৪র্থ অধ্যায়
সন্ধি সম্বন্ধে কৃষ্ণের যুক্তি
বাসুদেব কহিলেন, “দ্রুপদরাজ পাণ্ডবরাজের প্রয়োজনসিদ্ধির নিমিত্ত যে কথার উল্লেখ করিলেন, তাহা তাঁহার পক্ষে কোনক্রমেই অসম্ভাবিত বা যুক্তিবিরুদ্ধ নহে। যদি মঙ্গলাকাঙ্ক্ষা থাকে, তাহা হইলে তাঁহার আদেশানুসারে কার্য্য করাই আমাদিগের সর্ব্বতোভাবে কর্ত্তব্য, অন্যথাচরণ করিলে অকিশয় মূর্খতা প্রকাশ হইবে, সন্দেহ নাই। কিন্তু কুরু ও পাণ্ডবদিগের সহিত আমাদিগের তুল্যসম্বন্ধ, তাঁহারা কখন মর্য্যাদা লঙ্ঘনপূর্ব্বক আমদিগের সহি অশিষ্ট ব্যবহার করেন নাই। আমরা বিবাহে নিমন্ত্রিত হইয়া এ স্থানে আগমন করিয়াছি এবং আপনিও সেই নিমিত্ত আসিয়াছেন, এক্ষণে বিবাহ সম্পন্ন হইয়াছে, আমরা পরমাহ্লাদে নিজ নিজ গৃহে প্রতিগমন করিব। আপনি বয়সে ও জ্ঞানে সর্ব্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ, দ্রোণ ও কৃপাচার্য্যের সখা, রাজা ধৃতরাষ্ট্রও সর্ব্বদা আপনাকে বহুমান করিয়া থাকে। আমরা আপনার শিষ্যস্বরূপ; অতএব যেসকল বাক্য পাণ্ডবদিগের পক্ষে অর্থকর, আপনি তাহার উল্লেখ করুন; আপনার বাক্যে আমাদের সংশয় জন্মিবার কোন সম্ভাবনা নাই। যদি দুর্য্যোধন ন্যায়তঃ সন্ধিসংস্থাপন করে, তাহা হইলে আর কুরুপাণ্ডবের সৌভ্রাত্র [ভ্রাতৃসৌহার্দ্য] নাশ বা কুলক্ষয় হয় না; কিন্তু যদি দুর্ম্মতি দুর্য্যোধন দর্পান্বিত হইয়া মোহবশতঃ সন্ধি না করে, তাহা হইলে অগ্রে অন্যান্য ব্যক্তিদিগের নিকট দূত প্রেরণ করিয়া পাশ্চাৎ আমাদিগকে আহ্বান করিবেন। অর্জ্জুন ক্রুদ্ধ হইলে দুর্ব্বদ্ধিপরতন্ত্র দুর্য্যোধন বন্ধুবান্ধব ও অমাত্যগণের সহিত বিনাশপ্রাপ্ত হইবে, তাহাতে সন্দেহ নাই।”
বিরাট-দ্রুপদের যুদ্ধায়োজনে সাহায্য
অনন্তর বিরাটরাজ কৃষ্ণকে অর্চনা করিয়া আত্মীয়স্বজন-সমভিব্যাহারে দ্বারকায় প্রেরণপূর্ব্বক যুধিষ্ঠির প্রভৃতি নৃপতিগণের সহিত সাংগ্রামিক [যুদ্ধবিষয়ক] আয়োজন করিতে লাগিলেন। পরে মহীপতি দ্রূপদ ও বিরাজরাজ বন্ধুবান্ধবগণের সহিত একবাক্য হইয়া ভূপাল-সকলের নিকট দূত প্রেরণ করিলেন। মহাবলপরাক্রান্ত মহীপালেরা পাণ্ডবগণ, মৎস্যরাজ ও পাঞ্চালমহীপতির আদেশে হৃষ্ঠচিত্তে সসৈন্যে বিরাটনগরে সমাগত হইলেন। ইহা শ্রবণ করিয়া ধৃতরাষ্ট্রতনয়গণও চতুর্দ্দিক হইতে ভূপালসকলকে আনয়ন করিতে লাগিলেন।
এইরূপে কুরুপাণ্ডব নিমিত্ত সমাগত রাজগণের প্রয়াণে [সর্ব্বদিক হইতে রাজগণের যাত্রা] ভুমণ্ডল পরিব্যাপ্ত হইল, চতুর্দ্দিক হইতে মহাবলপরাক্রান্ত বীরপুরুষসকল আগমন করিতে লাগিল, চতুরঙ্গিনী সেনায় বসুমতী সঙ্কুলা হইয়া উঠিল। বোধ হইল যেন, তাহাদিগের পদভরে এই প্রকাণ্ড মেদিনীমণ্ডল পর্ব্বতকাননের সহিত কম্পিত হইতে লাগিল। অনন্তর পাঞ্চালরাজ রাজা যুধিষ্ঠিরের মতানুসারে প্রজ্ঞাশালী বয়োবৃদ্ধ স্বীয় পুরোহিতকে কৌরবগণের নিকট প্রেরণ করিলেন।