১৬শ অধ্যায়
ভীমের অর্জ্জুনবাক্যসমর্থনার্থ উত্তেজনা উক্তি
বৈশম্পায়ন কহিলেন, তখন অমর্ষপরায়ণ তেজস্বী ভীমসেন অর্জ্জুনের বাক্য শ্রবণ করিয়া ধৈৰ্য্যাবলম্বনপূৰ্ব্বক জ্যেষ্ঠভ্রাতা যুধিষ্ঠিরকে কহিতে লাগিলেন, “হে নরনাথ! ইহলোকে আপনার কোন ধৰ্ম্ম অবিদিত নাই। আমরা সতত আপনার চরিত্রের অনুসরণ করিবার চেষ্টা করি, কিন্তু কোনক্রমেই উহাতে সমর্থ হই না।আমি বারংবার মনে করি যে, আপনাকে উপদেশ প্রদান করা। আমার নিতান্ত অকৰ্ত্তব্য, অতএব তূষ্ণীম্ভাব অবলম্বন করিয়া থাকি, কিন্তু দুঃখবেগপ্রভাবে কোনক্রমেই নিরস্ত থাকিতে পারি না। এক্ষণে আমি নিতান্ত দুঃখিত হইয়া যাহা কহিতেছি, শ্রবণ করুন। আপনার মোহবশতঃ আমাদের সমুদয়ই নিষ্ফল হইয়াছে এবং আমরাও নিতান্ত অবসন্ন ও দুর্বল হইয়াছি। আপনি প্রজারঞ্জন ও সৰ্ব্বশাস্ত্রবিশারদ হইয়াও কি নিমিত্ত দৈন্যগ্রস্ত কাপুরুষের ন্যায় বিমুগ্ধ হইতেছেন? আপনি লোকের সদগতি ও দুর্গতি এবং ভবিষ্যৎ ও বর্ত্তমান কাল সবিশেষ অবগত আছেন। এক্ষণে আমি আপনাকে রাজ্যগ্রহণবিষয়ে অনুরোধ করিয়া যে যুক্তিযুক্ত কথা কহিতেছি, তাহা অবহিত হইয়া শ্রবণ করুন। ব্যাধি দ্বিবিধ-শারীরিক ও মানসিক। এ উভয়বিধ ব্যাধি পরস্পরের সাহায্যে পরস্পর সমুৎপন্ন হয়। একের সাহায্য না থাকিলে অন্যের উৎপত্তি হয় না। শরীর অসুস্থ হইলে মনের অসুখ ও মন অসুস্থ হইলে শরীরের অসুখ হয়, সন্দেহ নাই। যে ব্যক্তি অতীত শারীরিক ও মানসিক দুঃখ স্মরণ করিয়া অনুতাপিত হয়, সে দুঃখদ্বারা দুঃখ লাভ করে। কফ, পিত্ত ও বাত এই তিনটি শারীরিক গুণ। যাহাদিগের এই তিন গুণ সমভাবে থাকে, তাহাদিগকে সুস্থ, আর যাহাদিগের এই গুণত্রয়ের মধ্যে অন্যতরের[কোন একটির] বৈলক্ষণ্য [বৈষম্য] জন্মে, তাহাদিগকে অসুস্থ বলা যায়। পণ্ডিতেরা উষ্ণ দ্রব্যদ্বারা কফের ও শীতল দ্রব্যদ্বারা পিত্তের নিবারণ করিতে উপদেশ প্রদানপূর্ব্বক রোগের প্রতিবিধান নির্দিষ্ট করিয়াছেন। শরীরের ন্যায় মনেরও তিন গুণ আছে। সেই গুণত্রয়ের নাম সত্ত্ব, রজ ও তম। যাহাদিগের গুণত্রয় সমভাবাপন্ন থাকে, তাহারাই সুস্থ। ঐ গুণত্রয়ের মধ্যে কোন গুণের বৈলক্ষণ্য হইলে তাহার প্রতিবিধান করা আবশ্যক। শোকদ্বারা হর্ষবেগ ও হর্ষদ্বারা শোকবেগ অবরুদ্ধ হইয়া থাকে। অনেকে সুখসম্ভোগকালে দুঃখ স্মরণ ও অনেকে দুঃখের সময় সুখ স্মরণ করিয়া থাকে, কিন্তু আপনি কখনই দুঃখে অভিভূত বা সুখে একান্ত আসক্ত হয়েন নাই; সুতরাং আপনার সুখদুঃখস্মরণ হইবার বিষয় কি? অথবা যদি আপনি স্বভাবের দুস্ত্যজ্যতাবশতঃ[পরিত্যাগে অক্ষমতা] এক্ষণে দুঃখ স্মরণ করেন, তাহা হইলে একবস্ত্রা রজঃস্বলা দ্রৌপদী যে আমাদিগের সমক্ষে সভামধ্যে সমানীত হইয়াছিলেন, আমরা অজিনপরিধানপূৰ্ব্বক নগর হইতে বহিস্কৃত হইয়া যে মহারণ্যে বাস করিয়াছিলাম, চিত্রসেনের সহিত আমাদের যে যুদ্ধ হইয়াছিল, দুরাত্মা জটাসুর ও জয়দ্রথ আমাদিগকে যে ক্লেশ প্রদান করিয়াছিল এবং অজ্ঞাতবাসকালে পাপাত্মা কীচক রাজপুত্রী দ্রৌপদীকে যে পদাঘাত করিয়াছিল, সেইসমুদয় দুঃখ স্মরণ করাই আপনার কর্ত্তব্য।
“হে মহারাজ! ইতিপূৰ্ব্বে মহাবীর ভীষ্ম ও দ্রোণের সহিত আপনার যেরূপ যুদ্ধ হইয়াছিল, এক্ষণে মনের সহিত সেইরূপ যুদ্ধ করিবার সময় সমুপস্থিত হইয়াছে। এই যুদ্ধে শরনিকর বা বন্ধুবান্ধবের কিছুমাত্র প্রয়োজন নাই, কেবল নির্ব্বিকল্পাত্মক আত্মাকে সহায় করিতে হইবে। যদি এই যুদ্ধে আপনি জয়লাভ না করিয়া দেহত্যাগ করেন, তাহা হইলে দেহান্তর আশ্রয় করিয়াও পূর্বসংস্কারবশতঃ পুনরায় মনের সহিত সংগ্রামে প্রবৃত্ত হইতে পারিবেন। অতএব আজই আপনার আত্মাকে একাগ্র করিয়া মনকে যুদ্ধে পরাজিত করিবার চেষ্টা করা কর্ত্তব্য। উহাকে জয় করিতে পারিলেই কৃতকাৰ্য্য হইবেন, সন্দেহ নাই।
“হে মহারাজ! অতঃপর এই বুদ্ধি আশ্রয়পূৰ্ব্বক মনকে বশীভূত করিয়া পিতৃপিতামহগণের রীতি অনুসারে রাজ্যশাসনে প্রবৃত্ত হউন। এক্ষণে আমাদিগের সৌভাগ্যবশতঃই পাপাত্মা দুৰ্য্যোধন অনুচরগণের সহিত নিহত ও দ্রৌপদীর কেশপাশ সংযত হইয়াছে। আমরা বলবীৰ্য্যশালী বাসুদেবের সহিত আপনার কিঙ্কর হইলাম। আপনি, অতঃপর প্রভূতদক্ষিণ অশ্বমেধযজ্ঞের অনুষ্ঠান করুন।”