৯ম অধ্যায়
বৃত্ৰবধার্থ ইন্দ্রসহ দেবগণের বিষ্ণুস্তব
“ইন্দ্ৰ কহিলেন, “হে দেবগণ! বৃত্ৰাসুরের দৌরাত্ম্যে এই জগতীতলস্থ সমস্ত লোক নিতান্ত পরিপীড়িত হইয়াছে; কিন্তু আমার এমন কিছুই নাই যে, তদ্বারা তাঁহাকে সংহার করিতে সমর্থ হই। পূর্ব্বে আমার সামর্থ্য ছিল, সম্প্রতি অসমর্থ হইয়াছি; কি প্রকারে তোমাদিগের উপকার করিব? অতি দুৰ্দ্ধৰ্ষ, তেজস্বী ও সংগ্রামে অপরিমিত পরাক্রমশালী মহাত্মা বৃত্ৰাসুর সুরাসুর নরশালী [দেব, দানব ও মানুষ পরিপূর্ণ] ত্ৰিভুবন গ্ৰাস করিতে উদ্যত হইয়াছে; এই নিমিত্ত স্থির করিয়াছি যে, বিষ্ণুলোকে গমনপূর্ব্বক মহাত্মা বিষ্ণুর সহিত মন্ত্রণা করিয়া ঐ দুরাত্মার বধোপায় অবধারণ করিব।”
“মেঘবানের [ইন্দ্র] বাক্যাবসানে বৃত্ৰাসুরভয়বিহ্বল দেব ও ঋষিগণ পরমশরণ্য বিষ্ণুদেবের শরণাপন্ন হইয়া সত্ব করিতে লাগিলেন, ‘হে অমরোত্তম! তুমি পূর্ব্বে ত্রিবিক্রমপ্রভাবে লোকত্ৰয় আক্রমণ, অমৃত আহরণ ও অসুরগণ সংহার করিয়াছ; তুমি দৈত্যরাজ বলিকে বন্ধন করিয়া দেবরাজ ইন্দ্রকে সুররাজ্যে অভিষিক্ত করিয়াছ; তুমি সমস্ত দেবগণের প্রভু ও চরাচরের অধীশ্বর; দেব ও মহাদেব এবং সকল লোকের নমস্য; এক্ষণে আমাদিগকে বৃত্ৰভয় হইতে পরিত্রাণ কর। হে অসুরসূদন! সেই দুরাত্মা সমুদয় জগৎ আক্রমণ করিয়াছে।”
দেবগণস্তবে তুষ্ট বিষ্ণুকর্ত্তৃক বৃত্ৰবধোপায়নির্ণয়
“বিষ্ণু কহিলেন, “হে দেবগণ! তোমাদের হিতসাধন করা আমার অবশ্য কর্ত্তব্য; অতএব যে উপায়ে ঐ দুরাত্মা নিহত হইবে, শ্রবণ কর। তোমরা সকলে গন্ধর্ব্ব ও ঋষিগণসমভিব্যাহারে বিশ্বরূপী বৃত্ৰাসুরের আলয়ে গমন করিয়া সামোপায় প্রয়োগ কর। আমি অদৃশ্যরাপে আয়ুধশ্রেষ্ঠ বজ্রে প্রবিষ্ট হইব। আমার তেজে দেবরাজের অবশ্যই জয়লাভ হইবে; অতএব তোমরা শীঘ্ৰ গমন করিয়া বৃত্ৰাসুরের সহিত সন্ধিসংস্থাপন কর।”
“ইন্দ্ৰাদি দেবগণ গন্ধর্ব্ব ও ঋষিগণের সহিত বিষ্ণুর বাক্যানুসারে বৃত্রাসুরের আলয়ে গমন করিয়া দেখিলেন মহাতেজঃ বৃত্ৰাসুর চন্দ্ৰসূৰ্য্যের ন্যায় স্বীয় তেজে দশদিক সন্তাপিত ও লোকত্ৰয়কবলিত করিতেছে।
“অনন্তর ঋষিগণ তাহার সন্নিহিত হইয়া প্ৰিয়বাক্য কহিলেন, ‘হে দুৰ্জয়! তোমার তেজে সমুদয় জগৎ ব্যাপ্ত ও সন্তপ্ত হইতেছে এবং বাসবের সহিত যুদ্ধ করিতে অতি দীর্ঘকাল অতিক্রান্ত হইয়াছে; তথাপি তাঁহাকে পরাজিত করিতেও সমর্থ হও নাই; এক্ষণে কেবল দেবাসুর, মানুষপ্রকৃতি প্ৰজাগণ নির্ভর [নিরতিশয়] নিপীড়িত হইতেছে; অতএব সুররাজের সহিত চিরকালের নিমিত্ত সন্ধিবন্ধন করা কর্ত্তব্য; তাহা হইলে তুমি পরমসুখে সনাতন শক্ৰলোক অধিকার করিতে পরিবে।”
“মহাবল বৃত্ৰ ঋষিবাক্য শ্রবণ করিয়া তাঁহাদিগকে প্ৰণিপাতপূর্ব্বক কহিল, “হে মহাভাগগণ! তেজস্বিদ্বয়ের পরস্পর সখ্যসংস্থাপন নিতান্ত অসম্ভব, আমরা উভয়েই তেজস্বী; সুতরাং কি প্রকারে আমার সহিত ইন্দ্রের সন্ধিসংস্থাপন হইবে?”
“ঋষিগণ কহিলেন, “সাধুগণের সহিত অন্ততঃ একবারও মিলিত হওয়া কর্ত্তব্য; পশ্চাৎ যাহা ভবিতব্য, তাহাই হইবে; সাধুসমাগম পরিত্যাগ করা কোনক্রমেই উচিত নহে। ধীর ব্যক্তি অর্থকৃচ্ছ্র-সময়ে সাধুসঙ্গকেই অর্থ বলিয়া নির্দ্দেশ করেন। ফলতঃ সৎপুরুষ-সহবাস মহামূল্য রত্নস্বরূপ, এই নিমিত্ত পণ্ডিতেরা সাধুগণের হিংসা করেন না। দেবরাজ ইন্দ্র মনীষিগণের মাননীয়, মহাত্মাদিগের আশ্রয়, সত্যবাদী, অনিন্দনীয়, ধৰ্মজ্ঞ ও সূক্ষ্মদৰ্শী; অতএব তাঁহার সহিত তোমার স্থিরতর সন্ধিসংস্থাপন করা কর্ত্তব্য, তুমি এ বিষয়ে বিশ্বস্ত হও; তোমার বুদ্ধি যেন অন্যথাভূত না হয়।”
“মহাদ্যুতি বৃত্ৰাসুর মহর্ষিগণের বাক্য শ্রবণ করিয়া কহিল, “হে দ্বিজগণ! আপনারা আমার মাননীয়, তাহাতে সন্দেহ নাই; কিন্তু ইন্দ্ৰাদি দেবগণ আমার নিকটে যদি এইরূপ অঙ্গীকার করেন যে, তাহারা শুষ্ক বা আদ্ৰ বস্তু, প্রস্তর বা কাষ্ঠ, অস্ত্র বা শস্ত্রদ্বারা দিবাভাগে কিংবা রাত্রিকালে আমাকে বধ করিবেন না, তাহা হইলে আমি আপনাদের বাক্য রক্ষা করি।” ঋষিরা “তথাস্তু” বলিয়া অঙ্গীকার করিলেন। তখন বৃত্ৰাসুর অসীমহর্ষসাগরে নিমগ্ন হইল।
ইন্দ্রকর্ত্তৃক বৃত্রাসুরবধ
“এ দিকে পুরন্দর সন্ধিসংঘটনে আহ্লাদিত হইলেন বটে, কিন্তু সর্ব্বদা উদ্বিগ্নচিত্তে বৃত্ৰাসুরের বধোপায় চিন্তা ও তাহার ছিদ্রান্বেষণ করিতে লাগিলেন। একদা নিদারুণ মুহূর্ত্তসমন্বিত সন্ধ্যাকালে সমুদ্রতীরে ঐ মহাসুরকে অবলোকন করিয়া চিন্তা করিলেন, এই ভীষণ সন্ধ্যাকালে দিবাও নয়, রজনীও নয়, এই সময় আমার সর্ব্বস্বাপহারী বৃত্রাসুরকে নিহত করিলে ঋষিগণদত্ত বরের কিছুমাত্র ব্যতিক্রম হইবে না; কিন্তু আজি উহাকে বঞ্চনাপূর্ব্বক সংহার না করিলে কোনক্রমে আমার মঙ্গলের সম্ভাবনা নাই।” দেবরাজ এইরূপ মনে করিয়া ভগবান বিষ্ণুকে স্মরণ করিতেছেন, এমন সময়ে সমুদ্র-সলিলোপরি পর্ব্বতোপম ফেনরাশি নয়নগোচর করিয়া বিবেচনা করিলেন, “এই ফেনরাশি শুষ্ক, আদ্র বা শস্ত্র নয়; ইহা নিক্ষেপ করিলে ক্ষণমাত্ৰেই ইহার প্রাণ বিনষ্ট হইবে, তাহাতে সন্দেহ নাই।” অনন্তর সবজ্র ফেনরাশি বৃত্ৰাসুরের উপর নিক্ষিপ্ত হইবামাত্র ভগবান বিষ্ণু তাহাতে প্রবিষ্ট হইয়া বৃত্ৰাসুরকে বিনষ্ট করিলেন।
“বৃত্রাসুর বিনিষ্ট হইলে দিকসকল প্রসন্ন হইয়া উঠিল, সমীরণ মন্দ মন্দ প্রবাহিত হইতে লাগিল, প্ৰজাসকল পরম আহ্লাদিত হইল; দেব, গন্ধৰ্ব, যক্ষ, রক্ষ, ভুজগ ও ঋষিগণ দেবরাজের নানাবিধ স্তব করিতে আরম্ভ করিলেন। ধর্ম্মজ্ঞ দেবরাজ এইরূপে সর্ব্বপ্রাণীকর্ত্তৃক নমস্কৃত হইয়া সকলকে সাত্ত্বনাপূর্ব্বক দেবগণসমভিব্যাহারে ত্ৰিভুবনশ্রেষ্ঠ বিষ্ণুকে পূজা করিলেন।
ব্ৰহ্মহত্যা-পাপলিপ্ত ইন্দ্রের নিরুদ্দেশ
“দেবরাজ ইতিপূর্ব্বে ত্রিশিরাকে বিনিষ্ট করিয়া ব্রহ্মগত্যাজনিত পাতকে বিলিপ্ত হইয়াছিলেন; সম্প্রতি আবার মিথ্যায় অভিভূত হইয়া নিতান্ত দুৰ্মনায়মান হইলেন। তিনি স্বকৃত পাপসমূহে হতচেতন হইয়া জগতের প্রান্তবর্ত্তী সলিল মধ্যে প্রচ্ছন্ন হইয়া বিচেষ্টমান ভুজঙ্গের ন্যায় অধিষ্ঠান করিতে লাগিলেন। ব্রহ্মহত্যাভয়াভিভূত দেবরাজ ইন্দ্র নিরুদ্দেশ হইলে এই সমস্ত মেদিনীমণ্ডল বিনষ্টপ্ৰায় এবং কাননসকল শুষ্ক ও তরুবিহীন হইয়া উঠিল; স্রোতস্বতীর প্রবলপ্রবাহ একেবারে রুদ্ধ হইল; জলাশয়সকল সলিলশূন্য হইতে লাগিল; প্রাণীগণ অনাবৃষ্টিনিবন্ধন সংক্ষোভিত এবং সমুদয় জগৎ অরাজক ও উপদ্রবে পরিপূর্ণ হইল। অন্যের কথা দূরে থাকুক, দেবতা ও ঋষিগণও সাতিশয় ভীত হইয়া, কোন ব্যক্তি রাজা হইবে, এই শঙ্কা করিতে লাগিলেন এবং দেবরাজের অভাবে সেই দেবরাজ তাহাদিগের পক্ষে কোনক্রমেই সুখকর বোধ হইল না।”