৯ম অধ্যায়
যুধিষ্ঠিরের অপ্রবোধ-বৈরাগ্যের অবতারণা
যুধিষ্ঠির কহিলেন, “অৰ্জ্জুন! তুমি ক্ষণকাল একাগ্রচিত্ত হইয়া আমার বাক্য শ্রবণ কর, তাহা হইলেই আমার বাক্যে তোমার শ্রদ্ধা থাকিবে। আমি কি তোমার অনুরোধে সাধুজনসেবিত পথ অবলম্বনে পরাঙ্মুখ হইব! কখনই নহে। আমি নিশ্চয়ই গ্রাম্যসুখ [স্ত্রীবিলাসাদি] পরিত্যাগপূৰ্ব্বক অরণ্যে প্রস্থান করিব। এক্ষণে একাকী কোন্ পথে গমন করিলে শ্রেয়োলাভ করিতে পারি, এই প্রশ্ন করাই তোমার কৰ্ত্তব্য। অথবা তুমি জিজ্ঞাসা না করাতেই আমি কহিতেছি, শ্রবণ কর। আমি গ্রাম্যসুখ ও গ্রাম্য-আচার পরিহারপূর্ব্বক অরণ্যে ফলমূল ভক্ষণ করিয়া মৃগদিগের সহিত সঞ্চরণ করিব, মিতাহারী ও চৰ্ম্মচীরজটাধারী হইয়া দুই সন্ধ্যা সলিলে অবগাহনপুৰ্ব্বক নিয়মিত সময়ে হুতাশনে আহুতিপ্ৰদান করিব, ক্ষুৎপিপাসা[ক্ষুধাতৃষ্ণা], শ্রান্তি, শীত, আতপ ও বায়ুজনিত ক্লেশ সহ্য করিয়া অতিকঠোর তপানুষ্ঠানপূর্ব্বক শরীর শুষ্ক করিব এবং অরণ্যচারী একান্ত হৃষ্ট মৃগ ও পক্ষিগণের শ্রুতিসুখকর কলরব শ্রবণ, নানাপ্রকার পুষ্পের কোমল গন্ধ আঘ্রাণ ও অরণ্যস্থ বিবিধ রমণীয় বস্তু নিরীক্ষণ করিব। গ্রামবাসীদিগের কথা দূরে থাকুক, বনবাসীদিগেরও কোন অপকার করিব না। একাগ্রচিত্তে সমস্ত বিষয় বিবেচনা, পক্ক[পাকা] ও অপক্ক ফল ভক্ষণ এবং বনজাত দ্রব্য ও সুস্বাদু সলিলে পিতৃ ও দেবগণের তৃপ্তিসাধন করিব। এইরূপ অতিকঠোর আরণ্যক আচার প্রতিপালন করিয়া প্রাণান্তকাল প্রতীক্ষা করিয়া থাকিব; অথবা মুণ্ডিতমুণ্ড[মুণ্ডিতমস্তক-মাথা মুড়াইয়া] মুনি হইয়া একাকী প্রত্যেক বৃক্ষতলে এক-এক দিবস ভিক্ষাৰ্থ পর্য্যটন করিতে করিতে কলেবর পরিত্যাগ করিব। আমি গৃহ এবং প্রিয় ও অপ্রিয় বস্তুসমুদয় পরিত্যাগপূৰ্ব্বক বৃক্ষমূল আশ্রয় করিয়া নিরন্তর ধূলিজালে ধূসরিত হইয়া থাকিব। শোক বা হর্ষে কদাচ অভিভূত হইব না। স্তুতি ও নিন্দাবাদে আমার সমান জ্ঞান থাকিবে এবং আমি পরিগ্রহ ও মমতা পরিত্যাগপূৰ্ব্বক জড়, অন্ধ ও বধিরাকার হইয়া সতত প্রসন্নমনে অবস্থান করিব। স্বধৰ্ম্মনিরত স্থাবরজঙ্গমাত্মক চতুৰ্ব্বিধ প্রজাগণের প্রতি কদাচ হিংসা প্রকাশ বা কাহারও সহিত বাক্যালাপ করিব না। সকল জীবের প্রতি অপক্ষপাতিত্য প্রদর্শন করিব। কাহারও প্রতি কখন ভূভঙ্গী [ভ্রূকুটি] ও উপহাস করিব না। ইন্দ্রিয়সংযম করিয়া সতত প্রসন্নমুখে অবস্থান করিব। কাহাকে পথ জিজ্ঞাসা না করিয়া কামক্রোধাদিশূন্যচিত্তে যেকোনও একটি পথ অবলম্বনপূৰ্ব্বক গমন করিব। কোন দেশ বা কোন দিক লক্ষ্য করিয়া গমন অথবা গমনকালে পশ্চাদ্ভাগ অবলোকন করিব না। দেহ ও আত্মার অভিমান পরিত্যাগ করিব। স্বভাব সকলের অগ্রে অগ্রে গমন করিয়া থাকে, তন্নিবন্ধন আমাকে অবশ্যই আহার করিতে হইবে। কিন্তু আমি অল্পভোজনাদিজনিত ক্লেশ এককালে পরিত্যাগ করিব। এক গৃহে অল্পপরিমাণেও ভিক্ষা পাইলে অন্য গৃহে এবং তথায় ভিক্ষাপ্রাপ্ত না হইলে আর এক গৃহে ভিক্ষা প্রার্থনা করিব। যেদিন কোথাও কিছু না পাইব, সেদিন আমার নিরাহারেই অতিবাহিত হইবে। গৃহসকল মূষলশব্দ[উখলীতে তণ্ডুলাদি নির্ম্মাণ শেষ ও রন্ধনান্তে নির্ব্বাপিতবহ্নি], ধূম ও অগ্নিহীন, গৃহস্থগণের ভোজনব্যাপার সুসম্পন্ন ও অতিথিসঞ্চারবিরহিত [সমাগত অতিথির ভোজনাদি সমাপ্তি] হইলে আমি এককালে দুই, তিন বা পাঁচ গৃহে ভিক্ষাৰ্থ সঞ্চরণ করিব। আশপাশ হইতে এককালে বিমুক্ত হইব। লাভ ও ক্ষতি উভয়ই আমার পক্ষে সমান হইবে। আমি কদাচ জীবিতাভিলাষী বা মুমূর্ষুর ন্যায় ব্যবহার করিব না। জীবন ও মৃত্যুতে হর্ষ বা বিদ্বেষ প্রকাশ করিব না। এক ব্যক্তি কুঠারদ্বারা আমার এক হস্ত ছেদন ও অন্য ব্যক্তি আমার অপর হস্তে চন্দনানুলেপন করিতে প্রবৃত্ত হইলে আমি সেই দুই ব্যক্তির শুভ বা অশুভ কিছুই প্রার্থনা করিব না। জীবিত ব্যক্তি যেসকল উন্নতিজনক কাৰ্য্য সম্পাদন করিতে সমর্থ হয়, আমি সেই সেই কার্য্যে একান্ত পরাঙ্মুখ হইয়া কেবল দেহমাত্র ধারণ করিব। আমি কোন কাৰ্য্যেই লিপ্ত হইব না; সমুদয় ইন্দ্রিয়ব্যাপার পরিহার করিব; বিষয়বাসনাকে মনেও স্থান প্রদান করিব না; আত্মাকে পাপ হইতে বিমুক্ত করিব; অসত্ত্বাৰ্য্যরূপ পাশ হইতে অন্তরিত হইব এবং বায়ুর ন্যায় কাহারও আয়ত্ত হইব না”।
“হে অর্জ্জুন! আমি এইরূপে বৈরাগ্য অবলম্বন করিয়া শাশ্বত সন্তোষ লাভ করিব। আমি বিষয়বাসনাপরতন্ত্র হইয়া ঘোরতর পাপানুষ্ঠান করিয়াছি। অনেকানেক লোক উৎকৃষ্ট ও অপকৃষ্ট কার্য্যের অনুষ্ঠান করিয়া আপনার পার্থিব সুখস্বাচ্ছন্দ্যের নিদানভূত ভাৰ্য্যা প্রভৃতি পরিবারবর্গকে প্রতিপালন করিয়া থাকে, কিন্তু তাহাদিগকে দেহাবসানে সেইসমুদয় কৰ্ম্মের ফলভোগ করিতে হয়। এই সংসার রথচক্রের ন্যায় নিরন্তর ভ্রমণ করিতেছে। ইহাতে জীবগণ কর্ম্মসূত্রে বদ্ধ হইয়া জীবগণের সহিত সমাগত হয়। এই নিতান্ত অকিঞ্চিৎকর সংসার জন্ম, মৃত্যু, জরা, ব্যাধি ও বেদনায় নিতান্ত সমাকীর্ণ রহিয়াছে। যে ব্যক্তি ইহা পরিত্যাগ করিতে পারেন, তিনিই যথার্থ সুখলাভে সমর্থ হয়েন। দেবগণকে স্বর্গ হইতে এবং মহর্ষিগণকে স্ব স্ব স্থান হইতে পরিভ্রষ্ট হইতে দেখিয়া কোন্ সূক্ষ্মদর্শী ব্যক্তি সংসারবাসের বাসনা করিবেন? আর দেখ, একজন রাজা নানাপ্রকার কার্য্যানুষ্ঠান করিয়া পরিশেষে সামান্য কারণে অন্যান্য ভূপালগণকর্ত্তৃক নিহত হইয়া থাকেন।
“হে অর্জ্জুন! বহুকালের পর আমার এই দিব্যজ্ঞান জন্মিয়াছে। জ্ঞানপ্রভাবে আমি শাশ্বত স্থানলাভের অভিলাষ করিয়াছি। অতঃপর নিরন্তর ঐরূপ ধৈৰ্য্যসহকারে নির্ভয়পথ অবলম্বনপূর্ব্বক বিচরণ করিয়া এই জন্ম, মৃত্যু, জরা, ব্যাধি ও বেদনায় অভিভূত পাঞ্চভৌতিক দেহ পরিত্যাগ করিব।”