শুন শুন ধর্ম্মরাজ অপূর্ব্ব কথন।
কাননে বঞ্চেন চিন্তা শ্রীবৎস রাজন।।
পূর্ব্বমত ফলমূল না মিলে তথায়।
কানন ত্যজিয়া রাজা নগরেতে যায়।।
নগর উত্তরভাগে ধনীর বসতি।
তথায় বসতি মোর না হয় সঙ্গতি।।
দুঃখী হয়ে ধনাঢ্যের নিকটে না যাবে।
দরিদ্র দেখিয়া মোরে অবজ্ঞা করিবে।।
দুঃখীর সমাজে আকি কাটাইব কাল।
পাছে লোকে ঘৃণা করে, এ বড় জঞ্জাল।।
এত বলি দক্ষিণেতে প্রবেশিল রায়।
শত শত ঘর তথা কাঠুরিয়া রয়।।
রাজা রাণী তথাকারে হয় উপনীত।
দেকিয়া সম্ভ্রমে তারা জিজ্ঞাসে ত্বরিত।।
কহ তুমি, কেবা হও, কোথায় বসতি।
কি হেতু আসিলে দোঁহে, কহ শীঘ্রগতি।।
শুনিয়া সবার বাক্য কহে নৃপবর।
মোর সম দুঃখী নাহি পৃথিবী ভিতর।।
বহুদুঃখ পেয়ে আমি আইনু হেথায়।
তোমরা করিলে কৃপা তবে দুঃখ যায়।।
আশ্বাস করিয়া তারা কৈল অঙ্গীকার।
করিব তোমার হিত, প্রতিজ্ঞা সবার।।
মোরা কাঠুরিয়া জাতি, কাষ্ঠ বেচি কিনি।
নিত্য আনি নিত্য খাই, দুঃখ নাহি জানি।।
সঙ্গে থাকি কাষ্ঠ বেচি প্রত্যহ আনিবে।
এ কর্ম্মে নিযুক্ত হলে দুঃখ না রহিবে।।
শুনি আনন্দিত হন শ্রীবৎস রাজন।
ভাল ভাল এই কর্ম্ম করিব এখন।।
হেনমতে কাঠুরিয়া ঘরে দুই জন।
রহিল গোপনে রাজা নিরানন্দ মন।।
কাঠুরিয়াগণ ভার্য্যা যতেক আছিল।
চিন্তার সৌজন্য হেরি সবে বশ হল।।
নানা ধর্ম্ম নানা কর্ম্ম করান শ্রবণ।
শুনিয়া সন্তুষ্ট হল সবাকার মন।।
সবা সঙ্গে সখীভাবে আছে রাজরাণী।
শিষ্টালাপে থাকে সদা দিবস রজনী।।
প্রভাতে কাঠুরেগণ চলিল কাননে।
রাজাকে ডাকিল সবে, এস যাই বনে।।
শুনিয়া চলেন রাজা সবার সংহতি।
ঘোর বনে প্রবেশে করিল শীঘ্রগতি।।
কাঠুরিয়াগণ কাষ্ঠ ভাঙ্গিল অনেক।
বড় বড় বোঝা সবে বান্ধিল যতেক।।
ফলমূল পত্রপুষ্প নিল সর্ব্বজন।
আমি কি লইব চিত্তে চিন্তিল রাজন।।
নিন্দিত না হয় কর্ম্ম, ক্লেশ না সহিব।
অথচ আপন কর্ম্ম প্রকারে সাধিব।।
চিনিয়া লইল রাজা চন্দনের সার।
কাঠুরিয়া সঙ্গে সঙ্গে চলিল বাজার।।
বাজারে ফেলিলা বোঝা কাঠুরিয়া কুল।
গৃহীলোক আসি সবে করি নিল মূল।।
কেহ পায় চারি পণ কেহ আটপণ।
কেহ বা বেচিয়া কেনে খাদ্য প্রয়োজন।।
চন্দনের কাষ্ঠ লয়ে শ্রীবৎস রাজন।
বেচিবারে যায় তবে বণিক সদন।।
দিব্য চন্দনের সার পেয়ে সদাগর।
করিয়া উচিত মূল্য দিলেক সত্বর।।
তঙ্কা দুই চারি রাজা বেচিয়া পাইল।
অপূর্ব্ব বিচিত্র দ্রব্য কিনিয়া লইল।।
ঘৃত তৈল চালি ডালি লবণ সৈন্ধব।
মশলা মিষ্টান্ন দধি কিনিলেন সব।।
শাক সূপ তরকারী যতেক পাইল।
ভাল মৎস্য মাংস রায় যত্ন করি নিল।।
কিনিয়া অশেষ দ্রব্য লয়ে নরপতি।
গৃহেতে আনিয়া দিল যথা চিন্তাসতী।।
রাণী প্রতি কহে রাজা বিনয়-বচন।
কাঠুরিয়াগণ বন্ধু, কর নিমন্ত্রণ।।
শুনিয়া সন্তুষ্ট হৈল চিন্তা মহারাণী।
বিচিত্র করিয়া পাক করিল তখনি।।
লক্ষ্মী অংশে জন্ম তাঁর, লক্ষ্মী স্বরূপিণী।
চক্ষুর নিমিষে পাক কৈল চিন্তারাণী।।
স্নান দান করি রাজা আসিয়া সত্বর।
দেখিল সকল পাক হয়েছে সুন্দর।।
রাণী বলে, সবাকারে ডাকহ রাজন।
সকল রন্ধন হৈর করাহ ভোজন।।
এত শুনি নরপতি ডাকে সবাকারে।
আনন্দিত হয়ে সবে এল ভুঞ্জিবারে।।
একত্র হইয়া সব কাঠুরিয়াগণ।
ভোজনে বসিল সবে অতি হৃষ্ট মন।।
রাণী আসেন অন্ন নৃপ করেন বন্টন।
তৃপ্তিতে লাগিল সবে করিতে ভোজন।।
সুধা সম অন্নপাক খায় সর্ব্বজন।
ধন্য ধন্য ধ্বনি হল কাঠুরে ভবন।।
শ্রদ্ধা পুরস্কারে সবে বিদায় করিয়া।
পশ্চাতে ভুঞ্জিল রাজা হৃষ্টমন হৈয়া।।
এইরূপে কত দিন বঞ্চিল তথায়।
এক দিন শুন যুধিষ্ঠির মহাশয়।।
বাণিজ্য করিতে এক সদাগর যায়।
চাপাইয়া তরী সাধু সেইখানে রয়।।
অকস্মাৎ তার ডিঙ্গি চড়াতে লাগিল।
হায় হায় করি কান্দে, কি হল কি হল।।
হেনকালে শুন রাজা দৈবের ঘটন।
গণক হইয়া শনি আইল তখন।।
হস্তে লাঠি, কাঁখে পুঁথি গ্রহাচার্য্য হৈয়া।
সাধুর মঙ্গল কথা কহিল আসিয়া।।
শুন মহাজন তুমি, স্থির কর মন।
তোমার তরণী বদ্ধ হৈল যে কারণ।।
তব নারী নবগ্রহ করেন অর্চ্চন।
অবজ্ঞা করিয়া তুমি আইলে পাটন।।
সেই হেতু তব তরী হৈল হেনরূপ।
কহিনু যতেক কথা, জানিবে স্বরূপ।।
মহাজন কহে কথা করিয়া প্রণতি।
অমৃত অধিক শুনি আমার ভারতী।।
ব্রাহ্মণ বলেন, শুনি আমার বচন।
যেমতে তোমার তরী চলিবে এখন।।
এই গ্রামবাসী কাঠুরিয়া যত জন।
নিমন্ত্রণ করি আন তার ভার্য্যাগণ।।
সকলে আসিয়া তারা ধরিবেক তরী।
তার মধ্যে পতিব্রতা আছে এক নারী।।
সেই আসি যেইক্ষণে ছুঁইবে তরণী।
কহিনু স্বরূপ কথা, ভাসিবে তখনি।।
শুনি আনন্দিত হৈল সেই মহাজন।
এ কথা কহিয়া শনি করিল গমন।।
শুনিয়া উপায় সাধু চিন্তা করে মনে।
পাইনু পরম তত্ত্ব দৈবের ঘটনে।।
কিঙ্করের তবে সাধু কহিল সত্বরে।
কাঠুরিয়া জাতি সতী আনহ সাদরে।।
শুনিয়া সাধুর আজ্ঞা কিঙ্কর চলিল।
স্তবস্তুতি করি সবাকারে আমন্ত্রিল।।
সহজেতে হীনজাতি, অতি অল্পজ্ঞান।
পাইয়া সাধুর নাম আনন্দ বিধান।।
যতেক কাঠুরে ভার্য্যা নিমন্ত্রণ শুনি।
হরিষ বিধানে সবে চলিল তখনি।।
যেখানে নদীর ঘাটে আটক তরণী।
সেইখানে উত্তরিল যতেক রমণী।।
কমলা বিমলা গেল আর কলাবতী।
কৌশল্যা রোহিনী চলে আর সরস্বতী।।
রেবতী কৈকেয়ী উমা রম্ভা তিলোত্তমা।
হরিপ্রিয়া চিত্রাবতী রাধা সতী শ্যামা।।
যশোদা যমুনা জয়া বিমলা বিজয়া।
আর ষষ্ঠী গয়া গঙ্গা কালিন্দী অভয়া।।
চপলা চঞ্চলা ধায় চাণ্ডালী কেশরী।
পদ্মাবতী অরুন্ধতী সাবিত্রী মঞ্জরী।।
একে একে তরী সবে পরশ করিল।
জনে জনে মান নিয়া বিদায় হইল।।
কারো হাতে নাহি হল সাধু প্রয়োজন।
বুঝিল হইল মিথ্যা গণক বচন।।
কত নারী আইল, না এল কত জন।
কিঙ্করে জিজ্ঞাসে সাধু সে সব কারণ।।
নাবিক কহিল, সবে আসিয়াছে রায়।
এক নারী না আইল স্বামীর মানায়।।
শুনি সাধু মনে কৈল, সেই সাধ্বী তবে।
তিনি এলে মোর তরী অবশ্য চলিবে।।
মহাভারতের আখ্যান সুধার সার।
তরিবারে ইহা বিনা কিছু নাহি আর।।