১২তম অধ্যায়
বৃহস্পতির উপদিষ্ট সময় প্রার্থনা
ত্ৰিলোকাধিপতি ইন্দ্র; তুমি আমাকে পতিত্বে বরণ কর।” পতিপরায়ণা দেবী নহুষের বাক্য শ্রবণে ভয়বিহ্বলা হইয়া বাতাহত কদলীর ন্যায় কম্পিত হইতে লাগিলেন। পরে তিনি কৃতাঞ্জলিপুটে ব্ৰহ্মাকে প্ৰণাম করিয়া ভীষণদর্শন সুররাজ নহুষকে কহিলেন, “হে সুররাজ! আমি আপনার নিকট কিঞ্চিৎকাল অবকাশ প্রার্থনা করি; কারণ, ইন্দ্ৰ কোথায় গমন করিয়াছেন ও তাঁহার কি হইয়াছে, কিছুই জানিতে পারি নাই; অতএব ঐ সময়মধ্যে ইহার বিশেষ অনুসন্ধান করিব; যদি তাঁহার কোন সংবাদ না পাই, সত্য কহিতেছি, আমি অবশ্যই আপনার নিকট সমুপস্থিত হইব।”
“রাজা নহুষ ইন্দ্রাণীর এইরূপ আপাতমনোরম বাক্য শ্ৰবণগোচর করিয়া আহ্লাদসাগরে নিমগন হইলেন এবং কহিলেন, অয়ি নিতম্বিনি! হানি কি? তুমি যে কথা বলিলে, তাহাতে কোনক্রমেই আমার অসম্মতি নাই। আমি তোমার সত্যের উপর নির্ভর করিয়া রহিলাম, তুমি ইন্দ্রের অনুসন্ধান করিয়া আইস।”
বিষ্ণুর আদেশে ইন্দ্রের অশ্বমেধানুষ্ঠান
“যশস্বিনী ইন্দ্ৰাণী বিদায় গ্রহণপূর্ব্বক নিষ্ক্রান্ত হইয়া বৃহস্পতি ভবনে গমন করিলেন। অগ্নিপ্রমুখ দেবগণ তাঁহার সকরুণ বাক্য শ্রবণ করিয়া ইন্দ্রের নিমিত্ত একাগ্রচিত্তে চিন্তা করিতে লাগিলেন। অনন্তর সকলে সমবেত হইয়া উদ্বিগ্নমনে দেবদেব বিষ্ণুর নিকট গমনপূর্ব্বক কহিলেন, “হে দেবেশ! আপনি সর্ব্বশ্রেষ্ঠ, জগতের প্ৰভু, আমাদিগের একমাত্র গতি এবং সর্ব্বভূতের রক্ষণাবেক্ষণের নিমিত্ত বিষ্ণুত্ব প্রাপ্ত হইয়াছেন। বৃত্ৰাসুর আপনারই বীৰ্য্যে নিহত হইয়াছে; কিন্তু এক্ষণে বাসব ব্ৰহ্মহত্যাপাপে অভিভূত হইয়া রহিয়াছেন; অতএব, কিরূপে তাঁহার মুক্তি হইবে, তাহার উপায় বিধান করুন।”
“ভগবান বিষ্ণু দেবগণের বাক্য শ্রবণ করিয়া কহিলেন, “হে সুরগণ! পাকশাসন আমার উদ্দেশে পবিত্ৰ অশ্বমেধযজ্ঞের অনুষ্ঠান করুন, তাহা হইলে তিনি ব্ৰহ্মহত্যাজনিত পাপ হইতে বিমুক্ত হইয়া পুনরায় ইন্দ্ৰত্বলাভ করিতে পরিবেন এবং দুর্ম্মতি নহুষ স্বকৃত দুষ্কর্মের নিমিত্ত অচিরকালমধ্যেই বিনষ্ট হইবে, তাহাতে সন্দেহ নাই। তোমরা কিছু কালের নিমিত্ত সাবধান হইয়া অবস্থান কর।”
“দেবগণ অমৃতবর্ষিণী পরমহিতৈষিণী বিষ্ণুবাণী শ্রবণে সাতিশয় প্রীত হইয়া ইন্দ্রের নিকট গমনপূর্ব্বক সমস্ত বৃত্তান্ত কীর্ত্তন করিলেন। তখন পাকশাসন পাপ হইতে বিমুক্ত হইবার মানসে অশ্বমেধযজ্ঞে দীক্ষিত হইয়া যজ্ঞসমাপনপূর্ব্বক বৃক্ষ, নদী, পর্ব্বত, পৃথিবী ও স্ত্রীজাতিতে ব্ৰহ্মহত্যার পাপ বিভক্ত করিয়া রাখিলেন।
সতীত্বরক্ষার্থ শচীর ইন্দ্ৰ উদ্দেশ্যে প্রার্থনা
“সুররাজ এইরূপে পাপবিমুক্ত হইয়া আত্মস্বরূপ লাভ করিলেন, কিন্তু তেজোনিহন্তা [তেজের অপহৰ্ত্তা-তেজোহানিকর] বরদান-দুঃসহ নহুষকে স্বপদে দৃঢ়প্রতিষ্ঠিত দেখিয়া পুনরায় অন্তর্হিত হইলেন এবং সর্ব্বভূতের অদৃশ্য হইয়া কালপ্রতীক্ষায় ইতস্ততঃ পৰ্য্যটন করিতে আরম্ভ করিলেন। তখন পতিপরায়ণা শচী স্বামীর আদর্শনে নিতান্ত শোকসন্তপ্ত হইয়া, “হা নাথ! তুমি কোথায় প্রস্থান করিলে?” বলিয়া উচ্চৈঃস্বরে বিলাপ ও পরিতাপ করিতে লাগিলেন, “হে ধর্ম্ম! যদি আমি কখনও দান করিয়া থাকি, যদি কখনও হুতাশনে আহুতি প্ৰদান করিয়া থাকি, যদি কখনও গুরুজনকে পরিতুষ্ট করিয়া থাকি এবং যদি কখনও সত্যে আমার শ্রদ্ধা থাকে, তাহা হইলে যেন কদাচ আমার সতীত্ব বিনষ্ট না হয়। ভগবতি যামিনি! তুমি অতি পবিত্র ও উত্তরায়ণপ্রস্থিত; আমি তোমাকে নমস্কার করি, যেন আমার মনোরথ সিদ্ধ হয়।” এই বলিয়া নিশাদেবীর আরাধনা করিলেন। অনস্তর তিনি স্বীয় অকপট পতিপরায়ণতা ও সত্যনিষ্ঠা-প্ৰযুক্ত উপশ্রুতিত দেবীকে স্মরণ করিয়া কহিলেন, ‘দেবি! তুমি আমার প্রতি প্ৰসন্ন হইয়া দেবরাজের নিকট লইয়া চল।’ ”