৭ম অধ্যায়
দুৰ্য্যোধনকর্ত্তৃক শল্যাকে সপক্ষে আনয়ন
বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! মহাবীর শল্য দূতমুখে কুরুপাণ্ডবের সমরসংবাদ শ্রবণ করিয়া পুত্ৰগণের সহিত বিপুলসৈন্যমণ্ডলীসমভিব্যাহারে পাণ্ডবগণের সাহায্যাৰ্থ যাত্ৰা করিলেন। তাঁহার সেনানিবেশ অৰ্দ্ধযোজন বিস্তীর্ণ হইল। মহাবলপরাক্রান্ত, বিচিত্রকবচালঙ্কৃত, ধ্বজকার্মুকসম্পন্ন, কুসুমদাম [মাল্য]-বিভূষিত, স্বদেশপ্রচলিত বেশ ও আভরণধারী, শত সহস্ৰ ক্ষত্ৰিয়বীর রমণীয় রথে আরোহণ করিয়া তাঁহার সেনাপতিপদে প্রতিষ্ঠিত হইলেন। শল্যরাজ সেনাগণের শ্রমাপনোদন করিয়া মৃদুপদসঞ্চারে ক্রমে ক্রমে গমন করিতে লাগিলেন; বোধ হইল যেন, পদভরে প্রাণীগণকে ব্যথিত ও মেদিনীমণ্ডল বিকম্পিত করিয়া গমন করিতেছেন।
মহারাজ দুৰ্য্যোধন এই সংবাদ শ্রবণমাত্র সত্বর স্বয়ং তাঁহার নিকট উপস্থিত হইয়া যথোচিত উপচারে পূজা করিলেন। পরে তাঁহার প্রীতিসম্পাদনার্থ শিল্পীদ্বারা স্থানে স্থানে এক-এক সভা নির্ম্মাণ ও নানাপ্রকার ক্রীড়াদ্রব্য প্রস্তুত করাইলেন। তথায় নানাবিধ অন্ন, মাল্য, মাংস, সুসংস্কৃত ভক্ষ্য ও সুধাসোদর [অমৃততুল্য] পানীয় আহরণ, বিবিধ রমণীয় কূপ ও বাপী খনন এবং অনেকানেক রমণীয় গৃহ নির্ম্মাণ করাইলেন। শল্যরাজ সেই সকল সভায় সমুপস্থিত হইয়া দুৰ্য্যোধনের অমাত্যগণকর্ত্তৃক দেবতার ন্যায় পরমসমাদরে পূজিত হইলেন।
অনন্তর তিনি অমরাবতীর ন্যায় আর-এক সভায় গমন করিয়া অলৌকিক বিষয়সমুদয় অবলোকনপূর্ব্বক একান্ত হৃষ্ট ও নিতান্ত সন্তুষ্ট হইলেন এবং আপনাকে ইন্দ্ৰদেব অপেক্ষা সমধিক সৌভাগ্যশালী বিবেচনা করিতে লাগিলেন। পরে তত্ৰস্থ পরিচারিকাদিগকে আহ্বান করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “মহারাজ যুধিষ্ঠিরের কোন শিল্পীরা এই সমস্ত সভা নির্ম্মাণ করিয়াছে? এক্ষণে তোমরা তাহাদিগকে আনয়ন কর; তাহারা পারিতোষিকের সম্পূর্ণ উপযুক্ত; আমি রাজা যুধিষ্ঠিরের আদেশানুসারে তাহাদিগকে সমুচিত পারিতোষিক প্রদান করিব।” তখন পরিচারকেরা নিতান্ত বিস্মিত হইয়া অতি সত্বর রাজা দুর্য্যোধনকে নিবেদন করিল, “মহারাজ! শল্যরাজ সভাসন্দর্শনে সাতিশয় সন্তুষ্ট হইয়া আপনার জীবন পৰ্য্যন্তও প্ৰদান করিতে উদ্যত হইয়াছেন।” তখন রাজা দুৰ্য্যোধন প্রচ্ছন্নবেশে মদ্ররাজসমক্ষে সমুপস্থিত হইলে তিনি তাঁহাকে নিরীক্ষণ করিয়া তাঁহার শিল্পনৈপুণ্য সম্পূর্ণরূপ অবগত হইয়া প্রীতমনে আলিঙ্গনপূর্ব্বক কহিলেন, “হে শিল্পীপ্রধান! এক্ষণে তোমার কি অভিলাষ হয়, প্রার্থনা কর।” তখন দুৰ্য্যোধন কহিলেন, “হে মাতুল! আপনার বাক্য কদাচ মিথ্যা হইবে না; আপনাকে আমার সেনাপতিপদে প্রতিষ্ঠিত হইতে হইবে। আপনি আমাকে এই একমাত্ৰ অভীষ্টবর প্রদান করুন।”
তখন মদ্ররাজ কহিলেন, “বৎস! আমি তোমার প্রার্থনাবাক্যে সম্মত হইলাম; এক্ষণে বল, আর কি অনুষ্ঠান করিতে হইবে?” দুৰ্য্যোধন কহিলেন, “হে মাতুল! আমার অভিলাষসকল সম্পন্ন হইয়াছে, এখন আর অন্য বরে প্রয়োজন নাই।” তখন মদ্ররাজ কহিলেন, “হে দুৰ্য্যোধন! তুমি এক্ষণে স্বনগরে প্রতিগমন কর; রাজা যুধিষ্ঠিরের সহিত সাক্ষাৎ করা অবশ্য কর্ত্তব্য, এই অভিলাষে আমি মৎস্যদেশে গমন করিতেছি, তাঁহাকে দর্শন করিয়া শীঘ্রই প্রত্যাগমন করিব।” দুৰ্য্যোধন কহিলেন, “আপনি পাণ্ডবগণকে দর্শন করিয়া অনতিবিলম্বেই প্রত্যাগমন করিবেন, আমরা আপনারই অধীন, আপনি আমাদিগকে যে বর প্রদান করিয়াছেন, তাহা কদাচ বিস্মৃত হইবেন না।” শল্য কহিলেন, “আমি সত্বরেই আগমন করিব, তোমার মঙ্গল হউক, এক্ষণে তুমি নিজ রাজধানীতে প্ৰতিগমন কর।” এই বলিয়া তিনি দুৰ্য্যোধনকে আলিঙ্গন করিলে রাজা দুৰ্য্যোধনও তাঁহাকে আলিঙ্গন ও আমন্ত্রণ করিয়া নিজ নগরীতে প্ৰতিগমন করিলেন। অনন্তর শল্যরাজ পাণ্ডবগণকে এই ব্যাপার অবগত করিবার নিমিত্ত মৎস্যদেশে গমন করিতে লাগিলেন।
কর্ণবধে শল্যের যুধিষ্ঠির সাহায্যে প্রতিজ্ঞা
পরে মদ্ররাজ শল্য মৎস্যদেশে সমুপস্থিত হইয়া সেনানিবেশে প্রবেশপূর্ব্বক পাণ্ডবগণের সহিত সাক্ষাৎ করিলেন। পাণ্ডবেরা বিধানানুসারে তাঁহাকে, পাদ্য, অর্ঘ্য ও গো প্ৰদান করিলে তিনি তাহা স্বীকার করিয়া পরমপ্রীতমনে তাঁহাদিগকে আলিঙ্গন করিলেন। অনন্তর তাঁহারা স্ব স্ব আসনে আসীন হইলে তিনি তখন আসন গ্রহণপূর্ব্বক ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠিরকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “মহারাজ! আপনি ত’ কুশলে আছেন? আপনি ভ্রাতৃগণ ও প্ৰণয়িনী দ্রুপদনন্দিনীর সহিত দুঃসহ বনবাস ও অজ্ঞাতবাসে নিতান্ত দুষ্কর কর্ম্মসকল সংসাধন করিয়া এক্ষণে যে তাহা হইতে নির্ব্বিঘ্নে বির্নিমুক্ত হইয়াছেন, ইহা পরম সৌভাগ্য বলিয়া স্বীকার করিতে হইবে। রাজ্যভ্রষ্ট ব্যক্তির কদাচ সুখসম্ভোগ হয় না, সে কেবল প্রতিনিয়তই দুঃখভোগ করিয়া থাকে। এক্ষণে সেই দুঃখের সময় অতীত হইয়াছে, আপনি শত্ৰুসকল সংহার করিয়া পুনরায় সুখসম্ভোগ করুন।
“আপনি লোকতন্ত্রের বিষয়সকল বিলক্ষণ অবগত আছেন, আপনি কদাচ লোভের বশীভূত হন না; পূর্ব্বতন রাজর্ষিগণের অনুসরণ করিয়া দান, সত্য ও তপস্যায় মনোনিবেশ করুন। ক্ষমা, দম, অহিংসা ও লোকাতীত বিষয়সমুদয় আপনাতে প্রতিষ্ঠিত আছে। আপনি শান্তস্বভাব, বদান্য, ব্ৰহ্মপরায়ণ ও ধাৰ্মিক; লোকসাক্ষিক ধৰ্মসকল আপনার অবিদিত নাই। আপনি এই জগতের ভাবসকল সম্যক অবগত আছেন। আজি সৌভাগ্যবশতঃ তাদৃশ দুর্ব্বিষহ ক্লেশপরম্পরা হইতে বির্নিমুক্ত হইয়াছেন; আর আমরাও ভাগ্যক্রমে পুনরায় আপনার সাক্ষাৎকার লাভ করিলাম।” এই বলিয়া তিনি পথিমধ্যে দুৰ্য্যোধনসমাগম, তৎকৃত শুশ্রূষা ও আপনার বরদানবৃত্তান্ত আনুপূর্ব্বিক কীর্ত্তন করিলেন।
তখন ধৰ্মরাজ পাণ্ডুতনয় প্রফুল্লমনে কহিলেন, “হে মাতুল! আপনি দুৰ্য্যোধনের বাক্য অঙ্গীকার করিয়া অতি উত্তম কাৰ্য্য করিয়াছেন। কিন্তু আমার মুখাপেক্ষায় আপনাকে একটি অকাৰ্য্যসংসাধন করিতে হইবে; তাহা কীর্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ করুন। আপনি যুদ্ধে বাসুদেবসদৃশ। যখন কর্ণ ও অর্জ্জুনের দ্বৈরথযুদ্ধ আরম্ভ হইবে, তৎকালে আপনি কর্ণের সারথ্যস্বীকার করিয়া আমাদিগের হিতোদেশে অর্জ্জুনকে রক্ষা ও কর্ণের তেজঃসংহার করিবেন। হে তাত! ইহা অকাৰ্য্য হইলেও আমাদিগের মঙ্গলের নিমিত্ত আপনাকে অবশ্যই সম্পাদন করিতে হইবে।”
মদ্ররাজ কহিলেন, “হে যুধিষ্ঠির! আপনার মঙ্গল হউক; যুদ্ধে মহাবীর কর্ণের তেজঃসংহারার্থ যাহা কহিলেন আমি তাঁহার সারথ্য স্বীকার করিয়া অবশ্যই উহা সম্পাদনা করিব। তিনি আমাকে সমরে বাসুদেবতুল্য জ্ঞান করিয়া থাকেন; অতএব আমি সত্য কহিতেছি, তিনি যুদ্ধে প্ৰবৃত্ত হইলে আমি তাঁহাকে অবশ্যই অহিত ও প্রতিকূল উপদেশ প্ৰদান করিব। তিনি তাহাতে অবশ্যই হৃতদর্প ও হৃততেজঃ হইবেন; তখন আপনারা তাঁহাকে অনায়াসে সংহার করিতে সমর্থ হইবেন, সন্দেহ নাই। সাধ্যানুসারে আমা হইতে আপনার যেসকল প্রিয়কাৰ্য্যের সম্ভাবনা আছে, তাহাতে আমি অণুমাত্রও ত্রুটি করিব না। আপনি দ্ৰৌপদীর সহিত দ্যূতে পরাজিত হইয়া কৰ্ণকৃত সমস্ত পরুষবাক্য শ্রবণপূর্ব্বক যে সকল দুঃখভোগ করিয়াছেন এবং দ্রুপদনন্দিনী দময়ন্তীর ন্যায় দুষ্ট জটাসুর ও কীচক হইতে যে সমস্ত ক্লেশ সহ্য করিয়াছেন, এক্ষণে সেই সকল ক্লেশ সুখে পরিণত হইবে। আপনি কদাচ তাহাতে ক্ষুব্ধ হইবেন না; এই সংসারে সকলই দৈবায়ত্ত। কি দুরাত্মা, কি মহাত্মা—সকলকেই দুঃখভোগ করিতে হয়; অধিক কি, দেবগণও সময়ক্রমে অশেষ ক্লেশ স্বীকার করিয়া থাকেন। দেখুন, দেবরাজ ইন্দ্ৰ শচীদেবীর সহিত সাতিশয় দুঃখ সহ্য করিয়াছিলেন।”