নবম অধ্যায়
ডুণ্ডুভ-উপাখ্যান
সৌতি কহিলেন, সেই সকল মহাত্মা দ্বিজগণ তথায় উপবিষ্ট হইলে, রুরু সাতিশয় দুঃখিত হইয়া অরণ্যানী প্রবেশপূর্ব্বক উচ্চৈঃস্বরে রোদন করিতে লাগিলেন এবং শোকে একান্ত ব্যাকুল হইয়া স্বীয় প্রিয়তমা প্রমদ্বরাকে স্মরণ করিয়া করুণস্বরে এইরূপে বিলাপ করিতে লাগিলেন – “আমার ইহা অপেক্ষা আর দুঃখের বিষয় কি হইতে পারে যে, আমার ও বন্ধুবর্গের শোকবর্দ্ধিনী সেই সর্ব্বাঙ্গ সুন্দরী রমণী ধরাতলে পড়িয়া আছে? আমি যদি দান, তপশ্চরণ ও গুরুজনের শুশ্রূষা করিয়া থাকি, তবে আমার প্রিয়া পুনঃসঞ্জীবিত হউক। আমি জন্মাবধি আত্মসংযম ও ব্রতানুষ্ঠান করিয়া যে-সকল পুণ্যসঞ্চয় করিয়াছি, এক্ষণে আমার প্রাণপ্রিয়া প্রমদ্বরা সেই পুণ্যবলে ভূমিশয্যা হইতে গাত্রোত্থান করুক।”
রুরু স্বীয় প্রিয়তমা প্রমদ্বরাকে উদ্দেশ করিয়া এইরূপে বিলাপ করিতেছেন, ইত্যবসরে দেবদূত তৎসন্নিধানে আসিয়া কহিলেন, “রুরু! তুমি দুঃখার্ত্ত হইয়া যেরূপ প্রার্থনা করিতেছ, উহা নিতান্ত অসম্ভব; যেহেতু, মনুষ্য একবার কালগ্রাসে পতিত হইলে আর কদাচ পুনর্জ্জীবিত হয় না। এই প্রমদ্বরা গন্ধর্ব্বের ঔরসে অপ্সরাগর্ভে জন্মগ্রহণ করে, এক্ষণে আয়ুঃশেষ হইয়াছে বলিয়া মৃত্যুমুখে পতিত হইয়াছে। অতএব হে বৎস! তুমি আর শোকসাগরে নিমগ্ন হইও না। পূর্ব্বে দেবগণ এই বিষয়ে একটি উপায় নির্দ্দেশ করিয়াছেন, যদি তাহা করিতে পার, তবে পুনর্ব্বার প্রমদ্বরাকে লাভ করিতে পারিবে।” রুরু কহিলেন, “হে দেবদূত! দেবগণ এই বিষয়ে কি উপায় স্থির করিয়াছেন, যথার্থ করিয়া বল, আমি এই দণ্ডেই তদনুযায়ী কর্ম্ম করিব।” দেবদূত কহিলেন, “হে ভৃগুনন্দন! তুমি স্বীয় ভার্য্যাকে আপনার পরমায়ুর অর্দ্ধেক প্রদান কর, তাহা হইলেই সে পুনর্জ্জীবিতা হইবে।” রুরু কহিলেন, “আচ্ছা আমি প্রমদ্বরাকে আপন পরমায়ুর অর্দ্ধভাগ প্রদান করিলাম, সে মৃত্যুশয্যা হইতে গাত্রোত্থান করুক।” তখন গন্ধর্ব্বরাজ ও দেবদূত উভয়ে-যম-সমীপে গমন করিয়া নিবেদন করিলেন, “হে ধর্ম্মরাজ! যদি আপনি অনুমতি করেন, তবে রুরুর মৃতভার্য্যা প্রমদ্বরা স্বীয় ভর্ত্তার অর্দ্ধায়ু লইয়া পুনর্জ্জীবিত হয়।” ধর্ম্মরাজ কহিলেন, “হে দেবদূত! যদি তোমার ইচ্ছা হইয়া থাকে, তবে রুরুপত্নী রুরুর অর্দ্ধ পরমায়ু পাইয়া পুনর্জ্জীবিত হউক।” ধর্ম্মরাজ এই কথা কহিবামাত্র প্রমদ্বরা রুরুর অর্দ্ধ পরমায়ু প্রাপ্ত হইল এবং তৎক্ষণাৎ সুপ্তোত্থিতার ন্যায় ধরাতল হইতে গাত্রোত্থান করিল। এইরূপে প্রমদ্বরা পুনর্জ্জীবিত হইলে, রুরুর পিতা এবং প্রমদ্বরার পিতা উভয়ে আনন্দ-সাগরে মগ্ন হইয়া শুভলগ্নে পুৎত্র-কন্যার বিবাহবিধি নির্ব্বাহ করিলেন। তাঁহারাও পরস্পরের হিতসাধনে তৎপর হইয়া পরমানন্দে কালাতিপাত করিতে লাগিলেন। রুরু এইরূপে কমলসমপ্রভা সুদুর্লভা প্রিয়তমাকে পুনর্লাভ করিয়া সর্পবংশ ধ্বংস করিতে প্রতিজ্ঞারূঢ় হইলেন। সর্প অবলোকন করিবামাত্র তিনি ক্রোধে কম্পান্বিত-কলেবর হইয়া শস্ত্রাঘাতে তাহাকে বিনাশ করিতেন।
একদা তিনি এক নিবিড় অরণ্যানী প্রবেশ করিয়া দেখিলেন, এক অতি জীর্ণ-কলেবর ডুণ্ডুভ সর্প শয়ন করিয়া রহিয়াছে। রুরু তাহাকে দেখিবামাত্র ক্রোধান্ধ হইয়া যমদণ্ডের ন্যায় নিজ দণ্ড উদ্ধৃত করিয়া তাহার নিধন-সাধনে উদ্যত হইলেন। ডুণ্ডুভ তাঁহাকে জিঘাংসু দেখিয়া কহিল, “হে তপোধন! আমি ত’ তোমার কোন অপরাধ করি নাই, তবে কেন অকারণে রোষপরবশ হইয়া আমার প্রাণবধে উদ্যত হইতেছ?”