প্রকাশকের নিবেদন
স্বামীজী আমেরিকায় তাঁহার শিষ্য সারা সি.বুলের(Mrs.Sara C.Bull) বাড়িতে কয়েকজন অন্তরঙ্গের সহিত ‘যোগ’ সম্বন্ধে যে আলোচনা করেন, মিসেস বুল তাহা লিখিয়া রাখেন। পরে ভক্ত, স্বজন ও বন্ধুবান্ধবের মধ্যে বিতরণের জন্য আমেরিকার বন্ধুগণ ১৯৯৩ খ্রীঃ তাহা প্রকাশ করেন। বর্তমান পুস্তিকা তাহারই ভাষান্তর।
ভারতীয় ইংরেজী সংস্করণ (Six Lessons on Raja Yoga) ১৯২৮ খ্রীঃ ফেব্রুআরি মাসে প্রথম প্রকাশিত হয়। প্রকাশকের নিবেদন হইতে শেষ কয়েকটি পঙক্তির অনুবাদ দেওয়া হইলঃ
এই পাঠগুলি সম্বন্ধে বলা যায়-আধ্যাত্মিক সাধনার কথা এখানে সংক্ষিপ্ত আকারে ও পরিষ্কারভাবে উপস্থাপিত, উপরন্তু আছে-বিশেষতঃ রাজযোগসাধনার বহু মূল্যবান্ ইঙ্গিত ও পথনির্দেশ।
আমেরিকান সংস্করণে পুস্তকখানির প্রচ্ছদপট এইরূপে মুদ্রিতঃ
RAJA YOGA
Six Lessons
By
Swami Vivekananda
Gift Edition
1913
প্রস্তাবনা
রাজযোগও পৃথিবীতে প্রচলিত অন্যান্য বিজ্ঞানের মতো একটি বিজ্ঞান। এই বিজ্ঞান মনের বিশ্লেষণ; অতীন্দ্রিয় জগতের তথ্যসংগ্রহ দ্বারাই এতে আধ্যাত্মিক রাজ্য গড়ে তোলা হয়। সকল দেশের মহান্ আচার্যেরাই ব’লে গেছেন, ‘দেখেছি ও জানি’। যীশু, পল ও পিটার সকলেই বলেন, তাঁদের প্রচারিত সত্য তাঁরা প্রত্যক্ষ করেছেন।
এই প্রত্যক্ষানুভূতি যোগ-লব্ধ।
স্মৃতি বা চেতনা সত্তার সীমা হ’তে পারে না; কেননা আর একটা অতীন্দ্রিয় অবস্থা আছে; সেখানে এবং অচেতন অবস্থায় কোন ইন্দ্রিয়ের অনুভূতি নেই, কিন্তু এই দুটির মধ্যে আকাশ-পাতাল তফাত, যেমন-জ্ঞান আর অজ্ঞান। যে যোগশাস্ত্র নিয়ে আমরা আলোচনা করছি, সেটা ঠিক বিজ্ঞানের মতোই যুক্তির উপর প্রতিষ্ঠিত।
মনের একাগ্রতাই হচ্ছে সমস্ত জ্ঞানের উৎস।
যোগ আমাদের শিক্ষা দেয়-কিভাবে জড়কে অধীন ক’রে রাখা যায়; জড় চিরদিন চেতনের অধীনই থাকবে।
‘যোগ’ মানে (Yoke) জুড়ে দেওয়া; অর্থাৎ জীবাত্মার সঙ্গে পরমাত্মার মিলন ক’রে দেওয়া।
মন চেতন-ভূমিতে ও তার নিম্নস্তরে কাজ করে। আমরা যাকে চেতনা বলি, সেটা আমাদের প্রকৃতির অনন্ত শৃঙ্খলের একটা শিকলি-মাত্র।
একটুখানি চেতনা নিয়ে আমাদের এই ‘আমি’, আর তার চারদিকে বিরাট অচেতন সত্তা; এই ‘আমি’র ওপারে আমাদের অজ্ঞাত অতীন্দ্রিয় ভূমি।
নিয়মিতভাবে ঠিক ঠিক যোগ অভ্যাস করলে মনের স্তর একটার পর একটা উন্মুক্ত হয়, আর প্রত্যেক স্তরে আমাদের সামনে নতুন নতুন তথ্য প্রকাশিত হয়। আমরা দেখি, যেন আমাদের সামনে নতুন জগতের সৃষ্টি হচ্ছে, আমাদের হাতে যেন নতুন নতুন শক্তি এসে পড়ছে; কিন্তু মাঝ-রাস্তায় আমরা যেন থেমে না যাই! হীরের খনি সামনে পড়ে রয়েছে, কাঁচের পুঁতি যেন আমাদের চোখে ধাঁধাঁ লাগিয়ে না দেয়।
ভগবানই আমাদের লক্ষ্য, তাঁর কাছে যেতে না পারলে আমাদের বিনাশ।
যাঁরা সাধক-সিদ্ধি লাভ করতে চান, তাঁদের তিনটি জিনিস দরকার।
প্রথমঃ ইহলোকের ও পরলোকের সব ভোগ-বাসনা ছাড়তে হবে; চাইতে হবে শুধু ভগবান্ আর সত্য।
দ্বিতীয়ঃ সত্য আর ভগবানকে লাভ করবার জন্য তীব্র আকাঙ্ক্ষা চাই। যে-মানুষ জলে ডুবছে, সে যেমন বাতাসের জন্য ব্যাকুল হয়, ঠিক তেমনি ব্যাকুল হও; সত্য ও ভগবানের জন্য ঐরকম অধীর হও।
তৃতীয়ঃ ছ-টি শিক্ষা। ১ম-মনকে বহির্মুখ হ’তে না দেওয়া। ২য়-মনকে অন্তর্মুখ ক’রে একটা ভাবে আবদ্ধ রাখা। ৩য়-প্রতিবাদ না ক’রে সব জিনিস সহ্য করা। ৪র্থ-শুধু ঈশ্বরকে চাও, আর কিছুই নয়। আপাত-মনোরম বিষয় আর যেন তোমাকে ঠকাতে না পারে। সব ত্যাগ ক’রে শুধু ভগবানকেই চাও। ৫ম-উপস্থিত কোন একটা বিষয় নাও, তার শেষ পর্যন্ত বিচার কর, সমাধান না ক’রে ছেড়ো না। সময়ের হিসাব ক’রো না। আমাদের জীবন সত্যকে জানবার জন্য, ইন্দ্রিয়তৃপ্তির জন্য নয়; ইন্দ্রিয়তৃপ্তি পশুরা করুক, আমরা কখনও তাদের মতো ভোগ করতে পারি না। মানুষ মননশীল; মৃত্যুকে সে যতদিন না জয় করে, যতদিন না আলোকের সন্ধান পায়, ততদিন সে সংগ্রাম করবেই। নিষ্ফল বৃথা কথাবার্তায় সে নিজের শক্তিক্ষয় করবে না। সামাজিকতা ও লোকমতের পূজাই হচ্ছে পৌত্তলিকতা। আত্মা-লিঙ্গহীন, জাতিহীন, দেশহীন ও কালহীন। ৬ষ্ঠ-সর্বদা নিজের স্বরূপ চিন্তা কর। কুসংস্কারের পারে যাও। ক্রমাগত ‘আমি ছোট, আমি ছোট’-এই ভেবে নিজেকে ছোট ক’রে ফেলো না; যতদিন না ব্রহ্মের সঙ্গে অভেদজ্ঞান(অপরোক্ষানুভূতি) হচ্ছে, ততদিন দিনরাত্র নিজেকে বলো-তোমার স্বরূপের কথা।
এই সব কঠোর সাধননিষ্ঠা ব্যতীত কোন ফল-লাভ সম্ভব নয়।
নিরপেক্ষ পরব্রহ্ম উপলব্ধি করতে পারি, কিন্তু আমরা কখনও তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারি না; যে মুহূর্তে প্রকাশ করতে যাই, তখনি তাঁকে সীমাবদ্ধ ক’রে ফেলি; ফলে অনন্ত হয়ে পড়েন সান্ত।
ইন্দ্রিয়ের সীমা ছাড়িয়ে যেতে হবে, বুদ্ধিকেও অতিক্রম করতে হবে; আর এ শক্তি আমাদের কাছে।
প্রাণায়ামের প্রথম সাধন এক সপ্তাহ অভ্যাস ক’রে শিষ্য গুরূকে জানাবে।