১৮শ অধ্যায়
সংশপ্তকগণের সহিত অর্জ্জুনের যুদ্ধ
সঞ্জয় কহিলেন, “অনন্তর সংশপ্তকগণ সমতল ভূতলে অবস্থান করিয়া হৃষ্ট মনে রথ দ্বারা চন্দ্রাকার ব্যূহ নির্ম্মাণ করিলেন এবং অর্জ্জুনকে নিরীক্ষণ করিয়া হর্য্যভরে চীৎকার করিতে লাগিলেন। ঐ চীৎকার শব্দ চতুর্দ্দিক ও অন্তরীক্ষ সমাচ্ছন্ন করিল, কিন্তু চারিদিক, লোকে সমাবৃত ছিল বলিয়া প্রতিধ্বনি হইল না। তখন ধনঞ্জয় তাঁহাদিগকে নিতান্ত সন্তুষ্ট নিরীক্ষণ করিয়া সহাস্য মুখে কৃষ্ণকে কহিলেন, হে বাসুদেব! তুমি ঐ সমস্ত মুমূর্ষ ত্রিগর্ত্তদিগকে অবলোকন কর; উহারা রোদন করিবার স্থলে হর্ষ প্রকাশ করিতেছে অথবা উহারা কাপুরুষ দুষ্প্রাপ্য উৎকৃষ্ট লোক সমুদায় প্রাপ্ত হইবে বলিয়া এ সময় হর্ষ প্রকাশ করিতেছে; তাহার সন্দেহ নাই। এই বলিয়া অর্জ্জুন ত্ৰিগর্ত্ত দিগের বিপুল বল সমুদায়ের সম্মুখীন হইয়া চতুর্দ্দিক প্রতিধ্বনিত করত মহাবেগে সুবর্ণালঙ্কৃত দেবদত্ত শঙ্খ ধ্বনি করিতে লাগিলেন। সংশপ্তকদিগের বাহিনী সেই ভয়ঙ্কর শঙ্খধ্বনি শ্রবণে নিতান্ত শঙ্কিত হইয়া প্রস্তরময়ী মুক্তির ন্যায় নিশ্চেষ্ট হইয়া রহিল। তাঁহাদের অশ্ব সকল বিবৃতচক্ষু, স্তব্ধক, স্তব্ধগ্রীব ও স্তব্ধপাদ হইয়া রুধির বমন ও প্রস্রাব করিতে লাগিল। অনন্তর সংশপ্তকগণ সংজ্ঞা লাভ করত সেনাগণকে প্রকৃতিস্থ করিয়া অর্জ্জুনের প্রতি এককালে বাণ প্রয়োগ করিতে লাগিলেন। অর্জ্জুন পঞ্চদশ শরে সংশপ্তকবিনির্মুক্ত সহস্র শর আগত হইতে না হইতেই খণ্ড খণ্ড করিলেন। পরে তাঁহারা দশ দশ শরে অর্জ্জুনকে বিদ্ধ করিলে অর্জ্জুন তিন তিন শরে তাঁহাদিগকে বিদ্ধ করিলেন। অনন্তর সংশপ্তকগণ পাঁচ শরে অর্জ্জুনকে বিদ্ধ করিলে অর্জ্জুন দুই দুই শরে তাঁহাদিগকে বিদ্ধ করিলেন। সংশপ্তকগণ পুনরায় ক্রোধাবিষ্ট হইয়া যেমন বৃষ্টি দ্বারা তড়াগ সমাচ্ছন্ন হয়, তদ্রূপ শরনিকরে বাসুদেব ও অর্জ্জুনকে সমাচ্ছন্ন করিতে লাগিলেন। তখন যেমন কানন মধ্যে ভ্রমর পংক্তি কুসুমসুশোভিত পাদপে নিপতিত হয়, তদ্রূপ সহস্র সহস্র শর অর্জ্জুনের প্রতি নিপতিত হইতে লাগিল।
অনন্তর সুবাহু অদ্রিসারময় ত্রিশ শরে অর্জ্জুনের কিরীট বিদ্ধ করিলে অর্জ্জুন কিরীটস্থ সুবর্ণপুঙ্খ শরনিকরে সুবর্ণালঙ্কারে অলঙ্কৃতের ন্যায় ও উত্থিত দিবাকরের ন্যায় শোভা প্রাপ্ত হইলেন। পরে তিনি ভল্লাস্ত্রে সুবাহুর হস্তাবাপ ছেদন করিয়া পুনর্ব্বার তাঁহার প্রতি শরবৃষ্টি করিতে লাগিলেন। অনন্তর সুশৰ্ম্মা, সুরথ সুধৰ্ম্মা, সুধনু ও সুবাহু ইঁহারা দশ শরে অর্জ্জুনকে বিদ্ধ করিলেন। অর্জ্জুন তাঁহাদের প্রত্যেককেই শরজালে বিদ্ধ করিয়া ভল্লাস্ত্রে কাঞ্চনময় ধ্বজ ছেদ করিয়া ফেলিলেন। পরে সুধন্বার শরাসন ছেদন ও অশ্বগণকে বিনাশ করিয়া তাঁহার শিরস্ত্রাণ-সুশোভিত মস্তক ছেদন করিলেন। তখন তাঁহার অনুচরগণ নিতান্ত ভীত হইয়া যে স্থানে দুৰ্য্যোধনের সৈন্য সকল অবস্থান করিতেছে, তথায় ধাবমান হইল। যেমন দিবাকর করজালে অন্ধকার বিনাশ করিয়া থাকেন, তদ্রূপ অর্জ্জুন রোষভরে অবিচ্ছিন্ন শরনিকরে কৌরব সেনাগণকে সংহার করিতে লাগিলেন। তখন সেনাগণ ত্রস্ত ভীত ও ছিন্ন ভিন্ন হইয়া ইতস্তত পলায়ন করিতে লাগিল। ত্রিগর্তেরা অর্জ্জুনকে ক্রোধে নিতান্ত অধীর নিরীক্ষণ করত সাতিশয় শঙ্কিত হইল এবং পার্থ শরে আহত হইয়া ভয়ার্ত্ত মৃগযুথের ন্যায় সেই সেই স্থানেই মোহে অভিভূত হইতে লাগিল। অনন্তর ত্রিগৰ্ভরাজ ক্রোধাবিষ্ট হইয়া মহারথ ত্রিগর্ত্তদিগকে কহিলেন, হে বীরগণ! ভীত হইও না; পলায়ন করা তোমাদের কর্ত্তব্য হইতেছে না। তোমরা কৌরব সৈন্য সমক্ষে সেইরূপ ভয়ানক শপথ করিয়া এক্ষণে তাহাদের সন্নিধানে গমন পূর্ব্বক প্রধান প্রধানদিগকে কি বলিবে? পলায়ন করিলে কি লোকে উপহাস করিবে না? অতএব তোমরা একত্র মিলিত হইয়া যথাশক্তি যুদ্ধ কর। এই কথা শ্রবণ করিবামাত্র তাহারা তুমুল কোলাহল সহকারে পরস্পরকে হৃস্ট ও সন্তুষ্ট করিয়া শঙ্খধ্বনি করিতে লাগিল। অনন্তর সংশপ্তকগণ ও নারায়ণী সেনারা মৃত্যু পর্য্যন্ত স্বীকার করিয়া সমরে প্রবৃত্ত হইল।