১৯তম অধ্যায়
যাদবযুদ্ধে পরাজিত শাল্বের পলায়ন
শ্ৰীকৃষ্ণ কহিলেন, “হে যুধিষ্ঠির! দারুকানন্দন, প্ৰদ্যুম্নের বাক্য শ্রবণ করিয়া, মৃদুমধুরস্বরে কহিতে লাগিল, “হে রুক্মিণীনন্দন! আমি সংগ্রামে অশ্বচালনা করিতে কিছুমাত্ৰ ভয় করি না ও বৃষ্ণিবংশীয়দিগের যুদ্ধব্যবহার বিলক্ষণ জ্ঞাত আছি, কিন্তু যৎকালে আপনি শাল্বের তীক্ষ্নশরে আহত ও একান্ত অভিভূত হইয়াছিলেন, তখন সারথি সর্ব্বতোভাবে রথীকে রক্ষা করিবে, ইহা সারথিদিগের অবশ্য কর্ত্তব্য, এই উপদেশ মদীয় স্মৃতিপথে আরূঢ় হওয়াতে আমি রথ লইয়া প্রত্যাবর্ত্তন করিয়াছি। এক্ষণে আপনি লব্ধসংজ্ঞ হইয়াছেন; স্বেচ্ছানুসারে আমার অশ্বচালনাবিষয়ে নৈপুণ্য অবলোকন করুন। আমি দারুক হইতে জন্মগ্রহণ ও শিক্ষালাভ করিয়াছি; নির্ভয়চিত্তে শাল্বরাজের সৈন্যসমূহমধ্যে প্রবেশ করিতেছি, দেখুন।”
“দারুকানন্দন এই বলিয়া রশ্মিগ্রহণপূর্ব্বক অশ্বচালন করিয়া যমক, যমকেতর, সব্য ও দক্ষিণ প্রভৃতি বিবিধ বিচিত্ৰ মণ্ডলগতি প্রদর্শন করিল। অশ্বগণ রশ্মিসঞ্চালন ও কশাঘাতদ্বারা সারথির হস্তলাঘব [হস্তের ক্ষিপ্ৰতা—হাতের দ্রুততর পরিচালনা] বুঝিতে পারিয়া মহাবেগে গমন করিতে লাগিল। দেখিলে বোধ হয়, যেন তাহারা ক্ষুরদ্বারা ভূতল স্পর্শ না করিয়া রোষাভরে আকাশমার্গেই গমন করিতেছে। দারুকানন্দন সত্বরে শাল্বরাজের সৈন্যগণকে অপসব্যস্থ [সৈন্যের সারির মধ্য দিয়া বিনাবাধায় বেগে রথ চালনায়—বামে-দক্ষিণে দ্বিধাবিভক্ত সৈন্যের যোগসূত্রচ্ছেদ] করিল; তদর্শনে সকলে অতিমাত্র বিস্ময়ান্বিত হইল। তখন মহারাজ শাল্ব প্ৰদ্যুম্নের এইরূপ বিস্ময়কর। কাৰ্য্য দেখিয়া তাহার সারথির প্রতি তিনটি তীক্ষ্ন বাণ নিক্ষেপ করিল। দারুকানন্দন শাল্বের বাণাঘাত গণ্য না করিয়া তৎক্ষণাৎ অপসাব্য [দক্ষিণপার্শ্ব] হইতে অপসৃত হইল। সৌভরাজ পুনরায় আমার পুত্রের উপর বহুবিধ শরবর্ষণ করিতে লাগিল। তখন রুক্মিণীনন্দন প্ৰদ্যুন্ন হস্তলাঘব প্রদর্শনপূর্ব্বক হাসিতে হাসিতে অৰ্দ্ধপথেই সেই সমুদয় শরচ্ছেদন করিল। শাল্বনৃপতি আপনার বাণ-সমুদয় ব্যর্থ দেখিয়া আসুরীমায়া অবলম্বনপূর্ব্বক পুনরায় শরাসনে শরসন্ধান করিলে প্ৰদ্যুন্ন দৈতেয় অস্ত্ৰ প্ৰযুক্ত হইয়াছে দেখিয়া ব্রাহ্ম-অস্ত্রদ্বারা তাহা অৰ্দ্ধপথে ছেদনপূর্ব্বক শাল্বের উপর অন্যান্য তীক্ষ্ন অস্ত্ৰ-সমুদয় নিক্ষেপ করিতে লাগিল। সেই সমস্ত রুধিরপায়ী বাণ মস্তক, বক্ষ ও বক্ত্রে নিপতিত হইয়া ভূপতি শাল্বকে মূর্চ্ছিত ও ধরাতলে নিপাতিত করিল। নৃশংস শাল্ব নিপতিত হইয়াছে দেখিয়া প্ৰদ্যুম্ন আর এক অরাতি-নিপাতন শর সন্ধান করিল।
“সমুদয় যাদবকর্ত্তৃক পূজিত ও আশীবিষগ্নির ন্যায় প্রজ্বলিত সেই শর শরাসনে আরোপিত হইবামাত্ৰ অন্তরীক্ষে হাহাকারধ্বনি সমুত্থিত হইল। তখন ইন্দ্ৰাদি দেবগণ একত্র হইয়া নারদ ও বায়ুকে তথায় প্রেরণ করিলেন। তাঁহারা রুক্সিণীনন্দন প্ৰদ্যুম্নের নিকট আগমন করিয়া তাহাকে দেবগণোপদিষ্ট বাক্য কহিতে লাগিলেন, “হে মহাবীর! যদিও জগতীতলে এই বাণের অবধ্য কেহই নাই, তথাপি শাল্বরাজ কদাচি তোমার বধ্য নহে। ধাতা রণস্থলে কৃষ্ণের হস্তেই ইহার মৃত্যু নিৰ্দ্ধারিত করিয়া রাখিয়াছেন; কখনই তাঁহার অন্যথা হইবে না। অতএব তুমি এই অমোঘ বাণের প্রতিসংহার কর।” প্ৰদ্যুম্ন তাহাদের বচনানুসারে অতিমাত্র হৃষ্ট হইয়া সেই সর্বোৎকৃষ্ট শরের প্রতিসংহারপূর্ব্বক তৃণমধ্যে সংস্থাপন করিল। তখন প্ৰদ্যুম্নশরপীড়িত দুরাত্মা শাল্ব চেতনা লাভ করিয়া সৈন্যগণসমভিব্যাহারে সৌভপুরে আরোহণপূর্ব্বক দ্বারকাপুরী পরিত্যাগ করিয়া আকাশমার্গে গমন করিল।”