১৬শ অধ্যায়
শাল্বসেনার সহিত যাদবগণের যুদ্ধ
শ্ৰীকৃষ্ণ কহিলেন, “রাজেন্দ্ৰ! সৌভাপতি শাল্ব প্রভূত হস্ত্যশ্বযুক্ত সৈন্য লইয়া দ্বারকাপুরী আক্রমণ করিতে আগমন করিয়া চতুরঙ্গ-বলশালিনী সেনাকে শ্মশান, দেবতাস্থান, বাল্মীক ও চৈত্যবৃক্ষতল ব্যতীত প্রভূত জলাশয়সম্পন্ন সমস্থানে সন্নিবেশিত করিল। সমুদয় নগরমাৰ্গ সৈন্য-বিভাগদ্বারা ব্যাপ্ত হইল ও শাল্বশিবিরে যাতায়াতের পথ-সকল একেবারে অবরুদ্ধ হইয়া গেল। এইরূপে শাল্ব নরপতি সর্ব্বায়ুধসম্পন্ন সর্ব্বশাস্ত্ৰবিশারদ বিচিত্র রথ, নাগ, অশ্ব, পদাতি, ধ্বজ, বর্ম্ম ও কামুকে অভিব্যাপ্ত বীরলক্ষণে লক্ষিত, মহাবলপরাক্রান্ত সৈন্যসমূহ-সমভিব্যাহারে পতগেন্দ্র গরুড়ের ন্যায় বেগে আগমন করিয়া দ্বারকানগর আক্রমণ করিল।
“তখন বৃষ্ণিবংশীয় কুমারগণ শাল্বরাজের সমূহসৈন্যসমাগম-সমাচারশ্রবণে বহিৰ্গমনপূর্ব্বক যুদ্ধ আরম্ভ করিল। মহারথ চারুদেষ্ণ, শাম্ব ও প্ৰদ্যুম্ন শাল্বরাজের আক্রমণ সহিতে না পারিয়া বিচিত্ৰ ভূষণ ধারণ, বর্ম্ম পরিধান ও রথারোহণপূর্ব্বক বহুসংখ্যক বিপক্ষ সৈনিক পুরুষের সহিত সংগ্রামে প্রবৃত্ত হইল। তখন জাম্ববতীনন্দন শাম্ব কামুকগ্রহণপূর্ব্বক শাল্বরাজের সচিব চমূপতি ক্ষেমবৃদ্ধির সহিত যুদ্ধ করিতে আরম্ভ করিয়া বৃষ্টিধারার ন্যায় বাণ বর্ষণ করিতে লাগিল। সেনাপতি ক্ষেমবৃদ্ধি পর্ব্বতরাজ হিমাচলের ন্যায় নিশ্চল হইয়া সেই বাণবর্ষণ অনায়াসে সহ্য করিয়া শাম্বের উপর দুর্ভেদ্য মায়াময় শরজাল নিক্ষেপ করিলে শাম্বও স্বীয় মায়াপ্রভাবে সেনাপতির সেই মায়াশরজাল নিবারণ করিয়া তদীয় রথোপতি এককালে সহস্ৰ সহস্ৰ শর বিমোচন করিল। চমূপতি ক্ষেমবৃদ্ধি শাম্বশরে বিদ্ধ ও একান্ত ব্যথিত হইয়া রণস্থল হইতে পলায়নপরায়ণ হইল।
“শাল্বরাজ্যের সেনাপতি পলায়ন করিলে বেগবান নামে অসুর আমার পুত্র শাম্বকে আক্রমণ করিতে বেগে ধাবমান হইল। বৃষ্ণিবংশাবতংস প্রভূত-বলশালী শাম্ব অনায়াসে সেই বেগবানের বেগ সহ্য করিয়া সত্বর তাহার উপর এক গদা নিক্ষেপ করিল। মহাবীর বেগবান শাম্বের গদাঘাতে একান্ত আহত, নিতান্ত অভিভূত ও বাতাহত জীৰ্ণমূল তরুর ন্যায় ধরাতলে নিপতিত হইয়া প্ৰাণ পরিত্যাগ করিলে শাম্ব সেই সুমহান সৈন্যসমূহমধ্যে প্রবেশপূর্ব্বক যুদ্ধ করিতে আরম্ভ করিল।
“এদিকে মহাবলপরাক্রান্ত মহারথ বিবিন্ধ্যনামা দানব চারুদেষ্ণের সহিত বৃত্ৰ-বাসবের ন্যায় ঘোরতর সংগ্ৰাম করিতে প্ৰবৃত্ত হইল। সেই মহাবল পরাক্রান্ত বীরদ্বয় পরস্পর সাতিশয় সংক্রুদ্ধ হইয়া সিংহের ন্যায় গভীর গর্জ্জনপূর্ব্বক পরস্পরের প্রতি শরাঘাত করিতে লাগিল। তখন রুক্সিণীনন্দন চারুদেষ্ণ সূৰ্য্যাগ্নিসম তেজস্বী এক আশুগ [বাণ] মন্ত্রপূত করিয়া শরাসনে সংযোগ করিয়া ক্ৰোধাভরে বিবিন্ধ্যের উপর নিক্ষেপ করিল। সে বীণাঘাতে তৎক্ষণাৎ প্ৰাণ পরিত্যাগ করিয়া ধরাতলে নিপতিত হইল।
“তখন মহারাজ শাল্ব, বিবিন্ধ্য নিহত ও সেনাসমুদয় বিক্ষোভিত হইয়াছে দেখিয়া কামচারী সৌভপুরে আরোহণপূর্ব্বক দ্বারকায় আগমন করিল। দ্বারকাবাসী সমস্ত সৈন্যদল শাল্বরাজকে সৌভস্থ দেখিয়া সাতিশয় ব্যাকুল হইলে মহাবাহু প্ৰদ্যুন্ন নগর হইতে বহির্গত হইয়া সেনাগণকে আশ্বাস প্রদানপূর্ব্বক কহিতে লাগিল, “হে যাদবগণ! আমি সংগ্রামে সৌভনগরস্থ শাল্বরাজকে নিবারণ করিতেছি, তোমরা স্থির হইয়া অবলোকন কর। আজি আমি দুরাত্মা শাল্বকে ভীষণ ভুজঙ্গাকার শরদ্বারা সৌভনগরের সংগ্রামে বিনষ্ট ও তদীয় সৈন্য-সমুদয় সংহার করিব। তোমরা সকলে সাতিশয় উৎকলিকাকুল ও ভয়াভিভূত হইও না।” হে পাণ্ডুনন্দন! মহাবীর প্রদ্যুম্ন হৃষ্টচিত্তে এই কথা কহিলে দ্বারকাবাসী সমুদয় সৈন্যদল সুস্থির হইয়া সাতিশয় সাহসসহকারে নিরুদ্বেগে যুদ্ধ করিতে লাগিল।”