১৯তম অধ্যায়
যুধিষ্ঠিরের পুনঃ সন্ন্যাসধৰ্ম্মপ্রশংসা
যুধিষ্ঠির কহিলেন, “আমি ধর্ম্মশাস্ত্র ও বেদ উভয়ই অবগত আছি। বেদে কৰ্ম্মের অনুষ্ঠান ও কৰ্ম্মত্যাগ উভয়ই কর্ত্তব্য বলিয়া নির্দিষ্ট আছে। দেখ, শাস্ত্ৰসমুদয় নিতান্ত জটিল। যুক্তিদ্বারা উহার যেরূপ সিদ্ধান্ত হইয়াছে, আমি তাহা সম্যক অবগত আছি। তুমি কেবল বীরব্রতধারী ও অস্ত্রজ্ঞ; শাস্ত্রার্থপ্রকৃতরূপে অনুধাবন করিতে সমর্থনও। যদি তুমি শাস্ত্রের সূক্ষ্ম তাৎপৰ্য্য ও ধর্ম্মনিশ্চয় [ধর্ম্মসিদ্ধান্ত] সম্যক্রূপ অবগত হইতে, তাহা হইলে আমাকে কদাচ এইরূপ পরামর্শ প্রদান করিতে না। যাহা হউক, তুমি ভ্রাতৃসৌহার্দ্যনিবন্ধন আমাকে যেসকল কথা কহিলে, আমি তাহা শ্রবণ করিয়া তোমার প্রতি পরমপ্রীত ও প্রসন্ন হইয়াছি। যুদ্ধধৰ্ম্ম ও কার্য্যনৈপুণ্যবিষয়ে এই ত্রিলোকমধ্যে তোমার সদৃশ আর কেহই নাই। তুমি যুদ্ধবিষয়ে সূক্ষ্মতর নিতান্ত দুষ্প্রবেশ্য ধর্ম্মোপদেশ প্রদান করিতে পার। কিন্তু আমি যাহা কহিলাম, তদ্বিষয়ে কিছুমাত্র সন্দেহ করা তোমার কৰ্ত্তব্য নহে। তুমি কেবল যুদ্ধশাস্ত্রই অনুশীলন করিয়াছ, জ্ঞানবৃদ্ধদিগের সেবা কর নাই এবং যাঁহারা ধর্ম্মের প্রকৃত তত্ত্ব সংক্ষেপ ও সবিস্তর অবগত আছেন, তাঁহাদিগের ধর্ম্মনির্ণয়ও সবিশেষ অবগত নও। বুদ্ধিমান লোকে এরূপ নিশ্চয় করিয়া গিয়াছেন যে, তপস্যা, ত্যাগ ও ব্রহ্মজ্ঞানলাভ, এই তিনের মধ্যে তপস্যা অপেক্ষা ত্যাগ ও ত্যাগ অপেক্ষা ব্ৰহ্মজ্ঞানলাভ শ্রেষ্ঠ। তুমি ধন অপেক্ষা উৎকৃষ্ট পদার্থ আর কিছুই নাই বলিয়া সিদ্ধান্ত করিয়াছ, কিন্তু আমি উহা শ্রেষ্ঠ বলিয়া স্বীকার করি না। দেখ, স্বাধ্যায়সম্পন্ন, ধর্ম্মপরায়ণ মহর্ষিগণ তপঃপ্রভাবে অক্ষয়লোক লাভ করিয়া থাকেন। আর অন্যান্য বনবাসীরাও স্বাধ্যায়সম্পন্ন হইয়া স্বর্গ লাভ করেন। আর্য্য ব্যক্তিরা বিষয়বাসনা পরিত্যাগপূৰ্ব্বক অজ্ঞানান্ধকার হইতে বিমুক্ত হইয়া ত্যাগশীল ব্যক্তিদিগের অধিকৃত উত্তরদিক্স্থিত লোকসমুদয় লাভ করিয়া থাকেন। আর ক্রিয়াবান ব্যক্তিরা শ্মশানে কলেবর পরিত্যাগ করিয়া দক্ষিণদিগ্বৰ্ত্তীলোকে[পিতৃলোকে] গমন করেন। মোক্ষার্থীরা যে গতি লাভ করেন, তাহা নির্দেশ করা নিতান্ত সুকঠিন; অতএব যোগই সৰ্বোকৃষ্ট ও প্রার্থনীয়। এক্ষণে যোগের বিষয় তোমার হৃদয়ঙ্গম করা নিতান্ত দুঃসাধ্য। অনেক পণ্ডিত ব্যক্তি সার ও অসার পরীক্ষার্থ নানা প্রকার তর্ক-বিতর্ক ও বিবিধ শাস্ত্রের অনুসরণ করিয়া থাকেন। কিন্তু লোকে যেমন কদলীস্তম্ভ [কলাগাছ] বিপাটনপূর্ব্বক [বিদারণ] তন্মধ্যে সার নিরীক্ষণ করে না, তদ্রূপ তাহারাও শাস্ত্রমধ্যে সার নিরীক্ষণে বঞ্চিত হয়েন। কেহ কেহ অদ্বৈতভাব পরিত্যাগপূৰ্ব্বক পাঞ্চভৌতিক দেহমধ্যে অবস্থিত আত্মাকে ইচ্ছাদিসম্পন্ন বলিয়া কীৰ্ত্তন করেন। ফলতঃ আত্মা চক্ষুর অপ্রত্যক্ষ, বাক্যের অনিৰ্দেশ্য ও অতি সূক্ষ্মস্বরূপ। উহা অবিদ্যাপ্রভাবে জীবরূপে পরিবর্ত্তন করিতেছে। লোকে মন ও ইচ্ছাকে দমন, অহঙ্কার ও ক্রিয়াকলাপ পরিত্যাগ এবং আত্মার সহিত সাক্ষাৎকারলাভ করিতে পারিলেই সুখী হয়।
“হে ধনঞ্জয়! এইরূপ সূক্ষ্মবুদ্ধির গোচর সাধুজনসেবিত পথ বিদ্যমান থাকিতে তুমি কি নিমিত্ত অনর্থবহুল অর্থের প্রশংসা করিতেছ? জ্ঞানসম্পন্ন দান-যজ্ঞাদিনিরত ব্যক্তিরাও অর্থকে অনর্থ বলিয়া নির্দেশ করিয়া গিয়াছেন। এই ভূমণ্ডলে আর কতকগুলি এরূপ লোক আছে, যাহারা অধ্যয়ন করিয়া পূর্বজন্মসংস্কারবশতঃ আত্মার অস্তিত্ব স্বীকার করে না। ঐরূপ লোকেরা নিতান্ত মূঢ়। উহারা আত্মা নাই বলিয়া বাচালতা প্রকাশপূৰ্ব্বক ভূমণ্ডলে বিচরণ করে। হে অর্জ্জুন! এই জীবলোকে এরূপ বহুসংখ্যক শাস্ত্রজ্ঞ সাধু ও মহৎলোক আছেন যে, তাঁহাদের মাহাত্ম্য অবগত হওয়া আমাদের বা অন্যান্য লোকের সাধ্যায়ত্ত নহে। যাহা হউক, তত্ত্বজ্ঞ ব্যক্তি যে তপঃ ও বুদ্ধিপ্রভাবে মহত্ত্ব এবং ত্যাগদ্বারা অবিনশ্বর সুখ লাভ করিয়া থাকেন, তাহার আর সন্দেহ নাই।”