১১তম অধ্যায়
শচী আনয়নে নহুষের নির্ব্বন্ধ
“তখন দেবগণ ও ঋষিগণ নহুষকে ক্রুদ্ধ দেখিয়া বিনীতভাবে কহিতে লাগিলেন, ‘সুররাজ! ক্ৰোধ পরিহার করুন; আপনি ক্ৰোধান্বিত হওয়াতে সুরাসুর-গন্ধৰ্ব-কিন্নর-মহোরগ-সমবেত সমুদয় জগৎ ভীত ও ত্ৰস্ত হইয়াছে। হে সুরেশ্বর! প্রসন্ন হইয়া রোষাবেগ সংবরণ করুন; ভবদ্বিধ [আপনাদের মত] সজনগণ কদাপি ক্রোধের বশীভূত হয়েন না। শচী পরপত্নী; অতএব আপনি পরদারাভিমর্ষণ [পরনারীগ্রহণ] হইতে নিবৃত্ত হউন, আপনি দেবগণের অধীশ্বর; ধর্ম্মানুসারে প্রজাপলনে মনোনিবেশ করুন।”
“সুররাজ নহুষ কামশরে নিতান্ত বিমোহিত হইয়া সুরগণের বাক্যে কৰ্ণপাত না করিয়া কহিলেন, “হে দেবগণ! তোমাদের পূর্ব্বাধিপতি পুরন্দর পূর্ব্বে ঋষিপত্নী অহল্যার পতি বর্ত্তমানেও সতীত্বভঙ্গপ্রভৃতি বহুবিধ পাপকর্মের অনুষ্ঠান করিয়াছিলেন, তোমরা তৎকালে কি নিমিত্ত তাঁহাকে প্রতিনিবৃত্ত কর নাই? যাহা হউক, এক্ষণে যদি ইন্দ্ৰাণী আমার সমীপে সমুপস্থিত হইয়া মদীয় মনোভিলাষ পূর্ণ করেন, তাহা হইলেই তাহার ও তোমাদিগের শ্ৰেয়েলাভ হইবে।” দেবগণ নহুষের নির্ব্বদ্ধতিশয়সন্দর্শনে কহিলেন, ‘সুররাজ! ক্ৰোধসংবরণপূর্ব্বক প্রসন্ন হউন। আমরা আপনার ইচ্ছানুসারে অবশ্যই ইন্দ্ৰাণীকে আনয়ন করিব।” অমরগণ নহুষকে এই কথা কহিয়া ঋষিগণসমভিব্যাহারে বৃহস্পতি ও ইন্দ্ৰাণীকে এই অশুভ সংবাদ কহিবার নিমিত্ত গান করিলেন; অনন্তর বৃহস্পতিভবনে সমুপস্থিত হইয়া তাহাকে কহিতে লাগিলেন, “হে সুরাচাৰ্য্য! ইন্দ্ৰাণী যে আপনার শরণাপন্ন হইয়াছেন এবং আপনিও যে তাহাকে অভয় প্রদান করিয়াছেন, আমরা তাহা জ্ঞাত হইয়াছি। এক্ষণে দেবতা, গন্ধর্ব্ব ও ঋষিগণ প্রার্থনা করিতেছেন, আপনি অনুগ্রহ করিয়া নহুষকে ইন্দ্ৰাণী প্ৰদান করুন; দেবরাজ নহুষ শত্রু অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ; অতএব এই বরবর্ণিনী ইন্দ্ৰাণী তাহাকে পতিত্বে বরণ করুন।”
“পতিপরায়ণা শচী দেবগণের বাক্য শ্রবণে সাতিশয় ব্যাকুলিত হইয়া মুক্তকন্ঠে ক্রন্দন করিয়া বৃহস্পতিকে কহিলেন, ‘হে দেবর্ষিসত্তম! আমি নহুষকে পতিত্বে বরণ করিতে অভিলাষ করি না; এক্ষণে আপনার শরণাপন্ন হইয়াছি; আপনি আমাকে এই ভয় হইতে পরিত্ৰাণ করুন।”
শচীর সতীত্বরক্ষণে বৃহস্পতির অভয়দান
“বৃহস্পতি কহিলেন, “হে সত্যশীলে! তুমি যখন আমার শরণাপন্ন হইয়াছ, তখন আমি নিশ্চয়ই তোমাকে রক্ষা করিব। আমি ধর্ম্মভীরু, সত্যশীল ব্রাহ্মণ হইয়া কিরূপে এই অকাৰ্য্যের অনুষ্ঠান করিব?” মহাত্মা সুরাচাৰ্য্য শচীকে এইরূপ আশ্বাস প্ৰদানানন্তর সুরসমুদয়কে কহিলেন, “দেবগণ! তোমরা স্বস্ব স্থানে প্ৰস্থান কর; আমি ইন্দ্ৰাণীকে কদাচ পরিত্যাগ করিতে পারিব না। পূর্ব্বকালে ভগবান ব্ৰহ্মা শরণাগতপরিত্যাগবিষয়ে যাহা কহিয়াছেন, শ্রবণ কর। যে ব্যক্তি ভীত ও শরণাপন্নকে শক্রহস্তে প্রত্যাৰ্পণ করে, তাহার ভাগ্যে বীজ যথাকলে অঙ্কুরিত হয় না; পর্জ্জন্য তাহাকে যথাসময়ে বারিপ্ৰদান করে না; সে স্বয়ং শরণাপন্ন হইতে ইচ্ছা করিলে কেহই তাহার শরণ্য হয় না; তাহার অন্নভোজন করা বৃথা; সে বিশেষ যত্ন করিলেও অচেতন হইয়া স্বৰ্গ হইতে চ্যুত হয়; দেবগণ তদত্ত হাব্য গ্ৰহণ করেন না; তাহার প্রজাগণ অল্পকালে মৃত্যুমুখে পতিত হয় ও পিতৃগণ সতত বিবাদ এবং ইন্দ্ৰাদি দেবগণ তাহার উপর বজ্র নিক্ষেপ করেন। হে সুরগণ! আমি উক্ত বিষয় বিলক্ষণ অবগত হইয়া কিরূপে লোকবিশ্রুতা শক্রমহিষী শচীকে পরিত্যাগ করিব? অতএব এক্ষণে যাহাতে ইহার ও আমার হিতসাধন হয়, তোমরা তদনুরূপ কাৰ্য্যানুষ্ঠানে যত্নবান হও।”
“তখন দেবতা ও গন্ধৰ্ব্বগণ একত্র হইয়া কহিলেন, “হে সুরাচাৰ্য্য! এক্ষণে কিরূপে সকলের শ্রেয়োলাভ হইবে, আপনি এই বিষয়ে সৎপরামর্শ প্রদান করুন।”
শচীর নহুষসন্নিধানে গমন
“বৃহস্পতি কহিলেন, “হে সুরগণ! এক্ষণে ইন্দ্রাণী নহুষসন্নিধানে গমনপূর্ব্বক “কিয়ৎকাল পরে আপনাকে বরণ করিব।” বলিয়া প্রার্থনা করুন; তাহা হইলেই আমাদিগের সকলেরই শ্রেয়োলাভের সম্ভাবনা। কাল বহুবিঘ্নকর; অতএব কালক্রমে বরগর্ব্বিত দুরাত্মা নহুষেরও কোন বিঘ্ন হইতে পারে; তাহা হইলে আমরা এই দুরবস্থা হইতে অনায়াসে বিমুক্ত হইতে পারি।”
“দেবগণ বৃহস্পতিবাক্যশ্রবণে পরম প্রীত হইয়া কহিলেন, ‘মহাশয়! উত্তম কহিয়াছেন; ইহাতে সমুদয় দেবগণেরই হিতলাভের সম্ভাবনা। এক্ষণে ইন্দ্ৰাণীকে প্ৰসন্ন করা কর্ত্তব্য।’ এই স্থির করিয়া লোকহিতৈষী অগ্নিপ্রমুখ সুরগণ শচীকে কহিলেন, “হে দেবি! আপনি এই স্থাবরজঙ্গমাত্মক সমুদয় জগৎ ধারণ করিতেছেন; একবার অনুগ্রহ করিয়া নহুষের নিকট গমন করুন। আপনি পতিব্ৰতা; দুরাত্মা নহুষ যখন আপনাকে কামনা করিয়াছে, তখন সে অবশ্যই বিনষ্ট হইবে এবং শত্ৰুও সত্বর সুররাজ্য প্রাপ্ত হইবেন।”
“তখন পতিপরায়ণা ইন্দ্ৰাণী দেবগণের বাক্যে স্বকাৰ্য্যসাধনে কৃতনিশ্চয হইয়া লজ্জানম্রমুখে ভীষণদর্শন নহুষের সম্মুখে সমুপস্থিত হইলেন। সেই রূপযৌবনবতী ইন্দ্রমহিষীকে অবলোকন করিয়া কামশরবিমোহিত দুরাত্মা নহুষের আনন্দের আর পরিসীমা রইল না।”