১২শ অধ্যায়
দ্রোণ-বধ-বৃত্তান্ত – দুর্য্যোধনের দুষ্টচেষ্টা
সঞ্জয় কহিলেন, মহারাজ! আমি সমুদায় স্ব চক্ষে প্রত্যক্ষ করিয়াছি; অতএব আচার্য্য দ্রোণ যে রূপে পাণ্ডব ও সৃঞ্জয়গণ কর্ত্তৃক বিনাশিত ও নিপাতিত হইয়াছেন, তাহা কীৰ্ত্তন করিব।
মহারথ দ্রোণাচাৰ্য্য সেনাপতিপদ প্রাপ্ত হইয়া সৈন্যগণের সমক্ষে দুৰ্য্যোধনকে কহিলেন, হে মহারাজ! তুমি যে আজি কৌরবশ্রেষ্ঠ ভীষ্মের পরই সেনাপতিপদ প্রদান করিয়া আমারে পূজা করিলে, এক্ষণে তাহার অনুরূপ ফল লাভ করিবে; আজি তোমার কি অভিলাষ পূর্ণ করিতে হইবে, প্রার্থনা কর।
রাজা দুৰ্য্যোধন কর্ণ দুঃশাসন প্রভৃতির সহিত একত্র হইয়া দুদ্ধর্ষ, জয়িপ্রধান আচাৰ্য্যকে কহিলেন, হে আচার্য্য! যদি বর প্রদান করেন, তাহা হইলে এই বর প্রার্থনা করি যে, রথিশ্রেষ্ঠ যুধিষ্ঠিরকে জীবন্ত গ্রহণ করিয়া এই স্থানে আমার নিকট আনয়ন করুন।
কৌরবগণের আচার্য্য দ্রোণ দুৰ্য্যোধনের বাক্য শ্রবণে সেনাগণকে হর্ষযুক্ত করিয়া কহিলেন, হে দুৰ্য্যোধন! রাজা যুধিষ্ঠির ধন্য; কারণ, তুমি তাঁহাকে সংহার করিতে ইচ্ছা না করিয়া গ্রহণ করিতে ইচ্ছা করিতেছ। হে পুরুষোত্তম! তুমি কি নিমিত্ত যুধিষ্ঠিরের বধ কামনা করিতেছ না এবং মন্ত্রণাকুশল হইয়া কি নিমিত্তই বা এ বিষয়ের উল্লেখ করিলে না? কি আশ্চর্য্য! ধৰ্ম্মরাজের দ্বেষ্টা নাই। তুমি তাঁহাকে জীবিত রাখিতে ইচ্ছা করিয়া আপনার কুল রক্ষা করিতেছ, অথবা পাওগণকে যুদ্ধে পরাজিত করিয়া পরিশেষে রাজ্য প্রদান পূর্ব্বক সৌভ্রাত্র করিবার অভিলাষী হইতেছ। যাহা হউক, রাজা যুধিষ্ঠির ধন্য; শুভক্ষণে সেই ধীমানের জন্ম হইয়াছিল; তাহার অজাতশত্রু নামও অযথার্থ নয়; কেননা তুমি তাহার প্রতি স্নেহবান্ হইতেছ।
বৃহস্পতি সদৃশ ব্যক্তিও হৃদগত ভাব গোপন করিতে পারেন না; এই নিমিত্ত দুৰ্য্যোধনের চিরপোষিত হৃদয়গত অভিপ্রায় সহসা বহির্গত হইল; প্রফুল্ল হইয়া কহিলেন, হে আচার্য্য! যুধিষ্ঠিরের সংহারে আমার জয় লাভ হইবে না; তাঁহাকে বিনাশ করিলে ধনঞ্জয় আমাদের সকলকেই বিনাশ করিবে, সন্দেহ নাই। তাঁহাদিগের সকলকে সংহার করা সুরগণেরও অসাধ্য; সুতরাং যে অবশিষ্ট থাকিবে, সেই আমাদিগকে নিঃশেষিত করিবে। কিন্তু সত্যপ্রতিজ্ঞ যুধিষ্ঠিরকে আনয়ন করিলে তাঁহাকে পুনরায় দূতক্রীড়ায় পরাজিত করিব; তাহা হইলে তাঁহার অনুগত পাণ্ডবগণ পুনরায় বনে গমন করিবে এবং ঈদৃশ জয়ও ব্যক্ত রূপে দীর্ঘ কাল স্থায়ী হইবে; এই নিমিত্ত আমি কখন যুধিষ্ঠিরের বধ ইচ্ছা করি না।
দ্রোণাচার্য্যের বুদ্ধিনৈপুণ্যে দুর্য্যোধনের বিফলতা
অর্থতত্ত্ববিৎ বুদ্ধিমা দ্রোণাচার্য্য দুর্য্যোধনের কুটিল অভিপ্রায় অবগত হইয়া চিন্তা পূর্ব্বক তাঁহার প্রার্থিত বর এইরূপ সীমাবদ্ধ করিয়া প্রদান করিলেন; হে দুৰ্য্যোধন! যদি বীর্য্যশালী অর্জ্জুন যুদ্ধ স্থলে যুধিষ্ঠিরকে রক্ষা না করে। তাহা হইলে তুমি মনে করিবে, যুধিষ্ঠির স্ববশে সমানীত হইয়াছে; ইন্দ্র প্রভৃতি দেব ও অসুরগণও অর্জ্জুনের প্রত্যুদগমন করিতে পারেন না; এই নিমিত্ত আমি ইহা করিতে সাহসী হইতেছি না। অর্জ্জুন একাগ্র ও আমার শিষ্য এবং আমি তাহার অস্ত্র শিক্ষা বিষয়ে প্রথম আচার্য্য, যথার্থ বটে; কিন্তু সেই তরুণ বয়স্ক পুণ্যবান্ অর্জ্জুন আবার ইন্দ্র ও রুদ্র হইতে বহুবিধ অস্ত্র প্রাপ্ত এবং তোমা কর্ত্তৃক ক্রোধিত হইয়াছে; এই নিমিত্ত আমি যুধিষ্ঠিরকে গ্রহণ করিতে সমর্থ হইব না। অতএব যে উপায়ে পার, যুদ্ধ হইতে ধনঞ্জয়কে অপসারিত কর; তাহা হইলেই যুধিষ্ঠির তোমার নিকট পরাজিত হইবেন। হে পুরুষোত্তম! তাঁহাকে সংহার না করিয়া গ্রহণ করিলেই জয় লাভ হইবে আর তিনিও এই উপায়ে পরিগৃহীত হইবেন; নরশ্রেষ্ঠ ধনঞ্জয় অপনীত হইলে সত্যধৰ্ম্ম পরায়ণ যুধিষ্ঠির যুদ্ধে যদি মুহৰ্ত্ত কালও আমার অগ্রে অবস্থান করেন, তাহা হইলে আমি অদ্য তাঁহাকে গ্রহণ করিয়া তোমার বশীভূত করিব; তাহার সন্দেহ নাই। কিন্তু অর্জ্জুনের সমক্ষে ইন্দ্র প্রভৃতি সুরগণও তাঁহাকে গ্রহণ করিতে পারেন না।
দ্রোণাচার্য্য যুধিষ্ঠিরের গ্রহণ বিষয়ে এই রূপ সীমাবদ্ধ প্রতিজ্ঞা করিলে অতি মূর্খ আপনার পুত্রগণ তাঁহাকে গৃহীত বলিয়াই মনে করিতে লাগিলেন। কিন্তু দুৰ্য্যোধন দ্রোণচাৰ্য্যকে পাণ্ডবগণের পক্ষপাতী জানিতেন, এই জন্য সেই প্রতিজ্ঞা দৃঢ় করিবার নিমিত্ত অনেক মন্ত্রণা করিয়া যুধিষ্ঠিরের গ্রহণ সমুদায় সৈন্য মধ্যে ঘোষণা করিলেন।