১৯তম অধ্যায়
অর্জ্জুন সংশপ্তকের পরস্পর মায়াযুদ্ধ
সঞ্জয় কহিলেন, “অনন্তর মহাবীর অর্জ্জুন সংশপ্তকগণকে প্রত্যাগত নিরীক্ষণ করিয়া মহাত্মা বাসুদেবকে কহিলেন, হে কেশব! বোধ হইতেছে, সংশপ্তকগণ জীবন সত্ত্বে রণস্থল পরিত্যাগ করিবে না; অতএব এক্ষণে উহাদের দিকে অশ্বচালনা কর। আজি তুমি আমার ভুজবল ও গাণ্ডীববল অবলোকন করিবে। যেমন রুদ্রদেব পশুগণকে বিনাশ করিয়াছিলেন, তদ্রূপ আমিও ইহাদিগকে বধ করিব। তখন বাসুদেব সহাস্য মুখে শুভাকাঙ্ক্ষা দ্বারা অর্জ্জুনকে অভিনন্দন করিয়া তাহার ইচ্ছানুসারে রথ চালন করিতে লাগিলেন। সমরে পাণ্ডুবর্ণ অশ্বগণ কর্ত্তৃক সেই রথ পরিচালিত হইলে আকাশগামী বিমানের ন্যায় অপূর্ব্ব শোভা প্রাপ্ত হইল এবং পূর্ব্বকালে দেবাসুর যুদ্ধে সুররাজ রথের ন্যায় মণ্ডল ও গতি প্রত্যাগতি প্রদর্শন করিতে লাগিল।
অনন্তর বিবিধ আয়ুধধারী নারায়ণী সেনা সকল ক্রোধভরে শরনিকরে অর্জ্জুনকে সমাচ্ছন্ন করিতে লাগিল এবং মুহূর্ত্ত কাল মধ্যে অর্জ্জুন ও বাসুদেবকে নেত্রের অগোচর করিল। তখন অর্জ্জুন ক্রোধভরে দ্বিগুণ বিক্ৰম প্রকাশ পূর্ব্বক সত্বরে গাণ্ডীব শরাসন পরিমার্জিত করিয়া গ্রহণ করিলেন এবং ললাট দেশে ক্রোধচিহ্ন ভীষণ ভ্রুকুটি করিয়া দেবদত্ত শঙ্খধ্বনি করিতে লাগিলেন। অনন্তর শত্ৰুনিসূদন তাষ্ট্র অস্ত্র পরিত্যাগ করিলে সহস্র সহস্র মূর্ত্তি প্রাদুর্ভূত হইল। তখন সেনাগণ আপনার প্রতিরূপ সেই নানা রূপে বিমোহিত হইয়া পরস্পরকে অর্জ্জুন বোধে বিনাশ করিতে লাগিল। তাহারা এই অর্জ্জুন এই বাসুদেব বলিয়া মোহ প্রভাবে পরস্পরকে বিনাশ করিতে প্রবৃত্ত হইল। তখন সকলে তা অস্ত্র প্রভাবে বিমোহিত হইয়া এক কালে ক্ষয়প্রাপ্ত হইলে রণস্থল পুষ্পিত কিংশুক বৃক্ষের ন্যায় শোভা প্রাপ্ত হইল। সেই তা অস্ত্র শত্ৰুপ্রযুক্ত অস্ত্রজাল ভস্মসাৎ করিয়া বীরগণকে যমালয়ে প্রেরণ করিল।
অর্জ্জুন কর্ত্তৃক মালবকাদি ত্রিগর্ত্ত বধ
অনন্তর মহাবীর অর্জ্জুন সহাস্য মুখে ললিত্থ, মালব, মাবেল্লক, ত্ৰিগর্ত্ত ও অন্যান্য যোদ্ধাদিগকে শরনিকরে নিপীড়িত করিতে লাগিলেন। সেই সমস্ত ক্ষত্রিয়গণ কালপ্রেরিত হইয়া অর্জ্জুনের প্রতি বিবিধ আয়ুধজাল পরিত্যাগ করিতে প্রবৃত্ত হইলেন। সেই ভয়ানক শরনিকরে সমাচ্ছন্ন হইয়া অর্জ্জুন, রথ ও কেশব আর নয়নগোচর হইলেন না। ইত্যবসরে সংশপ্তকগণ লব্ধলক্ষ্য হইয়া পরস্পর কোলাহল করিতে লাগিলেন এবং কৃষ্ণ ও অর্জ্জুন উভয়ে বিনষ্ট হইয়াছে বলিয়া প্রীত মনে বসন বিকম্পিত করিতে প্রবৃত্ত হইলেন। সহস্র সহস্র বীরগণ ভেরী, মৃদঙ্গ ও শঙ্খ ধ্বনি করিয়া সিংহনাদ পরিত্যাগ করিতে লাগিল। তখন বাসুদেব একান্ত ক্লান্ত ও ঘর্ম্মাক্ত কলেবর হইয়া অর্জ্জুনকে কহিলেন, হে পার্থ! তুমি কোথায়; আমি তোমাকে নিরীক্ষণ করিতেছি না; তুমি ত জীবিত আছ? তাঁহার বাক্য শ্রবণে অর্জ্জুন সত্বর হইয়া বায়ব্যাস্ত্রে সেই সমস্ত শর নিরাকরণ করিলেন। তখন ভগবান প্রভঞ্জন শুষ্ক পত্র রাশির ন্যায় হস্তী, অশ্ব, রথ ও আয়ুধের সহিত সংশপ্তকগণকে বহন করিতে লাগিলেন। যেমন বিহঙ্গগণ যথা সময়ে বৃক্ষ হইতে উড্ডীন হইয়া থাকে, তদ্রূপ তাঁহারা বায়ুবেগে উড্ডীন হইয়া পরম শোভা প্রাপ্ত হইলেন। অর্জ্জুন সত্বরে তাঁহাদিগকে নিতান্ত ব্যাকুল করিয়া শত শত সহস্র সহস্র শরে প্রহার করিতে লাগিলেন। তিনি ভল্লাস্ত্রে তাঁহাদের মস্তক ও সশস্ত্র হস্ত ছেদ করিয়া শর দ্বারা করিশুণ্ডোপম উরুদণ্ড পৃথিবীতে নিপাতিত করিলেন। তখন কাহার পৃষ্ঠদেশ খণ্ড খণ্ড, কাহার চরণযুগল ছিন্ন ভিন্ন কাহারও বা বাহু নিকৃত্ত ও চক্ষু বিকল হইয়া গেল। মহাবীর অর্জ্জুন শত্রুগণকে এইরূপ ক্ষত বিক্ষত করত গন্ধৰ্ব্ব নগরাকার সুসজ্জিত রথ সকল শরজালে খণ্ড খণ্ড করিয়া হস্তী ও অশ্বগণকে বিনাশ করিতে লাগিলেন। কোন কোন স্থলে ছিন্নধ্বজ রথ সকল মুণ্ডিত তালবনের ন্যায় শোভা প্রাপ্ত হইল। উৎকৃষ্ট আয়ুধসনাথ পতাকা পরিশোভিত, ধ্বজ দণ্ডমণ্ডিত অঙ্কুশসম্পন্ন মাতঙ্গগণ তরুরাজি সমাকীর্ণ বজ্রাহত অচলের ন্যায় নিপতিত হইতে লাগিল। চামরপীড় কবচাবৃত তুরঙ্গম সকল পার্থ বাণে অস্ত্র, নেত্র ও জীবন বিনির্গত হওয়ায় আরোহী সহিত ধরাসনে শয়ন করিল। অসি ও নখরবিদ্ধ, ছিন্নবৰ্ম্মা ছিন্নাস্থিসন্ধি, ছিন্নমর্ম্মা পদাতিগণ নিহত হইয়া অতি দীন ভাবে শয়ন করিয়া রহিল। তখন কেহ নিহত, কেহ হন্যমান, কেহ নিপতিত, কেহ পাত্যমান, কেহ অবস্থিত, কেহ বা বিচেষ্টমান হইতে লাগিল। এইরূপে রণস্থল সাতিশয় ভীষণ হইয়া উঠিল। নভোমণ্ডলে উড্ডীন ধূলিজাল রুধিরধারাবর্ষণে প্রশান্ত হইয়া গেল; কবন্ধশতসঙ্কুল রণস্থল নিতান্ত দুর্গম হইয়া উঠিল। তখন কালাত্যয়ে পশুসংহারে প্রবৃত্ত ভগবান্ রুদ্রের আক্রীড়ের ন্যায় মহাবীর অর্জ্জুনের সাতিশয় ভয়ঙ্কর রথ বিলক্ষণ শোভা পাইতে লাগিল। নিতান্ত ব্যাকুল অশ্ব, রথ ও কুঞ্জরগণ। সমবেত অর্জ্জুনাভিমুখীন সৈন্যগণ অর্জ্জুন কর্ত্তৃক নিহত হইয়া ইন্দ্রপুরের আতিথ্য গ্রহণ করিতে লাগিল। তখন সেই রণক্ষেত্র নিহত মহারথগণে আস্তীর্ণ হইয়া সাতিশয় সুশোভিত হইল। অর্জ্জুন এই রূপে সমরমদে মত্ত হইলে দ্রোণাচার্য্য যুধিষ্ঠিরের প্রতি ধাবমান হইলেন। আয়ুধধারী বিপুল বল সমুদায় যুধিষ্ঠিরকে গ্রহণ করিবার অভিলাষে সত্বরে তাহার অনুসরণ করিতে লাগিল। তখন রণস্থল অতি তুমুল হইয়া উঠিল।”