সুরভি জিজ্ঞাসা করে, তুমি কোন জন।
রাজা বলে, শুন মাতা মোর নিবেদন।।
অবনীতে মহীপতি ছিলাম মা আমি।
শ্রীবৎস আমার নাম প্রাগদেশস্বামী।।
আনন্দেতে করিতাম প্রজার পালন।
কত দিনে শুন মাতা দৈবের ঘটন।।
একদিন শনি সঙ্গে জলধি তনয়া।
মম স্থানে আসে দোঁহে বিরোধ করিয়া।।
বিচার করিনু আমি ধর্ম্মশাস্ত্র ধরি।
বিপরীত বুঝি শনি হৈল মম অরি।।
রাজ্য ধন সব শনি করিল বিনাশ।
অবশেষে চিন্তা সহ আসি বনবাস।।
বনবাসে মহাক্লেশে বঞ্চি দুই জনে।
চিন্তাকে হারানু মাতা নির্জ্জন কাননে।।
সুরভি এতেক শুনি কহে নৃপ প্রতি।
ভয় নাই, থাক রাজা আমার বসতি।।
যত দিন গ্রহ মন্দ আছয়ে তোমার।
তত দিন মোর তেথা থাক গুণাধার।।
এখানে শনি ভয় নাহিক রাজন।
হেথা থাকি কর রাজা কালের হরণ।।
পুনঃ বসুমতী পতি হবে নৃপবর।
চিন্তা সতী পাবে কত দিবস অন্তর।।
এ বন ছাড়িয়া নাহি যাইবে কোথায়।
দুই ধার দুগ্ধি আমি ভুঞ্জাব তোমায়।।
এ বন ছাড়িয়া যদি যাও নররায়।
অবশ্য পড়িবে তুমি শনির মায়ায়।।
রাজা বলে, মাতা হয় যে আজ্ঞা তোমার।
রহিলাম যত দিন দুঃখ নহে পার।।
এরূপে শ্রীবৎস রায় রহিল তথায়।
শুনহ অপূর্ব্ব কথা ধর্ম্মের তনয়।।
মনোরথ নন্দিনীর যত দুগ্ধ খায়।
দুধারের দুগ্ধেতে ধরণী ভিজে যায়।।
সেই দুগ্ধে মৃত্তিকা ভিজায়ে কাদা করি।
দুই হাতে মহারাজ দুই পাট ধরি।।
চিন্তাদেবী শ্রীবৎস নৃপতি নাম স্মরি।
তাল ও বেতাল সিদ্ধ মনেতে বিচারি।।
যুগ্মপাট যুক্ত করি গঠয়ে রাজন।
এরূপে কতেক পাট করয়ে রচন।।
ঈশ্বরের ধ্যান করি কালের হরণ।
সহস্র সহস্র পাট করিল গঠন।।
স্থানে স্থানে স্তূপাকার শত শত করি।
এমতে শ্রীবৎস বঞ্চে দিবস শর্ব্বরী।।
কত দিনান্তরে শুন ধর্ম্ম মহাশয়।
পুনর্ব্বার পড়ে রাজা শনির মায়ায়।।
সেই মহাজন যায় বাহিয়া তরণী।
কূলেতে থাকিয়া দেখে শ্রীবৎস আপনি।।
মহাজন প্রতি রাজা বলিল ডাকিয়া।
শুন শুন সদাগর কূলেতে আসিয়া।।
নৃপতির উচ্চবর শুনি মহাজন।
শীঘ্র করি কূলে তরী লইল তখন।।
পাইয়া সাধুর আজ্ঞা নৌকার নফর।
শ্রীবৎসের কাছে তরী আনিল সত্বর।।
মৃদুভাষে রাজা কহে বিনয় বচন।
শুন মহাজন তুমি মোর বিবরণ।।
বড় বংশে জন্মিলাম পূর্ব্ব ভাগ্যবলে।
কিন্তু সব হৈল নষ্ট নিজ কর্ম্মফলে।।
কারে কি বলিব আমি, কি বলিতে পারি।
ঈশ্বরের ইচ্ছা যাহা, খণ্ডাইতে নারি।।
তুমি যদি দয়া করে এক কর্ম্ম কর।
তবে ত তরিব আমি বিপদ সাগর।।
কতগুলি স্বর্ণপাট করিয়াছি আমি।
তুলে যদি লয়ে যাও নৌকা পরে তুমি।।
যে দেশে বাণিজ্যে তুমি করিছ প্রয়াণ।
সেই দেশে তব সঙ্গে করিব প্রস্থান।।
স্বর্ণপাট বেচি যদি পাই কিছু ধন।
তবে ত বিপদে তরি, এই নিবেদন।।
রাজার বিনয় বাক্য শুনি মহাজন।
কিঙ্করের আজ্ঞা করে , লয়ে এস ধন।।
রাজাকে কহিল সাধু, শুন মহাশয়।
আইস আমার সঙ্গে, নাহি কিছু ভয়।।
হৃষ্ট হয়ে নরপতি উঠে নৌকা পরে।
স্বর্ণপাট বয়ে আনে যতেক কিঙ্করে।।
তুষ্ট হয়ে সদাগর বাহিল তরণী।
কি কব শনির মায়া শুন নৃপমণি।।
কপট পাষণ্ড বড় সেই সদাগর।
এই দুষ্ট, তবে চিন্তিল নিজ অন্তর।।
মিলাইল যদি ধন দৈবেতে আমাকে।
ঘুচাই মনের ব্যথা বধিয়া ইহাকে।।
এতেক ভাবিয়া মনে দুষ্ট দুরাচার।
রাজাকে ধরিয়া ফেলে সাগর মাঝার।।
যখন ধরিয়া দুষ্ট করিল বন্ধন।
ত্রাহি ত্রাহি বলি রাজা করিছে স্মরণ।।
কোথা তাল বেতাল বান্ধব দুই জন।
এ মহাবিপদে কর আমারে তারণ।।
কোথা গেলে চিন্তাদেবী আমারে ছাড়িয়া।
আমার দুর্গতি প্রিয়ে দেখ না আসিয়া।।
সেই নৌকা পরে ছিল চিন্তা পতিব্রতা।
কান্দিয়া উঠিল রাণী শুনি প্রভু কথা।।
যখন ধরিয়া নৃপে ফেলিল সমুদ্রে।
হইল বেতাল তাল রাজচক্ষে নিদ্রে।।
তাল রক্ষা কৈল চক্ষু বেতাল হৈল ভেলা।
ভাসিয়া নৃপতি যায় যেন রাশি তূলা।।
সেইক্ষণে চিন্তাদেবী বালিশ যোগায়।
বালিশে আলিস রাখি নৃপ ভাসি যায়।।
শুনহ আশ্চর্য্য কথা ধর্ম্মের তনয়।
বহুকাল জলে ভাসি সৌতিপুরে যায়।।
সৌতিপুরে রম্ভাবতী মালিনীর স্থানে।
আসিয়া লাগিল শুষ্ক পুষ্পের উদ্যানে।।
বহুকাল শুষ্ক ছিল যত পুষ্পবন।
রাজ আগমনে পুষ্প ফুটিল তখন।।
রাজ-দরশনে পুনঃ জীব সঞ্চরিল।
পূর্ব্বমত সব পুষ্প বিকশিত হৈল।।
অশোক কিংশুক নাগ ফুটিল বকুল।
গন্ধরাজ চাঁপা ফুটে জারুল পারুল।।
শেফালি সেঁওতী আদি নানাজাতি ফুল।
ফুটিল যতেক পুষ্প, নাহি সমতুল।।
পুষ্পগন্ধে অলিকুল ধায় মধু আশে।
কোকিল কোকিলা গান করিছে হরিষে।।
ষড়ঋতু আসি তথা হৈল উপনীত।
শর ধনু সহ কাম তথায় উদিত।।
পূর্ব্বমত বনশোভা হইল বিস্তর।
কর্ম্মান্তর হইতে মালিনী আইল ঘর।।
আশ্চর্য্য দেখিয়া বড় ভাবিছে মালিনী।
ইহার কারণ কিবা, কিছুই না জানি।।
বন দেখি হৃষ্ট অতি মালীর মহিষী।
কুসুম কাননে শীঘ্র প্রবেশিল আসি।।
একে একে নিরখিয়া চতুর্দ্দিকে চায়।
হেনকালে শ্রীবৎসকে দেখিল তথায়।।
কন্দর্প আকার এক পুরুষ সুন্দর।
মালিনী দেখিয়া কহে করি যোড়কর।।
কোথা হৈতে এলে তুমি, কোন মহাজন।
সত্য করি কহ বাছা, মোর নিবেদন।।
মালিনী বিনয় শুনি তবে নৃপমণি।
কহিতে লাগিল রাজা আপন কাহিনী।।
বাণিজ্যে আইনু আমি করিতে ব্যাপার।
ডিঙ্গা ডুবি হয়ে দুঃখ হইল আমার।।
ভাগ্য হেতু প্রাণ পাই, তেঁই আসি কূল।
আমার ভাবনা মিথ্যা,ভবিতব্য মূল।।
শুনিয়া মালিনী কহে, শুন মহাশয়।
থাকহ আমার ঘরে নাহি কিছু ভয়।।
শুভগ্রহ হৈল তব, দুঃখ অবসান।
নহে কেন নৌকা ডুবে পাইলে পরাণ।।
আর কেহ নাহি বাপু, বঞ্চি একাকিনী।
মোর গৃহে ভাগিনেয় ভাবে থাক তুমি।।
এমতে রহিল তথা শ্রীবৎস ভূপতি।
শুনহ অপূর্ব্ব কথা ধর্ম্ম মহামতি।।
সুধার সমান মহাভারতের কথা।
শ্রবণে পঠনে ঘুচে, পাপ তাপ ব্যথা।।