৭ম অধ্যায়
সমস্তকুলধ্বংসে যুধিষ্ঠিরের বিষাদ
বৈশম্পায়ন কহিলেন, হে মহারাজ! অনন্তর ধর্মপরায়ণ রাজা যুধিষ্ঠির মহারথ কর্ণকে স্মরণ করিয়া দুঃখিতমনে বারংবার বিলাপ ও পরিতাপ করিয়া ঘন ঘন দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগ করিতে করিতে অর্জুনের প্রতি দৃষ্টিনিক্ষেপপূর্বক কহিলেন, “ধনঞ্জয়! আমরা জ্ঞাতিবর্গকে নিঃশেষিত করিয়া নিতান্ত দুর্দশাপন্ন হইয়াছি; এক্ষণে আর এই দুর্গতি ভোগ করিতে পারিব না। চল, আমরা যাদবনগরে গিয়া ভিক্ষাৰ্থ পৰ্যটন করি। কৌরবগণ আমাদিগের আত্মতুল্য ছিল। আমরা তাহাদিগকে বিনষ্ট করিয়া আত্মবিনাশ করিয়াছি, সুতরাং আত্মঘাতী হইয়া আমরা কিরূপে ধর্মফল ভোগ করিব? ক্ষত্রিয়ধর্ম, বল, পৌরুষ ও অমর্ষে ধিক! এই সমুদয়ের প্রভাবেই আমরা এক্ষণে এই দারুণ বিপদে নিপতিত হইয়াছি। ক্ষমা, ইন্দ্রিয়সংযম, শৌচ, বৈরাগ্য, অমৎসরতা [মাৎসর্য্যহীনতা], অহিংসা ও সত্যই সর্বাপেক্ষা উৎকৃষ্ট। অরণ্যচারী সাধুগণ সতত ঐ সমুদয় গুণের সেবা করিয়া থাকেন। আমরা রাজ্যলাভলোভে মোহ, অহঙ্কার ও অভিমানপরতন্ত্র হইয়া এইরূপ দুরবস্থাপন্ন হইলাম। যখন আমাদিগের বন্ধুবান্ধবসমুদয় নিহত হইয়াছে, তখন কেহ ত্রৈলোকের রাজত্ব প্রদান করিয়াও আমাদিগকে সন্তুষ্ট করিতে পারে না। আমরা রাজ্যলাভের নিমিত্ত অবধ্য ভূপালগণকে মৃত্যুমুখে বিসর্জনপূর্বক বান্ধবশূন্য হইয়া জীবিত রহিয়াছি। আমরা আমিষলোলুপ কুকুরের ন্যায় রাজ্যগধ্নু[রাজ্যলোলুপ] হইয়া নিতান্ত বিপদগ্রস্ত হইলাম। পূর্বে রাজ্যলাভ আমাদের প্রার্থনীয় ছিল, কিন্তু এক্ষণে রাজ্যপরিত্যাগ আমাদের প্রীতিকর হইয়াছে। আমাদের যেসমস্ত বন্ধুবান্ধব নিহত হইয়াছেন, সমগ্র পৃথিবী, সুবর্ণরাশি এবং সমুদয় অশ্ব ও গোধনের বিনিময়েও তাঁহাদিগকে পরিত্যাগ করা কৰ্ত্তব্য নহে; তাঁহারা ক্রোধ ও হর্ষভরে মৃত্যুযানে[মৃত্যুপথে-যুদ্ধমৃত ব্যক্তি বিমানযানে স্বর্গারোহণ করে; কিন্তু কামক্রোধাদির অধীন হইয়া মরিলে যায় নরকে; নরকে যাওয়ার যানের পথ ভীষণ অন্ধকারময়] আরোহণ করিয়া যমলোকে প্রস্থান করিয়াছেন। পিতা তপস্যা, ব্রহ্মচর্য্য, সত্য ও ক্ষমা অবলম্বনপূর্বক বহুকল্যাণযুক্ত পুত্রলাভ করিতে অভিলাষ করিয়া থাকেন; আর মাতা উপবাস, যজ্ঞ, ব্রত, মঙ্গলানুষ্ঠানদ্বারা গর্ভধারণ করিয়া দশ মাস সেই দুর্বহ গর্ভভার বহন করিয়া মনে মনে চিন্তা করেন যে, আমার সন্তান নিরাপদে ভূমিষ্ঠ হইয়া বহুদিন জীবিত থাকিবে এবং বলিষ্ঠ ও সমাদৃত হইয়া আমাদিগকে ইহলোক ও পরলোকে সুখী করিবে। আহা! এক্ষণে আমাদিগের এই সংগ্রামে যেসকল মহাবীর- নিহত হইয়াছেন, তাঁহাদের জননীগণের সেইসমস্ত অভিলাষই নিষ্ফল হইল। ঐ হতভাগ্য কামিনীগণের যুবক তনয়েরা পার্থিব ভোগসমুদয় উপভোগ না করিয়াই, দেবতা ও পিতৃগণের ঋণজাল হইতে বিমুক্ত না হইয়াই কলেবর পরিত্যাগ করিয়াছেন, ঐ সমুদয় বীরের বলবীৰ্য্য ও রূপদর্শনে উহাদের জনকজননীগণের হৃদয়ে বহুবিধ শুভপ্রত্যাশা জন্মিবার সময়েই উহারা জীবনবিসৰ্জন করিলেন। উহারা আর কখনই জয়লাভজনিত সুখভোগ করিতে সমর্থ হইবেন না। পাঞ্চাল ও কৌরবগণ পরস্পর নিহত হইয়াছেন। যদি তাঁহারা সংগ্রামে প্রবৃত্ত না হইতেন, তাহা হইলে অনায়াসেই স্ব স্ব উৎকৃষ্ট কর্মের উৎকৃষ্ট ফলভোগ করিতে পারিতেন। আমরাই এই ঘোরতর লোকবিনাশের হেতুভূত, সন্দেহ নাই; কিন্তু বিশেষ বিবেচনা করিয়া দেখিলে ধৃতরাষ্ট্রতনয়গণের প্রতি এই দোষ সম্পূর্ণরূপে আরোপিত করা যাইতে পারে।
“রাজা দুৰ্য্যোধন অতিশয় শঠ, শুভদ্বেষী [সৎকর্মে দ্বেষকারী] ও মায়াবী ছিল; আমরা কোন অপরাধ না করিলেও সতত আমাদিগের অপকার করিত; এক্ষণে আমাদিগের অভীষ্টফললাভ বা ধৃতরাষ্ট্রতনয়গণের মনোরথ পরিপূর্ণ হইল না। আমাদিগের জয়লাভ হয় নাই এবং তাহারাও জয়লাভ করিতে পারে নাই। ঐ নির্বোধগণ পূর্বে আমাদের সমৃদ্ধিদর্শনে নিতান্ত দুঃখিত হইয়াছিল এবং তন্নিবন্ধন কখনই সুস্থ অন্তঃকরণে এই পৃথিবী উপভোগ, নারীগণের সহিত বিহার, গীতবাদ্য শ্রবণ, ধন দান, অর্থাগমের চেষ্টা এবং অমাত্য, সুহৃৎ ও জ্ঞানবৃদ্ধদিগের বাক্যে কর্ণপাতও করে নাই। মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র শকুনির মুখে আমাদিগের অভ্যুদয় বৃত্তান্ত শ্রবণ করিয়া বিবর্ণ ও একান্ত কৃশ হইয়াছিলেন। তিনি দুর্য্যোধনের দুর্নীতি অবগত হইয়াও পুত্রস্নেহনিবন্ধন বিদুর ও ভীষ্মের বাক্যে অনাদরপ্রদর্শনপূর্বক তদ্বিষয়ে অনুমোদন করিতেন। দুর্য্যোধন কিরূপে আমাদের ন্যায় সুখী হইবে, এই চিন্তাতেই তাঁহার দিনযামিনী অতিবাহিত হইত। অন্ধরাজ তৎকালে লুব্ধপ্রকৃতি স্বেচ্ছাচারপরায়ণ দুৰ্য্যোধনকে নিবারণ না করাতেই এক্ষণে আমার ন্যায় তাঁহার সর্বনাশ উপস্থিত হইয়াছে। রাজা দুৰ্য্যোধন সহোদরগণের বিনাশসাধন ও বৃদ্ধ জনকজননীকে শোকানলে নিক্ষেপ করিয়া যারপরনাই অযশোভাগী হইয়াছে। বাসুদেব শান্তিস্থাপনের উদ্দেশ্যে গমন করিলে সেই দুরাত্মা সংগ্রামার্থী হইয়া তাঁহাকে যে-কথা কহিয়াছিল, সৎকুলসত আর কোন্ ব্যক্তি সুহৃদের প্রতি সেইরূপ বাক্য প্রয়োগ করিতে পারে? এক্ষণে আমরা দিবাকরের ন্যায় স্বীয় তেজঃপ্রভাবে দশদিক্ দগ্ধ করিয়া আপনাদিগের দোষেই চিরকাল দুঃখভোগ করিব। আমাদিগের প্রবলশত্ৰু দুর্মতিপরায়ণ দুর্য্যোধন এক্ষণে কলেবর পরিত্যাগ করিয়াছে। ঐ দুরাত্মার দোষেই কৌরবকুল উৎসন্নপ্রায় হইল এবং আমরাও অবধ্য জ্ঞাতিগণকে বধ করিয়া জনসমাজে নিন্দনীয় হইলাম।
“রাজা ধৃতরাষ্ট্র পূর্বে কুলনাশক দুর্মতি পাপাত্মা দুৰ্য্যোধনকে রাজ্যের অধীশ্বর করিয়া এক্ষণে একান্ত শোকাকুল হইয়াছেন। তাঁহার পক্ষীয় বীরসমুদয় বিনষ্ট হইয়া গিয়াছে। তিনি পাপসৃষ্ট হইয়াছেন এবং তাঁহার রাজ্যসম্পত্তি হস্তান্তরিত হইয়াছে। এক্ষণে আমরা শত্রু বিনাশ করিয়া ক্রোধশূন্য হইয়াছি বটে, কিন্তু দুর্নিবার শোক আমাকে একান্ত ব্যাকুল করিতেছে। পাপকর্মের অনুষ্ঠান করিলে তাহার প্রচার মাঙ্গলিক[শুভ] কার্য্যের অনুষ্ঠান, অনুতাপ, দান, তপস্যা, শান্তি, তীর্থগমন, শ্রুতিস্মৃতিপাঠ[বেদম্মতি অধ্যয়ন] ও জপদ্বারা উহা বিনষ্ট হইয়া থাকে। লোকে ত্যাগশীল হইলে পাপানুষ্ঠানে বিরত হয়। বেদে নির্দিষ্ট আছে যে, ত্যাগশীল ব্যক্তিকে জন্মমৃত্যুজনিত যন্ত্রণা সহ্য করিতে হয় না। তিনি মোক্ষপথ অবলম্বনপূর্বক অনায়াসে ব্রহ্মলাভ করিতে সমর্থ হয়েন। অতএব এক্ষণে আমি তোমাদিগকে আমন্ত্রণপূর্বক মুনি, হইয়া বনে প্রস্থান করিব। স্পষ্টই প্রতীতি হইতেছে যে, লোকে ত্যাগশীল না হইলে কদাচ সমগ্ৰ ধৰ্মলাভে সমর্থ হয় না। আমি রাজ্যলোলুপ হইয়াই পাপপঙ্কে লিপ্ত হইয়াছি। যাহা হউক, এক্ষণে শ্রুতি অনুসারে ত্যাগশীল হইলে আর আমাকে জন্মপরিগ্রহ করিতে হইবে না। অতএব আমি সমস্ত রাজ্যসম্পদ পরিত্যাগপূর্বক শোকদুঃখবিবর্জিত হইয়া অরণ্যে গমন করিব। আমার রাজ্য বা উপভোগ্য দ্রব্যে কিছুমাত্র অভিলাষ নাই। অতঃপর তুমিই নির্বিঘ্নে এই পৃথিবী শাসন কর।” ধর্মরাজ এই কথা বলিয়া মৌনাবলম্বন করিলেন।।