনাই ক্রমশ তাঁর ব্যক্তিগত সমস্যার পুরো ষোলো আনা হয়ে দাঁড়ালো।

সে যেন এক চরম সংকট। গ্রীক সাহিত্যের ঠিক যে-বিষয়টি সম্বন্ধেই তাঁর তখন অমন খ্যাতি সেই বিষয়টিরই প্রকৃত তাৎপর্য কিনা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না! বিষয়টি হলো, এস্কাইলাসের নাটক। অধ্যাপক টমসন বলতে লাগলেন, একটা এস্পার-ওস্পার না-হলেই নয়। শেষ পর্যন্ত ঠিই করলাম, হয় এস্কাইলাস বুঝবো আর না হয় তো ছেড়ে দেবো। এমন সময় হাতে এলো একটি বই, ক্রিস্টোফার কড্‌ওয়েল-এর ‘ইলিউশ্‌ন্‌ এ্যাণ্ড রিয়ালিটি’(১)।  মনে হলো, অকূলে কূল পাওয়া যাচ্ছে। কড্‌ওয়েল-এর বই আমাকে এগিয়ে নিয়ে গেলো ম্যাক্সবাদ-এর দিকে। পড়লাম এঙ্গেল্‌স্‌-এর ‘দি ওরিজিন অব্‌ ফ্যামিলি’—‘পরিবার, ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও রাষ্ট্রের উৎপত্তি’(২)। এঙ্গেল্‌স্‌-এর বই আমাকে পৌঁছে দিলো মর্গান-এর ‘এন্সেণ্ট সোসাইটি’ বা ‘প্রাচীন সমাজ’(৩) পর্যন্ত। কূল পেলাম। এস্কাইলাস্‌ আর ছাড়তে হলো না।

এর পর গ্রীক বিষয়ে তিনি যে-দুটি বই লিখেছেন বিশ্বের জ্ঞান-ভাণ্ডারে তা অমূল্য সম্পদ হয়ে থাকবে। বই দুটির নাম : ‘এস্কাইলাস্‌ এ্যাণ্ড এথেন্স’ এবং ‘স্টাডিস্‌ ইন্‌ এন্সেণ্ট গ্রীক সোসাইটি’(৪)।

অবশ্যই, মর্গান নিজে গ্রীক সাহিত্যে সুপণ্ডিত ছিলেন। কিন্তু ‘প্রাচীন সমাজ’ বলে তাঁর ওই বই-এর প্রধান আলোচনাটা আমেরিকার আদিবাসীদের নিয়ে। আদিবাসী-সংক্রান্ত এই গবেষণা কেমন ভাবে আজকের দিনে একজন শ্রেষ্ঠ গ্রীকতত্ত্ববিদের হাতে গ্রীক সাহিত্য-জগতের তোরণদ্বার উদ্ঘাটন করবার চাবিকাঠি যুগিয়েছে সে-অভিজ্ঞতার কথা শুনতে শুনতে বিস্ময়ে স্তম্ভিত হতে হয়। তাঁর দিকে চেয়ে দেখলে আপনার মনে হতোম সেকালের গ্রীক-সমাজ তিনি স্বচক্ষে দেখতে পাচ্ছেন, দেখতে পাচ্ছেন সে-সমাজের প্রতিটি ঘাত-প্রতিঘাত, টাল-বেটাল। আর তারই আবর্তে পড়ে তখনকার জনৈক নাট্যকার কেন এক নির্দিষ্ট মতাদর্শে মেতে উঠলেন,—অন্য কোনো রকম রচনা কেন তাঁর পক্ষে সম্ভবপর হলো না,—অধ্যাপক টম্‌সনের মুখে সে-কথা শুনলে আপনার মনে হতো, তিনি কথা বলছেন না—ছবি আঁকছেন! এমনই নির্মল, এমনই প্রত্যক্ষ তাঁর অনুভূতি!

আমার জীবনে এর চেয়ে বড়ো বিস্ময় সত্যিই ঘটেনি।

বিস্ময় শুধু এই কারণে নয় যে এ-যুগের একজন শ্রেষ্ঠ মনীষীর মুখে থেকে তাঁর এই অসামান্য অভিজ্ঞতার কথাটা শুনতে পেয়েছিলাম। আরো বড়ো বিস্ময় এই কারণে যে আমার নিজের কাছে প্রাচীন ভারতীয় দর্শন নিয়ে যেগুলি ছিলো সবচেয়ে কঠিন আর সবচেয়ে জটিল সমস্যা তাঁর ওই উপলব্ধি আমাকে সেগুলির সমাধান খোঁজবার পথ দেখিয়ে দিলো।

সেদিন রাতে মনে হয়েছিলো, কাঁচের একটু কুঁচো খুঁজতে এ-দেশে,—এতোদূরে,—এসেছিলাম। তার বদলে পেয়ে গেলাম একেবারে হীরের টুকরো। এ-হীরে জীবনভোর আমার সমস্ত প্রচেষ্টার মূলধন হতে পারবে।

 

মর্গান-এর মূলসূত্র অনুসরণ করে কী ভাবে প্রাচীন পুঁথিপত্রগুলির প্রকৃত তাৎপর্য উদ্ধার করা সম্ভব তার নির্দেশ পাওয়া যায় অধ্যাপক জর্জ টম্‌সনের সাম্প্রতিক গ্রন্থাবলী থেকে। তাঁরই পদ্ধতি অনুসরণ করে লোকায়ত-দর্শনের কয়েকটি সমস্যা নিয়ে আমি এই আলোচনার খসড়া তৈরি করেছি। বলাই বাহুল্য, প্রাচীন গ্রীক সাহিত্যে তাঁর অসমান্য পাণ্ডিত্যের তুলনায় প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্য সম্বন্ধে আমার জ্ঞান নেহাতই নগণ্য। এদিক থেকে আমার সম্বল হলো পূর্বগামী ভারততত্ত্ববিদদের মৌলিক গবেষণা। মণৌ বজ্র-সমুৎকীর্ণে সূত্রস্যেবাস্তি মে গতিঃ। কালিদাসের কাছে এ-কথা অতিরঞ্জিত বিনয় হোক আর নাই হোক, আমার কাছে নিছক আত্মোপলব্ধি।

তবু সাহসী যে হয়েছি তার একটা গুরুত্বপূর্ণ কারণ আছে। একটি সংকীর্ণ ক্ষেত্রে, এবং প্রাচীন পুঁথিপত্রের সঙ্গে অনেক সময় পরোক্ষ পরিচয়ের ভিত্তিতেই, আমি এই পদ্ধতি প্রয়োগ নিয়ে যে-পরীক্ষা করেছি তার পিছনে প্রধান উৎসাহ অবশ্যই পদ্ধতিটির সম্বাবনা সম্বন্ধে দক্ষতর বিদ্বানদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা। আমাদের বিদগ্ব-সমাজে এ-পদ্ধতি সুপরিচিত নয়। অথচ, এর সম্ভাবনা যেন সীমাহীন। যোগ্যতর বিদ্বান বিস্তৃততর ক্ষেত্রে এর প্রয়োগ করে প্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃতির সবচেয়ে দুর্বোধ্য কোণগুলিকে উজ্জ্বল আলোয় উদ্ভাসিত করতে পারবেন। শুধু তাই নয়। সামগ্রিক ভাবে মানবজাতির ইতিহাস রচনায় প্রাচীন ভারতীয় পুঁথিপত্রগুলির সাক্ষ্য অসামান্য গুরুত্বপূর্ণ। তার কারণ, মানবজাতির অগ্রগতি-পথের একটি বিশেষ স্তরের লিখিত দলিলপত্র ভারতবর্ষে এমন ভাবে টিকে আছে যা একমাত্র চীন ছাড়া আর কোনো দেশে খুঁজে পাওয়া যায় কিনা খুবই সন্দেহের কথা। তাই অন্যান্য দেশের ইতিহাসে যে-কথা আবছা আর অস্পষ্ট হয়ে এসেছে সেগুলিকে বোঝা যেতে পারে ভারতীয় ইতিহাসে আজো যা স্পষ্ট ভাবে বেঁচে রয়েছে তারই সাহায্যে।

বলাই বাহুল্য, লোকায়ত-দর্শনের এই আলোচনায় যদি কোনো ভুল-ভ্রান্তি ঘটে থাকে তাহলেই প্রমাণ হবে না পদ্ধতিটি ভ্রান্ত। কেননা, পদ্ধতি ফলপ্রসূতা ছাড়াও প্রয়োগ-পটুত্বের কথা রয়েছে। তবু, আত্মশক্তি সম্বন্ধে মনে কোনো মোহকে প্রশ্রয় না দিয়েও এটুকু ভেবেছি যে, ভুলের ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে থাকলে আমরা কোনোদিনই সত্যে পৌঁছতে পারবো না। এ-বিষয়ে অধ্যাপক টম্‌সনেরই একটি উক্তি(৫) মনে পড়ে :
We cannot reach truth unless we risk error.
হঠকারিতার বরাভয় নয়, অম্বেষীর কাছে আশ্বাসবাণী।

অধ্যাপক টম্‌সনের পদ্ধতিটি ঠিক কী এই পরিচ্ছেদে তার পরিচয় দিতে চাই। তার আগে দেখা দরকার লোকায়ত-দর্শন প্রসঙ্গে সত্যিই এমন সমস্যা ওঠে যার সমাধান পাবার জন্যে একটি কোনো বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির প্রয়োজন আছে।

————————-
১. C. Caudwell IL.
২. F. Engels OFPPS.
৩. H. L. Morgan AS.
৪. G. Thomson AA এবং SAGS.
৫. G. Thomson SAGS 36.