১১শ অধ্যায়
ভূমিপৰ্যাধ্যায়-স্বীপসমুদ্রাদির পরিমাণ
ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, “হে সঞ্জয়! তুমি জম্মুখণ্ডের বিষয়ে কীর্ত্তন করিলে, এক্ষণে ইহার বিস্তার, পরিমাণ, সমুদ্রের প্রকৃত প্রমাণ এবং শাকদ্বীপ, কুশদ্বীপ, শাল্মলীদ্বীপ, ক্ৰৌঞ্চদ্বীপ, চন্দ্র, সূৰ্য্য ও রাহুর বিষয় কীর্ত্তন কর।”
সঞ্জয় কহিলেন, “মহারাজ! বহুসংখ্যক দ্বীপ এই পৃথিবী ব্যাপ্ত করিয়া রহিয়াছে। এক্ষণে সপ্তদ্বীপ, চন্দ্ৰ, সূৰ্য্য ও গ্রহদিগের বিষয় কীর্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ করুন;—জম্বুদ্বীপ অষ্টাদশসহস্রছয়শত যোজন বিস্তীর্ণ। লবণসমুদ্রের বিস্তার ইহা অপেক্ষা দ্বিগুণ; ঐ সাগর নানা জনপদসমাকীর্ণ, রক্তপ্রবালাদি নানা মণিভূষিত, অনেক ধাতুসম্পন্ন, পর্ব্বতরাজি-পরিশোভিত, সিদ্ধচারণসঙ্কুল ও নিতান্ত দুর্নিরীক্ষ্য। এক্ষণে ন্যায়ানুসারে শাকদ্বীপের বিষয় বর্ণন করিতেছি, শ্রবণ করুন—জম্বুদ্বীপের যেরূপ বিস্তার কীর্ত্তিত হইল, শাকদ্বীপ। তদপেক্ষা দ্বিগুণ এবং ইহার সাগর জম্বুদ্বীপের সাগর অপেক্ষাও দ্বিগুণ বিস্তীর্ণ। এই শাকদ্বীপ ক্ষীরসাগরে পরিবেষ্টিত, তথায় কতিপয় পবিত্ৰ জনপদসকল অধিষ্ঠিত আছে। তত্রত্য মনুষ্যগণ কদাচ অকালে কালগ্রাসে নিপতিত হয় না, তাহারা সকলেই তেজ ও ক্ষমাসম্পন্ন। ঐ স্থানে দুর্ভিক্ষজনিত ক্লেশের লেশমাত্ৰ সহ্য করিতে হয় না। হে মহারাজ! আমি শাকদ্বীপের সংক্ষেপবৃত্তান্ত কীর্ত্তন করিলাম; এক্ষণে আর কি শ্রবণ করিতে অভিলাষ হয়, বলুন।”
ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, “হে সঞ্জয়! তুমি শাকদ্বীপের সংক্ষেপবৃত্তান্ত বর্ণন করিলে, এক্ষণে উহা বিস্তৃতরূপে কীর্ত্তন কর।”
শাকদ্বীপের বিস্তৃত-বৃত্তান্ত
সঞ্জয় কহিলেন, “মহারাজ! শাকদ্বীপে মণিবিভূষিত সাতটি পর্ব্বত ও নানারত্বের আকর [উৎপত্তিস্থান] নদীসকল প্রবাহিত আছে। তথায় সমস্ত বিষয়ই গুণসম্পন্ন ও অতি পবিত্র দেবর্ষিগণসেবিত মহাগিরি মেরুই সর্ব্বপ্রধান। উহার পশ্চিমে মলয় পর্ব্বত বিস্তীর্ণ আছে, সেই পর্ব্বত হইতে মেঘসকল সঞ্চালিত হইয়া সর্ব্বত্র পরিব্যাপ্ত হইয়া থাকে। তাহার পূর্ব্বদিকে জলধারনামক এক বৃহৎ পর্ব্বত প্রতিষ্ঠিত আছে। দেবরাজ ইন্দ্ৰ সেই স্থান হইতেই সলিল গ্রহণপূর্ব্বক বর্ষাকালে বর্ষণ করেন। তাহার পর অতি উন্নত রৈবতকপর্ব্বত প্রতিষ্ঠিত আছে; ভগবান ব্ৰহ্মার আদেশানুসারে তথায় রেবতীনক্ষত্র নিত্য আকাশে উদিত হয়। সুমেরুর উত্তরে অতি উন্নত, নবীন মেঘের ন্যায় শ্যামল-উজ্জ্বলকান্তিসম্পন্ন শ্যামগিরি প্রতিষ্ঠিত আছে; এই পর্ব্বতের শ্যামবৰ্ণহেতু তত্ৰত্য মনুষ্যগণ শ্যামবর্ণ হইয়া থাকে।”
ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, “হে সঞ্জয়! তত্ৰত্য মনুষ্যগণ কিরূপে শ্যামলত্ব প্রাপ্ত হইয়া থাকে, এই বিষয়ে আমার সাতিশয় সংশয় জন্মিয়াছে।”
সঞ্জয় কহিলেন, “মহারাজ। সকল দ্বীপেই গৌর, কৃষ্ণ ও তদুভয়ের মিশ্রবর্ণ হইয়া থাকে, কিন্তু এই গিরি হইতে শ্যামবর্ণ মাত্র হইয়া থাকে; এই জন্যই এই গিরি শ্যামগিরি বলিয়া কথিত হইয়াছে। শ্যামগিরির পর অতি উন্নত দুৰ্গ-শৈল, তথায় কেশরসম্পন্ন [জটাযুক্ত-সিংহের মাথায় দুই ধারা দিয়া যে জটার মত বিলম্বিত থাকে, তাহাকে কেশর কহে] সিংহ জন্মগ্রহণ করে ও কুঙ্কুমবাহী সমীরণ সর্ব্বত্র প্রবাহিত হইয়া থাকে। এইসকল পর্ব্বতের বিস্তার উত্তরোত্তর দ্বিগুণ [একটির দ্বিগুণ অপরটি, তৎপরবর্ত্তী পর্ব্বত— পূর্ব্ববতী পর্ব্বতের দ্বিগুণ এই প্রকার।], এইসকল পর্ব্বতের মহামেরু, মহাকাশ, জলদ, কুমুদ, উত্তর, জলধার ও সুকুমার, এই সাতটি বর্ষ [বর্ষ-সমীপস্থ বিখ্যাত পর্ব্বত, উহাকে বর্ষপর্ব্বতও বলা হয়] আছে। রৈবতকপর্ব্বতের কৌমার বর্ষ, শ্যামগিরির মণিকাঞ্চনবর্ষ। কেদারপর্ব্বতের মোদকীবৰ্ষ এবং দুর্গ-শৈলের মহাপুরুষবর্ষ কীর্ত্তিত হইয়াছে। তাহার পর মহাপুমাননামে এক পর্ব্বত আছে; তাহার পরিমাণ জম্মুদ্বীপের তুল্য; সেই গিরি শাকদ্বীপের বেষ্টনরূপে বিদ্যমান। শাকদ্বীপে শাকনামে এক বৃক্ষ আছে। তাহার পরিমাণ জম্বুদ্বীপের জম্বুবৃক্ষের অনুরূপ। প্ৰজাসকল ঐ বৃক্ষের উপাসক। ঐ পর্ব্বতে অতিপবিত্র জনপদসকল সন্নিবেশিত আছে। তত্রত্য মানবগণ ভগবান শঙ্করের আরাধনা করিয়া থাকে; সিদ্ধ, চারণ ও দেবগণ তথায় সতত গমন করেন। প্রজাসকল চারিবর্ণে বিভক্ত, দীর্ঘজীবী, ও স্ব স্ব ধর্ম্মে একান্ত অনুরক্ত; তথায় চোর-ভয় নাই, জরামৃত্যুর অধিকার নাই। যেমন বর্ষাকালে নদীসকল পরিবর্দ্ধিত হয়, তদ্রূপ প্রজারাও ক্রমে ক্ৰমে পরিবর্দ্ধিত হইয়া থাকে। তথায় বহুশাখায় বিভক্ত গঙ্গা, সুকুমারী, কুমারী, সীতা, কাবেরকা, মহানদী, মণিজলা, বংক্ষু ও বর্দ্ধনিকা, এই সকল নদী প্রবাহিত হইতেছে; ইহা ভিন্ন শতসহস্র পবিত্রসলিলা নদীও বর্ত্তমান আছে। সুরপতি সেইসমুদয়ের সলিল গ্রহণ করিয়া সর্ব্বত্র বর্ষণ করিয়া থাকেন। সেইসমস্ত নদীর নাম ও পরিমাণ করা নিতান্ত সুকঠিন। সেই স্থানে মৃগ, মশক, মানস ও মন্দগ—এই চারিটি জনপদ আছে। মৃগদেশে স্বকর্ম্মনিরত ব্ৰাহ্মণগণ বাস করেন, মশকদেশে সর্ব্বকামপ্ৰদ পরমধার্ম্মিক ক্ষত্ৰিয়েরা বাস করিয়া থাকেন, মানসাদেশ স্বধর্ম্মপরায়ণ সর্ব্বকামসম্পন্ন মহাবীর বৈশ্যগণের বাসস্থান এবং মন্দগদেশে ধর্ম্মশীল শূদ্রেরা বাস করে। সেইসকল স্থানে রাজা নাই, রাজদণ্ডের ভয় নাই এবং দণ্ডধারী পুরুষও নাই। তত্ৰত্য মানবগণ স্বধর্ম্মদ্বারা পরস্পরকে রক্ষা করেন। হে মহারাজ! সমধিক দীপ্তিশালী শাকদ্বীপের বিষয় এই পর্যন্ত কীর্ত্তন করিতে পারা যায়, আর এইসকল বিষয়ই শ্রোতব্য।”