০০৭. উত্তরকুরু-বিবরণ

৭ম অধ্যায়

উত্তরকুরু-বিবরণ

ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, “হে সঞ্জয়! তুমি সুমেরুপর্ব্বতের অন্য পার্শ্ব এবং মাল্যবানপর্ব্বতের বিষয় সম্যক কীর্ত্তন কর।” সঞ্জয় কহিলেন, “মহারাজ! সুমেরুর উত্তর ও নীলপর্ব্বতের দক্ষিণপার্শ্বে সিদ্ধগণনিষেবিত অতি পবিত্ৰ উত্তরকুরু প্রতিষ্ঠিত আছে। তথায় বৃক্ষসকল প্রতিনিয়ত মধুরীরসসম্পন্ন সুস্বাদু ফল ও সুগন্ধি কুসুমনিচয় প্রসব করে; সেই স্থানে সর্ব্বপ্রকার কাম্যফলপ্ৰদ কতকগুলি বৃক্ষ আছে; তাহারা সকলের মনোরথ পরিপূর্ণ করিয়া থাকে। অপর ক্ষীরিনামে কতকগুলি বৃক্ষ আছে, তাহারা অমৃতোপবম ক্ষীরধারা বর্ষণ এবং ছয় প্রকার রস ক্ষরণ করিয়া থাকে। এই বৃক্ষের ফল হইতে বস্ত্র ও আভরণসমূহ উৎপন্ন হয়। সেই স্থানের সমস্ত ভূভাগ মণিময় ও সূক্ষ্ম কাঞ্চন-বালুকাসম্পন্ন। কোন কোন ভূমিখণ্ড হীরক, বৈদূৰ্য্য ও পদ্মরাগ,তুল্য অতিরমণীয় দৃষ্ট হইয়া থাকে। তত্ৰত্য পুষ্করিণীসকল পঙ্কশূন্য ও মনোরম; তাহার সলিল সমুদয় ঋতুতে সাতিশয় স্বাদু ও সুখস্পর্শ হইয়া থাকে। মনুষ্যসকল দেবলোক হইতে পরিভ্রষ্ট হইয়া তথায় জন্মগ্রহণ করে; তাহারা সকলেই প্রিয়দর্শন ও বিশুদ্ধ বংশসমুদ্ভূত। স্ত্রীসকল অপ্সরাসদৃশ। সেই স্থানের সমুদয় লোক ক্ষীরিপাদপের অমৃতসদৃশ ক্ষীর পান করিয়া থাকে। তথায় চক্ৰবাকযুগলের ন্যায় নরমিথুন [স্ত্রীপুরুষ] এককালে জন্মগ্রহণ করিয়া সমভাবে পরিবর্দ্ধিত হয়। তাহারা তুল্যরূপগুণসম্পন্ন, তুল্যবেশসূশোভিত, রোগশূন্য ও নিত্যসন্তুষ্ট। তাহারা একাদশসহস্ৰ বৎসর জীবিত থাকে এবং কেহ কাহাকেও কখনো পরিত্যাগ করে না। তাহারা কলেবর পরিত্যাগ করিলে তীক্ষ্মতুণ্ডসম্পন্ন [কঠিন ঠোঁটযুক্ত] অতি ভয়ঙ্কর মহাবল ভারুণ্ড [ভাডুইপাখী] নামক পক্ষিসকল তাহাদিগের মৃতদেহ হরণ করিয়া গিরিগুহায় নিক্ষেপ করিয়া থাকে।

জম্বুদ্বীপের নামোৎপত্তির কারণ

“হে মহারাজ! আমি বিস্তৃতভঅবে উত্তরকুরুর বিষয়ে কীর্ত্তন করিলাম; এক্ষণে সুমেরুর পূর্ব্বপার্শ্বের বিষয় বর্ণন করিতেছি, শ্রবণ করুন;-তথায় ভদ্রাশ্বনামে এক প্রধান প্রদেশ আছে; সেই প্রদেশে ভদ্রশালবন ও এক যোজন উন্নত কালাম্রবৃক্ষ রহিয়াছে। কালাম্রবৃক্ষ প্রতিনিয়ত ফল-পুস্প প্রসব করে এবং সিদ্ধ ও চারণগণকর্ত্তৃক সেবিত হইয়া থাকে। তথায় পুরুষসকল মহাবলপরাক্রান্ত, তেজস্বী ও শ্বেতবর্ণ, স্ত্রীলোকেরা কুমুদ বর্ণ ও প্রিয়দর্শন। তাহাদের মুখমণ্ডল পূর্ণচন্দ্রের ন্যায় ও গাত্র অতি শীতল; তাহারা সকলেই নৃত্য-গীতে নিতান্ত অনুরক্ত। তথায় সকলেই স্থিরযৌবন ও দশসহস্ৰ বৎসর জীবিত থাকে এবং কালাম্রফলের রস পান করে। নীলপর্ব্বতের দক্ষিণ ও নিষধের উত্তরে সুদৰ্শননামে এক সনাতন জম্বুবৃক্ষ [জামগাছ] আছে; এই নিমিত্ত ইহা জম্বুদ্বীপ বলিয়া পরিকীর্ত্তিত হইয়াছে। ঐ জম্বুবৃক্ষ সকলকেই অভিলষিত ফল প্ৰদান করে এবং সিদ্ধচারণগণ নিরন্তর উহার সেবা করিয়া থাকেন; এই গগনস্পর্শী বৃক্ষ শতসহস্ৰ যোজন উন্নত; উহার ফলের বিশাল আকার দুই সহস্রপাঁচশত অরত্নি [তিনপোয়া হাত—কনুই হইতে কনিষ্ঠাঙ্গুলীর মূল পর্যন্ত]। ঐ জম্বুফল রসভরে বিদীর্ণ হইয়া পতনকালে অতি গভীর শব্দ উৎপাদন করিয়া থাকে। ঐ ফল হইতে সুবর্ণসন্নিভ রস নির্গত ও নদীরূপে পরিণত হইয়া সুমেরুকে প্ৰদক্ষিণপূর্ব্বক উত্তরকুরুতে প্রবাহিত হইতেছে; জম্মুফলের রস পান করিলে জম্বুদ্বীপবাসিগণের অন্তঃকরণে শান্তিসঞ্চার হয়; পিপাসা ও জরাজনিত ক্লেশের লেশও থাকে না। তথায় ইন্দ্ৰগোপসঙ্কাশ [ইন্দ্ৰগোপিকীটতুল্যকান্তি], অতি ভাস্বর দেবগণের ভূষণ জাম্বুনন্দনামক কনক উৎপন্ন হয়। সেই স্থানে মানবসকল তরুণ দিবাকরতুল্য দীপ্তিসম্পন্ন হইয়া জন্মগ্রহণ করে।

“মাল্যবানপর্ব্বতের শিখরদেশে সংবর্ত্তকনামে কালাগ্নি নিরন্তর পরিদৃশ্যমান হইতে থাকে; তথায় গণ্ডশৈলসকল সুশোভিত আছে। মাল্যবানপর্ব্বত পঞ্চাশৎসহস্ৰ যোজন বিস্তীর্ণ; সেই স্থানে সুবৰ্ণবর্ণ মনুষ্যসকল জন্মগ্রহণ করিয়া অতি কঠোর তপানুষ্ঠানপূর্ব্বক ঊৰ্দ্ধরেতঃ [অস্থলিত ব্ৰহ্মচৰ্য্যসম্পন্ন] হইয়া থাকেন। তাঁহারা সকলেই দেবালোকপরিভ্রষ্ট ও ব্ৰহ্মবাদী, তাহারা প্রাণীগণের রক্ষাবিধান করিবার নিমিত্ত সূৰ্য্যমণ্ডলে প্রবেশ করিয়া থাকেন। তাঁহাদিগের ষট্‌ষষ্টিসহস্ৰ ব্যক্তি দিবাকরকে পরিবৃত করিয়া অরুণের অগ্ৰে গমন করেন এবং ষট্‌ষষ্টিসহস্ৰ বৎসর সূৰ্য্যতাপে তাপিত হইয়া চন্দ্ৰমণ্ডলে প্ৰবেশ করিয়া থাকেন।”