১১শ অধ্যায়
কর্ম্মপ্রবৃত্তির উত্তেজক পক্ষি ইন্দ্র-ঋষিসংবাদ
অর্জ্জুন কহিলেন, “মহারাজ! এই বিষয়ে তাপসগণের সহিত ভগবান্ পুরন্দরের কথোপকথন উপলক্ষে এক পুরাতন ইতিহাস কীৰ্ত্তিত আছে, আমি আপনার নিকট সেই ইতিহাস কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ করুন। পূৰ্ব্বকালে কতকগুলি অজাতশ্মশ্রু [অল্পবয়স্ক—যাহাদের দাড়ি গজায় নাই] ব্রাহ্মণ ইতস্ততঃ পরিভ্রমণ করাই যথার্থ ধৰ্ম্ম এইরূপ বিবেচনা করিয়া গৃহস্থাশ্রম পরিত্যাগপূৰ্ব্বক ব্রহ্মচারিবেশে বনে বনে পরিভ্রমণ করিতে আরম্ভ করিলেন। দেবরাজ ইন্দ্র তদ্দর্শনে তাঁহাদিগের প্রতি সদয় হইয়া হিরন্ময় পক্ষীর বেশ ধারণপূৰ্ব্বক তাঁহাদিগের সমক্ষে কহিলেন, ‘বিঘসাশীরা[যজ্ঞশেষভোজী] যে কৰ্ম্মের অনুষ্ঠান করিয়া থাকেন, প্রাকৃত মনুষ্যের পক্ষে তাহা নিতান্ত সুকঠিন; ঐ কৰ্ম্মদ্বারা পুণ্যসঞ্চয়, জীবনে সার্থকতা ও অন্তে সদ্গতিলাভ হইয়া থাকে।
“তখন সেই ঋষিগণ পক্ষীর বাক্যশ্রবণে পরস্পর কহিলেন, ‘ঐ দেখ, এই বিহঙ্গম বিঘসাশীদিগের প্রশংসা করিতেছে। আমরা বিঘসাশী, অতএব এ প্রশংসা আমাদিগেরই, তাহার আর সন্দেহ নাই।
“তখন পক্ষী কহিল, ‘হে তাপসগণ! তোমরা পঙ্কদিগ্ধাঙ্গ[কাদামাখা দেহ], রজোগুণযুক্ত, উচ্ছিষ্টভোজী ও মন্দবুদ্ধি; তোমরা কখনই বিঘসাশী নও, আমি তোমাদিগকে প্রশংসা করি নাই।
“ঋষিগণ কহিলেন, ‘বিহঙ্গম! আমরা এইরূপে অবস্থান করাই উৎকৃষ্ট ধর্ম্ম জ্ঞান করিয়া ইহাতে রত হইয়াছি। যদি ইহা অপেক্ষা কিছু শ্রেয়স্কর থাকে, তবে তাহার উপদেশ প্রদান কর। আমরা তাহাতে সম্পূর্ণ বিশ্বাস করিব।’
“পক্ষী কহিল, ‘হে তাপসগণ! যদি তোমরা আমার বাক্যে কোন আশঙ্কা না কর, তাহা হইলে আমি তোমাদিগকে যথার্থ উপদেশ প্রদান করিব।’
“ঋষিগণ কহিলেন, ‘ধৰ্ম্মাত্মন! তোমার কোন পথই অবিদিত নাই; অতএব আমরা তোমার বাক্য শ্রবণ এবং তোমার বাক্যানুসারে কৰ্ম্মানুষ্ঠান করিব, এক্ষণে তুমি আমাদিগকে উপদেশ প্রদান কর।’
মানুষজন্মে গৃহস্থধৰ্ম্মে সিদ্ধির সার্থকতা
“অনন্তর পক্ষী কহিল, “হে তাপসগণ! চতুষ্পদমধ্যে গোধন, ধাতুদ্রব্যমধ্যে সুবর্ণ, শব্দমধ্যে মন্ত্র এবং দ্বিপদমধ্যে ব্রাহ্মণই শ্রেষ্ঠ। ব্রাহ্মণের জন্মাবধি মরণ পৰ্য্যন্ত জাতকৰ্ম্মাদিদ্বারা সংস্কার হইয়া থাকে। বেদমন্ত্রোক্ত ক্রিয়াকলাপের অনুষ্ঠানই ব্রাহ্মণের স্বর্গলাভের উপায়; যে ব্যক্তি দৃঢ়বিশ্বাসসহকারে যে দেবতাকে ঈশ্বর জ্ঞান করিয়া আরাধনা করে, সে দেহান্তে সেই দেবতার সালোক্য প্রাপ্তিরূপ সিদ্ধিলাভ করিতে সমর্থ হয়। সিদ্ধিলাভ সকলেরই প্রার্থনীয়, কিন্তু কৰ্ম্ম ত্যাগ করিলে কদাপি সিদ্ধিলাভের সম্ভাবনা নাই; সুতরাং কৰ্ম্মানুষ্ঠানের প্রধান উপায় গৃহস্থাশ্রম অতিপবিত্র ও সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। যাহারা কৰ্ম্মের নিন্দা করিয়া কুপথে পদার্পণ করে, তাহারা নিতান্ত মূঢ়, অর্থহীন ও পাপাত্মা। যাহারা শাশ্বত দেবলোকগমন, পিতৃলোকগমন ও ব্রহ্মপ্রাপ্তির পথ ত্যাগ করে, তাহাদিগকে পরিশেষে কীটযোনি প্রাপ্ত হইতে হয়। গার্হস্থ্যধৰ্ম্ম অবলম্বনপূৰ্ব্বক বিবিধ পুণ্যকর্ম্মের অনুষ্ঠান করিলে যথার্থ তপানুষ্ঠান করা হয়। অতএব তোমরা ঐরূপ কার্য্যানুষ্ঠানে প্রবৃত্ত হও। প্রতিদিন যথানিয়মে দেবার্চ্চনা, পিতৃতর্পণ, ব্রহ্মোপাসনা ও গুরুর পরিচর্য্যা করা নিতান্ত সহজ ব্যাপার নহে। উহা অনুষ্ঠান করিতে পারিলেই সিদ্ধিলাভ হয়। দেখ, দেবতারা ঐরূপ দুরূহ তপানুষ্ঠান করিয়া পরম ঐশ্বৰ্য্য প্রাপ্ত হইয়াছেন। অতএব আমি তোমাদিগকে সুকঠিন গাৰ্হস্থ্যধৰ্ম্ম প্রতিপালন করিতে উপদেশ প্রদান করিতেছি। গার্হস্থ্যধৰ্ম্ম-প্রতিপালনই মানবদিগের মহাতপস্যা, সন্দেহ নাই। উহার অনুষ্ঠানদ্বারা সর্ব্বপ্রকার: সিদ্ধিলাভ করা যাইতে পারে। রাগদ্বেষশুন্য নির্ম্মৎসর ব্রাহ্মণগণ গার্হস্থ্যধৰ্ম্মানুষ্ঠানকে তপস্যা বলিয়া কীৰ্ত্তন করিয়া গিয়াছেন। হে তাপসগণ! যাহারা প্রাতঃকালে ও সায়ংকালে পিতৃলোক, অতিথি, দেবতা ও আত্মীয়গণকে অন্নপ্রদানপূর্ব্বক স্বয়ং অবশিষ্ট অন্ন ভোজন করে, তাহারাই বিঘসাশী। বিঘসাশীদিগের ন্যায় কঠোর নিয়ম অবলম্বন করিতে কেহই সমর্থ নহেন। উহারা আপনাদিগের কঠোর ব্রতানুষ্ঠানফলে ইহলোকে জনসমাজে সম্মানভাজন হইয়া অন্তে অনন্তকাল নিরাপদে ইন্দ্রলোকে বাস করিয়া থাকেন।
“হে মহারাজ! তখন ব্রাহ্মণগণ সেই বিহঙ্গের ধৰ্ম্মার্থযুক্ত বাক্যশ্রবণে গৃহস্থাশ্রম ভিন্ন অন্য আশ্রমে সিদ্ধিলাভের সম্ভাবনা নাই স্থির করিয়া সন্ন্যাসধর্ম্ম পরিত্যাগপূৰ্ব্বক গৃহস্থাশ্রম আশ্রয় করিলেন। অতএব আপনিও এক্ষণে ধৈৰ্য্যাবলম্বনপূর্ব্বক এই শত্রুশূন্য সসাগরা বসুন্ধরা শাসন করুন।”