১৬শ অধ্যায়
উভয়পক্ষের যুদ্ধসজ্জা
সঞ্জয় কহিলেন, “মহারাজ! রজনী প্ৰভাত হইলে ভুপালগণের ‘সাজ সাজ’ শব্দে, শঙ্খ ও দুন্দুভির বাদ্যে, সেনাগণের সিংহনাদে, তুরঙ্গের হ্রেষারবে, রথনেমির ঘর্ঘরঘোষে, মাতঙ্গের বৃংহিতে ও যোদ্ধাগণের ব্যাহ্বাস্ফোটন[স্পৰ্দ্ধাপূর্ব্বক বাহুর উপর সশব্দ করতলের আঘাত] শব্দে দশদিক আকুলিত হইয়া উঠিল। সূৰ্য্যোদয়ানন্তর উভয়পক্ষের সৈন্যগণ, দুৰ্দ্ধৰ্ষ অস্ত্ৰ, শস্ত্র ও কবচসকল নয়নগোচর হইতে লাগিল। সুবর্ণমণ্ডিত হস্তিসকল চপলাসনাথ [সবিদ্যুৎ] জলধরের ন্যায়, সৈন্যগণপরিবৃত রথনিকর নানাবিধ নগরের ন্যায় ও পিতামহ ভীষ্ম পূৰ্ণচন্দ্রের ন্যায় শোভা পাইতেছেন, দেখিলাম। অনন্তর শরাসন, ঋষ্টি, খড়্গ, গদা, শক্তি, তোমর ও অন্যান্য শুভ্রবর্ণ প্রহরণসমূহে [অস্ত্রশস্ত্ৰ] শোভিত যোদ্ধাসকল শতসহস্ৰ গজ, পদাতি, রথী ও তুরঙ্গ বাগুরাকারে [জালের মত— যেন বিপক্ষের সেই সৈন্যরূপ পাশে আবদ্ধ হয়-এইরূপ ভাবে] অবস্থান করিতেছে; উভয়পক্ষের নানাবিধ দীপ্তিমান ধ্বজদণ্ডসকল সমুত্থিত হইয়াছে; কাঞ্চন-মণিভূষিত সহস্ৰ-সহস্র ধ্বজপটসকল জ্বলন্ত অনলের ন্যায়, অমরাবতীস্থ শুভ্রবর্ণ ইন্দ্রপতাকার ন্যায় দীপ্তি পাইতেছে; সমরাভিলাষী সন্নদ্ধ [উদ্যমের সহিত সজ্জিত] বীরপুরুষেবা সমুৎসুকচিত্তে ঐ সকল পতাকা নিরীক্ষণ করিতেছেন। ঋষভাক্ষ [বৃষভনেত্র] প্রধানযোদ্ধারা বিচিত্র কবচ, আয়ুধ, তল [দস্তানা] ও তূণীর ধারণ করিয়া সেনামুখে [রণক্ষেত্রেসৈন্যগণের সম্মুখে] শোভা পাইতেছেন। সুবলনন্দন শকুনি, শল্য, অবন্তিরাজ, বিন্দ, অনুবিন্দ, কেকয়গণ, কাম্বোজরাজ সুদক্ষিণ, কলিঙ্গরাজ, শ্রুতায়ুধ, রাজা জয়ৎসেন, বৃহদ্বল, কৌরব, সাত্বত, কৃতবর্ম্মা ও দুৰ্য্যোধনের বশবর্ত্তী অন্যান্য রাজা ও রাজপুত্ৰগণ স্ব স্ব সৈন্যে অবস্থান করিতেছেন; এই সকল অক্ষৌহিণীপতি মহারথগণ কৃষ্ণাজিন পরিধানপূর্ব্বক দুৰ্য্যোধনের নিমিত্ত হৃষ্টচিত্তে ব্ৰহ্মলোকগমনে [ক্ষত্রিয়ধর্ম্মে যুদ্ধে নিহত হইয়া স্বৰ্গযাত্রায়] দীক্ষিত হইয়া দশ অক্ষৌহিণী পরিগ্রহ করিয়াছেন। সেনাপতি ভীষ্ম এক আক্ষৌহিণী মহাসেনাসমভিব্যাহারে সকলের অগ্রে অবস্থিতি করিতে লাগিলেন; তিনি শ্বেত উষ্ণীষ, শ্বেত ছত্র ও শ্বেত কবচ ধারণ করিয়া সমুদিত চন্দ্রের ন্যায় শোভামান হইলেন। কুরু ও পাণ্ডব রাজতময় [রৌপ্যনির্ম্মিত] রথে অবস্থিত হেমনির্ম্মিত তালধ্বজশোভিত [তালতরুপরিমাণ উচ্চ সুবৰ্ণধ্বজে শোভিত] ভীষ্মকে শ্বেতমেঘসমারাঢ় শীতাংশুর [শুভ্ৰ মেঘমধ্যস্থ চন্দ্রের] ন্যায়। অবলোকন করিতে লাগিলেন; যেমন ক্ষুদ্র মৃগগণ জৃম্ভমাণ [হাইতোলায় বিস্তৃত বদন] মহাসিংহকে সন্দর্শন করিয়া ভীত হয়, সেইরূপ ধৃষ্টদ্যুম্ন প্রভৃতি সৃঞ্জয়গণ ভীষ্মকে অবলোকন করিয়া উদ্বিগ্ন হইয়া উঠিলেন। আপনার এই শোভাশালী একাদশ ও পাণ্ডবগণের মহাপুরুষপালিত [রণনিপুণ বীরদ্বারা চালিত] সপ্ত অক্ষৌহিণী উন্মত্তমকরাবর্ত্তযুক্ত [মত্ত মকরাকীর্ণ জলঘুর্ণিযুক্ত], মহাগ্রাহ [ভীষণ কুম্ভীর] সমাকুল, যুগান্তকালীন সমবেত সাগরদ্বয়ের ন্যায় প্রতীয়মান হইতে লাগিল। মহারাজ! যেরূপ কৌরবগণের সৈন্যসকল একত্ৰ সমবেত হইয়াছে, আমি ঈদৃশ সৈন্যসমবায় [সেনানিবেশ—সৈন্যসজ্জা] কখনো নয়ন বা শ্রবণগোচর করি নাই।”