৭ম অধ্যায়
দ্রোণাচার্য্যের সেনাপতিপদে অভিষেক
সঞ্জয় কহিলেন, “অনন্তর দ্রোণাচার্য্য দুৰ্য্যোধনকে কহিলেন, ‘হে দুৰ্য্যোধন! আমি ষড়ঙ্গ বেদ, মানবী অর্থবিদ্যা, শৈব অস্ত্র ও বাণ এবং অন্যান্য বিবিধ অস্ত্র অবগত আছি; তোমরা জয়াকাঙ্ক্ষী হইয়া আমাতে যে সকল গুণ আরোপ করিলে, এক্ষণে তদনুযায়ী কাৰ্য্য করিবার নিমিত্ত পাণ্ডবগণের সহিত যুদ্ধ করিব; কিন্তু কদাচ ধৃষ্টদ্যুম্নকে বিনাশ করিতে পারি না; সে আমার বধের নিমিত্ত সৃষ্ট হইয়াছে। সমুদয় সোমগণকে বিনাশ ও অন্যান্য সৈন্যগণের সহিত সংগ্রাম করিব; কিন্তু পাণ্ডবগণ হর্ষিত হইয়া আমার সহিত যুদ্ধ করিবেন না।
অনন্তর দুৰ্য্যোধন দ্রোণাচার্যের অনুজ্ঞা গ্রহণ করিয়া তাঁহাকে সেনাপতি করিলেন; যেমন কার্ত্তিকেয় ইন্দ্রাদি দেবগণ কর্ত্তৃক সৈনাপত্যে অভিষিক্ত হইয়াছিলেন, সেইরূপ তিনি দুৰ্য্যোধন প্রভৃতি ভূপতিগণ কর্ত্তৃক সেনাপতিপদে অভিষিক্ত হইলেন। কৌরবগণ বাদিত্র ও শঙ্খনাদে হর্ষ প্রকাশ করিতে লাগিলেন, পরিশেষে পুণ্যাহ শব্দে স্বস্তিবাদে সূত, মাগধ ও বন্দিগণের স্তুতিগানে, দ্বিজগণের জয় শব্দে এবং সূতগণের নৃত্যে দ্রোণকে সমুচিত সৎকার করিয়া পাণ্ডবগণ পরাজিত বলিয়া বোধ করিতে লাগিলেন।
দ্রোণাচার্য্যের যুদ্ধযাত্রা
মহারথ দ্রোণ সেনাপতিপদ প্রাপ্ত হইয়া সৈন্যগণকে ব্যূহিত করত সমরাভিলাষে আপনার পুত্রগণ সমভিব্যাহারে যাত্রা করিলেন। জয়দ্ৰথ, কলিঙ্গ ও আপনার পুত্র বিকর্ণ তাঁহার দক্ষিণপক্ষে অবস্থান করিতে লাগিলেন। শকুনি প্রধান প্রধান অশ্বারোহী ও প্রাসযোধী গান্ধারগণ সমভিব্যাহারে তাঁহাদিগের পক্ষ হইলেন। কৃপ, কৃতবর্ম্মা, চিত্রসেন, বিবিংশতি ও দুঃশাসন প্রভৃতি বীরগণ সাবধানে দ্রোণের বামপক্ষ রক্ষণে নিযুক্ত হইলেন। কাম্বোজগণ সুদক্ষিণকে অগ্রসর করিয়া মহাবেগ অশ্বে আরোহণ পূর্ব্বক শক ও যবন গণ সমভিব্যাহারে তাঁহাদিগের প্রপক্ষ হইয়া গমন করিতে লাগিলেন। মদ্র, ত্রিগর্ত্ত, অম্বষ্ঠ, প্রতীচ্য, উদীচ্য, মালব, শিবি, শূরসেন, শূদ্র, মলদ, সৌবীর, কিতব, প্রাচ্য এবং দাক্ষিণাত্যগণ দুৰ্য্যোধন ও কর্ণকে অগ্রসর করিয়া স্বীয় সৈন্যগণকে হর্ষিত করত গমন করিতে লাগিলেন।
কর্ণ সেনাসমূহের বলবর্দ্ধন করিয়া সকল ধনুর্দ্ধরের অগ্রে গমন করিলেন। তাঁহার অতি বৃহৎ প্রদীপ্ত সিংহলাঞ্ছিত সূৰ্য্যসংকাশ মহাকেতু সৈন্যগণের হর্ষ বর্দ্ধন করিয়া শোভা পাইতে লাগিল। তখন কর্ণকে অবলোকন করিয়া কেহই ভীষ্মের বিপদ গণনা করিলেন না; কৌরব ও অন্যান্য রাজাগণ সকলেই শোক পরিত্যাগ করিলেন। অনেক যোদ্ধা একত্র হইয়া হৃষ্ট চিত্তে পরস্পর কহিতে লাগিল যে, পাণ্ডবগণ কর্ণকে অবলোকন করিলে যুদ্ধক্ষেত্রে অবস্থান করিবে না; হীনবীৰ্য্য হীনপরাক্রম পাণ্ডবগণের কথা কি, কর্ণ সবাসব দেবগণকেও পরাজয় করিতে পারেন। মহাবাহু ভীষ্ম সংগ্রামে পাণ্ডবগণকে রক্ষা করিয়াছেন; কিন্তু কর্ণ তাহাদিগকে তীক্ষ্ণ শনিকরে বিনষ্ট করিবেন। যোদ্ধাগণ কর্ণের এইরূপ প্রশংসা করিতে করিতে বহির্গত হইলেন। দ্রোণাচাৰ্য্য আমাদিগের যে ব্যূহ প্ৰস্তুত করিলেন, তাহার নাম শকটব্যূহ।
যুধিষ্ঠির প্রীতচিত্তে ক্রৌঞ্চব্যূহ নির্ম্মাণ করিলেন। পুরুষশ্রেষ্ঠ বাসুদেব ও ধনঞ্জয় বানরধ্বজ সমুচ্ছ্রিত করিয়া সেই ব্যূহমুখে অবস্থান করিতে লাগিলেন। সমুদায় সৈন্যগণের অগ্রগণ্য, ধনুর্দ্ধরগণের তেজ স্বরূপ, অমিততেজা ধনঞ্জয়ের কেতু সৈন্যগণকে সমুজ্জ্বলিত করিল; তাহা দর্শন করিয়া বোধ হইল যেন প্রলয়কালীন সূৰ্য্য প্রজ্বলিত হইয়া বসুন্ধরা দগ্ধ করিতেছে। অর্জ্জুন সমুদায় যোদ্ধার শ্রেষ্ঠ, গাণ্ডীব সমুদায় শরাসনের শ্রেষ্ঠ, বাসুদেব সমুদায় প্রাণীর শ্রেষ্ঠ ও সুদর্শন সমুদায় চক্রের শ্রেষ্ঠ; শ্বেতহয়সংযুক্ত রথ এই চারি তেজ বহন করিয়া শত্রুগণের সম্মুখে সমুদ্যত কালচক্রের ন্যায় অবস্থান করিতে লাগিল। কৌরবগণের অগ্রসর কর্ণ ও পাণ্ডবগণের অগ্রসর অর্জ্জুন, ইহারা পরস্পর জাতক্রোধ ও বধপ্রার্থী হইয়া পরস্পর অবলোকন করিতে লাগিলেন।
অনন্তর মহারথ দ্রোণাচাৰ্য্য সহসা যুদ্ধার্থ গমন করিলে ঘোরতর আর্ত্তনাদে ধরাতল কম্পিত হইয়া উঠিল; কৌশেয় নিকর সদৃশ অবিরল ধূলিপটল বায়ুবেগে উত্থিত হইয়া দিনকরের সহিত নভোমণ্ডল আচ্ছন্ন করিল; অন্তরীক্ষ মেঘশূন্য হইয়াও মাংস, অস্থি ও রুধির বর্ষণ করিতে লাগিল। সহস্র সহস্র গৃধ্র, শ্যেন, কাক ও কঙ্ক সৈন্যের উপর মুহুর্স্মুহু পতিত হইতে লাগিল; গোমায়ু অতি ভীষণ নিদারুণ চীৎকার করিতে লাগিল এবং মাংস ভক্ষণ ও শোণিতপানাভিলাষে বারংবার কোরব সৈন্যের দক্ষিণ দিকে গমন করিতে প্রবৃত্ত হইল; অতি চঞ্চল দীপ্যমান উল্কাসকল পুচ্ছ দ্বারা সমুদায় আবৃত করিয়া নির্ঘাত সহকারে সন্তাপিত করিতে লাগিল; বিদ্যুৎ ও মেঘসহকৃত পরিবেশ দিবাকরকে পরিবেষ্টন করিল; কৌরবগণের সেনাপতি গমন করিলে এইরূপ ও অন্যান্য রূপ নিদারুণ উৎপাত সকল প্রাদুর্ভূত হইতে লাগিল।
দ্রোণাচার্য্য-ধৃষ্টদ্যুম্ন যুদ্ধ
অনন্তর পরস্পর-বধার্থী কৌরব ও পাণ্ডবসেনা শরশব্দে সমুদায় জগৎ পরিপূরিত করিয়া যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইল। কৌরব ও পাণ্ডবগণও জয় প্রত্যাশায় পরস্পর নিশিত শর নিক্ষেপ করিতে লাগিলেন। মহাধনুর্দ্ধর মহাদ্যুতি দ্রোণাচার্য্য শত শত নিশিতসায়কে সৈন্যগণকে আচ্ছন্ন করিতে করিতে পাণ্ডবগণের প্রতি ধাবমান হইলেন। পাণ্ডব ও সৃঞ্জয়গণ শর বর্ষণ পূর্ব্বক তাঁহাকে গ্রহণ করিলেন। দ্রোণাচার্য্য পাবগুগণের মহাসৈন্য ও পাঞ্চালগণকে সংক্ষোভিত ও ছিন্নভিন্ন এবং ক্ষণ মধ্যে ভূরি ভূরি দিব্য অস্ত্র সৃষ্টি করিয়া পাণ্ডব ও সৃঞ্জয়গণকে নিপীড়িত করিতে লাগিলেন। ধৃষ্টদ্যুম্নের অনুগত পাঞ্চালগণ বাসবতাড়িত দানবগণের ন্যায় দ্রোণ কর্ত্তৃক আহত হইয়া কম্পিত হইতে লাগিল। দিব্যাস্ত্রবিৎ শৌর্য্যশালী মহারথ ধৃষ্টদ্যুম্ন শরবৃষ্টি দ্বারা দ্রোণাচার্য্যের সৈন্যগণকে বহুধা ছিন্ন ভিন্ন ও তাঁহার শরজাল নিবারিত করিয়া কৌরবগণকে সংহার করিতে আরম্ভ করিলেন। মহাবাহু দ্রোণ আপনার ভগ্ন সৈন্য একত্র করিয়া ধৃষ্টদ্যুম্নকে আক্রমণ করিলেন; যেমন ইন্দ্র ক্রুদ্ধ হইয়া দানবগণের উপর শর বর্ষণ করিয়াছিলেন, সেই রূপ দ্রোণাচাৰ্য্য ধৃষ্টদ্যুম্নের প্রতি শরজাল পরিত্যাগ করিতে লাগিলেন। পশুগণ যেমন সিংহের নিকট ছিন্ন ভিন্ন হয় সেইরূপ দ্রোণাচার্য্যের শরনিকরে কম্পমান পাণ্ডব ও সৃঞ্জয়গণ বারংবার ভগ্ন হইতে লাগিলেন। দ্রোণাচার্য্য পাণ্ডব সৈন্যের মধ্যে পরিভ্রমণ করিতে আরম্ভ করিলেন, উহা অতি অদ্ভুত বলিয়া বোধ হইতে লাগিল। শাস্ত্রানুসারে সুসজ্জিত দ্রোণাচার্য্যের রথ আকাশচর নগরের ন্যায় বোধ হইতে লাগিল, স্ফটিক সদৃশ বিমল ধ্বজদণ্ড শোভা পাইতে লাগিল; পতাকা অনিলভরে সঞ্চালিত হইতে লাগিল; রথনির্ঘোষ বিনির্গত হইতে লাগিল; অশ্ব সকল পরিচালিত হইতে আরম্ভ হইল; তিনি তখন সেই রথে আরোহণ করিয়া শত্রু সৈন্যগণকে ত্রাসিত ও নিহত করিতে লাগিলেন।