মধুর বচনে কহিছেন জগন্নাথ।
যুধিষ্ঠির আগে যোড় করি পদ্ম হাত।।
দ্বারকা ছাড়িয়া আমি নিকটে থাকিলে।
নিবৃত্ত করিতে পারিতাম দ্যূতকালে।।
অন্ধেরে নিবৃত্ত করিতাম শাস্ত্রবলে।
পাশা-আদি নীচকর্ম্মে বহু দোষ ফলে।।
মৃগয়া মদিরাপান পাশা ও স্বৈরিণী।
এ চারি অনর্থ হেতু, করে লক্ষ্মীহানি।।
বিশেষে দেবন দোষ সর্ব্বশাস্ত্রে কয়।
পাশায় এ সব দোষ একক্ষণে হয়।।
বহুমতে দ্যূত করিতাম নিবারণ।
না শুনিলে রণ করিতাম সেইক্ষণ।।
নতুবা পাশাকে চক্রে করিতাম ছেদ।
আমি তথা থাকিলে না হত ভেদাভেদ।।
এ সকল বৃত্তান্ত কহিল যুযুধান।
শ্রুতমাত্র নৃপতি এলাম তব স্থান।।
তোমার এ বেশ বনে ফল মূলাহার।
তব দুঃখ নয় রাজা সকলি আমার।।
যুধিষ্ঠির বলিলেন, শুন নারায়ণ।
আসিতে বিলম্ব এত কিসের কারণ।।
মুহূর্ত্তেকে ভ্রমিবারে পার তিন পুর।
তোমার হস্তিনাপুর কত বড় দূর।।
গোবিন্দ বলেন, রাজা নহে অপ্রমাণ।
যেই হেতু নাহি আসি, কর অবধান।।
শাল্ব নামে মহাবল দৈত্যের ঈশ্বর।
সসৈন্যে বেড়িয়াছিল দ্বারকা নগর।।
তব রাজসূয় হতে গেলাম যখন।
সবারে পীড়িল দুষ্ট করি মায়া রণ।।
আমার সহিত যুদ্ধ হৈল বহুতর।
বহু কষ্টে তারে মারিলাম নরেশ্বর।।
এত শুনি যুধিষ্ঠির পুনঃ জিজ্ঞাসিল।
কত শুনি, শাল্ব কে দ্বারকা হিংসিল।।
তোমর সহিত কেন বৈরিতা হইল।
কার হিত কারণ সে দ্বারকা আইল।।
কোন মায়া ধরে দুষ্ট, কত করে রণ।
বিস্তারি আমারে কহ শ্রীমধুসূদন।।
গোবিন্দ বলেন, শুন পাণ্ডুর নন্দন।
তব রাজসূয়-যজ্ঞ অনর্থ কারণ।।
শিশুপাল আমা হৈতে হইল নিধন।
সেই বৈর বৃক্ষ বীজ হইল রোপন।।
শিশুপাল বিনাশ শুনিয়া দৈত্যেশ্বর।
সসৈন্যে বেড়িল আসি দ্বারকা নগর।।
দ্বারকার লোক তার আগমন শুনি।
উগ্রসেন আদি সবে সাজিল বাহিনী।।
দ্বারকা পশিতে যত নৌকাপথ ছিল।
সকল স্থানের নৌকা ডুবাইয়া দিল।।
লোহার কণ্টক সব পৌঁতাইল পথে।
ক্রোশেক পর্য্যন্ত বিষ রাখিল জলেতে।।
ধন রত্ন রাখে সব গর্ত্তের ভিতর।
রক্ষক উদ্ধব উগ্রসেন নৃপবর।।
আসিতে যাইতে লোক করে নিবারণ।
বিনা চিহ্নে তথা নাহি চলে কোন জন।।
চিহ্ন পেলে রক্ষকেরা ছাড়ি দেয় পথ।
দৈত্যভয়ে সুরপুর রাখে যেই মত।।
সৌভপতি আইল সে চতুরঙ্গ দলে।
পৃথিবী কম্পিত হল রথ কোলাহলে।।
চতুর্দ্দিকে দ্বারকা সে রহিল বেড়িয়া।
বহু সৈন্য জলে স্থলে রহিল যুড়িয়া।।
দেবালয় শ্মশান সৈন্যে পূর্ণিত কৈল।
দৈত্যের যতেক বাহিনী হুহুঙ্কারিল।।
দেখিয়া দৈত্যের সৈন্য বৃষ্ণি বংশগণ।
বাহির হইল তবে করিবারে রণ।।
চারুদেষ্ণ শাম্ব গদ প্রদ্যুন্ন সারণ।
সসৈন্যে বাহির হৈল করিবারে রণ।।
ক্ষেমবৃদ্ধি নামেতে শাল্বের সেনাপতি।
সে যুদ্ধ করিল শাম্ব-কুমার সংহতি।।
মহাবল শাম্ব জাম্ববতীর নন্দন।
অস্ত্রবৃষ্টি কৈল যেন জল বরিষণ।।
সহিতে না হরি রণে ভঙ্গ দিয়া গেল।
ক্ষেমবৃদ্ধি ভঙ্গ দেখি সৈন্য পলাইল।।
বেগবান্ নামে দৈত্য আছিল তাহার।
আগুবাড়ি শাম্ব সহ যুঝিল অপার।।
শাম্বের হস্তেতে মহাগদা যে আছিল।
তাহার প্রহারে বেগবান্ সে পড়িল।।
বিবিন্ধ্য নামেতে দৈত্য আসিয়া রুষিল।
নানা অস্ত্রে দুই বীরে মহাযুদ্ধ হৈল।।
মহাবীর চারুদেষ্ণ রুক্মিণী তনয়।
অগ্নিবাণে সকল করিল অগ্নিময়।।
সেই বাণে ভস্ম হৈল বিবিন্ধ্য অসুর।
যার ভয়ে সদাই কম্পয়ে সুরপুর।।
সেনাপতি পড়িল, পলায় সেনাগণ।
সৈন্যভঙ্গ দেখি শাল্ব আইল তখন।।
জিনিয়া মেঘের ধ্বনি তাহার গর্জ্জন।
দেখি ভয়যুক্ত হৈল দ্বারকার জন।।
সৌভ নামে তার পুরী, কামাচার গতি।
ক্ষণেক আকাশে উঠে, ক্ষণে বৈসে ক্ষিতি।।
অশ্ব রথ পদাতিক না যায় গণন।
বিষম আয়ুধ ধরে সব সেনাগণ।।
শাল্বে দেখি বিকম্পিত হৈল সব বীর।
বাহির হইল কাম নির্ভর শরীর।।
নির্ভয় করিয়া যত দ্বারকার জনে।
আইল মকরধ্বজ রথ আরোহণে।।
অপ্রমিত যুদ্ধ হৈল শাল্বের সংহতি।
অঞ্জন-পর্ব্বত তুল্য শাল্ব দৈত্যপতি।।
মর্ম্মভেদী এক অস্ত্র প্রদ্যুন্ন ছাড়িল।
কবচ ভেদিয়া অস্ত্র শাল্বেরে ছেদিল।।
মূর্চ্ছিত হইয়া শাল্ব রথেতে পড়িল।
দেখিয়া যাদব-বল চৌদিকে বেড়িল।।
হাহারবে কান্দয়ে যতেক দৈত্যগণ।
কতক্ষণে শাল্ব রাজা পাইল চেতন।।
গর্জ্জিয়া উঠিয়া চাপে দিলেক টঙ্কার।
পলায় যাদব-দল শব্দ শুনি তার।।
বহু মায়া জানে শাল্ব, মায়ার নিধান।
কামদেবে প্রহারিল তীক্ষ্ণ তীক্ষ্ণ বাণ।।
মোহ হৈল প্রদ্যুন্নের মায়া অস্ত্রাঘাতে।
মূর্চ্ছিত হইয়া কাম পড়িলেক রথে।।
কামদেবে মূর্চ্ছা দেখি দারুক সন্ততি।
রথ ফিরাইয়া পলাইল শীঘ্রগতি।।
কতক্ষণে সচেতন হল মম সুত।
সারথিরে নিন্দা করি বলয়ে বহুত।।
কি কর্ম্ম করিলে তুমি দারুক নন্দন।
মম রথ ফিরাইলে কিসের কারণ।।
শাল্বে দেখি ভয় তব হৈল হৃদি মাঝ।
সে কারণে সারথি করিলে হেন কাজ।।
বৃষ্ণিবংশ সমরে বিমুখ কোন্ কালে।
কেবা অগ্রসর হবে মোর শরজালে।।
সূত বলে, ভয় কিছু নাহিক আমার।
শাল্ব অস্ত্রে রথেতে মূর্চ্ছা হৈল তোমার।।
রথী মূর্চ্ছা দেখি রথ ফিরায় সারথি।
নাহিক তাহাতে দোষ, আছে হেন নীতি।।
বিশেষ গরিষ্ঠ বাক্য শুনিয়া তাহার।
ঈষৎ হাসিয়া কহে রুক্মিণী কুমার।।
আর কভু কর্ম্ম না করিহ হেনমত।
জীবন্ত থাকিতে রথী না ফিরাও রথ।।
বৃঞ্চিবংশে হেনরূপ কভু নাহি হয়।
কি বলিবে শুনি জ্যেষ্ঠতাত মহাশয়।।
কি বলিবে মোরে সবে পিতৃ ভ্রাতৃ তাত।
তোমা হৈতে বৃষ্ণিবংশ হইল ধিক্কৃত।।
কি বলিবে সাত্যকি বা উদ্ধব শুনিয়া।
মৃত্যু ইচ্ছা করি আমি এসব গণিয়া।।
পাছে পাছে শাল্ব মোরে প্রহারিবে শর।
পলাইয়া যাব আমি স্ত্রীগণ-ভিতর।।
দেখিয়া হাসিবে সব বৃষ্ণিকুল-নারী।
পলাইয়া গেল বলি বহু নিন্দা করি।।
এ কর্ম্ম হইতে মৃত্যু শতগুণে ভাল।
দ্বারকার ভার যে আমারে সমর্পিল।।
রাজসূয় যজ্ঞে গেল আমারে রাখিয়া।
কি বলিবে তাত মোর এ সব শুনিয়া।।
শীঘ্র বাহুড়াহ রথ দারুক নন্দন।
এখনি সে সৌভ পুরী করিব নিধান।।
কামের এতেক বাক্য শুনিয়া সারথি।
রণমুখে রথ চালাইল শীঘ্রগতি।।
শাল্বের যতেক সৈন্য, না যায় গণন।
কামের সম্মূখে নাহি রহে কোন জন।।
মারিল বহুত সৈন্য, না যায় গণনা।
রক্তে কলকলি উঠে, আর উঠে ফেণা।।
ভগ্ন সৈন্য দেখিয়া কুপিল দৈত্যপতি।
নানা অস্ত্র প্রদ্যুন্নে প্রহারে শীঘ্রগতি।।
পুনঃ পুনঃ মায়াবী সে হানে নানা শর।
সব শর ছেদ করে কাম ধনুর্দ্ধর।।
পরে ক্রোধে কামদেব নিল দিব্যবাণ।
চন্দ্র-সূর্য্য তেজ দেখি যাহে বিদ্যমান।।
ঝাঁকে ঝাঁকে অগ্নি উঠে বাণের মুখেতে।
অন্তরীক্ষ বাসিগণ পলায় ভয়েতে।।
অস্ত্র দেখি দেবগণ করে হাহাকার।
শীঘ্র পাঠাইল তথা ব্রহ্মার কুমার।।
বায়ুবেগে আসিলেন নারদ ঝটিতি।
সবিনয়ে কহিলেন কামদেব প্রতি।।
সম্বরহ অস্ত্র এই কৃষ্ণের নন্দন।
এই অস্ত্রে রক্ষা নাহি পায় ত্রিভুবন।।
শাল্ব দৈত্যরাজ কভু তব বধ্য নয়।
স্বহস্তে মারিবে এরে দৈবকী তনয়।।
এত শুনি হৃষ্ট হয়ে তূণে অস্ত্র থুইল।
এ সব কারণ শাল্ব সকলি জানিল।।
রণ ত্যজি সৌভ পুরে উত্তরিল গিয়া।
নিজ রাজ্যে গেল তবে দ্বারকা ত্যজিয়া।।
মহাভারতের কথা অমৃত সমান।
কাশীরাম দাস কহে, শুনে পুন্যবান।।