১৪শ অধ্যায়
দ্রৌপদীর সখেদ উত্তেজক উক্তি
বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! ভ্রাতৃগণ এইরূপ বিবিধ বেদবিধানানুরূপ বাক্য প্রয়োগ করিলে ধৰ্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির কিছুমাত্র উত্তর প্রদান করিলেন না। তখন অসাধারণ-রূপলাবণ্যসম্পন্না সকুলসম্ভূতা ধৰ্ম্মদর্শিনী [ধৰ্ম্মজ্ঞা] দ্রৌপদী গজযূথপরিবেষ্টিত যূথপতির ন্যায় ভ্রাতৃগণপরিবৃত ধৰ্ম্মরাজের প্রতি দৃষ্টিনিক্ষেপ করিয়া সুমধুর সান্ত্বনাবাক্যে কহিলেন, “নাথ! এই আপনার ভ্রাতৃগণ চাতকের ন্যায় বারংবার শুষ্ককণ্ঠে চীৎকার করিতেছে; কিন্তু আপনি একবারও উহাদিগকে অভিনন্দন করিতেছেন না। এক্ষণে যুক্তিযুক্ত বচনবিন্যাস দ্বারা ঐ চিরদুঃখভোগী ভ্রাতৃগণের আহ্লাদবর্দ্ধন করা আপনার অবশ্য কর্ত্তব্য। পূর্বে দ্বৈতবনে আপনার ভ্রাতৃগণ শীত, বায়ু ও আতপে একান্ত পরিক্লিষ্ট হইলে আপনি উহাদিগকে কহিয়াছিলেন যে, আমরা রথারোহণপূৰ্ব্বক দুর্য্যোধনকে নিধন করিয়া সসাগরা বসুন্ধরা উপভোগ করিব। যখন তোমরা রথিগণকে রথবিহীন এবং গজ ও আরোহিগণের মৃতকলেবর ও রথসমূহে বসুন্ধরা সমাচ্ছন্ন করিয়া বিপুল দক্ষিণাসম্পন্ন যজ্ঞের অনুষ্ঠান করিবে, সেই সময় তোমাদিগের এই বনবাসদুঃখ অতীব সুখকর হইয়া উঠিবে। আপনি তৎকালে উহাদিগকে ঐ কথা কহিয়া আজ কি নিমিত্ত আমাদিগের মন ব্যথিত করিতেছেন? ক্লীব ব্যক্তি কখনই পৃথিবী বা ঐশ্বৰ্য্যভোগে অধিকারী হয় না। মৎস্য যেমন পঙ্কে অবস্থান করে না, তদ্রূপ ক্লীবের গৃহে কখনই পুত্র বিদ্যমান থাকিবার সম্ভাবনা নাই। রাজা দণ্ড[শাসনদণ্ড—শাসন করিবার ক্ষমতা] বিহীন হইলে তাহার কিছুমাত্র প্রতাপ বা ভূমিভোগে অধিকার থাকে না এবং তাহার প্রজারাও সুখসম্ভোগে বঞ্চিত হয়। সকলের সহিত মিত্রতা, দান, অধ্যয়ন ও তপানুষ্ঠান ব্রাহ্মণেরই নিত্যকর্ম্ম, ক্ষত্রিয়ের নহে। অসাধুদিগের দমন ও সাধুগণের প্রতিপালন এবং যুদ্ধে অপরাঙ্মুখতাই নরপতিদিগের শ্রেষ্ঠ ধর্ম্ম। যাঁহার শরীরে ক্ষমা ও ক্রোধ, দান ও অদান, ভয় ও নির্ভীকতা এবং নিগ্রহ[শাসনশক্তি] ও অনুগ্রহ বিদ্যমান আছে, লোকে তাঁহাকে ধার্ম্মিক বলিয়া গণনা করে। আপনি বিদ্যা, দান, সন্ধি, যজ্ঞ বা যাজ্ঞাদ্বারা এই পৃথিবী লাভ করেন নাই। দ্রোণ, কর্ণ, কৃপ ও অশ্বত্থামা প্রভৃতি যোধগণকর্ত্তৃক সুরক্ষিত প্রভূত গজ, অশ্ব ও রথসম্পন্ন শত্রুপক্ষীয় সৈন্যগণকে সংহার করিয়াই উহা অধিকার করিয়াছেন। অতএব এক্ষণে পৃথিবী উপভোগ করাই আপনার কর্ত্তব্য।
“হে পুরুষশার্দ্দূল! আপনি দণ্ডবলে বিবিধ জনপদাকীর্ণ জম্বুদ্বীপ, মহামেরুর পশ্চিমস্থিত ক্রৌঞ্চদ্বীপ, ঐ পৰ্ব্বতের পূৰ্ব্বস্থিত শাকদ্বীপ, উহার উত্তরস্থিত শাকদ্বীপসদৃশ ভদ্রাশ্বপ্রদেশ এবং বিবিধ দেশপরিপূর্ণ সমীপবর্তী অন্যান্য দ্বীপ শাসন করিয়াছেন। এই সমস্ত অলৌকিক অসাধারণ কাৰ্য্য সম্পাদনপূৰ্ব্বক ব্রাহ্মণগণের নিকট সম্মান লাভ করিয়া এক্ষণে কি নিমিত্ত প্রীত হইতেছেন না? একবার উদ্ধত বৃষভতুল্য প্রমত্ত গজেন্দ্রসদৃশ ভ্রাতৃগণকে অবলোকন করিয়া আনন্দিত হউন। উহারা সকলেই অরাতিতাপন ও অমরসদৃশ। আমার বোধ হয়, আপনাদের মধ্যে একজন মাত্র স্বামী হইলেই আমার সুখের পরিসীমা থাকিত না; কিন্তু আমার অদৃষ্টবলে শরীরস্থিত পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের ন্যায় আপনারা পাঁচজনই আমার স্বামী।
“হে মহারাজ! পূৰ্ব্বে কুন্তীদেবী আমাকে কহিয়াছিলেন, ‘পাঞ্চালি! যুধিষ্ঠির অসংখ্য নরপতিকে বিনাশ করিয়া তোমাকে যারপরনাই সুখে রাখিবেন। সেই পরিণামদর্শিনী আৰ্য্যার ঐ বাক্য কদাপি মিথ্যা হইবার নহে; কিন্তু এক্ষণে আপনার মোহপ্রভাবে বুঝি তাঁহার সেই বাক্য মিথ্যা হয়। হে মহারাজ! জ্যেষ্ঠ উন্মত্ত হইলে তাঁহার ভ্রাতৃগণও তাঁহার অনুসরণ করিয়া থাকে, সুতরাং একমাত্র আপনার উন্মত্ততাতে সকল পাণ্ডবই উন্মত্ত হইয়াছে। যদি উহারা উন্মত্ত না হইতেন, তাহা হইলে আপনাকে নাস্তিকদিগের সহিত বদ্ধ করিয়া তাঁহারাই পৃথিবী শাসন করিতেন। এক্ষণে আপনি যেরূপ অভিপ্রায় প্রকাশ করিতেছেন, শ্ৰেয়োলাভে বঞ্চিত মূঢ় ব্যক্তিরাই এইরূপ অভিলাষ করিয়া থাকে। যে ব্যক্তি উন্মত্ত হইয়া উঠে, ধূপ, কল ও নস্য প্রভৃতি ঔষধদ্বারা তাহার চিকিৎসা করা কর্ত্তব্য। আমি পুত্রহীন সুতরাং কামিনীগণের মধ্যে নিতান্ত অধম হইয়াও জীবিত থাকিতে বাসনা করিতেছি। আপনি ইহাদিগের সমক্ষে আমার বাক্য অগ্রাহ্য করিবেন না। আপনি পৃথিবী পরিত্যাগ করিতে বাসনা করিয়া স্বয়ং অগাধ বিপদসাগরে নিপতিত হইতেছেন। মহারাজ মান্ধাতা ও অম্বরীষ যেমন পৃথিবীস্থ যাবতীয় ভূপতির মাননীয় ছিলেন, এক্ষণে আপনিও তদ্রূপ হইয়াছেন। অতএব মনঃক্ষোভ পরিত্যাগপূৰ্ব্বক ধৰ্ম্মানুসারে এই গিরিকাননসমন্বিতা সপ্তদ্বীপা পৃথিবী শাসন, প্রজাপালন, বিবিধ যজ্ঞের অনুষ্ঠান, অরাতিদিগের সহিত সংগ্রাম এবং দ্বিজগণকে ভোজ্য, বস্ত্র ও ধনরত্ন প্রদান করুন।”