৪র্থ অধ্যায়
কুরু-পাণ্ডবে সন্ধিস্থাপনে বিদুরের উপদেশ
বৈশম্পায়ন কহিলেন, পাণ্ডবগণ বনে গমন করিলে পর প্রজ্ঞাচক্ষু মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র ধর্ম্মাত্মা অগাধবুদ্ধি বিদুরকে সম্বোধন করিয়া কহিতে লাগিলেন, ‘হে বিদুর! তোমার বুদ্ধি শুক্রাচার্য্যের বুদ্ধির ন্যায় পরিশুদ্ধ; তুমি ধর্ম্মের সূক্ষ্মতা বিলক্ষণ অবগত আছ ও সমুদয় কুরুবংশীয়দিগের প্রতি তোমার সমান ভাব দৃষ্ট হইতেছে; অতএব যাহাতে উভয়কুলের হিত সম্ভাবিতে পারে, ঈদৃশ পরামর্শ প্রদান কর। দেখ, যাহা হইবার হইয়াছে, এক্ষণে কি করা কর্ত্তব্য? পৌরগণ কিরূপে আমাদিগের বশবর্ত্তী হইবে? হে ক্ষত্তঃ! যাহাতে তাহারা আমাদিগের সমূলে উন্মুলন না করে, এমন উপায় উদ্ভাবন করিয়া আমাকে সৎপরামর্শ প্ৰদান কর।”
বিদুর কহিলেন, “হে নরেন্দ্ৰ! ধর্ম্মবিৎ পণ্ডিতগণ ত্রিবর্গ ও রাজ্যকে ধর্ম্মমূল কহিয়া থাকেন, অতএব আপনি ধর্ম্মপথ অবলম্বনপূর্ব্বক স্বশক্তিপ্রভাবে স্বীয় পুত্ৰগণ ও পাণ্ডবদিগকে প্রতিপালন করুন। দেখুন, শকুনিপ্রমুখ পাপাত্মাগণ সভামধ্যে অধর্ম্মকর্ম্মের অনুষ্ঠান করিয়াছে, আপনার পুত্র, ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠিরকে আহ্বান করিয়া কপটদ্যূতে পরাজয় করিয়াছে। হে মহারাজ! আমি আপনাদিগের এই দুষ্কর্ম্মের প্রতিবিধান করিবার নিমিত্ত এক উপায় স্থির করিয়াছি, উহা অবলম্বন করিলে আপনার পুত্র স্বকৃত পাপপুঞ্জ হইতে মুক্ত ও জনসমাজে লব্ধপ্রতিষ্ঠ হইতে পরিবে। হে রাজন! আপনি পাণ্ডবগণকে যাহা প্ৰদান করিয়াছিলেন, তাহারা তৎসমুদয় পুনঃপ্রাপ্ত হউন। হে ভূপতে! স্বধনে পরিতৃপ্ত হওয়া ও পরিধানে লোভ না করাই রাজাদিগের পরম ধর্ম্ম। পাণ্ডবগণের তুষ্টি-সম্পাদন ও শকুনির অবমাননা করা আপনার প্রধান কর্ম্ম, ইহা হইলে আপনার যশের হানি, জ্ঞাতিভেদ বা ধর্ম্মলোপ হইবে না। হে মহীপাল! যদি আপনি স্বীয় পুত্ৰগণের মঙ্গলাকাঙ্ক্ষী হয়েন, তবে সত্বর আমার বাক্যানুসারে কর্ম্ম করুন, নতুবা নিশ্চয়ই কুরুকুলের বিনাশ হইবে। ভীমসেন ও অৰ্জ্জুন ক্রুদ্ধ হইলে কখনই শক্রগণের শেষ রাখিবেন না। শরাসনশ্রেষ্ঠ গাণ্ডীব যাঁহাদের ধনু এবং অস্ত্রবিদ্যাবিশারদ ধনঞ্জয় ও বাহুবলশালী বৃকোদর যাঁহাদের যোদ্ধা, এই ভূমণ্ডলে তাঁহাদের অসাধ্য কি আছে? আমি দুৰ্য্যোধন জন্মিবামাত্র আপনার হিতসাধনাৰ্থ কহিয়াছিলাম, “উহাকে পরিত্যাগ করুন”, আপনি তখন আমার সেই হিতকর বাক্য শ্রবণ করেন নাই। এক্ষণে আপনাকে পুনরায় অন্য এক হিতবাক্য কহিলাম, যদি এতদনুসারে কাৰ্য্য না করেন, পশ্চাৎ পরিতাপ করিতে হইবে। যদি আপনার পুত্ৰ সন্তুষ্টচিত্তে পাণ্ডবগণের সহিত একত্র রাজ্যভোগ করিতে সম্মত হয়, তাহা হইলে আপনার আর সন্তাপের বিষয় থাকিবে না। নচেৎ দূরাত্মা দুৰ্য্যোধনকে নিগ্ৰহ করিয়া ধর্ম্মাত্মা যুধিষ্ঠিরের হস্তে আধিপত্য সমর্পণ করুন। অজাতশত্রু পাণ্ডুতনয় রাগদ্বেষশূন্য হইয়া ধর্ম্মতঃ পৃথিবী শাসন করুন; তাহা হইলে সমস্ত ভূপালগণ বৈশ্যগণের ন্যায় আমাদের উপাসনা করিবেন; দুৰ্য্যোধন, শকুনি ও সূতপুত্ৰ কৰ্ণ প্রীতিপূর্ব্বক পাণ্ডবগণের শরণাগত হউক এবং দুঃশাসন সভামধ্যে ভীমসেন ও দ্রৌপদীর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করুক। হে রাজন! আপনি যুধিষ্ঠিরকে সান্ত্বনা করিয়া রাজ্যে অভিষিক্ত করুন। হে মহারাজ! আপনি আমাকে উপদেশ জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন, আমার যাঁহা কর্ত্তব্য, তাঁহা বলিলাম; এক্ষণে তদনুসারে কাৰ্য্য করিলেই কৃতকাৰ্য্য হইবেন, সন্দেহ নাই।”
বিদূরের কাম্যাকবনে গমন
তখন ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, “হে বিদুর! তুমি যৎকালে সভামধ্যে আমার ও পাণ্ডবগণের সমক্ষে এই সমস্ত কথা কহিয়াছিলে, তৎকালে এ সকল পাণ্ডবগণের হিতকর ও আমাদের অহিতকর বলিয়া বোধ হয় নাই; কিন্তু অদ্য স্পষ্টই বোধ হইল, তুমি পাণ্ডবগণের হিতার্থেই এই সকল কথা কহিতেছ; আমাদের হিতসাধনে তোমার অণুমাত্ৰও যত্ন নাই। আমি কিরূপে পাণ্ডবগণের নিমিত্ত স্বীয় পুত্র পরিত্যাগ করিব? পাণ্ডবেরাও আমার পুত্র বটে, কিন্তু দুৰ্য্যোধন আমার দেহ হইতে সমুৎপন্ন হইয়াছে। হে বিদুর! কোন সমদর্শী ব্যক্তি পরের নিমিত্ত আপন দেহ পরিত্যাগ করিতে উপদেশ প্ৰদান করেন? হে ক্ষত্তঃ! কিন্তু আমি তোমার যথেষ্ট সম্মান করিয়া থাকি, স্পষ্টই বোধ হইতেছে, তুমি আমাকে অহিতকর কপট উপদেশ দিতেছ, অতএব তুমি এই স্থানে থাক বা অন্য কোন স্থানেই গমন কর, তাহাতে আমার ক্ষতি নাই; বুঝিলাম কুলটা স্ত্রীকে উত্তমরূপে সাত্ত্বনা করিলেও সে স্বামীকে পরিত্যাগ করিয়া থাকে।”
মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র এই কথা কহিয়া সহসা গাত্ৰোত্থানপূর্ব্বক অন্তঃপুরে প্রস্থান করিলেন। মহাত্মা বিদুরও “এ কাৰ্য্য হইবার নহে”, এই কথা বলিতে বলিতে পাণ্ডবগণের নিকট গমন করিলেন।