এইরূপ বিবেচনা করিয়া ভূপতি।
ত্রিপক্ষের পর তাঁর স্থির হল মতি।।
শনি দুঃখ দিবেন আমারে এইমতে।
উপায় ইহার এক, ভাবি জগন্নাথে।।
চিন্তাদেবী কর তুমি কিঞ্চিৎ সঞ্চয়।
হীরা মুক্তা মণি স্বর্ণ যাহা মনে লয়।।
প্রবাল প্রস্তর আর যত জহরত।
বহুমূল্য অল্পভার এমত রজত।।
সঞ্চয় করিয়া লহ বিচিত্র বসন।
অন্য বস্ত্র দিয়া সব কর আচ্ছাদন।।
শুনি রাণী কাঁথা এক করিল তখন।
কাঁথার ভিতরে রাখে বহুমূল্য ধন।।
রাজা বলে, শুন রাণী আমার বচন।
শনিদোষে মজিল সকল রাজ্যধন।।
কেবল আছয়ে মাত্র জীবন দোঁহার।
এখন উপায় কিছু নাহি দেখি আর।।
পিত্রালয়ে যাও তুমি রাখিতে জীবন।
যথা তথা আমি কাল করিব ক্ষেপন।।
শনিত্যাগ যদি হয় কখন আমার।
তব সহ মিলন হইবে পুনর্ব্বার।।
এত শুনি চিন্তাদেবী লাগিল কহিতে।
না যাব বাপের বাড়ী রহিব সঙ্গেতে।।
পিতৃগৃহে যাইবার সময় এ নয়।
হাসিবেক শত্রুগণ, সে দুঃখ না সয়।।
দুঃখের সময় তব থাকিব সংহতি।
যা হবে তোমার গতি, আমার সে গতি।।
তব সঙ্গে থাকি আমি সেবিব ও পদ।
আমি সঙ্গে থাকিলে না ঘটিবে আপদ।।
গৃহিণী থাকিলে সঙ্গে গৃহস্থ বলায়।
উভয়ে যেখানে থাকে, তথা সুখ পায়।।
শনির দোষেতে তুমি আমারে ছাড়িবে।
চিন্তারে ত্যজিয়া চিন্তা দুঃখ ত পাইবে।।
শুনিয়া রাণীর কথা নৃপতি দুঃখিত।
আশ্বাস করিয়া এই করিল নিশ্চিত।।
শুন ধর্ম্ম অবতার অদ্ভূত বচন।
শ্রীবৎস শনির দোষে করিল যেমন।।
অর্দ্ধ রাত্রি কালে তবে উঠি নরপতি।
রাণীরে করিয়া সঙ্গে যান শীঘ্রগতি।।
এইকালে লক্ষ্মীদেবী আসিয়া তথায়।
সদয় হইয়া এই বলেন রাজায়।।
যথায় থাকিবে, তথা করিব গমন।
কায়ার সহিত ছায়া মিলন যেমন।।
কিছুকাল দুঃখ তুমি গ্রহেতে পাইবে।
পুনর্ব্বার নিজরাজ্যে ঈশ্বর হইবে।।
এক্ষণে বিদায় রাজা হইলাম আমি।
শুভক্ষণে বনপথে হও অগ্রগামী।।
অতিশয় ঘোর রাত্রে যান নররায়।
রমণী সহিত কাঁথা করিয়া মাথায়।।
গৃহের বাহিরে কভু না যায় যে জন।
সেই চিন্তা পদব্রজে করিল গমন।।
কণ্টক অঙ্কুর যত ফুটে তাঁর পায়।
অতি ক্লেশে পতি সহ দ্রুত গতি যায়।।
সঘনে নির্জ্জন বনে প্রবেশ করিল।
তার মধ্যে মায়ানদী দেখিতে পাইল।।
অকূল সমুদ্র প্রায়, নাহি পারাপার।
ভূপতি করেন চিন্তা, কিসে হব পার।।
নদীর কুলেতে বসি কাঁদেন দুজন।
হায় বিধি মম ভাগ্যে এই কি লিখন।।
কর্ণধাররূপে শনি আসিয়া তখন।
ভগ্ন নৌকা লয়ে ঘাটে দিল দরশন।।
মন্দ মন্দ বাহে তরী, চলে বা না চলে।
নৌকা দেখি নরপতি কাণ্ডারীরে বলে।।
ত্বরা করি পার করি দেহ হে কাণ্ডারী।
বিলম্ব না সহে, দুঃখ সহিতে না পারি।।
নাবিক আসিয়া কহে, তুমি কোন জন।
রমণী সহিতে রাত্রে কোথায় গমন।।
হরিয়া কাহার নারী কোথা নিয়া যাও।
পরিচয় দেহ আগে, কূলেতে দাঁড়াও।।
রাজা বলে, শুনিয়াছ শ্রীবৎস নৃপতি।
সেই আমি, এই মম নারী চিন্তা সতী।।
আমার কুদিন হয় দৈবের ঘটনে।
নারী সঙ্গে করি তাই আসিয়াছি বনে।।
শনি কহিলেন, তবে বুঝেছি বিস্তর।
তাল ও বেতাল সিদ্ধ আছিল তোমার।।
তারা সবে কোথা গেল বিপত্তি সময়।
কোথা গেল মন্ত্রীবর্গ, কহ মহাশয়।।
রাজা বলে, ভাই বন্ধু যত পরিবার।
বিপত্তি সময়ে সঙ্গী নহে কেহ কার।।
অসার সংসার এই মায়া মদে মজে।
সকল করয়ে নষ্ট ধর্ম্মপথ ত্যজে।।
আমার আমার বলে, কেহ কারো নয়।
কস্য মাতা কস্য পিতা শাস্ত্রে এই কয়।।
কেবা কার পতি পুত্র, কেবা বন্ধু জন।
মায়াবদ্ধ হয়ে প্রাণী করিছে ভ্রমণ।।
আপনার রক্ষা হেতু যদি রাখে ধর্ম্ম।
আপনার নাশ হেতু, করয়ে কুকর্ম্ম।।
আমার সর্ব্বদা হয় ধর্ম্মেতে বাসনা।
কায়মনোবাক্যে এই করি হে ভাবনা।।
শুনিয়া হাসিয়া শনি কহে পুনর্ব্বার।
অতি জীর্ণ ভগ্ন নৌকা, দেখহ আমার।।
দুই জন হলে যেতে পারে পরপারে।
তিনজন, ক্ষীণতরী, পারে কি না পারে।।
আপনি সুবুদ্ধি বট, দেখ বর্ত্তমান।
বিবেচনা করি রাজা কর অনুমান।।
কান্তারে লইয়া আগে পার হও তুমি।
কান্তা যদি লহ, তবে কাঁথা রাখ ভূমি।।
শুনিয়া নাবিক বাক্য করেন বিচার।
কাঁথা পার করি আগে, শেষে হব পার।।
রাজা রাণী দুই জনে ধরিয়া কাঁথায়।
যতনে তুলিয়া দেন শনির নৌকায়।।
কাঁথা লয়ে সূর্য্যপুত্র বাহিয়া চলিল।
দেখিতে দেখিতে মায়ানদী শুখাইল।।
শ্রীবৎস নৃপতি খেদে করে হায় হায়।
যে সকল দেখিলাম, ভোজবাজী প্রায়।।
বুঝিলাম এ সকল শনির চাতুরী।
মায়া করি বহু ধন করিলেক চুরি।।
দেখিলে সাক্ষাতে রাণী বঞ্চনা শনির।
চঞ্চল হৃদয় তাঁর নাহি হয় স্থির।।
চিন্তিয়া কহেন রাজা করিব গমন।
উঠিতে নাহিক শক্তি, না চলে চরণ।।
বহুকষ্টে গমন করিয়া দুই জন।
প্রবেশ করেন শেষে চিত্রধ্বজ বন।।
হেনকালে সেই স্থানে হইল প্রভাত।
পূর্ব্বদিকে সমুদিত দেব দিননাথ।।
ক্ষুর্ধাত্ত তৃষ্ণার্ত্ত দোঁহে কাতর হৃদয়।
রম্যস্থান দেখি রাণী নৃপতিরে কয়।।
চলিতে না পারি নাথ করি নিবেদন।
বিশ্রাম করহ এই স্থানে কিছুক্ষণ।।
দিব্য জল স্থলে নানা পুষ্প বিকসিত।
এই স্থানে স্নান কর, আছ ত ক্ষুধিত।।
রমণী কাতরা দেখি ব্যথিত অন্তর।
বন হতে ফল মূল আনেন সত্বর।।
উভয়ে করিয়া স্নান ইষ্টপূজা করি।
কুড়াইয়া আনে বহু সুপক্ক বদরী।।
উভয়ে খাইল জল শ্রান্তি হৈল দূর।
গমন করিতে শক্তি হইল প্রচুর।।
নানাস্থান এড়াইল পর্ব্বত কানন।
নদ নদী কত শত বন-উপবন।।
তমাল পিয়াল শাল বৃক্ষ নানাজাতি।
মল্লিকা মালতী বক চম্পক প্রভৃতি।।
বদরী খর্জ্জুর জম্বূ পলাশ রসাল।
নারিকেল গুবাক দাড়িম্ব আর তাল।।
কদলী বয়ড়া ফল আর আমলকী।
কদম্ব অশ্বথ বট নিম্ব হরীতকী।।
জারুল পারুল বেল প্রিয়ঙ্গু অগুরু।
রক্তসার চন্দন বাদাম দেবদারু।।
ইত্যাদি অনেক বৃক্ষে নানা পক্ষিগণ।
ব্যাঘ্র্যাদি হিংস্রক কত করিছে ভ্রমণ।।
মৃগেন্দ্র গজেন্দ্র উষ্ট্র গণ্ডার কাসর।
ঘোটক গোধিকা খর ভল্লুক শূকর।।
শত শত পশু দেখে বনের ভিতর।
বিকট দশন দেখে অতি ভয়ঙ্কর।।
ভূচর খেচর কত, কে করে গণন।
দেখিয়া চিন্তিত রাজা অতি ঘোর বন।।
মনে মনে বলে, রক্ষা কর লক্ষ্মীপতি।
সংসারের সার তুমি, অগতির গতি।।
দয়া করি দীননাথ করুণা নিদান।
সমূহ সঙ্কটে প্রভু কর পরিত্রাণ।।
তোমা বিনা রক্ষা করে, নাহি হেন জন।
আমার ভরসামাত্র প্রভুর চরণ।।
গোবিন্দ গোপাল গিরিধারী গদাধর।
ত্রাণ কর মোরে বড় হয়েছি কাতর।।
এইরূপ বলি রাজা স্মরে চক্রপাণি।
অকস্মাৎ তথা এই হৈল দৈববাণী।।
যত দিন নৃপ তুমি থাকিবে কাননে।
থাকিব তোমার সঙ্গে রক্ষার কারণে।।
শুনিয়া আনন্দ বড় হইল অন্তরে।
বনমধ্যে ভ্রমে সদা নির্ভয় শরীরে।।
একদিন বনমধ্যে করে দরশন।
মৎস্যঘাতী ধীবর আসিছে কত জন।।
ধীবর দেখিয়া রাজা করয়ে যাচন।
কিছু মৎস্য দেহ, আজি করিব ভোজন।।
জেলে বলে, কুক্ষণেতে ধরি জাল করে।
কিছুই না পাইলাম ফিরে যাই ঘরে।।
রাজা বলে, শুন সবে আমার বচন।
পুনর্ব্বার ফেল জাল, পাইবে এখন।।
তাল বেতালের স্মরিলেন শ্রীবৎস।
সকলে ফেলিয়া জাল পায় বহু মৎস্য।।
চতুর ধীবর জাল করিয়া বিস্তার।
পুনর্ব্বার ফেলে জাল করিয়া বিস্তার।।
পাইয়া অনেক মীন কৈবর্ত্তের গণ।
জানিল, সাধক বটে এই দুই জন।।
সাদরে শকুল মৎস্য দিল নৃপতিরে।
মৎস্য পেয়ে নৃপবর কহেন রাণীরে।।
ক্ষুধার্ত্ত হয়েছি রাণী কাতর জীবন।
মীন পোড়াইয়া দেহ, করিব ভোজন।।
শুনিয়া কহেন রাণী যে আজ্ঞা তোমার।
মীন-পোড়া খেলে হয় শনি প্রতিকার।।
ইতিমধ্যে যুধিষ্ঠির করহ শ্রবণ।
মায়া করি শনি মৎস্য করিল হরণ।।
সবিষাদে চিন্তাদেভী অনল জ্বালিল।
যতন পূর্ব্বক সেই মৎস্য পোড়াইল।।
মীন দগ্ধ করি চিন্তা, চিন্তা করে মনে।
মৎস্য পোড়া রাজহস্তে দিব বা কেমনে।।
ক্ষীর ছানা নবনী যে করিত ভোজন।
বনে আসি মীনগন্ধ খাবে সেই জন।।
কিরূপে এই ছাই খাওয়াব তাঁহারে।
শতেক ব্যঞ্জক হয় যাঁহার আহারে।।
এতেক চিন্তিয়া চিন্তা মীন লয়ে করে।
ধুইয়া আনিব বলি গেল সরোবরে।।
জলেই ধুইতে পোড়া মৎস্য পলাইল।
ইহা দেখি চিন্তাদেবী কান্দিতে লাগিল।।
হাহাকার করি রাণী কান্দে বিনাইয়া।
কি বলিবে মহারাজ এ কথা শুনিয়া।।
কে দেখেছে কে শুনেছে পোড়া মৎস্য বাঁচে।
কি হইবে মম ভাগ্যে, না জানি কি আছে।।
শুনিয়া বিশ্বাস নাহি করিবে ভূপতি।
একে ত ক্ষুধার্ত্ত রাজা হবে ক্রুদ্ধ মতি।।
বলিবেন তুমি মৎস্য করেছ ভক্ষণ।
পালাল বলিয়া এবে কর প্রতারণ।।
হায় বিধি এত দুঃখ ঘটালে আমায়।
এখন রয়েছে প্রাণ, নাহি কেন যায়।।
এত ভাবি চিন্তাদেবী কান্দিতে কান্দিতে।
সকল বৃত্তান্ত কহে রাজার সাক্ষাতে।।
শুনিয়া হাসিয়া রাজা রাণীরে কহিল।
এ বড় আশ্চর্য্য কথা শুনিতে হইল।।
মহাভারতের কথা অমৃত সমান।
কাশীরাম দাস কহে, শুনে পুণ্যবান।।