সপ্তম অধ্যায়
পুলোমা রাক্ষস নিধন
উগ্রশ্রবাঃ কহিলেন, ভৃগু এইরূপ শাপ প্রদান করিলে অগ্নি সাতিশয় ক্রুদ্ধ হইয়া কহিলেন, “হে ব্রহ্মন্! আপনি কেন অকারণে আমাকে এই নিদারুণ অভিসম্পাত করিলেন? আমি তৎকর্ত্তৃক জিজ্ঞাসিত হইয়া ধর্ম্মপ্রতিপালনার্থ সত্যকথা কহিয়াছি, ইহাতে আমার দোষ কি? যে ব্যক্তি জিজ্ঞাসিত হইয়া জানিয়া-শুনিয়া মিথ্যা বলে, সে আপনার ঊর্দ্ধতন সপ্তপুরুষ ও অধস্তন সপ্তপুরুষকে নরকে পাতিত করে। আর যে ব্যক্তি যথার্থ জানিয়াও না কহে, সেও সেই পাপে লিপ্ত হয়, ইহাতে সন্দেহ নাই। যাহা হউক, আমিও আপনাকে শাপ প্রদান করিতে পারি, কিন্তু আমি ব্রাহ্মণদিগকে মান্য করি, এই নিমিত্ত বিরত হইলাম। আপনি সর্ব্বজ্ঞ, তথাপি আপনাকে কিছু কহিতেছি, শ্রবণ করুন। আমি যোগবলে আত্মাকে বহুধা বিভক্ত করিয়া শরীরভেদে অগ্নিহোত্র, গর্ভাধান ও জ্যোতিষ্টোমাদি ক্রিয়াকলাপে অধিষ্ঠিত আছি। বেদোক্তবিধিপূর্ব্বক আমাতে হুত যে হবিঃ, তদ্দ্বারা দেবগণ ও পিতৃগণ পরিতৃপ্ত হয়েন। হূয়মান সোমরসাদি সামগ্রী সকল দেবগণ ও পিতৃগণের শরীররূপে পরিণত হয়। দেবগণ ও পিতৃগণকে উদ্দেশ করিয়া একত্র দর্শ ও পৌর্ণমাস যজ্ঞের অনুষ্ঠান হয়, অতএব দেবগণ ও পিতৃগণ অভিন্নস্বরূপ এবং প্রতি পর্ব্বে কখন একত্র, কখন বা পৃথক্ কৃথক্ পূজিত হইয়া থাকেন। আমাতে যে আহুতি-সকল প্রদত্ত হয়, সেই সকল আহুতি দেবগণ ও পিতৃগণ ভক্ষণ করেন। তন্নিমিত্ত আমি দেবগণ ও পিতৃগণের মুখস্বরূপ। অমাবস্যাতে পিতৃগণকে ও পূর্ণিমাতে দেবগণকে উদ্দেশ করিয়া আমাতে আহুতি প্রদত্ত হয়, তাঁহারাও আমারই মুখ দ্বারা তাহা ভক্ষণ করেন, অতএব আমি কি প্রকারে সর্ব্বভক্ষ হইব?”
পরে অগ্নি ক্ষণকাল চিন্তা করিয়া বিপ্রগণের অগ্নিহোত্রাদি যজ্ঞক্রিয়া হইতে আপনাকে তিরোহিত করিলেন। তাঁহার অন্তর্দ্ধানান্তর প্রজাগণ ওঙ্কার, বষট্কার ও স্বধা-স্বাহা-বিবর্জ্জিত হইয়া দুঃখার্ণবে নিমগ্ন হইল। ঋষিগণ তদ্দর্শনে উদ্বিগ্নমনে দেবগণ সন্নিধানে উপস্থিত হইয়া নিবেদন করিলেন, “হে দেবগণ! অগ্নির অন্তর্দ্ধানপ্রযুক্ত ক্রিয়ালোপ হওয়াতে ত্রিলোকী ইতিকর্ত্তব্যতাবিমূঢ় হইয়াছে, অতএব এ বিষয়ে যাহা কর্ত্তব্য হয়, শীঘ্র বিধান করুন, আর কালাতিপাত করিবেন না।”
অনন্তর ঋষিগণ ও দেবগণ ব্রহ্মার নিকট গমন করিয়া অগ্নির শাপ ও তন্নিবন্ধন ক্রিয়ালাপের বৃত্তান্ত নিবেদন করিয়া কহিলেন, “হে ব্রহ্মন্! মহর্ষি ভৃগু কোন কারণবশতঃ অগ্নিকে ‘সর্ব্বভক্ষ হও] বলিয়া শাপ দিয়াছেন, কিন্তু অগ্নি দেবগণের মুখ ও যজ্ঞের অগ্রভাগভোক্তা হইয়া কিরূপে সর্ব্বভক্ষ হইবেন?” বিধাতা তাঁহাদিগের সেই বাক্য শ্রবণ করিয়া অগ্নিকে আহ্বান করিলেন এবং মধুরবাক্যে সান্ত্বনা করিয়া কহিতে লাগিলেন, “বৎস! তুমি সর্ব্বলোকের কর্ত্তা ও সংহর্ত্তা এবং অগ্নিহোত্রাদি ক্রিয়াকলাপের প্রবর্ত্তয়িতা, তুমিই এই ত্রিলোকী ধারণ করিতেছ; অতএব হে ত্রিলোকেশ হুতবহ! এক্ষণে যাহাতে ক্রিয়াকলাপের উচ্ছেদ না হয়, তাহা কর। তুমি সর্ব্বলোকের ঈশ্বর হইয়া এরূপ বিমূঢ়প্রায় হইতেছ কেন? তুমি সর্ব্বলোকে সর্ব্বদা পবিত্র এবং সর্ব্বজীবের গতিস্বরূপ। অতত্রব আমি বলিতেছি তুমি সর্ব্বশরীরে সর্ব্বভক্ষ হইবে না। অপানদেশে তোমার যে-সকল শিখা আছে, তাহারাই সকল বস্তু ভক্ষণ করিবে এবং তোমার মাংসভক্ষিকা যে তনু আছে, সেই সর্ব্বভক্ষ হইবে। যেমন রবিকিরণ-সংস্পর্শে সকল বস্তু শুচি হয়, সেইরূপ তোমার শিখা দ্বারা দগ্ধ হইয়া সকল বস্তু শুচি হইবে। হে হুতাশন! তুমি সর্ব্বশ্রেষ্ঠ তেজঃপদার্থ, তুমি আপনার প্রভাবে আপনি বিনির্গত হইয়াছ, এক্ষণেও স্বকীয় তেজঃপ্রভাবে ঋষির শাপ সত্য কর এবং তোমার মুখে হুত দেবভাগ ও আত্মভাগ গ্রহণ কর।”
অগ্নি সর্ব্বলোকপিতামহ ব্রহ্মার এই বাক্য শ্রবণ করিয়া “যে আজ্ঞা” বলিয়া তদীয় আজ্ঞা-পালনার্থে গমন করিলেন। দেবগণ ও ঋষিগণ আহ্লাদিত হইয়া স্ব স্ব স্থানে প্রতিনিবৃত্ত হইলেন। মহর্ষিগণ পূর্ব্বের ন্যায় যাগযজ্ঞাদি ক্রিয়াসকল সম্পন্ন করিতে লাগিলেন। স্বর্গে দেবগণ ও ধরাতলে নরগণ অত্যন্ত হৃষ্টচিত্ত হইলেন। অগ্নিও শাপ-বিনির্ম্মুক্ত হইয়া সাতিশয় প্রীতিলাভ করিলেন। পূর্ব্বকালে ভগবান অগ্নি মহর্ষি ভৃগু হইতে এইরূপে শাপগ্রস্ত হইয়াছিলেন। অগ্নির শাপ, পুলোমা রাক্ষসের নিধন ও চ্যবনের জন্মবৃত্তান্ত-ঘটিত প্রাচীন ইতিহাস এই।