১৭শ অধ্যায়
সংশপ্তকবধপর্ব্বাধ্যায় – দ্রোণের দুর্য্যোধনাশ্বাস
সঞ্জয় কহিলেন, “মহারাজ! অনন্তর উভয় পক্ষীয় সেনাগণ শিবিরে প্রবেশ করিয়া স্ব স্ব ভাগে ও স্ব স্ব গুল্মে ন্যায়ানুসারে বাস করিতে লাগিল। মহাবীর দ্রোণ সৈন্যগণের অবহার করিয়া রাজা দুৰ্য্যোধনকে অবলোকন পূর্ব্বক লজ্জিত মনে কহিলেন, মহারাজ! আমি পূর্ব্বেই বলিয়াছি যে, অর্জ্জুন থাকিতে দেবগণও ধৰ্ম্মরাজ যুধিষ্ঠিরকে গ্রহণ করিতে সমর্থ হইবেন না। তোমরা দৃঢ়তর যত্ন করিয়াছিলে; তথাপি ধনঞ্জয় সেই কাৰ্য্য সমাপন করিয়াছেন; অতএব আমার বাক্যে অণুমাত্র সন্দেহ করিও না; কৃষ্ণ ও অর্জ্জুন উভয়েই অজেয়। অতএব কোন রূপে অর্জ্জুনকে অপসারিত করিতে পারিলে আজি যুধিষ্ঠির তোমার বশবর্তী হইবেন। এক্ষণে অন্য কোন বীরকে যুদ্ধের নিমিত্ত আহ্বান করুন; তিনি অর্জ্জুনকে যুদ্ধার্থ স্থানান্তরিত করিলে যুদ্ধস্থলে অর্জ্জুন তাঁহাকে পরাজয় না করিয়া কখনই প্রতিনিবৃত্ত হইবে না; আমি সেই অবসরে পাণ্ডবসেনা ভেদ করিয়া ধৃষ্টদ্যুম্নের সমক্ষেই ধৰ্ম্মরাজ যুধিষ্ঠিরকে গ্রহণ করিব। যদি যুধিষ্ঠির অর্জ্জুনের অবস্থান কালে আমাকে নিরীক্ষণ পূর্ব্বক সংগ্রামে পরাঙ্মুখ না হন, তাহা হইলে তাঁহাকে গৃহীত বিবেচনা করিবে। হে মহারাজ! আজি এই রূপে ধৰ্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির ও তাঁহার অনুচরগণকে তোমার বশম্বদ করিব; তাহার সন্দেহ নাই।
অর্জ্জুন-বধে সুশর্ম্মাদির প্রতিজ্ঞা
ত্রিগৰ্ভাধিপতি দ্রোণবাক্য শ্রবণানন্তর ভ্রাতৃগণ সমভিব্যাহারে রাজা দুৰ্য্যোধনকে কহিলেন, মহারাজ! অর্জ্জুন বারংবার আমাদিগকে পরাভব করিয়াছে; আমরা নিরপরাধী কিন্তু সে আমাদের নিকট অপরাধ করিয়া থাকে। আমরা সেই সকল নানা প্রকার পরাভব স্মরণ করিয়া রোষানলে নিরন্তর দগ্ধ হইতে থাকি; রজনী যোগে কিছুতেই নিদ্রাসুখ অনুভব করিতে সমর্থ হই না। সে অস্ত্র সম্পন্ন হইয়া ভাগ্যবশত আমাদিগের দৃষ্টিগোচর হইয়াছে; আমরা আজি অভিলাষানুরূপ আপনার হিতকর ও আমাদের যশস্কর কাৰ্যানুষ্ঠান করিব; আমরা রণক্ষেত্রের বহির্ভাগে গমন করিয়া তাঁহাকে সংহার করিব। আজি পৃথিবী অর্জ্জুনশূন্য বা ত্রিগৰ্তশূন্য হইবে; আমি সত্য প্রতিজ্ঞা করিতেছি, ইহা কখনই মিথ্যা হইবে না।
প্রস্থলাধিপতি ত্ৰিগৰ্ত্ত সুশর্ম্মা সত্যরথ, সত্যধৰ্ম্মা, সত্যব্রত, সত্যেযু ও সত্যকৰ্ম্মা এই পাঁচ ভ্রাতা এবং অযুত রথ সমভিব্যাহারী মাবেলক, ললিত্থু ও মদ্রকগণের সহিত নানা জনপদ হইতে সমাগত উৎকৃষ্ট অযুত রথ সমভিব্যাহারে এবং মালব ও তুণ্ডিকেরগণ তিন অযুত রথ লইয়া শপথ করিবার নিমিত্ত উপস্থিত হইলেন। অনন্তর সকলে হুতাশন আনয়ন ও পৃথক পৃথক স্থাপিত করিয়া কুশচীর ও বিচিত্র কবচ ধারণ করিলেন; পরে সেই মহাত্মারা ঘৃতাক্ত, মৌর্ব্বী মেখলালঙ্কৃত, সহস্র শত দক্ষিণাসম্পন্ন, যাজ্ঞিক, পুত্রসমবেত, পুণ্য লোকলাভের যোগ্য, কৃতকৃত্য, জীবিত নিরপেক্ষ, যশ ও বিজয়লাভার্থী এবং ব্রহ্মচর্য্য প্রমুখ, শ্রুতিবিহিত, ভূরিদক্ষিণ যজ্ঞ দ্বারা প্রাপ্য লোক সমুদায় লাভে সমুৎসুক হইয়া সংগ্রামে তনুত্যাগ পূর্ব্বক তথায় গমন করিতে অভিলাষী হইলেন এবং পৃথক্ পৃথক্ নিস্ক, ধেনু ও বস্ত্র প্রদান করিয়া ব্রাহ্মণগণের তৃপ্তি সাধন, পরস্পর সম্ভাষণ ও সমরব্রত ধারণ পূর্ব্বক অগ্নি প্রজ্বলিত করিলেন। পরে তাঁহারা সৰ্ব্বসমক্ষে সেই হুতাশন স্পর্শ করিয়া অর্জ্জুনবধে প্রতিজ্ঞা করত উচ্চ স্বরে কহিলেন, হে ভূপালগণ! যদি আমরা অর্জ্জুনকে বধ না করিয়া নিবৃত্ত হই অথবা তাহার ভয়ে নিতান্ত ভীত হইয়া সমরে পরাঙ্মুখ হই, তাহা হইলে মিথ্যাবাদী, ব্রহ্মঘাতক মদ্যপায়ী, গুরুদারাভিগামী, ব্রহ্মস্ব ও রাজপিণ্ডাপহারী, শরণাগত পরিত্যাগী, অর্থিঘাতী, গৃহদাহী, গোহন্তা, অপকারী, ব্রহ্মদ্বেষী, ন্যস্ত ধনাপহারী, শাস্ত্র বিহিত পথ পরিত্যাগী, দীনানুসারী, নাস্তিক এবং অগ্নি ও মাতৃ পরিত্যাগীদিগের যে লোক, আর যে ব্যক্তি মোহ পরতন্ত্র হইয়া ঋতুকালে ভাৰ্য্যাভিগমন না করে, যে ব্যক্তি শ্রাদ্ধ দিবসে স্ত্রীসম্ভোগ করে ও যে ব্যক্তি ক্লীবের সহিত যুদ্ধ করে, তাহাদের যে লোক এবং অন্যান্য পাপানুষ্ঠানপরায়ণ ব্যক্তিদিগের যে লোক, আমরা তাহাই প্রাপ্ত হইব। কিন্তু যদি রণস্থলে অতি দুষ্কর কাৰ্যানুষ্ঠানে সমর্থ হই, তাহা হইলে আজি নিঃসন্দেহ অভীষ্ট লোক সকল প্রাপ্ত হইব।
দ্বাদশ দিন যুদ্ধ – অর্জ্জুন-সুশর্ম্মাভিযান
সুশৰ্ম্মা প্রভৃতি বীরগণ এইরূপ শপথ করিয়া যুদ্ধাৰ্থ নির্গত হইলেন এবং অর্জ্জুনকে দক্ষিণ দিকে আহ্বান করিতে করিতে সমরে সমুপস্থিত হইলেন।
তখন অর্জ্জুন ধৰ্ম্মরাজ যুধিষ্ঠিরকে সম্বোধন করিয়া, কহিলেন, মহারাজ! আমি যুদ্ধে আহূত হইয়া কদাচ নিবৃত্ত হই না; এই রূপ ব্ৰত ধারণ করিয়াছি। এ ক্ষণে সংশপ্তকগণ আমাকে আহ্বান করিতেছে, অতএব আপনি অনুচরগণের সহিত উহাদিগকে বিনাশ করিবার নিমিত্ত অনুমতি প্রদান করুন। আমি উহাদিগের এই রূপ আহ্বান কিছুতেই সহ্য করিতে সমর্থ হইতেছি না। এক্ষণে সত্যই প্রতিজ্ঞা করিতেছি যে, আমি উহাদিগকে অবশ্যই বিনাশ করিব। যুধিষ্ঠির কহিলেন, হে অর্জ্জুন! মহাবীর দ্রোণাচার্য্য যে রূপ অভিলাষ করিয়াছেন, তাহাও তুমি সম্যক্ কর্ণগোচর করিয়াছ; এক্ষণে যাহাতে ইহা মিথ্যা হয় তাহার অনুষ্ঠান কর। দ্রোণ মহাবল, পরাক্রান্ত, শিক্ষিতাস্ত্র ও জিতশ্রম; তিনি আমাকে গ্রহণ করিবার নিমিত্ত প্রতিজ্ঞা করিয়াছেন।
অর্জ্জুন কহিলেন, মহারাজ! সত্যজিৎ আজি আপনার রক্ষক হইবেন; ইনি জীবিত থাকিতে দ্রোণাচাৰ্য্য স্বীয় অভিলাষ পূরণে কদাচ সমর্থ হইবেন না। সত্যজিৎ বিনষ্ট হইলে আপনারা কেহই রণস্থলে অবস্থান করিবেন না।
অনন্তর ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির প্রীতিস্নিগ্ধ নয়নে অর্জ্জুনকে অবলোকন ও আলিঙ্গন করিয়া বারংবার আশীর্ব্বাদ করত গমনে অনুমতি করিলেন। তখন যেমন ক্ষুধার্ত্ত সিংহ ক্ষুধা শান্তির নিমিত্ত মৃগগণের প্রতি গমন করে, তদ্রূপ তিনি ত্ৰিগৰ্ত্তদিগের প্রতি গমন করিতে লাগিলেন। ইত্যবসরে দুৰ্য্যোধনের সৈন্যগণ রোষাবিষ্ট চিত্তে অর্জ্জুনবিহীন রাজা যুধিষ্ঠিরকে গ্রহণ করিবার নিমিত্ত নিতান্ত সন্তুষ্ট হইল। অনন্তর উভয় পক্ষীয় সৈন্যগণ বর্ষাকালে প্রবৃদ্ধসলিলা অতি বেগবতী ভগবতী ভাগীরথী যেমন সরিৎ দ্বারা সরযুর সহিত মহাবেগে মিলিত হয় তদ্রূপ মহাবেগে মিলিত হইল।