১১শ অধ্যায়
কির্মীরবধপর্ব্বাধ্যায়
ধৃতরাষ্ট্র বিদুরকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “হে ক্ষত্তঃ! কিরূপে ভীমের সহিত কিৰ্ম্মীর নিশাচরের যুদ্ধ-ঘটনা হয় ও রাক্ষসই বা কিরূপে নিধনপ্রাপ্ত হয়, আমি তাহা আদ্যোপান্ত সমস্ত শ্রবণ করিতে অভিলাষ করি, তুমি সবিস্তর বর্ণন কর।” বিদুর কহিলেন, “মহারাজ! ভীমের কার্য্যসকল অলৌকিক, তাহা শ্রবণ করিলে বিস্মিত হইতে হয়, প্রায়ই কথাপ্রসঙ্গে ঐ সকল বর্ণিত হইয়া থাকে।
“হে রাজেন্দ্ৰ! দ্যূতপরাজিত পাণ্ডবেরা এ স্থান হইতে নির্ব্বাসিত হইলে তিন দিবস অহোরাত্ৰ গমন করিয়া অতিভীষণ নিশীথসময়ে নরমাংসলোলুপ ভয়ঙ্কর নিশাচরগণসমাকীর্ণ কাম্যাকবনে উত্তীর্ণ হইলেন। তাপসাগণ ও বনচারী গোপ-সকল নিশাচরভয়ে সেই বন পরিত্যাগপূর্ব্বক দূরতর প্রদেশে প্রস্থান করিয়াছে। পাণ্ডবেরা তথায় প্রবেশ করিবামাত্র উল্মূকধারী [মশালের ন্যায় জ্বলন্ত কাষ্ঠের আলোক] প্রচণ্ডাকৃতি প্ৰদীপ্তনয়ন এক রাক্ষসকে সম্মুখীন দেখিলেন। তাহার আরক্ত চক্ষুদ্বয় অগ্নিশিখার ন্যায় প্রদীপ্ত, শিরোরুহ-সকল সুদীর্ঘ ও উজ্জ্বল এবং দশনরাজি সাতিশয় ধবলবৰ্ণ; দেখিবামাত্ৰ বোধ হয়, যেন নিবিড় জলদাবলিতে সূৰ্য্যকিরণ, তড়িম্মালা ও বলাকপঙক্তি সম্পৃক্ত হইয়াছে। সে সুদীর্ঘ বাহুযুগল বিস্তার ও ভয়ানক মুখমণ্ডল ব্যাদানপূর্ব্বক পাণ্ডবদিগের পথবিরোধ করিয়া দণ্ডায়মান হইয়া নানাপ্রকার রাক্ষসীমায়া বিস্তার ও ঘোরতর ঘনঘটার ন্যায় গভীর গর্জ্জন করিতে লাগিল। তাহার নিনাদে তত্ৰত্য সমস্ত জলচর, স্থলচর ও বিহঙ্গমগণ সন্ত্রস্ত হইয়া আর্ত্তস্বরে পলায়ন করিতে লাগিল। মৃগ, মহিষ, শার্দ্দুল, বরাহ, ভলুক প্রভৃতি জন্তুসকল শশব্যস্ত হইয়া ইতস্ততঃ ধাবমান হওয়াতে বনস্থল সমাকুল ও অত্যন্ত উপদ্রুতের ন্যায় বোধ হইতে লাগিল। বিপ্রকৃষ্ট লতা-সকল তাহার উরুবাতাভিহিত হইয়া তাম্রবর্ণ পল্লবরূপ বাহুদ্বারা পাদপদিগকে আলিঙ্গন করিতে লাগিল। তৎকালে সেই মহাবেগবান বায়ুদ্বারা রাশি রাশি ধূলি সমুত্থিত হইয়া গগনমণ্ডল আচ্ছন্ন করিল। ঘোরতর অন্ধকারে চতুর্দ্দিক আবৃত হইল। সেই দুৰ্বৃত্ত পাণ্ডবারি পাণ্ডবদিগের বনবাসের বিলক্ষণ বিঘ্নস্বরূপ হইয়া উঠিল। পাণ্ডবেরা তাহাকে জানিতে পারেন নাই, কিন্তু সে দূর হইতে কৃষ্ণজিনধারী পাণ্ডবদিগকে লক্ষ্য করিয়া মৈনাক-পর্ব্বতের ন্যায় সেই বনের দ্বার অবরোধ করিয়া রহিল। কমললোচনা দ্ৰৌপদী সেই অদৃষ্টপূর্ব্ব ভীষণমূর্ত্তি-সন্দর্শনে ত্ৰস্ত ও মূর্চ্ছিত হইয়া নয়নযুগল নিমীলন করিবামাত্র পাণ্ডবেরা ব্যগ্রতা প্রদর্শনপূর্ব্বক তাঁহাকে ধারণ করিলেন। একে দুঃশাসনের আকর্ষণে তদীয় কেশপাশ বিকীর্ণ হইয়াছিল, তাহাতে আবার তিনি নিশাচরদর্শনে ভীত হইয়া পঞ্চপাণ্ডবের মধ্যস্থিত হইয়া রহিলেন; ইহাতে বোধ হইতে লাগিল যেন, পর্ব্বতমধ্যগ স্রোতস্বতী সমধিক সমাকুল হইয়া রহিয়াছে।
“অনন্তর ধৌম্য মহাশয় নিশাচরনাশক বিবিধ মন্ত্রপ্রয়োগদ্বারা করিলেন। মায়া বিনষ্ট হইলে সেই কামরূপী মহাবল পরাক্রান্ত লোহিতলোচন নিশাচরকে সাক্ষাৎ কৃতান্তের ন্যায় বোধ হইতে লাগিল। মহাপ্ৰজ্ঞ যুধিষ্ঠির তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুমি কে? কাহার পুত্ৰ? তোমার কি কাৰ্য্য করিতে হইবে বল? রাক্ষস কহিল, “আমি বকের ভ্রাতা, আমার নাম কিৰ্ম্মীর; এই জনশূন্য কাম্যাকবন আমার আবাসস্থান। প্রতিদিন যুদ্ধনির্জ্জিত নরমাংসদ্ধারা আমি জীবিকা নির্ব্বাহ করি। তোমরা কে আমার ভক্ষ্যভূত হইয়া এস্থানে উপস্থিত হইয়াছ? অতএব তোমাদের সকলকেই যুদ্ধে পরাভব করিয়া সুস্থশরীরে ভক্ষণ করিব।” যুধিষ্ঠির সেই দুরাত্মার নিষ্ঠুর বচন শ্রবণ করিয়া স্বীয় নাম-গোত্র প্রভৃতি সমস্ত পরিচয় প্ৰদান করিতে লাগিলেন, কহিলেন—“আমি পাণ্ডুর তনয়, আমার নাম ধর্ম্মরাজ, বোধ হয় শুনিয়া থাকিবে। আমি হৃতরাজ্য হইয়া বনবাসবাসনায় ভীম, অর্জ্জুন প্রভৃতি ভ্রাতৃগণ-সমভিব্যাহারে তোমার অধিকারে আসিয়াছি।”
কিৰ্ম্মীর কহিল, “কি সৌভাগ্যের বিষয়! দেবানুগ্রহে আমার চিরাভীষ্ট বস্তু অদ্য গৃহে উপস্থিত হইয়াছে, ভীমের বধার্থে উদ্যতায়ুধ হইয়া আমি সমস্ত পৃথিবী পরিভ্রমণ করিতেছি, কুত্ৰাপি তাহাকে দেখিতে পাই নাই, আদ্য ভাগ্যক্রমে বহুকালের পর মদীয় ভ্ৰাতৃনিহন্তা সেই দুরাচারকে প্রাপ্ত হইয়াছি। যে দুরাত্মা ভীম বেত্ৰকীয় বনে কপট ব্ৰাহ্মণরূপ ধারণা করিয়া আমার ভ্রাতা বকের প্ৰাণসংহার করিয়াছে, স্বীয় বলে নহে, কেবল বিদ্যাবল অবলম্বনপূর্ব্বক যে আমার প্রিয়সখা হিড়িম্বকে নিহত করিয়া তাহার ভগিনীকে হরণ করিয়াছে, সেই পাণ্ডব অস্মৎপ্রচারকাল অৰ্দ্ধরাত্রে মদ্ভুজরক্ষিত এই বনে স্বয়ং সমাগত হইয়াছে; অতএব অদ্য চিরসম্ভূত বৈরানিল নির্ব্বাণ করিব। অদ্য ইহার অপরিমিত শোণিতসলিলে ভ্রাতা ও বন্ধুর তর্পণ করিয়া আমি তাহাদিগের নিকট অঋণী হইব। অদ্য বদ্ধমূল রাক্ষসকুলকণ্টক ভীমসেনকে কালভবনে প্রেরণ করিয়া শান্তিলাভ করিব। হে যুধিষ্ঠির! যদিও ভীমসেন আমার ভ্রাতার নিকট পরিত্ৰাণ পাইয়াছে, কিন্তু যেমন অগস্ত্য মহাসুর বাতাপিকে জীৰ্ণ করিয়াছিলেন, তদ্রূপ আমি তোমার সমক্ষে বৃকোদরকে ভক্ষণ করিয়া জীৰ্ণ করিব।” ধর্ম্মাত্মা যুধিষ্ঠির রাক্ষসকর্ত্তৃক এইরূপ কথিত হইয়া ক্রোধাভরে তাহাকে ভৎসনা করত কহিলেন, “তোমার এই দুষ্টাভিসন্ধি কখনই সিদ্ধ হইবে না।”
“অনন্তর মহাবাহু ভীম এক প্ৰকাণ্ড দশব্যামপরিমিত মহীরুহ উৎপাটনপূর্ব্বক নিষ্পত্ৰ করিলেন; বিজয়ী অর্জ্জুনও নিমেষমধ্যে বজ্রের ন্যায় সুদৃঢ় গাণ্ডীবাশরাসনে জ্যা-রোপণ করিলেন। ভীম অর্জ্জুনকে নিবারণ করিয়া দ্রুত পদসঞ্চারে রাক্ষসসন্নিধানে উপস্থিত হইয়া “তিষ্ঠ তিষ্ঠ” এই কথা কহিলেন। পরে ক্রোধাভরে: বাহাস্ফোটন, করতলে কর-বিমর্দ্দন ও দশনে ওষ্ঠ দংশনপূর্ব্বক পাদপায়ুধসহায় হইয়া বেগে রাক্ষসের নিকট গমন করিলেন। ইন্দ্র যেমন প্রচণ্ডবেগে বজ্রঘাত করেন, তদ্রূপ ভীমসেন কালদণ্ডসদৃশ সেই মহীরুহদ্বারা রাক্ষসের মস্তকে আঘাত করিলেন। সে অব্যাকুলিতচিত্তে ভীমকৃত প্ৰহারের নির্য্যাকরণপূর্ব্বক জ্বলিত কুলিশের [বজ্রের] ন্যায় প্রদীপ্ত উল্মুকাস্ত্র নিক্ষেপ করিল। ভীম বামপাদদ্বারা তাহা দূরীকৃত করিয়া পুনর্ব্বার রাক্ষসের প্রতি ধাবমান হইলেন। ক্ৰোধপূর্ণ কিৰ্ম্মীর এক বৃক্ষ উৎপাটনপূর্ব্বক সাক্ষাৎ যমের ন্যায় যুদ্ধার্থ প্রস্তুত হইল। পূর্ব্বে স্ত্রীর নিমিত্ত বালী ও সুগ্ৰীবের যেমন ঘোরতর সংগ্রাম হইয়াছিল, তদ্রূপ ভীম ও কির্মীরের তুমুল বৃক্ষযুদ্ধ হইতে লাগিল। সেই যুদ্ধে অগণ্য বন্যপাদপ বিনষ্ট হইল। যেমন মত্ত মাতঙ্গযুথের বিলোড়নে কমলিনীদল বিদলিত হইয়া যায়, সেইরূপ উক্ত বীরযুগলের মস্তকাঘাতে মহীরুহ-সকল শতধা বিদীর্ণ ও উন্মলিত হইতে লাগিল। অনেকানেক পাদপ মৌঞ্জীতৃণের [শরমুঞ্জের] ন্যায় জর্জ্জরীভূত হইয়া চীর [ছিন্নবস্ত্ৰ] সদৃশ বোধ হইতে লাগিল। এইরূপে মুহুর্ত্তকাল উভয়ের : বৃক্ষযুদ্ধ হইল। অনন্তর নিশাচর রোষ-পরবশ হইয়া এক শিলা উত্তোলনপূর্ব্বক ভীমের প্রতি নিক্ষেপ করিল। মহাবল ভীম তাহাতে কিঞ্চিন্মাত্রও বিচলিত হইলেন না দেখিয়া সেই দুৰ্বৃত্ত অধিকতর কোপাবিষ্ট হইল। রাহু যেমন বাহুপ্রসারণপূর্ব্বক সূৰ্য্যকে গ্রাস করিবার নিমিত্ত ধাবমান হয়, তদ্রূপ সে ভীমাভিমুখে বেগে ধাবমান হইল। তখন তাঁহারা বাহুযুদ্ধে প্ৰবৃত্ত হইয়া পরস্পরকে
আক্রমণ ও আকর্ষণ করাতে প্রবৃদ্ধ বৃষভদ্বয়ের ন্যায় শোভমান হইতে লাগিলেন। নখদংষ্ট্রায়ুধ ভীষণাকার ব্যান্ত্রের ন্যায় তাঁহাদিগের যুদ্ধ অতীব ভয়ঙ্কর ও তুমুল হইয়া উঠিল। অসাধারণবালদর্পিত বৃকোদর সভামধ্যে দ্রৌপদীর আনয়ন ও দুৰ্য্যোধনকৃত নানাপ্রকার অবমাননাবশতঃ অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হইয়াছিলেন, সুতরাং এক্ষণে যেমন এক মত্ত মাতঙ্গ বিদাৰ্ণগাণ্ড অপর মত্ত মাতঙ্গকে কর [শুড়] দ্বারা আক্রমণ করে, তদ্রূপ ভীমসেন রাক্ষসকে ও রাক্ষস ভীমসেনকে বাহুদ্বারা আক্রমণ করিতে লাগিল। রাক্ষস তাহাকে আক্রমণ করিলে তিনি বাহুবলে তাহাকে দূরে নিক্ষেপ করিলেন। সেই পরাক্রান্ত বীরযুগলের ভুজনিষ্পেষহেতু ঘোরতর চপপট-ধ্বনি হইতে লাগিল। যেমন প্রচণ্ড বায়ু বৃক্ষকে ঘূর্ণিত করে, তদ্রূপ মহাবল ভীম রাক্ষসের মধ্যদেশ গ্রহণপূর্ব্বক তাহাকে চালিত করিতে লাগিলেন। নিশাচর ভীমের ঘর্ষণে নিতান্ত দুর্ব্বল ও কম্পিত হইয়াও প্রাণপণে তাঁহাকে আকর্ষণ করিতে লাগিল। বৃকোদার রাক্ষসকে একান্ত ক্লান্ত দেখিয়া পশুবন্ধনের ন্যায়, করপাশে বন্ধন করিলে সে তখন তুমুল ভেরীনির্ঘোষের ন্যায় চীৎকারস্বরে আর্ত্তনাদ করিতে লাগিল। ভীম পুনর্ব্বার তাহাকে ঘূর্ণিত করাতে সে কম্পিত ও বিচেতন হইয়া পড়িল। বৃকোদর এইরূপে তাহাকে জ্ঞানশূন্য ও অবসন্ন জানিয়া তদীয় কটিদেশে জানুপ্ৰদানপূর্ব্বক হস্তদ্বারা গলদেশ নিপীড়িত করিয়া পশুর ন্যায় বধ করিলেন। পরিশেষে তাহার সর্ব্বাঙ্গ জর্জ্জরিত ও নয়নযুগল বিদ্ধ করিয়া ভূতলে ঘর্ষণ করিতে করিতে এই কথা কহিলেন, “অরে পাপাত্মা রাক্ষসাধম! তুই যমসদনে গমন করিলেও হিড়িম্ব ও বক কখন অশ্রু বিসর্জ্জন করিবে না।” তদনন্তর অমর্ষপূৰ্ণ বৃকোদর বস্ত্রাভরণ-বিহীন, বিকম্পিত্যকলেবর ও গতাসু সেই রাক্ষসকে, পরিত্যাগ করিলেন। সেই কৃষ্ণকায় নিশাচর পঞ্চোত্বপ্রাপ্ত হইলে নরেন্দ্ৰপুত্রেরা দ্রৌপদীকে অগ্ৰে করিয়া ভীমের ভুরি ভুরি প্রশংসা করিয়া দ্বৈতবনে চলিলেন।