১৫শ অধ্যায়
ভীম-শল্যের গদাযুদ্ধ
ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, “হে সঞ্জয়! তোমার কথিত বহুবিধ বিচিত্র দ্বন্দ্বযুদ্ধ শ্রবণ করিয়া চক্ষুষ্মান ব্যক্তিগণকে ধন্য বোধ করিতেছি। মানবগণ কুরু ও পাণ্ডবগণের দেবাসুরোপম যুদ্ধ আশ্চৰ্য্য বলিয়া কীর্ত্তন করিবেন। আমি এই উৎকৃষ্ট যুদ্ধ শ্রবণ করিতেছি বটে, কিন্তু ইহাতে আমার তৃপ্তি হইতেছে না; অতএব আমার নিকটে শল্য ও অভিমন্যুর যুদ্ধ কীর্ত্তন কর।
সঞ্জয় কহিলেন, মহারাজ! শল্য সারথিকে ব্যাপাদিত দেখিয়া ক্রুদ্ধ হইয়া লৌহময় গদা উৎক্ষিপ্ত করত রথ হইতে অবতীর্ণ হইলেন। ভীমসেন তাঁহাকে প্রদীপ্ত কালানলের ন্যায়, দণ্ডহস্ত যমের ন্যায় অবলোকন করিয়া বৃহৎ গদা গ্রহণ পূর্ব্বক অতিবেগে গমন করিলেন। অভিমন্যুও বজ্রতুল্য মহাগদা ধারণ করিয়া আইস, আইস, বলিয়া শল্যকে আহ্বান করিতে লাগিলেন। প্রতাপবান্ ভীমসেন যত্ন পূর্ব্বক অভিমন্যুকে নিবারণ করিলেন এবং শল্যের নিকট গমন করিয়া অঞ্চলের ন্যায় অবস্থান করিতে লাগিলেন। সেই রূপ মহাবল মদ্ররাজও ভীমসেনকে অবলোকন করিয়া কুঞ্জরের অভিমুখগামী শর্দুলের ন্যায় তাঁহার অভিমুখে গমন করিলেন। অনন্তর তুৰ্য্য নিনাদ, সহস্র সহস্র শঙ্খধ্বনি, সিংহনাদ ও ভেরীসমূহের মহাশব্দ হইতে লাগিল এবং পরস্পরের অভিমুখে ধাবমান পাণ্ডব ও কৌরবগণের শত শত সাধু সাধু শব্দ সমুৎপন্ন হইল। সমরে শল্য ভিন্ন কেহই ভীমসেনের বেগ সহ্য করিতে সমর্থ হয় না; সেইরূপ ভীম ভিন্ন কোন ব্যক্তিই মহাত্মা মদ্ৰাধিপের গদাবেগ সহ্য করিতে পারে না। স্বর্ণপট্টসংযুক্ত সকল লোকের হর্ষজনন বৃহৎ গদা ভীমকর্ত্তৃক বিদ্ধ হইয়া প্রজ্জ্বলিত হইতে লাগিল এবং শল্য বিভাগ ক্রমে মণ্ডলাকার পথে বিচরণ করাতে তাঁহার গদাও মহাবিদ্যুতের ন্যায় শোভা ধারণ করিল। দুই বীরই বৃষভদ্বয়ের ন্যায় বিঘূর্ণিত গদারূপ শৃঙ্গে সুশোভিত হইয়া গর্জ্জন সহকারে মণ্ডলগতিতে বিচরণ করিতে লাগিলেন। মণ্ডলগতিতে ও গদাপ্রহারে উভয়ের তুল্যরূপ যুদ্ধ হইতে লাগিল। মদ্ররাজের মহতী গদা ভীম কর্ত্তৃক আহত হওয়াতে অগ্নিশিখা সহকারে অতি ভীষণ হইয়া আশুবিশীর্ণ হইল এবং ভীমসেনের গদাও শল্য কর্ত্তৃক আহত হইয়া বর্ষা প্রদোষে খদ্যোত পরিবৃত বৃক্ষের ন্যায় শোভা ধারণ করিল। মদ্ররাজ নিক্ষিপ্ত গদা আকাশমণ্ডল উদ্ভাসিত করিয়া মুহুর্মুহু হুতাশন উৎপাদন করিতে লাগিল এবং ভীমসেনের গদা শত্রুর প্রতি প্রযুক্ত হইয়া পতন্তী মহোল্কার ন্যায় শল্যের সৈন্যগণকে সন্তাপিত করিল। সেই উভয় গদাই পরস্পর সংযুক্ত হইয়া নিশ্বসন্তী নাগকন্যার ন্যায় অনল বিসৰ্জন করিতে লাগিল। যেমন দুই মহাব্যাঘ্ৰ নখদ্বারা এবং দুই মহাগজ দশনদ্বারা পরস্পর আক্রমণ করিয়া বিচরণ করে, সেই রূপ শল্য ও বৃকোদর উভয় গদাদ্বারা পরস্পর আক্রমণ করিয়া বিচরণ করিতে লাগিলেন।
অনন্তর দুই মহাত্মা ক্ষণমাত্রে মহাগদার আঘাতে রুধির সিক্ত হইয়া কুসুমিত কিংশুক তরুর ন্যায় দৃষ্টি গোচর হইলেন। সেই নরসিংহদ্বয়ের গদাঘাত জনিত মহাশব্দ, সকল দিকে বজ্রধ্বনির ন্যায় শ্রবণপোচর হইতে লাগিল। পর্ব্বত যেমন বিদীর্ণ হইলেও কম্পিত হয় না, সেইরূপ ভীমসেন শল্যকর্ত্তৃক গদা দ্বারা বাম ও দক্ষিণ উভয় পার্শ্বে আহত হইয়াও কম্পমান হইলেন না এবং মহাবল শল্যও ভীম সেনের গদাবেগে তাড্যমান হইয়াও ধৈৰ্য্যবশত, বজ্রসমূহে আহত পর্ব্বতের ন্যায় অবস্থান করিতে লাগিলেন। মহাবেগশালী মাতঙ্গ সদৃশ উভয় বীরই গদা উন্নমিত করিয়া উভয়ের প্রতি পতিত হইলেন, পুনরায় অন্তর মর্গে অবস্থান পূর্ব্বক মণ্ডলগতিতে বিচরণ করিতে আরম্ভ করিলেন; পরে সহসা লম্ফ প্রদান পূর্ব্বক অষ্ট পদ গমন করিয়া সেই লৌহদণ্ড দ্বারা পরস্পরের আঘাত করিতে লাগিলেন। এইরূপে উভয় বীর পরস্পরের বেগে ও গদাঘাতে নির্ভরনিপীড়িত হইয়া ইন্দ্র ধ্বজের ন্যায় ক্ষিতিতলে যুগপৎ নিপতিত হইলেন।
অনন্তর মহারথ কৃতবর্ম্মা বিহ্বল ও পুনঃপুন নিশ্বসন্ত শল্যের নিকট অবিলম্বে উপস্থিত হইলেন এবং তাঁহাকে গদা দ্বারা নিতান্ত নিপীড়িত ও বিচেষ্ট বিষধরের ন্যায় মুর্চ্ছাভিভূত নিরীক্ষণ করিয়া শীঘ্র স্বরথে আরোহিত করত সংগ্রাম হইতে অপবাহিত করিলেন। অনন্তর মন্তবৎ বিহ্বল, বীর্য্যশালী, মহাবাহু, গদাহস্ত ভীমসেন নিমেষমাত্রে পুনরায় উত্থিত হইয়াছেন, অবলোকন করিলাম। আপনার পুত্রগণ মদ্ৰাধিপতিরে পরাঙ্মুখ নিরীক্ষণ করিয়া হস্তী, পদাতি, অশ্ব ও বুথের সহিত কম্পিত হইয়া উঠিলেন। জয়শালী পাণ্ডবগণ কর্ত্তৃক পীড্যমান কৌরব সৈন্যগণ ভীত হইয়া বাতনোদিত জলদজালের ন্যায় চতুর্দ্দিকে পলায়ন করিল। মহারথ পাণ্ডবগণ ধার্ত্তরাষ্ট্রগণকে পরাজিত করিয়া দীপ্যমান অগ্নির ন্যায় শোভা ধারণ করিলেন, হর্ষিত হইয়া উচ্চস্বরে সিংহনাদ ও শঙ্খনাদ করিতে লাগিলেন এবং ভেরী, মৃদঙ্গ ও আনক সকল বাদিত করিতে আরম্ভ করিলেন।”