৪র্থ অধ্যায়
পৃথিবীমাহাত্ম্য
বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! সত্যবতীসূত ভগবান্ বেদব্যাস ধীমান ধৃতরাষ্ট্রকে এইরূপ সম্ভাষণ করিয়া প্রস্থান করিলে পর রাজা ধৃতরাষ্ট্র মুহুর্ত্তকাল চিন্তা করিয়া ঘন ঘন দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগপূর্ব্বক সঞ্জয়কে কহিলেন, “হে সঞ্জয়! সংগ্রামানুরক্ত মহাবল পরাক্রান্ত মহীপালগণ রাজ্যলাভার্থ জীবনে উপেক্ষা করিয়াও বহুবিধ অস্ত্রশস্ত্রদ্বারা পরস্পরের সংহারে প্রবৃত্ত হইবেন; তাঁহারা লোকসংহার করিয়া কেবল যমালয় পরিপূর্ণ করিবেন; তথাচ কিছুতেই নিবৃত্ত হইবেন না। তাঁহারা পরস্পর পার্থিব ঐশ্বৰ্য্যলাভে অভিলাষী হইয়া কোনক্রমেই ক্ষান্ত হইতেছেন না; তন্নিমিত্ত ভূমিই [পৃথিবী রাজ্য] বহুগুণসম্পন্ন বলিয়া প্রতীয়মান হইতেছে; অতএব তুমি তাহার গুণকীর্ত্তন কর। হে সঞ্জয়! তুমি অমিততেজ্যাঃ [অসীম তেজস্বী] ব্যাসদেবের প্রসাদে দিব্যবুদ্ধি [সদবুদ্ধি] ও জ্ঞানচক্ষু লাভ করিয়াছ; অতএব কুরুক্ষেত্রে সহস্ৰ-সহস্ৰ, কোটি-কোটি, অবুদ-অর্বুদ বীরপুরুষ যেসকল দেশ ও নগর হইতে আগমন করিয়াছেন, এক্ষণে তাহারও পরিমাণ শ্রবণ করিতে বাসনা করি।”
সঞ্জয় কহিলেন, “মহারাজ! আপনি জ্ঞানচক্ষু, আমি আপনাকে নমস্কার করিয়া প্রজ্ঞানুসারে ভূমি সমুদয় গুণকীর্ত্তন করিতেছি শ্ৰবণ করুন। ভূত [প্রাণী] দুই প্রকারী—স্থাবর [স্থিতিশীল বৃক্ষাদি] ও জঙ্গম [গতিশীল পশু, পক্ষী, মনুষ্যাদি]। জঙ্গম তিন প্রকার—অণ্ডজ [ডিম হইতে জাত-পক্ষী], স্বেদজ [সর্প, সরীসৃপাদি; ঘর্ম্মাদি ক্লেদ হইতে জাত—ছারপোকাদি কীট] ও জরুয়ুজ [জরায়ুজ-জরায়ুনামক নারীগর্ভস্থ যন্ত্রমধ্যে জাত-পশু, মনুষ্য-প্রভৃতি]। এই ত্ৰিবিধ জঙ্গমের মধ্যে জরুয়ুজই শ্রেষ্ঠ; তাহার মধ্যে বিবিধ রূপধারী যজ্ঞের সাধন ও প্রবর্ত্তক পশুই প্রধান; তাহাদিগের মধ্যে সাতটি অরণ্যবাসী ও সাতটি গ্রামবাসী, এই চতুর্দ্দশ প্রকার ভেদ কল্পিত হইয়াছে। সিংহ, ব্যাঘ্র, বরাহ, মহিষ, হস্তী, বানর ও ভল্লুক, এই সাতটি অরণ্যবাসী; আর গো, ছাগ, মেষ, মনুষ্য, অশ্ব, অশ্বতর [গর্দ্দভ হইতে ঘোটকীতে জাত-খচ্চর] ও গর্দ্দভ- এই সাতটি গ্রামবাসী বলিয়া পরিগণিত হয়। হে মহারাজ! এই চতুর্দ্দশ প্রকার ভেদ বেদে নির্দ্দিষ্ট ও ইহাতে যাগযজ্ঞসমুদয় প্রতিষ্ঠিত আছে। গ্রামের মধ্যে মনুষ্য ও অরণ্যবাসীর মধ্যে সিংহই শ্রেষ্ঠ। এইসকল জীব পরস্পরকে আশ্রয় করিয়া জীবিকানির্ব্বাহ করিয়া থাকে। সমুদয় স্থাবর উদ্ভিজ্জ [ভূমিভেদপূর্ব্বক জাত]; তন্মধ্যে বৃক্ষ, গুল্ম [ডালপালাশূন্য ছোট ছোট গাছের ঝাড়—কুশাদি], লতা [বৃক্ষের আশ্রয়ে বৰ্দ্ধিত-গুডুচী প্রভৃতি], বল্লী [মৃত্তিকায় বিস্তৃত— কুমড়া, ফুটি প্রভৃতির লতা] ও ত্বকসার [বোম্বা-বেণা] তৃণজাতি, এই পাঁচ প্রকার প্রভেদ কল্পিত হইয়াছে। এই ঊনবিংশতি প্রকার স্থাবর-জঙ্গমাত্মক ভূত পঞ্চ মহাভূত[ব্ৰাহ্মণগণের মোক্ষদায়ক যে ব্ৰহ্ম-গায়ত্রী, তাহার অক্ষর, অর্থাৎ বর্ণ ২৪টি। স্থূল দেহ সৃষ্টির উৎপাদনও ২৪টি ক্ষিতি (মৃত্তিকা), অপ (জল), তেজ, মরুৎ (বায়ু), আকাশ, এই পঞ্চভূত, ইহার গ্রাহ্য বিষয় গন্ধ, রস, রূপ, স্পর্শ ও শব্দ, এই পাঁচটি, ইহার গ্রাহক নাসিকা, রসনা, চক্ষু, ত্বক ও কর্ণ, এই পাঁচ অক্ষর ইন্দ্ৰিয়; ইহাদের সহকারী হস্ত, পাদ, মুখ, পায়ু ও উপস্থ, এই পঞ্চ বাহ্য ইন্দ্ৰিয়; ইহাতে যোগ হয় প্রকৃতি, মন, বুদ্ধি, অহঙ্কার এই চারিটি— সমষ্টিতে চতুর্ব্বিংশতি। ইহার নাম চতুর্ব্বিংশতিতত্ত্ব, ভূমি-জয় প্রসঙ্গে ইহার অবতারণা, অতএব ইহা ভোগিজনজপ্য গায়ত্রী। ইহারও তত্ত্ব চতুর্ব্বিংশতি। তাহা অনুবাদে উক্ত। ছন্দোগ্য উপনিষদে এই গায়ত্রীর ইঙ্গিত আছে। অনুবাদে এই গায়ত্রীকে সর্ব্বত্রই চতুর্ব্বিংশতিবর্ণাত্মিকা বলা হইয়াছে, মূলে ও নীলকণ্ঠটীকায় বর্ণ বা অক্ষরের কথা নাই; হয় ত’ বা ব্ৰহ্মগায়ন্ত্রীর ২৪টি অক্ষর দৃষ্টি ইহাকে চতুর্ব্বিংশতিবর্ণাত্মিকা বলা হইয়া থাকিবে। চতুর্ব্বিংশতিতত্ত্বাত্মিকা বলিলে বোধহয় কোন গোল থাকে না।] সহ মিলিত হইয়া চতুর্ব্বিংশতি প্রকার হইতেছে; লোকে ইহাকে চতুর্ব্বিংশতিবর্ণাত্মিকা গায়ন্ত্ৰী বলিয়া নির্দেশ করে। যিনি এই সর্ব্বগুণযুক্ত অতি পবিত্র গায়ত্রী সম্যক্ বিদিত হইয়াছেন, তাঁহার আর ইহলোকে বিনাশ নাই। ভূমি হইতে সমস্ত উৎপন্ন ও ভূমিতেই লয় প্রাপ্ত হইয়া থাকে, ভূমি সর্ব্বভূতের অধিষ্ঠান ও ভূমিই নিত্য। যাহার ভূমি আছে তাহারই এই স্থাবরজঙ্গমাত্মক জগৎ বশীভূত। ভূপালগণ এই ভূমিলাভের নিমিত্তই একান্ত লোলুপ হইয়া পরস্পর বিনষ্ট হইয়া থাকেন।”