০১. অদ্ভুত এক ধরনের শব্দ হচ্ছে

অদ্ভুত এক ধরনের শব্দ হচ্ছে।

পরিচিত কোনো শব্দের সঙ্গে এর বিন্দুমাত্র মিল নেই বলে শব্দটাকে ঠিক। ব্যাখ্যা করা যাবে না। লক্ষ লক্ষ ঝিঝি পোকার আওয়াজকে যদি কোনো উপায়ে কমিয়ে অতি সূক্ষ্ম পর্দায় নিয়ে আসা যায় এবং সেই আওয়াজটাকে দিয়ে ঘূর্ণির মতো কিছু করা যায়, তাহলে বোধহয় কিছুটা ব্যাখ্যা হয়। না, তাও হয় না। আওয়াজটার মধ্যে ধাতব ঝংকার আছে। ঝিঝি পোকার আওয়াজে কোনো ধাতব ঝংকার নেই। শব্দটা অস্বস্তিকর। স্নায়ুর ওপর চাপ ফেলে। আমাকে বলা। হয়েছে এই শব্দ সহ্য হয়ে যাবে। মানুষের সহ্য করবার শক্তি অসীম। কাজেই সহ্য হলেও হতে পারে। কিন্তু আমার এখনো হচ্ছে না। কোনো দিন হবে বলেও মনে হয় না। আমি খুবই অস্থির বোধ করছি।

মহাশূন্যযান—গ্যালাক্সি টু-তে আজ আমার তৃতীয় দিন। এর আগে আমি কখনো কোনো মহাশূন্যযানে ওঠা দূরে থাক, তার ভেতরের ছবি পর্যন্ত দেখি নি। মহাশূন্যের প্রতি আমার কোনো আগ্রহ নেই। অযুত নিযুত লক্ষ কোটি মাইল দূরের গ্রহগুলি কেমন? সেখানে প্রাণের বিকাশ ঘটেছে কিনা তা নিয়ে আমি মাথা ঘামাই না।

আমি এক জন টিভি প্রোগ্রাম মনিটার কার্যক্রমের অতি সামান্য কর্মচারী। আমার কাজ হচ্ছে বিশেষ বিশেষ কোনো টিভি প্রোগ্রাম দর্শকদের কেমন লাগল তা মনিটর করে স্ট্যাটিসটিক্স তৈরি করা। যেমন টিভি চ্যানেল থ্রিতে একটা হাসির সিরিয়েল হচ্ছে, নাম–কথা বলা না-বলা। আমার কাজ হচ্ছে প্রোগ্রাম চলাকালীন সময়ে বিভিন্ন বাড়িতে টেলিফোন করে অত্যন্ত ভদ্ৰভাবে জানতে চাওয়া, ম্যাডাম (বা স্যার), আপনি কি এই মুহূর্তে টিভি দেখছেন?

যদি উত্তর হয় হ্যাঁ, তাহলে বলা, কোন চ্যানেল দেখছেন?

তার উত্তর হ্যাঁ হলে জিজ্ঞেস করা, কথা বলা না বলা অনুষ্ঠানটি আপনার কেমন লাগছে? বেশির ভাগ সময়ই কোনো উত্তর পাওয়া যায় না, আমার প্রশ্ন শুনেই খট করে টেলিফোন নামিয়ে রাখে। কেউ কেউ অত্যন্ত রাগী গলায়। বলে, আমাদের এভাবে বিরক্ত করার কী অধিকার আছে আপনার? আবার অনেকে কুৎসিত গালাগালি করে। আমি গায়ে মাখি না। গায়ে মাখলে চাকরি করা যায় না। আমি হাসিমুখে আমার কাজ করি। যথাসময়ে রিপোর্ট পাঠিয়ে দিই। আমার মতো আরো অনেকেই আছে। তারাও রিপোর্ট পাঠায়। এইসব রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে প্রোগ্রাম রেটিং করা হয়। মাস শেষ হলে একটা চেক পাই।

গত মাসে ব্যতিক্রম হল। চেকের সঙ্গে আলাদা খামে এক চিঠি এসে উপস্থিত। চিঠির ওপর সোনালি রঙের ত্রিভুজের ছাপ। এর মানে হচ্ছে, অত্যন্ত জরুরি। এক্ষুণি খাম খুলে চিঠি পড়ে ব্যবস্থা নিতে হবে। আমি অবশ্য তা করলাম না। প্রথম চেকটি দেখলাম, টাকার অঠিক আছে কিনা। একটি বোনাস পাওনা হয়েছিল। সেই বোনাস দেয়া হয়েছে কিনা। দেয়া হয়েছে। সব ঠিকঠাক আছে। তারপর আমি ত্ৰিভুজ চিহ্নের খাম খুললাম। এ কী অসম্ভব ব্যাপার। মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্রের ডিরেক্টর আমাকে একটি চিঠি পাঠিয়েছেন।

জনাব, আপনাকে অবিলম্বে মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্রের সপ্তম শাখায় উপস্থিত হতে বলা হচ্ছে। অত্যন্ত জরুরী।

বিনীত
এস মাথুর
ডিরেক্টর মহাশূন্য গবেষণা কেন্দ্র-৭

নিশ্চয়ই কোথাও কোনো ভুল হয়েছে। প্যাঁচ লেগে গেছে। আমার মতো নগণ্য ব্যক্তিকে মহাশূন্য গবেষণা কেন্দ্র কেন শুধু শুধু ডাকবে? তবে ভুল হোক আর যাই হোক উপস্থিত আমাকে হতেই হবে। কারণ চিঠির উপর সোনালি রঙের ত্রিভুজ আঁকা। একে অগ্রাহ্য করা প্রথম শ্রেণীর রাষ্ট্ৰীয় অপরাধ। আমি ছুটলাম ট্রাভেল এজেন্টের কাছে বিমানের বুকিং-এর ব্যাপার আছে। কিভাবে গবেষণা কেন্দ্র-৭-এ যেতে হয় তাও জানি না।

ট্রাভেল এজেন্টের সুন্দরী তরুণী যেন আমাকে অত্যন্ত আনন্দের সংবাদ দিচ্ছে এমন ভঙ্গিতে বলল, আগামী দু মাসের ভেতর কোনো বুকিং দেয়া যাবে না। আমি ত্রিভুজ আঁকা চিঠি তার হাতে দিতেই সে গম্ভীর মুখে বলল, মিনিট দশেক অপেক্ষা করুন। দেখি কি করা যায়।

দশ মিনিট অপেক্ষা করতে হল না। সাত মিনিটের মাথায় সে বলল, আপনাকে একটি জরুরি বুকিং দেয়া হয়েছে। আজ রাত নটা কুড়ি মিনিটে আপনার ফ্লাইট। নটার সময় চলে আসবেন। কাগজপত্র রেডি করে রাখব। আপনার ভ্রমণ শুভ হোক, সুন্দর হোক।

আমি মুখ শুকনো করে এ্যাপার্টমেন্টে চলে এলাম। রাত নটা বাজতে এখনো পাঁচ ঘণ্টা দেরি। এই পাঁচ ঘণ্টা কাজে লাগানো যায়। আমার কেমন ভয় ভয় করতে লাগল। এ কী সমস্যায় পড়লাম। একদল লোক আছে, দেশ-বিদেশ ঘুরতে যাদের ভালো লাগে আমি সেরকম না। কাজ শেষ করে নিজের এ্যাপার্টমেন্টে ফিরে টিভি সেট খুলে বসাতেই আমার আনন্দ। রান্নাবান্না করাতেও আমার কিছু শখ আছে। আমার লাইব্রেরিতে বেশ কিছু রান্নার বই আছে। বইপত্র দেখে সপ্তাহে এক দিন একটা নতুন রান্না করি। সেদিন নিকিকে আসতে বলি। সব দিন সে আসতে পারে না। সে একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে কাজ করে। অবসর তার খুবই কম। সেই অবসরগুলির বেশির ভাগই ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের ম্যানেজার দখল করে রাখে। এখানে ওখানে নিকিকে নিয়ে যায়। সুযোগ পেলেই গায়ে হাত দিতে চায়। নিকি সব সহ্য করে। কারণ ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের চাকরিটা সে ছাড়তে চায় না। বোনাস-টোনাস মিলিয়ে এই চাকরিটা ভালোই। ওভারটাইম আছে। ওভারটাইমের পয়সাও ভালো। নিকি টাকা জমাচ্ছে। আমি নিজেও জমাচ্ছি। আমরা বিয়ে করতে চাই। বিয়ের জন্যে যে বিশাল অঙ্কের লাইসেন্স ফি দরকার, তা আমাদের নেই। কষ্ট করে টাকা জমানোর এই হচ্ছে রহস্য।

আমরা ঠিক করে রেখেছি বিয়ের পর দু কামরার একটা এ্যাপার্টমেন্ট নেব। দুজনে খুব কষ্ট করে হলেও টাকা জমাব। সেই টাকায় প্রতি বৎসর ভ্রমণ-পাস কিনব। নিকি নতুন নতুন জায়গায় যেতে খুব ভালোবাসে। আমার এত শখ নেই, তবু নিকির আনন্দেই আমার আনন্দ।

টেলিফোন করতেই নিকিকে পাওয়া গেল। তার গলার স্বরে ক্লান্তি ঝরে পড়ছে। যেন হা-না বলতেও তার কষ্ট হচ্ছে। আমি বললাম, নিকি তুমি কী করছ?

কিছু করছি না। বসে বসে হাই তুলছি। এত ক্লান্ত যে মনে হচ্ছে এক্ষুণি ঘুমিয়ে পড়ব।

তুমি কি একটু আসতে পারবে।

কেন?

আমি একটা ঝামেলায় পড়েছি।

নিকির গলার স্বর থেকে ক্লান্তি মুছে গেল। সে উদ্বিগ্ন গলায় বলল, কী হয়েছে?

আমি নিজেও ঠিক বুঝতে পারছি না।

এক্ষুণি আসছি।

এই হচ্ছে নিকি। তার যত কাজই থাকুক, যত ঝামেলাই থাকুক, আমার কোনো সমস্যা হয়েছে শুনলে ছুটে আসবে। বাস বা ট্রামের জন্যে অপেক্ষা করবে না। সাবওয়েতে লাইনে দাঁড়াবে না। ট্যাক্সি ভাড়া করবে, যাতে সবচেয়ে কম সময়ে উপস্থিত হওয়া যায়।

নিকি ঠিক রূপবতী নয়। তার ঠোঁট মোটা, চোখ ঘোট ঘোট। হাতের থাবা পুরুষদের মতো বিশাল তবু তার দিকে তাকালেই আমার মন অন্য রকম হয়ে যায়। তাকে মনে হয় এই পৃথিবীর সবচেয়ে রূপবতী মেয়ে। যার পাশে বসে একটি জীবন অনায়াসে পার করে দেয়া যায়।

নিকি আধ ঘণ্টার মধ্যে উপস্থিত হল। ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের ইউনিফর্ম পর্যন্ত ছাড়ে নি। চলে এসেছে।

কী হয়েছে?

বস। স্বাভাবিক ভাবে নিঃশ্বাস নিতে শুরু কর, তারপর বলছি।

এক্ষুণি বল।

আমি ত্রিভুজ আঁকা চিঠিটি দিলাম। নিকি নিজেও কিছু বুঝতে পারল না। অবাক হয়ে বলল, তোমাকে এই চিঠি দিচ্ছে কেন?

আমি জানি না। বড় ভয় লাগছে।

ভয়ের কী আছে? তুমি তো কোনো অন্যায় কর নি। হয়তো তারা তোমাকে কোনো কাজ দিতে চায়।

আমাকে কাজ দেবে কেন? ওদের কাজের আমি জানি কী?

আমি লক্ষ করলাম নিকি নিজেও ভয় পাচ্ছে। ভয় পেলে নিকির খুব নাক ঘমে। এবং সে রুমাল দিয়ে একটু পর পর নাক ঘষতে থাকে। এখনো সে তাই করছে। আমি নরম গলায় বললাম, চল যাই, বাইরে কোথাও খেয়ে নেব। আমার হাতে সময় বেশি নেই।

নিকি হ্যাঁ-না কিছু বলল না। আমি বললাম শুধু শুধু দুশ্চিন্তা করছি, আমার মনে হয় কোথাও একটা ভুল হয়েছে। সপ্তম কেন্দ্রে পৌছানমাত্র ভুল ধরা পড়বে।

আমরা দামি একটা রেস্তোরায় খাবার খেলাম। অনেকগুলি টাকা বেরিয়ে গেল। এত দামি দামি খাবার, অথচ কোনোটাই ভালো লাগছে না। নিকি মন খারাপ করে খাবারদাবার নাড়াচাড়া করছে। আমি আবার বললাম, কোথাও একটা ভুল হয়েছে। তুমি দুশ্চিন্তা করবে না। সপ্তম কেন্দ্রে পৌছেই তোমার সঙ্গে আমি কথা বলব।

নিকি এই কথারও জবাব দিল না।

 

সপ্তম কেন্দ্রে পৌছে আমি নিকির সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারলাম না। আমাকে সরাসরি নিয়ে যাওয়া হল এস, মাথুরের কামরায়।

কামরাটি বিশাল। দিনের বেলাতেও বড় একটা ডিমলাইট জ্বলছে। দরজা জানালা বন্ধ। ঘরটা অন্য সব ঘরের চেয়ে ঠাণ্ডা। আমার শীত করতে লাগল। এস, মাধুর মানুষটি বুদ্ধ মাথায় কোনো চুল নেই। শুধু মাথা নয়, ভুরুতেও চুল নেই। গোলাকার মুখ–কুৎসিত দেখাচ্ছে। কিন্তু গলার স্বর আশ্চর্য রকম সতেজ। তিনি আমার দিকে না তাকিয়েই বললেন, আপনি বসুন।

আম বসলাম। ক্ষীণ স্বরে বললাম, আমাকে কেন ডাকা হয়েছে বুঝতে পারছি না।

এস. মাথুর কিশোরদের মত সতেজ গলায় বললেন, মহাশূন্য গবেষণা প্রকল্প থেকে প্রতি ছ বছর পরপর একটি বিশেষ ধরনের মহাকাশযান পাঠান হয়, তা কি আপনি জানেন?

জ্বি না।

সাধারণ মহাকাশযানের গতিপথ সৌরমণ্ডলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এই বিশেষ মহাকাশযানগুলি হাইপারডাইভ ক্ষমতাসম্পন্ন। হাইপারডাইড কী, আপনি জানেন?

জ্বি না।

সময় সংকোচক ডাইভ। আরো সহ করে বলি। ধরুন আপনি একটি মহাকাশযানে করে যাচ্ছেন। মহাকাশযানটির গতিবেগ আলোর গতিবেগের কাছাকাছি। এই ক্ষেত্রে ১০ আলোকবর্ষ দূরের কোনো জায়গায় যেতে আপনার সময় লাগবে দশ বৎসর কিন্তু এই দূরত্ব হাইপার স্পেস ডাইভের কল্যাণে আপনি এক মাইক্রো সেকেণ্ডে অতিক্রম করতে পারবেন। হাইপার স্পেস ডাইভের কল্যাণে আমরা আজ অকল্পনীয় দূরত্বে পৌঁছতে পারছি।

আপনি আমাকে এসব কেন বলছেন বুঝতে পারছি না।

হাইপার স্পেস ডাইভ ক্ষমতাসম্পন্ন একটি মহাকাশযান খুব শিগগিরই রওনা হচ্ছে। ঐ মহাকাশযানে সাত জন কু আছে। এরা সবাই একেকটি বিষয়ে বিশেষজ্ঞ। এ ছাড়াও আছে চারটি পিএস-ফোর রোবট। পিএসরোবট হচ্ছে রোবটটিকস-এর বিস্ময়। টেনার জাংশানে মুক্ত কপোট্রনের রোবট।

আমি এখনো বুঝতে পারছি না, আপনি আমাকে এসব কেন বলছেন।

আপনাকে এত কিছু বলছি, কারণ ঐ মহাকাশযানের আপনিও একজন যাত্রী।

আমি আপনার কথা বুঝতে পারছি না।

বড় ধরনের এক্সপিডিশনগুলিতে আমরা নিয়মিত ক্রুদের সঙ্গে অনিয়মিত এক জনকে ঢুকিয়ে দিই। খুবই সাধারণ একজন। যার কোনো রকম টেকনিক্যাল জ্ঞান নেই। সে চলে তার সহজাত বুদ্ধিতে। কোনো বড় ধরনের সমস্যা সে তার নিজের মতো করে সমাধান করতে চায়। আমরা দেখেছি শতকরা সাতানব্বই ভাগ ক্ষেত্রে এই জাতীয় সহজ সমাধানই একমাত্র সমাধান। বিশেষজ্ঞরা বা অতি উন্নত রোবটা সহজ সমাধান চট করে ধরতে পারে না।

কোনো রকম সমস্যা সমাধান করবার ক্ষমতা আমার নেই। আমি খুবই নগণ্য ব্যক্তি।

অনেক রকম বাছাইয়ের পর আপনাকে আলাদা করা হয়েছে। এক সপ্তাহের মতো সময় আপনার হাতে আছে। এই সময়ে আপনাকে নিয়ে কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হবে। হাইপার স্পেস ডাইভ দেয়ার মতো শারীরিক যোগ্যতা আপনার আছে কি না দেখা হবে। তারপর যাত্রা শুরু।

ফিরে আসব কবে?

কখন ফিরবেন এই ব্যাপারটা বেশ অদ্ভুত। একটি হাইপার স্পেস ডাইভের সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবীর বয়স প্রায় এক শ বছর বেড়ে যায়। ধরুন, তিনটি হাইপার স্পেস ডাইভ দিয়ে আপনি পৃথিবীতে ফিরলেন। ফিরে এসে দেখবেন পৃথিবীর বয়স তিন শ বছর বেড়ে গেছে। হয়তো পৃথিবী কোনো প্রাকৃতিক কারণে ধ্বংসই হয়ে গেছে। কাজেই ফিরে আসার সময় জানতে চাওয়া অর্থহীন।

আমি অবাক হয়ে এই লোকের দিকে তাকিয়ে রইলাম। কী বলছে সে! এর মানে কী!

কত বড় সৌভাগ্য আপনার ভেবে দেখুন। আপনি হবেন মানবজাতির প্রথম প্রতিনিধি দলের একজন, যে অন্য একটি গ্যলাক্সিতে পা রাখবে।

কী হবে পা রেখে?

অনেক কিছুই হতে পার। হয়তো অসীম ক্ষমতাসম্পন্ন কোনো প্রাণীর সঙ্গে আপনাদের যোগাযোগ হবে। তাদের কল্যাণে আমরা সৃষ্টিতত্ত্বের রহস্যগুলি জেনে ফেলতে পারব। সময় ব্যাপারটা আমরা বুঝতে পারছি না। তারা হয়তো আমাদের সময় ব্যাপারটা কী, বুঝিয়ে দেবে। আমরা তখন ইচ্ছামতো সময়কে সংকুচিত ও প্রসারিত করতে পারব।

আপনি বলতে চাচ্ছেন আমি আর কোনোদিন এই চেনা পৃথিবীতে ফিরে আসব না?

হ্যাঁ তাই।

আমি অবাক হয়ে তাঁর দিকে তাকিয়ে রইলাম। আমাকে এই ঘর থেকে বের করে আলাদা করে ফেলা হল। আমি কত জনকে যে বললাম, আমাকে একটা টেলিফোন করতে দিন। এক জনের সঙ্গে একটু কথা বলব। ঘড়ি ধরে এক মিনিট। এর বেশি নয়।

কেউ আমার কথার কোনো উত্তর দিল না। এক জন শুধু বলল, সপ্তম কেন্দ্রের গবেষণাগার থেকে বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে যোগাযোগের কোনো ব্যবস্থা নেই।

নিকির সঙ্গে আমার কথা বলা হল না।

সময়ের কোনো হিসাব আমার কাছে ছিল না। গবেষণা কেন্দ্রের যেখানে আমাকে রাখা হল, দিন এবং রাত বলে সেখানে কিছু নেই। সারাক্ষণই কৃত্রিম আলো জ্বলছে। আমাকে বলা হল মানুষের শরীরে দিন। রাত্রির যে চক্র তৈরি হয় তা ভেঙে দেবার জন্যই এই ব্যবস্থা। তাদের কোনো কথাই আমি মন দিয়ে শুনি না। যা করতে বলে করি, এই পর্যন্তই।

এক বার তারা আমাকে একটা সিলিন্ডারের ভেতর ঢুকিয়ে দিল। নিচ্ছিদ্র অন্ধকার। এ জাতীয় অন্ধকার পৃথিবীতে কখনো পাওয়া যায় না। অন্ধকার যে এত ভয়াবহ হতে পারে তা আমার কল্পনাতেও ছিল না। কত সময় যে কেটে গেল সেই সিলিন্ডারে। কী ভয়াবহ অবস্থা! প্ৰচণ্ড খিদে, তবু মনে হয়েছে খাদ্য নয়, আমার প্রয়োজন আলে। সামান্য আলো। প্ৰদীপের একটি ক্ষুদ্র শিখার জন্যে আমি আমার নশ্বর জীবন দিয়ে দিতে পারি। কিন্তু আলো ভাগ্যে জোটে নি। খাদ্য এসেছে, আলো নয়। আশ্চর্য, এক সময় সেই অন্ধকারও সহ্য হয়ে গেল। মনে হল আলোহী এই জগতইব। মন্দ কি। যখন পুরোপুরি অভ্যস্ত হয়ে গেলাম তখন আমাকে চোখ-ধাঁধানো আলোয় ঝলমল করছে এমন একটি ঘরে ঢুকিয়ে দেয়া হল। আহ্ কী তীব্র আলো! প্ৰাণপণে চেঁচিয়েছি, আলো চাই না, অন্ধকার চাই। কুৎসিত এই আলোর হাত থেকে আমাকে রক্ষা কর।

কত বিচিত্র ধরনের ট্রেনিং। ভরশূন্যতার ট্রেনিং, শব্দহীন জগতের ট্রেনিং আবার ভয়াবহ শব্দের ট্রেনিং।

তারপর একদিন ট্রেনিং পর্ব শেষ হল। আমাকে গোলাকার একটি ঘরে নিয়ে যাওয়া হল। আমার সঙ্গে গবেষণাগারের এক জন কর্মী। ঘরটির মাঝখানে ছোট্ট টেবিলে একটা টেলিফোনের সেট।

গবেষণাগারের কর্মী আমাকে বললন, এখন আপনি আপনার বান্ধবীকে একটা টেলিফোন করতে পারেন। নাম্বার মনে আছে তো, নাকি ট্রেনিং-এর ঝামেলায় সব ভুলে বসে আছেন?

নাম্বার মনে আছে।

নিকিকে তার বাসার নাম্বারেই পাওয়া গেল। সে অসম্ভব অবাক হয়ে বলল, কী ব্যাপার তোমার?

আমি বহু কষ্ঠে বললাম, তোমার কী খবর? তুমি কেমন আছ? নিকি রাগী স্বরে বলল, আমার খবর তোমার কী দরকার? তুমি তোমার খবর বল। হচ্ছেটা কী?

আমাকে একটা মহাকাশযান করে পাঠান হচ্ছে।

কী বলছ তুমি এসব!

সত্যি কথাই বলছি নিকি।

আমি কিছু বুঝতে পারছি না।

আমিও বুঝতে পারছি না।

প্রায় দশ মিনিটের মতো কথা বললাম। নিকি ব্যাকুল হয়ে কাঁদল। আমার চোখও বারবার ভিজে উঠল। এক সময় টেলিফোন নামিয়ে রাখলাম। আমার সঙ্গী আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি তার চোখে চোখ রেখে একটু হেসে বললাম, এতক্ষণ যার সঙ্গে কথা বললাম, সে নিকি নয়। সে আপনাদের একজন।

আমার সঙ্গী বিস্মিত হয়ে বলল, একথা কেন বলছেন? তার গলার স্বর কি আপনার কাছে অন্য রকম মনে হয়েছে?

না, গলার স্বর নিকির মতো। আচার-আচরণ, কথা বলার ঢং সবই নিকির মতো। তবু আমি জানি, সে নিকি নয়।

কখন জানলেন?

টেলিফোন নামিয়ে রাখার সঙ্গে সঙ্গে জানলাম।

আপনি ঠিকই ধরেছেন। এতক্ষণ আপনি কথা বলেছেন একটি ভয়েস সিনথেসাইজারের সঙ্গে।

আমার সঙ্গে এই রসিকতা করার প্রয়োজনটা তো ধরতে পারছি না। শুরুতে আমি নিকির সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছি। পরে কিন্তু আর চাই নি।

আমরা ছোট্ট একটা পরীক্ষা চালানর জন্যে টেলিফোনের ব্যবস্থাটা করেছি।

কী পরীক্ষা?

মহাকাশযানে করে পাঠানর জন্যে সব সময় স্বাভাবিক ক্ৰদের বাইরে এক জনকে নেয়া হয়। সেই একজন কিন্তু রাম শ্যাম যদু মধু কেউ নয়। সেই একজন হচ্ছে বিশেষ একজন। যার কিছু বিশেষ ক্ষমতা আছে। ইএসপি জাতীয় ক্ষমতা। আপনার তা প্রচুর পরিমাণে আছে।

কী করে বুঝলেন?

সেন্ট্রাল কম্পিউটার পৃথিবীর সব মানুষদের সম্পর্কে খোঁজ খবর রাখে। আপনার সম্পর্কে খবর সেখান থেকেই পাওয়া।

খবরটা ভুল। আমার ইএসপি কেন, কোনো ক্ষমতাই নেই। থাকলে আমি তা জানতাম। আমি জানব না, অথচ সেন্ট্রাল কম্পিউটার জানবেতা কী করে হয়?

জন্মসূত্রে আপনি যে ক্ষমতা নিয়ে এসেছেন তার কথা তো আপনার জানার কথা নয়। তা জানবে অন্য জন। আপনার মনে আছে নিশ্চয়ই, আপনি টিভি প্রোগ্রাম মনিটর করতেন।

হ্যাঁ, ওটাই আমার চাকরি।

চ্যানেল থিীর একটা প্রোগ্রাম আপনি মনিটর করছিলেন, তাই না?

হ্যাঁ।

যে সময় ঐ প্রোগ্রামটি চলত তখন মাত্র নয় দশমিক একভাগ লোক ঐ প্রোগ্রাম দেখত। চল্লিশ দশমিক দুই ভাগ লোক কোনো প্রোগ্রামই দেখত না। বাকিরা দেখত অন্য চ্যানেলের প্রোগ্রাম, ঠিক না?

হ্যাঁ, ঠিক।

অথচ আপনি যাদের বাসায় টেলিফোন করতেন তারা সবাই ঐ প্রোগ্রামটি দেখত। আপনি জেনেশুনে টেলিফোন করতেন না। এমনিতেই করতেন। কিন্তু দেখা যেত ঐ বাসায় কেউ না কেউ চ্যানেল থ্রির প্রোগ্রামটি দেখছে। খুব উঁচু ধরনের ইএসপি ক্ষমতা না থাকলে তা সম্ভব নয়। তাছাড়া–।

তাছাড়া কী?

আপনাকে নিয়ে পাঁচটি জেনার টেস্ট করা হয়েছে। প্রতিটি টেস্টে আপনি এক শ নম্বর স্কোর করেছেন, যা অকল্পনীয় একটা ব্যাপার।

আমার ইএসপি ক্ষমতা কী কাজে লাগবে?

হয়তো কোনোই কাজে লাগবে না, তবে মহাকাশ-যাত্রা, বিশেষ করে নিজেদের গ্যালাক্সি ছেড়ে অন্য একটি গ্যালাক্সিতে পা দেয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ একটি ব্যাপারে আপনার মতো ইএসপি ক্ষমতাধর কাউকে দরকার।

আমার ইচ্ছা করছিল আচমকা লোকটির গালে একটা চড় বসিয়ে দিই। বহু কষ্টে সেই ইচ্ছা দমন করলাম। কী লাভ? কী হবে হৈচৈ করে? কিছুই হবে না। যথাসময়ে আমাকে যাত্রা করতে হবে। যেতে হবে সব কিছু পেছনে ফেলে। এই পৃথিবীকে আমার কখনো অসাধারণ কিছু বলে মনে হয় নি, তবু পৃথিবীর জন্যে মায়া লাগছে।