৫ম অধ্যায়
সন্ধি-উপেক্ষায় বিদুরের পাণ্ডবমীপে গমন
বৈশম্পায়ন কহিলেন, এদিকে পাণ্ডবেরা কাম্যাকবনবাসোদ্দেশে অনুচরগণ সমভিব্যাহারে জাহ্নবীকুল হইতে কুরুক্ষেত্রে গমন করিলেন। তাঁহারা ক্রমে সরস্বতী, দৃষদ্বতী ও যমুনায় স্নান করিয়া ক্ৰমাগত পশ্চিমমুখে এক বন হইতে বনান্তরে গমন করিতে লাগিলেন। অনন্তর তাঁহারা সরস্বতীতীরস্থিত মরুস্থলসমীপে মুনিজনপ্রিয় কাম্যকবন নিরীক্ষণ করিলেন। মহাপ্রবীর পাণ্ডবগণ মৃগপক্ষি-সমাকীর্ণ সেই কাম্যাকবনে বাস করিতে লাগিলেন; মুনিগণ তাঁহাদের সমভিব্যাহারে বাস করিয়া তাহাদিগকে সাত্ত্বনা করিতে লাগিলেন।
এই সময়ে সতত পাণ্ডবগণ-দর্শনলালস মহামতি বিদুর শীঘ্ৰগামী অশ্বগণযুক্ত স্যন্দনে আরোহণ করিয়া ঐশ্বৰ্য্যশালী কাম্যাকবনে গমন করিলেন। তথায় গিয়া দেখিলেন, ধর্ম্মাত্মা ধর্ম্মানন্দন নির্জ্জনে দ্রৌপদী ও ভ্রাতৃচতুষ্টয়-সমভিব্যাহারে উপবিষ্ট আছেন। সত্যপ্রতিজ্ঞ যুধিষ্ঠির দূর হইতে বিদুরকে শীঘ্ৰ আগমন করিতে দেখিয়া ভ্রাতা ভীমসেনকে কহিতে লাগিলেন, “হে বৃকোদর! ক্ষত্তা এখানে আগমন করিয়া না জানি আমাদিগকে কি বলিবেন। উনি কি শকুনির বিচনানুসারে পুনরায় দ্যূতক্রীড়ার নিমিত্ত আমাকে আহ্বান করিতে আসিতেছেন? হীনমতি শকুনি কি দ্যূতে আমাদের অস্ত্রশস্ত্ৰও জয় করিবে! হে ভীম! কেহ আমাকে আহ্বান করিলে আমি প্রত্যাখ্যান করিতে পারি না, কিন্তু গাণ্ডীব পরহস্তগত হইলে আমাদের রাজ্যলাভ করা নিতান্ত দুষ্কর হইবে।”
অনন্তর পাণ্ডবগণ গাত্ৰোত্থানপূর্ব্বক প্রত্যুদগমন করিয়া বিদুরকে আনয়ন করিলেন। বিদুর পাণ্ডবগণকর্ত্তৃক সৎকৃত হইয়া পরমসুখে তাঁহাদের সহিত একত্ৰ আসীন হইলেন। মহামতি ক্ষত্তা কিয়াৎকাল বিশ্রাম করিলে পর পাণ্ডবগণ তাঁহার আগমনকারণ জিজ্ঞাসা করিলেন। তখন তিনি আদ্যোপান্ত ধৃতরাষ্ট্রের সমুদয় বৃত্তান্ত কহিতে লাগিলেন।
বিদুরকর্ত্তৃক ধৃতরাষ্ট্রের ধৃষ্টতাকথন
বিদুর কহিলেন, “হে অজাতশত্রো, মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র আমাকে নির্জ্জনে আহ্বান করিয়া কহিলেন, “হে বিদুর! যাহা হইবার হইয়াছে, এক্ষণে যাহাতে উভয়কুলের হিত হয়, এমত উপদেশ প্রদান কর।” আমি তাহার বচনানুসারে তাহাকে কুরুবংশীয়দিগের, বিশেষতঃ তাঁহার যাহাতে শ্রেয়োলাভ হয়, এরূপ উপদেশ দিয়াছিলাম; কিন্তু তিনি তাহা শ্রবণ করিলেন না, কি করি, তদ্ব্যতীত অন্য কোন পরামর্শ আমার মতে শ্রেয়স্কর বোধ হইল না। হে পাণ্ডবগণ! ধৃতরাষ্ট্রের পক্ষে যাহা একান্ত শ্ৰেয়ঃ, আমি তাহাকে সেইরূপ পরামর্শ দিয়াছিলাম; যেমন পীড়িত ব্যক্তির উত্তম আহারদ্রব্যে রুচি হয় না, সেইরূপ অম্বিকানন্দনেরও আমার হিতকর বাক্যে প্রবৃত্তি হইল না। হে অজাতশত্ৰো! যেরূপ শ্রোত্রিয় গৃহবাসিনী ব্যভিচারিণী কামিনী কুলের অমঙ্গলজনক হয়, সেইরূপ ধৃতরাষ্ট্র আপন কুলবিনাশের কারণ হইলেন। যেমন কুমারীর ষষ্টিবৰ্ষবয়স্ক বৃদ্ধ স্বামীর প্রতি প্রীতি জন্মে না, সেইরূপ আমার বাক্যে ধৃতরাষ্ট্রের শ্রদ্ধা জন্মিল না। হে ভূপ! নিশ্চয়ই কুরুকুলের বিনাশ সমুপস্থিত হইয়াছে। ধৃতরাষ্ট্র শ্রেয়স্কর পথ অবলম্বন করিলেন না; আমার হিতকর উপদেশবাক্য পদ্মপত্রস্থিত জলের ন্যায় তাহার অন্তঃকরণে অস্থায়ী হইল। মহারাজ অম্বিকানন্দন আমার বাক্যশ্রবণে সাতিশয় ক্রুদ্ধ হইয়া কহিলেন, “বিদুর! তোমার যথা ইচ্ছা হয়, গমন কর; আমি এই পৃথিবী কিংবা নগর পালন করিবার নিমিত্ত আর তোমার সাহাৰ্য্যপ্রার্থনা করিব না।” হে যুধিষ্ঠির! ধৃতরাষ্ট্র আমাকে পরিত্যাগ করিয়াছেন; এক্ষণে তোমাকে সদুপদেশ দিতে আসিয়াছি; সভামধ্যে যাহা কহিয়াছিলাম, পুনর্ব্বার কহিতেছি, সাবধানে শ্রবণ কর ও যত্নসহকারে মনে রাখিও। হে পাণ্ডুনন্দন! যে ব্যক্তি সপত্নসমুত্থিত অশেষবিধ ক্লেশ সহ্য করিয়াও ক্ষমা অবলম্বনপূর্ব্বক কালপ্রতীক্ষা করে, সে ভবিষ্যতে একাকী সমুদয় পৃথিবী ভোগ করে। যে ব্যক্তি সহায়দিগের সহিত সমভাবে বিষয় ভোগ করে, সহায়গণ তাহার দুঃখের অংশভাগী হয়। হে ধর্ম্মানন্দন! সহায়সংগ্রহের এই একমাত্র উপায়; সহায় প্ৰাপ্তি পৃথিবীলাভের সদৃশ বোধ করিবে। হে যুধিষ্ঠির! সহায়গণের সহিত তুল্যরূপে বিষয় ভোগ করা শ্রেয়স্কর; তদ্বিপরীতচরণ বিপদের হেতু। উহাদের সমীপে কদাচ আত্মশ্লাঘা করিবে না। ভূমিপাল এইরূপ ব্যবহার করিলে অবশ্যই বৃদ্ধিলাভ করিতে পরিবেন।”
যুধিষ্ঠির কহিলেন, “হে ক্ষত্তঃ! আপনি যেরূপ উপদেশ দিলেন, আমি সাবধান হইয়া স্বীয় বুদ্ধিসাধ্যে তাহাই করিব; আর যে কিছু দেশকালোপযুক্ত পরামর্শ আছে, তাহাও বলুন, আমি যত্নপূর্ব্বক সে সকল পালন করিব।”