তৃতীয় অধ্যায়
পৌষ্যপর্ব্ব-জনমেজয় শাপ
উগ্রশ্রবাঃ কহিলেন, কুরুক্ষেত্রে পরীক্ষিতপুৎত্র রাজা জনমেজয় ভ্রাতৃগণ সমভিব্যাহারে এক দীর্ঘ-সত্র [দীর্ঘকালব্যাপী যজ্ঞ] অনুষ্ঠান করিতেছেন। তাঁহার তিন সহোদর– শ্রুতসেন, উগ্রসেন ও ভীমসেন। তাঁহাদিগের যজ্ঞানুষ্ঠানকালে একটা কুক্কুর তথায় উপস্থিত হইল। জনমেজয়ের ভ্রাতৃগণ ক্রোধান্ধ হইয়া তাহাকে প্রহার করিলে সে রোদন করিতে করিতে মাতৃসন্নিধানে গমন করিল। সরমা তাহাকে অকস্মাৎ রোদন করিতে দেখিয়া কহিল, “তুমি কেন কাঁদিতেছ? কে তোমাকে প্রহার করিয়াছে, বল।” জননী কর্ত্তৃক এইরূপ অভিহিত হইয়া সে কহিল, “জনমেজয়ের ভ্রাতৃগণ আমাকে প্রহার করিয়াছেন।” তাহা শুনিয়া দেবশুনী কহিল, “বোধ হয়, তুমি তাঁহাদিগের কোন অপকার করিয়া থাকিবে।” সে পুনর্ব্বার কহিল, “আমি তাঁহাদিগের কিছুমাত্র অপকার করি নাই, যজ্ঞের হবিঃও নিরীক্ষণ করি নাই, তাঁহারা অকারণে আমাকে প্রহার করিয়াছেন।” তৎশ্রবণে সরমা অতি দুঃখিতা হইয়া যথায় জনমেজয় ভ্রাতৃগণসমভিব্যাহারে বহুবার্ষিক যজ্ঞের অনুষ্ঠান করিতেছেন, তথায় সমুপস্থিত হইয়া রোষভরে কহিতে লাগিল, “আমার পুৎত্র তোমাদিগের কিছুমাত্র অপকার করে নাই, যজ্ঞের হবিঃ অবেক্ষণ [দর্শন] ও অবলেহন করে নাই, তোমরা কি নিমিত্ত ইহাকে প্রহার করিয়াছ, বল?” তাঁহারা কিছুই প্রত্যুত্তর দিলেন না। তখন সরমা কহিল, “তোমরা নিরপরাধকে প্রহার করিয়াছ, অতত্রব অনুপলক্ষিত [অজ্ঞাত] ভয় তোমাদিগকে আক্রমণ করিবে।” জনমেজয় দেবশুনী সরমার এইরূপ অভিশাপ শ্রবণ করিয়া অতিশয় বিষণ্ণ ও সন্ত্রস্ত হইলেন।
সোমশ্রবা ঋষির উপাখ্যান
অনন্তর সেই যজ্ঞ সমাপ্ত হইলে জনমেজয় হস্তিনাপুরে আগমন ও সরমাশাপ-নিবারণের নিমিত্ত সাতিশয় প্রযত্নসহকারে এক অনুরূপ পুরোহিত অনুসন্ধান করিতে লাগিলেন। একদা মৃগয়ায় নির্গত হইয়া জনমেজয় স্বীয় জনপদের অন্তর্গত এক আশ্রম দর্শন করিলেন। তথায় শ্রুতশ্রবাঃ নামক এক ঋষি বাস করিতেন। তাঁহার সোমশ্রবাঃ নামে এক পুৎত্র ছিল। জনমেজয় ঋষিপুৎত্রের সন্নিহিত হইয়া তাঁহাকে পৌরোহিত্যে বরণ করিলেন এবং ঋষিকে নমস্কার করিয়া কৃতাঞ্জলিপুটে কহিলেন, “ভগবন্! আপনার এই পুৎত্র আমার পুরোহিত হউন।” রাজার এইরূপ কথা শ্রবণ করিয়া শ্রুতশ্রবাঃ কহিলেন, “হে জনমেজয়! একদা এক সর্পী আমার শুক্র পান করিয়াছিল। ঐ শুক্রে তাহার গর্ভসঞ্চার হয়; আমার এই পুৎত্র ঐ গর্ভে জন্মেন। ইনি মহাতপস্বী, অধ্যয়ননিরত ও মদীয় তপোবীর্য্যে সম্ভূত। মহাদেবের অভিশাপ ব্যতিরেকে তোমার সমুদয় শাপশান্তি করিতে সমর্থ হইবেন। কিন্তু ইঁহার একটি নিগূঢ় ব্রত আছে যে, যদি কোন ব্রাহ্মণ ইঁহার সন্নিধানে কোন বিষয় প্রার্থনা করেন, ইনি তৎক্ষণাৎ তাহা প্রদান করিয়া থাকেন, যদি ইহাতে সাহস হয়, তবে ইঁহাকে লইয়া যাও।” শ্রুতশ্রবার এইরূপ কথা শুনিয়া জনমেজয় প্রত্যুত্তর করিলেন, “মহাশয়! আপনি যাহা অনুমতি করিতেছেন, আমি তাহাতে সম্মত আছি।” এই কথা কহিয়া পুরোহিত-সহ স্বনগরে প্রত্যাগমনকরতঃ ভ্রাতৃগণকে কহিলেন, “আমি এই মহাত্মাকে পৌরোহিত্যে বরণ করিয়াছি, ইনি যখন যাহা অনুজ্ঞা করিবেন, তোমরা তদ্বিষয়ে কোন বিচার না করিয়া তৎক্ষণাৎ তাহা সম্পাদন করিবে; কিছুতেই যেন তাহার ব্যতিক্রম না হয়। “সহোদরদিগকে এইরূপ আদেশ করিয়া তিনি তক্ষশিলায় প্রস্থান করিলেন ও অনতিবিলম্বেই সেই প্রদেশ আপন অধিকারে আনিলেন।
আয়োধধৌম্য ও আরুণিবৃত্তান্ত
ইত্যবসরে প্রসঙ্গক্রমে একটি উপাখ্যানের উল্লেখ হইতেছে। আয়োধধৌম্য নামে এক ঋষি ছিলেন। উপমন্যু, আরুণি ও বেদ নামে তাঁহার তিনটি শিষ্য ছিল। তিনি একদিন পাঞ্চালদেশীয় আরুণি নামক শিষ্যকে আহ্বান করিয়া ক্ষেত্রের আলি বাঁধিতে অনুমতি করিলেন। আরুণি উপাধ্যায়ের উপদেশক্রমে ক্ষেত্রে গমন করিয়া অশেষ ক্লেশ স্বীকার করিয়াও পরিশেষে আলি বাঁধিতে অশক্ত হইলেন। অগত্যা তথায় শয়ন করিয়া জলনির্গম নিবারণ করিলেন। কোন সময়ে উপাধ্যায় আয়োধধৌম্য শিষ্যগণকে জিজ্ঞাসিলেন, “পাঞ্চালদেশীয় আরুণি কোথায় গিয়াছে?” তাহারা কহিল, “ভগবন্! আপনি তাহাকে ক্ষেত্রের আলি বাঁধিতে প্রেরণ করিয়াছেন।” তাহা শ্রবণ করিয়া উপাধ্যায় কহিলেন, “যথায় আরুণি গমন করিয়াছে, চল, আমরাও তথায় যাই।” অনন্তর সেই স্থানে গমন করিয়া উচ্চৈঃস্বরে এইরূপে তাঁহাকে আহ্বান করিতে লাগিলেন, “ভো বৎস আরুণি! কোথায় গিয়াছ, আইস।” তৎশ্রবণে আরুণি সহসা তথা হইতে উত্থিত ও উপাধ্যায়ের সন্নিহিত হইয়া অতি বিনীতবচনে নিবেদন করিলেন, “ক্ষেত্রের যে জল নিঃসৃত হইতেছিল, তাহা অবারণীয়; সুতরাং তৎপ্রতিরোধের নিমিত্ত আমি তথায় শয়ন করিয়াছিলাম। এক্ষণে আপনার কথা শ্রবণ করিয়া সহসা কেদার [ক্ষেতের আলি] খণ্ড বিদারণপূর্ব্বক আপনার সম্মুখীন হইলাম; অভিবাদন করি, আর কি অনুষ্ঠান করিব, অনুমতি করুন।” আরুণি এইরূপ কহিলে উপাধ্যায় উত্তর করিলেন, “বৎস! যেহেতু তুমি কেদারখণ্ড বিদারণ করিয়া উত্থিত হইয়াছ, অতত্রব অদ্যাবধি তোমার নাম উদ্দালক বলিয়া প্রসিদ্ধ হইবে এবং আমার আজ্ঞাপালন করিয়াছ, এই নিমিত্ত তোমার শ্রেয়োলাভ হইবে। সকল বেদ ও সকল ধর্ম্মশাস্ত্র সর্ব্বকালে সমভাবে তোমার অন্তরে প্রতিভাত হইবে।” পরে আরুণি উপাধ্যায়ের আদেশ লাভ করিয়া অভিলষিত দেশে গমন করিলেন।
উপমন্যু-উপাখ্যান
আয়োধধৌম্যের উপমন্যু নামে একটি শিষ্য ছিলেন। একদা উপাধ্যায় তাঁহাকে কহিলেন, “বৎস উপমন্যু! সতত সাবধানে আমার গোধন রক্ষা কর।” এই বলিয়া তাঁহাকে গোচারণে প্রেরণ করিলেন। উপমন্যু তাঁহার অনুমতিক্রমে দিবাভাগে গোচারণ করিয়া সায়াহ্নে গুরুগৃহে প্রত্যাগমনপূর্ব্বক তাঁহাকে অভিবাদন করিয়া সম্মুখে দণ্ডায়মান থাকিতেন। একদিন উপাধ্যায় তাঁহাকে স্থূলকায় দেখিয়া কহিলেন, “বৎস উপমন্যু! তোমাকে ক্রমশঃ অতিশয় হৃষ্ট-পুষ্ট দেখিতেছি, এক্ষণে কিরূপ আহার করিয়া থাক, বল।” তিনি উত্তর করিলেন, “ভগবন্! আমি এক্ষণে ভিক্ষাবৃত্তি অবলম্বন করিয়াছি।” তাহা শ্রবণ করিয়া উপাধ্যায় কহিলেন, “দেখ, আমাকে না জানাইয়া ভিক্ষালব্ধ দ্রব্যজাত উপযোগ [ভক্ষণ] করা তোমার বিধেয় নহে। “উপমন্যু তাহাই স্বীকার করিয়া ভিক্ষান্ন আহরণপূর্ব্বক গুরুকে প্রত্যর্পণ করিলেন; উপাধ্যায় সমস্ত ভিক্ষান্ন গ্রহণ করিলেন; ভক্ষণার্থ তাঁহাকে কিছুই দিলেন না। অনন্তর উপমন্যু দিবাভাগে গো-রক্ষা করিয়া সায়াহ্নে গুরুগৃহে আগমন ও তাঁহার সম্মুখে উপস্থিত হইয়া নমস্কার করিলেন। উপাধ্যায় তাঁহাকে অত্যন্ত পুষ্ট দেখিয়া কহিলেন, “বৎস উপমন্যু! তোমার ভিক্ষান্ন সমুদয়ই গ্রহণ করিয়া থাকি, তথাপি তোমাকে অতিশয় স্থূলকায় দেখিতেছি, এক্ষণে কি আহার করিয়া থাক, বল।” তিনি এইরূপ অভিহিত হইয়া প্রত্যুত্তর করিলেন, “ভগবন্! একবার ভিক্ষা করিয়া আপনাকে প্রদান করি, দ্বিতীয়বার কয়েক মুষ্টি তণ্ডুল আহরণ করিয়া আপনার উদর পূরণ করিয়া থাকি।” উপাধ্যায় কহিলেন, “দেখ, ইহা ভদ্রলোকের ধর্ম্ম ও সমুচিত কর্ম্ম নহে। ইহাতে অন্যের বৃত্তিরোধ হইতেছে, আরও এইরূপ অনুষ্ঠান করিলে তুমিও ক্রমশঃ লোভপরায়ণ হইবে। “উপাধ্যায় কর্ত্তৃক এইরূপ আদিষ্ট হইয়া উপমন্যু পূর্ব্ববৎ গোচারণ ও সায়ংকালে গুরুগৃহে আগমন করিলে উপাধ্যায় তাঁহাকে কহিলেন, “বৎস উপমন্যু! তুমি ইতস্ততঃ পর্য্যটন করিয়া যে ভিক্ষান্ন আহরণ কর, তাহা আমি সম্পূর্ণই লইয়া থাকি এবং প্রতিষেধ করিয়াছি বলিয়া তুমিও দ্বিতীয়বার ভিক্ষা কর না; তথাপি তোমাকে পূর্ব্বাপেক্ষা সমধিক স্থূলকায় দেখিতেছি, এক্ষণে কি আহার করিয়া থাক, বল।” এইরূপ অভিহিত হইয়া উপমন্যু কহিলেন, “ভগবন্! এক্ষণে ধেনুগণের দুগ্ধ পান করিয়া প্রাণধারণ করিতেছি।” উপাধ্যায় কহিলেন, “দেখ, আমি তোমাকে অনুমতি করি নাই, সুতরাং ধেনুর দুগ্ধ পান করা তোমার অত্যন্ত অন্যায় হইতেছে।” গুরুবাক্য অঙ্গীকার করিয়া উপমন্যু পূর্ব্ববৎ গোচারণ ও গুরুগৃহে প্রত্যাগমনপূর্ব্বক তাঁহার সম্মুখে উপস্থিত হইয়া নমস্কার করিলেন। গুরু তাঁহাকে বিলক্ষণ স্থূল দেখিয়া কহিলেন, “বৎস উপমন্যু! তুমি ভিক্ষান্ন ভক্ষণ ও দ্বিতীয়বার ভিক্ষার্থ পর্য্যটন কর না এবং ধেনুর দুগ্ধ পান করিতেও তোমাকে নিবারণ করিয়াছি, তথাপি তোমাকে অতিশয় স্থূলকলেবর দেখিতেছি, এক্ষণে কি আহার করিয়া থাক, বল।” উপমন্যু কহিলেন, :বৎসগণ মাতৃস্তন পান করিয়া যে ফেন উদগার করে, আমি তাহা পান করি।” উপাধ্যায় কহিলেন, “অতি শান্তস্বভাব বৎসগণ তোমার প্রতি অনুকম্পা করিয়া অধিক পরিমাণে ফেন উদগার করিয়া থাকে, সুতরাং তুমি তাহাদিগের আহারের ব্যাঘাত করিতেছ। অতঃপর তোমার ফেন পান করাও বিধেয় নহে।” এইরূপ আদিষ্ট হইয়া উপমন্যু পূর্ব্ববৎ গোরক্ষা করিতে লাগিলেন।
এইরূপে উপাধ্যায় কর্ত্তৃক প্রতিষিদ্ধ হইয়া তিনি আর ভিক্ষান্ন ভক্ষণ করিতেন না, দ্বিতীয়বার ভিক্ষার্থ পর্য্যটন করিতেন না, ধেনুর দুগ্ধপান ও দুগ্ধের ফেনোপযোগেও বিরত হইলেন। একদা তিনি অরণ্যে গোচারণে ক্ষুধার্ত্ত হইয়া অর্কপত্র ভক্ষণ করিলেন। সেই সকল ক্ষার, তিক্ত, কটু, রুক্ষ ও তীক্ষ্মবিপাক অর্কপত্র উপযোগ করাতে চক্ষুদোষ জন্মিয়া অন্ধ হইলেন; অন্ধ হইয়া ইতস্ততঃ ভ্রমণ করিতে করিতে এক কূপে নিপাতিত হইলেন।
অনন্তর ভগবান্ দিনমণি অস্তাচল-চূড়াবলম্বী হইলে, উপাধ্যায় আয়োধধৌম্য শিষ্যদিগকে কহিলেন, “দেখ উপমন্যু এখনও আসিতেছে না।” শিষ্যেরা কহিলেন, “ভগবন্! উপমন্যুকে আপনি গোচারণের নিমিত্ত অরণ্যে প্রেরণ করিয়াছেন।” উপাধ্যায় কহিলেন, “দেখ, আমি উপমন্যুকে সর্ব্বপ্রকার আহার করিতে নিষেধ করিয়াছি, বোধ হয়, সে কুপিত হইয়াছে; এই নিমিত্ত প্রত্যাগত হইতেছে না। চল, আমরা গিয়া তাহার অনুসন্ধান করি।” এই বলিয়া শিষ্যগণ-সমভিব্যাহারে বন-গমনপূর্ব্বক “বৎস উপমন্যু! কোথায় গিয়াছ?” এই বলিয়া মুক্তকণ্ঠে তাহাকে আহ্বান করিতে লাগিলেন। উপমন্যু উপাধ্যায়ের স্বরসংযোগ শ্রবণ করিয়া উচ্চৈঃস্বরে কহিলেন, “আমি কূপে পতিত হইয়াছি।” তাহা শ্রবণ করিয়া উপাধ্যায় কহিলেন, “তুমি কিরূপে কূপে নিপতিত হইয়াছ?” তিনি প্রত্যুত্তর করিলেন, “আমি অর্কপত্র-ভক্ষণে অন্ধ হইয়া কূপে পতিত হইলাম।” উপাধ্যায় কহিলেন, “তুমি দেববৈদ্য অশ্বিনীকুমারের স্তব কর। তাহা হইলে তোমার চক্ষুলাভ হইবে।” উপমন্যু উপাধ্যায়ের উপদেশানুসারে বেদবাক্য দ্বারা অশ্বিনীকুমার দেবতাদ্বয়ের স্তব আরম্ভ করিলেন। “হে অশ্বিনীকুমার! তোমরা সৃষ্টির প্রারম্ভে বিদ্যমান ছিলে; তোমরাই সর্ব্বভূতপ্রধান হিরণ্যগর্ভরূপে উৎপন্ন হইয়াছ, পরে তোমরাই সংসারে প্রপঞ্চ [সংসার জীব] স্বরূপে প্রকাশমান হইয়াছ; দেশ, কাল ও অবস্থা দ্বারা তোমাদিগের ইয়ত্তা করা যায় না; তোমরাই মায়া ও মায়ারূঢ় চৈতন্যরূপে দ্যোতমান আছ; তোমরা শরীরবৃক্ষে পক্ষিরূপে অবস্থান করিতেছ; তোমরা সৃষ্টিপ্রক্রিয়ায় পরমাণুসমষ্টি ও প্রকৃতির সহযোগিতার আবশ্যকতা রাখ না; তোমরা বাক্য ও মনের অগোচর; তোমরাই স্বীয় প্রকৃতির বিক্ষেপশক্তি দ্বারা নিখিল বিশ্বকে সুপ্রকাশ করিয়াছ। এক্ষণে আমি নির্ব্ব্যাধি হইবার জন্য শ্রবণ, মনন ও নিদিধ্যাসন [প্রগাঢ় চিন্তা] দ্বারা তোমাদিগের আরাধনা করিতে প্রবৃত্ত হইয়াছি। তোমরা পরম রমণীয় ও নির্লিপ্ত, বিলীন জগতের অধিষ্ঠানভূত, মায়াবিকার-রহিত এবং জন্মমৃত্যু বিবর্জ্জিত; তোমরা সর্ব্বকাল সমভাবে বিরাজমান আছ; তোমরা ভাস্কর সৃষ্টি করিয়া দিনযামিনীরূপ শুক্ল ও কৃষ্ণবর্ণ সূত্র দ্বারা সংবৎসররূপ বস্ত্র বয়ন করিতেছ; তোমরা জীবদিগকে সুবিহিত পথ সতত প্রদর্শন কর; তোমরা পরমাত্মশক্তিরূপ কালপাশ হইতে বিমুক্ত করিয়া জীবাত্ম-স্বরূপ পক্ষিণীকে মোক্ষরূপ সৌভাগ্যশালিনী করিয়াছ। জীবেরা যাবৎ অজ্ঞানান্ধকারাচ্ছন্ন থাকিয়া নিরবচ্ছিন্ন ইন্দ্রিয়-পরতন্ত্র থাকে, তাবৎ তাহারা সর্ব্বদোষ-স্পর্শশূন্য চৈতন্যস্বরূপ তোমাদিগকে শরীরী বলিয়া ভাবনা করে। ত্রিশতষষ্টি দিবস-স্বরূপ গোসকল সংবৎসররূপ যে বৎস উৎপাদন করে, তত্ত্বজিজ্ঞাসুরা ঐ বৎসকে আশ্রয় করিয়া পৃথক ফলক্রিয়াসমূহরূপ গো হইতে তত্ত্বজ্ঞানস্বরূপ দুগ্ধ দোহন করেন; উৎপাদক ও সংহারক সেই বৎসকে তোমরাই প্রসব করিয়াছ। অহোরাত্রস্বরূপ সপ্তশতবিংশতি অর [চক্রমধ্যস্থ কাষ্ঠ] সংবৎসররূপ নাভিতে [চাকার হাঁড়ী] সংস্থিত এবং দ্বাদশমাসরূপ প্রধি [রথচক্রের প্রান্ত] দ্বারা পরিবেষ্টিত যুষ্মৎ-প্রকাশিত নেমিশূন্য মায়াত্মক অক্ষয় কালচক্র নিরন্তর পরিবর্ত্তিত হইতেছে। দ্বাদশ রাশিরূপ অর, ছয় ঋতুস্বরূপ নাভি ও সংবৎসররূপ অক্ষ [চক্রের মধ্যমণ্ডল]-সংযুক্ত এবং ধর্ম্মফলের আধারভূত একখানি চক্র আছে, যাহাতে কালাভিমানিনী দেবতা সতত অবস্থিত আছেন। হে অশ্বিনীকুমার যুগল! তোমরা ঐ চক্র হইতে আমাকে মুক্ত কর, আমি জন্ম মরণ ক্লেশে অতিশয় ক্লিষ্ট আছি। তোমরা সনাতন ব্রহ্ম হইয়াও জড়স্বভাব বিশ্বস্বরূপ; তোমরাই কর্ম্ম ও কর্ম্মফল স্বরূপ। আকাশাদি সমস্ত জড়পদার্থ তোমাদের স্বরূপে লয়প্রাপ্ত হয়, তোমরাই অবিদ্যাপ্রভাবে তত্ত্বজ্ঞান উপার্জ্জন করিতে বিমুখ হইয়াও বিষম-বিষয়-রসাস্বাদ-সুখভোগ দ্বারা ইন্দ্রিয়বৃত্তি চরিতার্থ করিয়া সংসার-মায়াজালে জড়িত হও। তোমরা সৃষ্টির পূর্ব্বে দশদিক্ আকাশ ও সূর্য্যমণ্ডলের উদ্ভাবন করিয়াছ; মহর্ষিগণ সূর্য্য-বিহিত সময়ানুসারে বেদ-প্রতিপাদ্য কার্য্যকলাপ নির্ব্বাহ করেন এবং নিখিল দেবগণ ও মনুষ্যেরা বিবিধ ঐশ্বর্য্য ভোগ করেন। তোমরা আকাশাদি সূক্ষ্ম পঞ্চভূত সৃষ্টি করিয়া তাহাদের পঞ্চীকরণ করিয়াছ, সেই পঞ্চভূত হইতে অখিল ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্ট হইয়াছে, প্রাণিগণ ইন্দ্রিয়পরবশ হইয়া বিষয়ানুরক্ত হইতেছে এবং নিখিল দেবগণ ও সমগ্র মনুষ্য অধিষ্ঠানভূতা এই পৃথিবীতে অধিষ্ঠত আছে। তোমাদিগকে ও তোমাদের কণ্ঠদেশাবলম্বিত কমলমালিকাকে প্রণাম করি। নিত্যযুক্ত কর্ম্মফলদাতা অশ্বিনীকুমারযুগলের সাহায্য বিনা অন্যান্য দেবগণ স্বকীয় কার্য্যসাধনে সক্ষম নহেন। হে অশ্বিনীকুমার! তোমরা অগ্রে মুখ দ্বারা অন্নরূপ গর্ভ গ্রহণ কর, পরে অচেতন দেহ ইন্দ্রিয় দ্বারা সেই গর্ভ প্রসব করে। ঐ গর্ভ প্রসূতমাত্র মাতৃস্তন্যপানে নিযুক্ত হয়। এক্ষণে তোমরা আমার চক্ষুর্দ্বয়ের অন্ধত্ব মোচন করিয়া প্রাণরক্ষা কর।” অশ্বিনীকুমারযুগল উপমন্যুর এইরূপ স্তবে সন্তুষ্ট হইয়া তথায় আবির্ভূত হইলেন এবং কহিলেন, “আমরা তোমার প্রতি অতিশয় প্রসন্ন হইয়াছি, অতএব তোমাকে এক পিষ্টক দিতেছি, ভক্ষণ কর।” এইরূপ আদিষ্ট হইয়া তিনি কহিলেন, “আপনাদিগের কথা অবহেলন করিবার যোগ্য নয়; কিন্তু আমি গুরুকে নিবেদন না করিয়া অপূপ [পিষ্টক] ভক্ষণ করিতে পারি না।” তখন অশ্বিনীতনয়দ্বয় কহিলেন “পূর্ব্বে তোমার উপাধ্যায় আমাদিগকে স্তব করিয়াছিলেন। আমরা তাঁহার প্রতি সন্তুষ্ট হইয়া এক পিষ্টক দিয়াছিলাম; কিন্তু তিনি গুরুর আদেশ না লইয়া তাহা উপযোগ করেন; অতএব তোমার উপাধ্যায় যেরূপ করিয়াছিলেন, তুমিও সেইরূপ কর।” এইরূপ অভিহিত হইয়া উপমন্যু কহিলেন, “আপনাদিগকে অনুনয় করিতেছি, আমি গুরুকে নিবেদন না করিয়া অপূপভক্ষণ করিতে পারিব না।” অশ্বিনীকুমার কহিলেন, “তোমার এই প্রকার অসাধারণ গুরুভক্তি দর্শনে আমরা অতিশয় প্রসন্ন হইলাম, তোমার উপাধ্যায়ের সন্ত-সকল লৌহময়, তোমারও হিরণ্ময় হইবে এবং তুমি চক্ষু ও শ্রেয়োলাভ করিবে।” উপমন্যু অশ্বিনীকুমারের বরদান-প্রভাবে পূর্ব্ববৎ চক্ষুরত্ন লাভ করিয়া গুরু-সন্নিধানে গমন ও অভিবাদনপূর্ব্বক আদ্যোপান্ত সমুদয় বৃত্তান্ত নিবেদন করিলেন। তিনি শুনিয়া অত্যন্ত প্রীত হইলেন এবং কহিলেন, “অশ্বিনীতনয়েরা যেরূপ কহিয়াছেন, তুমিও সেইরূপ মঙ্গললাভ করিবে, সকল বেদ ও সকল ধর্ম্মশাস্ত্র সর্ব্বকাল তোমার স্মৃতিপথে থাকিবে।” উপমন্যুর এই পরীক্ষা হইল।
বেদ ঋষি-উতঙ্ক-বৃত্তান্ত
আয়োধধৌম্যের বেদ নামে অপর একটি শিষ্য ছিলেন। একদা উপাধ্যায় তাঁহাকে আদেশ করিলেন, “বৎস বেদ, তুমি আমার গৃহে থাকিয়া কিছুকাল শুশ্রূষা কর, তোমার শ্রেয়োলাভ হইবে।” বেদ তদীয় বাক্য শিরোধারণপূর্ব্বক গুরুশুশ্রূষায় রত হইয়া বহুকাল গুরুগৃহে অবস্থিতি করিতে লাগিলেন। গুরু যখন যাহা নিয়োগ করিতেন, তিনি শীত, উত্তাপ, ক্ষুধা, তৃষ্ণা প্রভৃতি অশেষ ক্লেশ গণনা না করিয়া ভক্তি ও শ্রদ্ধাসহকারে তৎক্ষণাৎ তাহা অনুষ্ঠান করিতেন; কখন কোন বিষয়ে অবহেলা করিতেন না। এইরূপে বহুকাল অতীত হইলে উপাধ্যায় তাঁহার প্রতি অতি প্রীত ও প্রসন্ন হইলেন। তখন বেদ গুরুর প্রসাদে শ্রেয়ঃ ও সর্ব্বজ্ঞতা লাভ করিলেন। বেদের এই পরীক্ষা হইল।
অনন্তর বেদ উপাধ্যায়ের অনুমতিক্রমে গুরুকুল হইলে প্রত্যাগত হইয়া গৃহস্থাশ্রমে প্রবেশ করিলেন। ঐ আশ্রমে অবস্থানকালে তাঁহারও তিনটি শিষ্য হইল। বেদ শিষ্যদিগকে কোন কর্ম্মে নিয়োগ বা আত্মশুশ্রূষা করিতে আদেশ করিতেন না। কারণ, গুরুকুলবাসের দুঃখ তাঁহার মনোমধ্যে সতত জাগরূক ছিল। এই নিমিত্ত তিনি শিষ্যগণকে ক্লেশ দিতে পরাঙ্মুখ হইলেন।
কিয়ৎকাল পরে রাজা জনমেজয় ও পৌষ্য-নামক অপর এক ভূপাল বেদের নিকট উপস্থিত হইয়া তাঁহাকে উপাধ্যায় রূপে বরণ করিলেন। একদা তিনি যাজনকার্য্যোপলক্ষে স্থানান্তরে প্রস্থান করিবার কালে উতঙ্ক-নামক শিষ্যকে আদেশ করিলেন, “বৎস! আমার অবস্থানকালে মদীয় গৃহে যে-কোন বিষয়ের অসদ্ভাব হইবে, তাহা তুমি তৎক্ষণাৎ সম্পন্ন করিবে।” উতঙ্ককে এইরূপ আদেশ দিয়া বেদ প্রবাসে গমন করিলেন। উতঙ্ক গুরুকুলে বাস করিয়া গুরুর অনুজ্ঞা পালন করিতে লাগিলেন।
একদিন উপাধ্যায়পত্নীরা উতঙ্ককে আহ্বান করিয়া কহিলেন, “তোমার উপাধ্যায়ানী ঋতুমতী হইয়াছেন। এ সময় তোমার গুরু গৃহে নাই। যাহাতে তাঁহার ঋতু ফলহীন না হয়, তুমি তাহা কর, কাল অতিক্রান্ত হইয়াছে।” উতঙ্ক এতাদৃশ অসঙ্গত কথা শুনিয়া কহিলেন, “আমি স্ত্রীলোকের কথায় এরূপ কুকর্ম্মে কদাচ প্রবৃত্ত হইতে পারি না এবং গুরু আমাকে অন্যায় আচরণ করিতে কহিয়া যান নাই।” কিয়ৎকাল পরে উপাধ্যায় প্রবাস হইতে গৃহে আগমন করিয়া উতঙ্কের সুচরিত আদ্যোপান্ত শ্রবণ করিয়া অত্যন্ত প্রসন্ন হইলেন এবং তাহাকে কহিলেন, “বৎস উতঙ্ক! তোমার কি প্রিয়কার্য্য অনুষ্ঠান করিব, বল? তুমি ধর্ম্মতঃ আমার শুশ্রূষা করিয়াছ, তাহাতে আমি অতিশয় সন্তুষ্ট হইয়াছি অতএব এক্ষণে তোমাকে অনুজ্ঞা করিতেছি, তোমার সকল মনোরথ সফল হউক; গমন কর।” গুরু কর্ত্তৃক এইরূপ অভিহিত হইয়া উতঙ্ক কহিলেন, “ভগবন্! আমি দক্ষিণা দিতে প্রার্থনা করি। কারণ, এইরূপ শ্রুতি আছে যে, যিনি দক্ষিণা গ্রহণ না করিয়া শিক্ষাদান করেন ও যে ব্যক্তি দক্ষিণা না দিয়া অধ্যয়ন করে, তাহাদের মধ্যে একজন মৃত্যু বা বিদ্বেষ প্রাপ্ত হয়। অনুমতি করিলে আপনার ইচ্ছানুরূপ দক্ষিণা আহরণ করি।” উপাধ্যায় কহিলেন, “বৎস উতঙ্ক! অবসর ক্রমে আদেশ করিব।” উতঙ্ক আর একদিন গুরুকে নিবেদন করিলেন, “মহাশয়, আজ্ঞা করুন, কিরূপ দক্ষিণা আপনার অভিমত, তাহা আহরণ করিতে আমার নিতান্ত বাসনা হইতেছে।” তাহা শুনিয়া উপাধ্যায় কহিলেন, “বৎস উতঙ্ক! গুরুদক্ষিণা আহরণ করিবে বলিয়া আমাকে বারংবার জিজ্ঞাসা করিয়া থাক, অতত্রব তোমার উপাধ্যায়ানীকে বল, তাঁহার যাহা অভিরুচি, সেইরূপ গুরুদক্ষিণা আহরণ কর।” উতঙ্ক উপাধ্যায়ের উপদেশক্রমে গুরু-পত্নী সমীপে গমনপূর্ব্বক কহিলেন, “মাতঃ! গৃহে যাইতে উপাধ্যায় আমাকে অনুমতি করিয়াছেন, এক্ষণে আপনার অভিলষিত গুরুদক্ষিণা দিয়া ঋণমুক্ত হইতে বাসনা করি। বলুন, কি দক্ষিণা আপনার অভিপ্রেত?” উপাধ্যায়ানী কহিলেন, “বৎস! পৌষ্যরাজের ধর্ম্মপত্নী যে কুণ্ডলদ্বয় ধারণ করিয়া আছেন, তাহা আনয়ন করিয়া আমাকে প্রদান কর। আগামী চতুর্থ দিবসে এক ব্রত উপলক্ষে মহা সমারোহ হইবে, সেইদিন ঐ দুই কুণ্ডল ধারণ করিয়া নিমন্ত্রিত ব্রাহ্মণদিগের পরিবেশন করিব; অতএব তুমি সত্বর গমন কর, ইহা করিতে পারিলে তোমার শ্রেয়োলাভ হইবে, অন্যথা মঙ্গল হওয়া সুকঠিন।”
উতঙ্ক এইরূপ অভিহিত হইয়া প্রস্থান করিলেন। গমন করিতে করিতে পথিমধ্যে অতি বৃহৎ এক বৃষ দেখিলেন। ঐ বৃষে বৃহৎকায় এক পুরুষ আরোহণ করিয়াছিলেন। তিনি উতঙ্ককে আহ্বান করিয়া কহিলেন, “ওহে উতঙ্ক! তুমি এই বৃষের পুরীষ ভক্ষণ কর।” উতঙ্ক তাহাতে অসম্মত হইলেন। তখন ঐ পুরুষ পুনর্ব্বার তাঁহাকে কহিলেন, “উতঙ্ক! তুমি মনোমধ্যে কোনপ্রকার বিচার না করিয়া এই বৃষের পুরীষ ভক্ষণ কর, পূর্ব্বে তোমার উপধ্যায় ইহার পুরীষ ভক্ষণ করিয়াছিলেন।” তখন উতঙ্ক ঐ কথায় স্বীকার করিয়া সেই বৃষের মূত্র ও পুরীষ ভক্ষণ করিলেন। অনন্তর সত্বর আচমন করিতে করিতে সসম্ভ্রমে প্রস্থান করিলেন এবং আসনাসীন পৌষ্যের সন্নিধানে গমন করিয়া আশীর্ব্বাদ-প্রয়োগ-পুরঃসর কহিলেন, “মহারাজ! আমি অর্থিভাবে আপনার নিকট অভ্যাগত হইয়াছি।” রাজা তাঁহাকে অভিবাদন করিয়া কহিলেন, “ভগবন্! এই কিঙ্কর আপনার কি উপকার করিবে, বলুন। “উতঙ্ক কহিলেন, “মহারাজ! আপনার মহিষী যে কুণ্ডলদ্বয় ধারণ করেন, গুরুদক্ষিণা-প্রদান-বাসনায় আপনার নিকট আমি তাহা প্রার্থনা করিতে আসিয়াছি।” পৌষ্য কহিলেন, “মহাশয়! অন্তঃপুরে প্রবেশ করিয়া আমার সহধর্ম্মিণীর নিকট উহা যাচ্ঞা করুন।” উতঙ্ক তাঁহার আদেশানুসারে অন্তঃপুরে গমন করিয়া রাজ-মহিষীকে দেখিতে পাইলেন না। তখন তিনি পুনর্ব্বার পৌষ্যের নিকট আসিয়া কহিলেন, “মহারাজ। আমার প্রতি এরূপ মিথ্যা আচরণ করা আপনার উচিত হয় নাই। অনেক অনুসন্ধান করিলাম, কিন্তু অন্তঃপুরে আপনার মহিষীকে দেখিতে পাইলাম না।” পৌষ্য ক্ষণকাল বিবেচনা করিয়া তাঁহাকে কহিলেন, “মহাশয়! বোধ হয়, আপনি অশুচি আছেন, মনে করিয়া দেখুন। আমার গৃহিণী অতি পতিব্রতা, অপবিত্র থাকিলে কেহই তাঁহার সন্দর্শন পায় না।” এইরূপ অভিহিত হইলে উতঙ্ক সমুদয় স্মরণ করিয়া কহিলেন, “আমি বৃষ-পুরীষ ভক্ষণান্তর সত্বরে উত্থিত হইয়া গমনকালে আচমন করিয়াছিলাম।” পৌষ্য প্রত্যুত্তর করিলেন, “মহাশয়! আপনার ইহাই ব্যাতিক্রম হইয়াছে। উত্থানাবস্থায় ও গমনকালে আচমন করা আর না করা উভয়ই তুল্য।” তখন উতঙ্ক প্রাঙ্মুখে উপবেশন এবং করচরণ ও বদন প্রক্ষালন পূর্ব্বক নিঃশব্দ, অফেন, অনুষ্ণ ও হৃদয়দেশ পর্য্যন্ত গমন করিতে পারে, এইরূপ পরিমাণে জল তিনবার আচমনপূর্ব্বক অন্তঃপুরে প্রবেশ করিলেন এবং রাজমহিষীকে দেখিতে পাইলেন। রাজমহিষী তাঁহার দর্শনমাত্রে সত্বরে উত্থিত হইয়া অভিবাদন করিলেন এবং স্বাগত জিজ্ঞাসা করিয়া কহিলেন, “ভগবন্! এ কিঙ্করী আপনার কি করিবে, আজ্ঞা করুন?” উতঙ্ক কহিলেন, “গুরুদক্ষিণা প্রদান করিবার নিমিত্ত তোমার নিকট কুণ্ডলদ্বয় ভিক্ষা করিতে আসিয়াছি, আমাকে তাহা দান কর।” রাজমহিষী তাঁহার তাদৃশ প্রার্থনায় প্রীতা ও প্রসন্না হইয়া সৎপাত্র বোধে তৎক্ষণাৎ কর্ণ হইতে উন্মোচনপূর্ব্বক কুণ্ডলদ্বয় তাঁহার হস্তে সমর্পণ করিলেন এবং কহিলেন, “নাগরাজ তক্ষক আগ্রহাতিশয়সহকারে ইহা প্রার্থনা করেন। অতত্রব সাবধান হইয়া লইয়া যাউন।” উতঙ্ক কহিলেন, “তুমি কোনরূপ আশঙ্কা করিও না। নিশ্চয় কহিতেছি, তক্ষক আমার কিছুই করিতে পারিবে না।”
উতঙ্ক ইহা কহিয়া সমুচিত সংবর্দ্ধনাপূর্ব্বক তাঁহার নিকট বিদায় লইয়া পৌষ্য-সকাশে গমন করিলেন এবং কহিলেন, “মহারাজ! অভিলষিত-ফললাভে আমি অতিশয় প্রীত হইয়াছি। “অনন্তর পৌষ্য কহিলেন, “ভগবন্! সকল সময় সুপাত্র-সমাগম হয় না। আপনি গুণবান্ অতিথি উপস্থিত হইয়াছেন। ইচ্ছা হয়, আতিথ্য করি, অতএব কাল-নির্দ্দেশ করুন।” উতঙ্ক প্রত্যুত্তর করিলেন, “আমি এক্ষণেই প্রস্তুত আছি, আপনি অন্ন আনয়ন করুন।” রাজা তদীয় আদেশানুসারে অন্ন উপস্থিত করিয়া তাঁহাকে উপযোগ করিতে দিলেন। তিনি তাহা শীতল ও কেশসংস্পর্শে অশুচি দেখিয়া কহিলেন, “তুমি আমাকে দূষিত অন্ন ভোজন করিতে দিয়াছ, অতএব অন্ধ হইবে।” পৌষ্য এইরূপ অভিশাপ শ্রবণ করিয়া কহিলেন, “তুমি অদূষিত অন্নে দোষারোপ করিলে, অতএব তোমারও বংশলোপ হইবে।” তখন উতঙ্ক কহিলেন, “দেখ তুমি অশুচি অন্ন ভোজন করিতে দিয়া পুনর্ব্বার প্রতিশাপ প্রদান করিতেছ, ইহা তোমার সমুচিত কর্ম্ম হইল না, বরং তুমি অন্নের দোষ স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ কর।” পৌষ্য অন্নের অশুচিত্ব স্পষ্টই দেখিতে পাইলেন। পরে উতঙ্ককে বিনয়বাক্যে কহিলেন, “ভগবন্! আমি সবিশেষ না জানিতে পারিয়া এই অশুচি অন্ন আহরণ করিয়াছিলাম, এক্ষণে আপনার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করিতেছি। আপনি প্রসন্ন হইয়া যাহাতে আমি অন্ধ না হই, এইরূপ অনুগ্রহ করুন।”
তখন উতঙ্ক প্রত্যুত্তর করিলেন, “দেখ, আমার বাক্য মিথ্যা হইবার নহে, সুতরাং একবার অন্ধ ও অনতিবিলম্বে চক্ষুষ্মান্ হইবে, সন্দেহ নাই। কিন্তু তুমি যে শাপ দিয়াছ, তাহা হইতে আমাকে মুক্ত কর।” পৌষ্য কহিলেন, “এখনও আমার ক্রোধের উপশম হয় নাই; অতএব শাপ প্রতিসংহার করিতে পারি না। আর আপনি কি জানেন না যে, ব্রাহ্মণের হৃদয় নবনীতের ন্যায় সুকোমল ও বাক্য খরধার ক্ষুরের ন্যায় নিতান্ত তীক্ষ্ম; ক্ষৎত্রিয়দিগের উভয়ই বিপরীত অর্থাৎ তাহাদিগের বাক্য নবনীতবৎ কোমল ও হৃদয় ক্ষুরধার-তুল্য সুতীক্ষ্ম; সুতরাং আমি স্বভাবসুলভ তীক্ষ্মভাব-প্রযুক্ত এক্ষণে প্রদত্ত শাপের অন্যথা করিতে পারি না।” উতঙ্ক কহিলেন, “আমি অদূষিত অন্নে দোষারোপ করিয়া তোমাকে অভিসম্পাত করিয়াছি, এই ভাবিয়া তুমি আমাকে প্রতিশাপ প্রদান করিয়াছিলে। এক্ষণে অন্নের দোষ স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করিয়া অনুনয়-বিনয় পূর্ব্বক আমাকে প্রসন্ন করিলে এবং শাপ বিমোচন করিয়া লইলে; কিন্তু তুমি যে শাপ দিয়াছ, তাহা মোচন করিতে চাহিতেছ না। এই প্রবঞ্চনা-প্রযুক্ত সে শাপ আমাকে লাগিবে না; আমি চলিলাম।” এই বলিয়া কুণ্ডলদ্বয় গ্রহণপূর্ব্বক সে স্থান হইতে প্রস্থান করিলেন।
পথিমধ্যে দেখিলেন, এক নগ্ন ক্ষপণক [বৌদ্ধ ভিক্ষুক-ন্যাঙটা ভিখারী] আসিতেছে; কিন্তু সে মধ্যে মধ্যে অদৃশ্য হইতেছে। উতঙ্ক সেই সময়ে পৌষ্য-মহিষীদত্ত কুণ্ডলদ্বয় ভূতলে রাখিয়া স্নানতর্পণাদির নিমিত্ত সরোবরে গমন করিলেন। ইত্যবসরে-ক্ষপণক নিঃশব্দ পদসঞ্চারে সত্বর তথায় আগমন ও কুণ্ডলদ্বয় অপহরণ করিয়া পলায়ন করিল। উতঙ্ক স্নানাহ্নিক-সমাপনানন্তর অতি পূতমনে দেবতা ও গুরুকে প্রণাম করিয়া প্রবলবেগে তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ ধাবমান হইলেন। তিনি সেই ক্ষপণকের সন্নিকৃষ্ট হইবামাত্র সে ক্ষপণকরূপ পরিহারপূর্ব্বক তক্ষকরূপ পরিগ্রহ করিল এবং অকস্মাৎ ভূপৃষ্ঠ বিদীর্ণ হইয়া তাহার সম্মুখে এক মহাগর্ত্ত সমুৎপন্ন হইল। তক্ষক সেই মহাগর্ত্ত দিয়া নাগলোকস্থ স্বীয়ভবনে গমন করিলেন। তখন উতঙ্ক পৌষ্য-মহিষীর কথা স্মরণ করিয়া প্রাণপণে তক্ষকের অনুসরণে যত্নবান হইলেন এবং প্রবেশদ্বার বিস্তার করিবার নিমিত্ত দণ্ডকাষ্ঠ দ্বারা খনন করিতে লাগিলেন; কিন্তু তাহাতে কৃতকার্য্য হইতে পারিলেন না। দেবরাজ ইন্দ্র তাঁহাকে কষ্টভোগ করিতে দেখিয়া স্বীয় বজ্রাস্ত্রকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “বজ্র! তুমি যাইয়া এই ব্রাহ্মণের সাহায্য কর।” বজ্র প্রভুর আদেশক্রমে তদ্দণ্ডে দণ্ডকাষ্ঠে অনুপ্রবিষ্ট হইয়া গর্ত্তদ্বার বিস্তীর্ণ করিল। উতঙ্ক তদ্দ্বারা রসাতলে প্রবেশ করিলেন। তিনি এইরূপে নাগলোকে প্রবেশ করিয়া বহুবিধ প্রাসাদ, হর্ম্ম্য, বলভী ও নানাবিধ ক্রীড়াকৌতুকের রমণীয় স্থান অবলোকন করিলেন এবং বক্ষ্যমাণ প্রকারে নাগগণের স্তব করিতে আরম্ভ করিলেন।
“ঐরাবত যে-সকল সর্পের অধিরাজ এবং যাঁহারা যুদ্ধে অতিশয় শোভমান, সৌদামিনী সহকৃত পবনচালিত মেঘমালার ন্যায় বেগবান্ সেই সকল সর্পদিগকে স্তব করি। ঐরাবত সম্ভূত অন্যান্য সুরূপ ও বহুরূপ বিচিত্র কুণ্ডলধারী সর্প, যাঁহারা প্রচণ্ড দিবাকরের ন্যায় অমরলোকে নিরবচ্ছিন্ন বিরাজমান আছেন এবং ভাগীরথীর উত্তর তীরে যে-সকল নাগের বাসস্থান আছে, সেই সকল সুমহৎ পন্নগদিগকেও স্তব করি। ঐরাবত ব্যতিরেকে আর কে সূর্য্যকিরণে বিচরণ করিতে পারে? যখন ধৃতরাষ্ট্র সর্প গমন করেন, তৎকালে বিংশতিসহস্র অষ্টশত অশীতি সর্প তাঁহার অনুসরণ করেন। যাঁহারা ধৃতরাষ্ট্রের সমভিব্যাহারে গমন করেন ও যাঁহারা অতিদূরে বাস করেন, সেই সমস্ত ঐরাবতের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতাদিগকে নমস্কার করি। পূর্ব্বে খাণ্ডবপ্রস্থে ও কুরুক্ষেত্রে যাঁহার বাসস্থান ছিল, কুণ্ডলের নিমিত্ত সেই নাগরাজ তক্ষককে স্তব করি। তক্ষক ও অশ্বসেন এই উভয়ে নিত্যকাল সহচর হইয়া স্রোতস্বতী ইক্ষুমতীতীরে সতত বাস করিতেন। মহাত্মা তক্ষকের কনিষ্ঠ পুৎত্র শ্রুতসেন, যিনি সর্ব্বনাগের আধিপত্য লাভ করিবার প্রত্যাশায় কুরুক্ষেত্রে বাস করিয়াছিলেন, তাঁহাকেও নমস্কার করি।”
উতঙ্ক এইরূপে সর্পদিগকে স্তব করিয়াও যখন কুণ্ডলদ্বয় লাভ করিতে পারিলেন না, তখন অত্যন্ত চিন্তিত হইলেন এবং ইতস্ততঃ দৃষ্টিপাত করিয়া দেখিলেন, দুইটি স্ত্রীলোক সুচারু বাপদণ্ডযুক্ত তন্ত্রে [তাঁতে] বস্ত্র বয়ন করিতেছে। সেই তন্ত্রের সুত্রসকল শুক্ল ও কৃষ্ণবর্ণ এবং দেখিলেন, দ্বাদশ অর-যুক্ত একখানি চক্র ছয়টি শিশু কর্ত্তৃক পরিবর্ত্তিত হইতেছে। আর একজন পুরুষ ও অতি মনোহর একটি অশ্ব নিরীক্ষণ করিলেন। এইরূপ অবলোকন করিয়া তিনি তাঁহাদিগকেও স্তব করিতে লাগিলেন।
“সতত ভ্রাম্যমাণ চতুর্ব্বিংশতি পর্ব্বযুক্ত এই চক্রে তিনশত ষষ্টি তন্তু সমর্পিত আছে। ইহাকে ছয় জন কুমার পরিবর্ত্তিত করিতেছে। বিশ্বরূপ দুই যুবতী শুক্ল ও কৃষ্ণ সূত্র দ্বারা এই তন্ত্রে বস্ত্র বয়ন করিতেছেন। এই দুই যুবতী সমস্ত প্রাণী ও চতুর্দ্দশ ভুবন উৎপাদন করেন। নিখিল ভুবনের রক্ষাকর্ত্তা, বৃত্রাসুর ও নমুচির হন্তা, বজ্রধর ইন্দ্র, যিনি সেই কৃষ্ণবর্ণ বসনযুগল পরিধান করিয়া ত্রিলোকে সত্য-মিথ্যা উভয়ই বিচার করেন, সেই ত্রিলোকীনাথ পুরন্দরকে নমস্কার করি।”
অনন্তর সেই পুরুষ উতঙ্ককে কহিলেন, “তোমার এইরূপ স্তবে আমি অতিশয় র্প্রীত হইলাম, এক্ষণে কি উপকার করিব, বল?” উতঙ্ক কহিলেন, “ভগবন্! এই করুন, যেন সমস্ত নাগগণ আমার বশবর্ত্তী হয়।” তখন সেই পুরুষ কহিলেন, “ভাল, তুমি এই অশ্বের অপান [গুহ্যদেশ]-দেশে ফুৎকার প্রদান কর।” তদীয় বাক্যানুসারে উতঙ্ক অশ্বের অপানদেশে ফুৎকার প্রদান করিলে তাহার শরীর প্রধূমিত হইয়া উঠিল এবং ইন্দ্রিয়রন্ধ্র হইতে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ সকল নির্গত হইতে লাগিল। তদ্দ্বারা নাগলোক সাতিশয় সন্তপ্ত হইলে পর তক্ষক অগ্ন্যুৎপাতভয়ে ভীত ও ব্যাকুলিত হইয়া কুণ্ডলদ্বয়ের সহিত স্বীয় বাসভবন হইতে সহসা নিষ্ক্রান্ত হইলেন এবং উতঙ্ক-সমীপে আসিয়া কহিলেন, “আপনার এই কুণ্ডলদ্বয় গ্রহণ করুন।” উতঙ্ক কুণ্ডল লইয়া চিন্তা করিতে লাগিলেন, “অদ্য ব্রতোপলক্ষে মহাসমারোহ হইবে, কিন্তু আমি অতিদূরে রহিলাম, অতএব এক্ষণে কিরূপে উপাধ্যায়ানীর মনোরথ সম্পূর্ণ হইবে?” পরে সেই পুরুষ উতঙ্ককে চিন্তাকুল দেখিয়া কহিলেন, “উতঙ্ক! তুমি আমার এই অশ্বে আরোহণ কর, অনতিবিলম্বেই গুরুকুলে উপস্থিত হইতে পারিবে। উতঙ্ক তাঁহার আদেশানুসারে অশ্বে অধিরূঢ় হইয়া ক্ষণকালমধ্যে গুরুগৃহে প্রত্যাগমন করিলেন। তৎকালে তাঁহার উপাধ্যায়ানী স্নানপূজাদি সমাপনানন্তর কেশবিন্যাস করিতেছিলেন, তিনি উতঙ্কের বিলম্ব দেখিয়া অভিসম্পাত করিবার উপক্রম করিতেছেন, এমন সময়ে উতঙ্ক গুরুগৃহে প্রবেশপূর্ব্বক উপাধ্যায়ানীকে অভিবাদন করিয়া কুণ্ডল দিলেন। তিনি তাহা গ্রহণ করিয়া কহিলেন, “বৎস উতঙ্ক! ভাল আছ ত’? বৎস! তুমি ভাল সময়ে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছ। আমি এখনই অকারণে তোমাকে শাপ দিলাম, ভাগ্যে দিই নাই। এক্ষণে আশীর্ব্বাদ করি, তুমি চিরকাল কুশলে থাক।”
অনন্তর উতঙ্ক গুরুপত্নী সন্নিধানে বিদায় গ্রহণ করিয়া উপাধ্যায়ের নিকট উপস্থিত হইয়া প্রণাম করিলেন। উপাধ্যায় তাঁহাকে প্রত্যাগত দেখিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “বৎস! ভাল আছ ত’? এত বিলম্ব হইল কেন?” উতঙ্ক প্রত্যুত্তর কহিলেন, “ভগবন্! নাগরাজ তক্ষক কুণ্ডলাহরণবিষয়ে অতিশয় বিঘ্ন করিয়াছিলেন, এই নিমিত্ত আমি নাগলোকে গমন করিয়াছিলাম। তথায় দেখিলাম, দুইটি স্ত্রীলোক কৃষ্ণ ও শুক্লবর্ণ সূত্র তন্ত্রে আরোপণ করিয়া বস্ত্র বয়ন করিতেছেন, তাহা কি? ছয়টি কুমার দ্বাদশ অরসংযুক্ত একখানি চক্র নিয়ত পরিবর্ত্তিত করিতেছে, তাহাই বা কি? এবং তথায় এক পুরুষ ও এক বৃহৎকায় অশ্ব দেখিলাম, তাহাই বা কি? আর পথিমধ্যে গমন করিতে করিতে এক বৃষ দেখিলাম, ঐ বৃষে এক পুরুষ আরোহণ করিয়া আছেন, তিনি আমাকে বৃষের পুরীষ ভক্ষণ করিতে অনুরোধ করিলেন এবং কহিলেন, ‘পূর্ব্বে তোমার উপাধ্যায় এই বৃষের পুরীষ ভক্ষণ করিয়াছিলেন।’ পরে তাঁহার নির্দ্দেশক্রমে আমি সেই বৃষের পুরীষ উপযোগ করিলাম, ঐ বৃষ ও বৃষাধিরূঢ় পুরুষই বা কে। আপনি অনুগ্রহ করিয়া এই সমস্ত বর্ণনা করুন, আমি শ্রবণ করিতে অভিলাষ করি।”
উতঙ্কের প্রার্থনায় উপাধ্যায় কহিলেন, “বৎস! তুমি যে দুইটি স্ত্রীলোক দেখিয়াছ, তাঁহারা পরমাত্মা ও জীবাত্মা। দ্বাদশ অর-সংযুক্ত যে চক্র দেখিয়াছ, উহা সংবৎসর। শুক্ল ও কৃষ্ণবর্ণ যে-সকল তন্তু দেখিয়াছিলে, উহা দিবা রাত্রি। ছয়টি কুমার ছয় ঋতু। যে পুরুষ দেখিয়াছ, তিনি পর্জ্জন্য। আর অশ্বটি অগ্নি। পথিমধ্যে যে বৃষভ দেখিয়াছিলে, তিনি নাগরাজ ঐরাবত। আর ঐ অশ্বে যে পুরুষ আরোহণ করিয়াছিলেন, তিনি দেবরাজ ইন্দ্র। যে পুরীষ ভক্ষণ করিয়াছ, তাহা অমৃত। বৎস! সেই অমৃত ভক্ষণ করিয়াছিলে বলিয়াই নাগলোকে পরিত্রাণ পাইয়াছ। ভগবন্ ইন্দ্র আমার সখা, তিনি কৃপারসপরবশ হইয়া তোমাকে রক্ষা করিয়াছেন, নতুবা নাগলোক হইতে কুণ্ডল লইয়া আগমন করা দুষ্কর হইত। বৎস! এক্ষণে আমি তোমাকে অনুমতি করিতেছি, গৃহে গমন কর এবং তোমার শ্রেয়োলাভ হউক।”
জনমেজয়ের সর্পযজ্ঞ প্ররোচনা
উতঙ্ক উপাধ্যায়ের অনুজ্ঞালাভানন্তর তক্ষকের প্রতি জাতক্রোধ হইয়া তাহার প্রতীকার-সঙ্কল্পে হস্তিনাপুরে প্রস্থান করিলেন এবং অনতিকালবিলম্বে তথায় উপস্থিত হইয়া রাজা জনমেজয়ের সহিত সমাগত হইলেন। তৎকালে মহারাজ জনমেজয় অমাত্যগণে পরিবৃত হইয়া বসিয়া ছিলেন। উতঙ্ক অবসর বুঝিয়া রাজা জনমেজয়কে যথাবিধি আশীর্ব্বাদবিধানপূর্ব্বক কহিলেন, “মহারাজ! প্রকৃত কার্য্যে অনাস্থা করিয়া বালকের ন্যায় সামান্য কার্য্যে ব্যাপৃত রহিয়াছেন।”
জনমেজয় তাঁহাকে যথোচিত সৎকার করিয়া কহিলেন, “হে দ্বিজোত্তম! আমি সুতনির্ব্বিশেষে প্রজাপালন করিয়া ক্ষৎত্রিয়ধর্ম্ম প্রতিপালন করিতেছি, এক্ষণে আপনি কি নিমিত্ত আগমন করিয়াছেন, আজ্ঞা করুন।” উতঙ্ক কহিলেন, “মহারাজ! আমি যে কার্য্যের নিমিত্ত আগমন করিয়াছি, উহা আপনারই কর্ত্তব্য কর্ম্ম। দুরাত্মা তক্ষক আপনার পিতার প্রাণ হিংসা করিয়াছিল, এক্ষণে তাহার প্রতিবিধান করুন। ঐ অবশ্যকর্ত্তব্য কর্ম্মের অনুষ্ঠানকাল উপস্থিত হইয়াছে; অতএব হে মহারাজ! আপনার পিতৃবৈরী তক্ষককে সমুচিত প্রতিফল প্রদান করুন। সেই দুরাত্মা বিনা দোষে আপনার পিতাকে দংশন করিয়াছিল, তাহাতেই তিনি বজ্রহত বৃক্ষের ন্যায় ভূতলে পতিত ও পঞ্চত্ব প্রাপ্ত হয়েন। বলদৃপ্ত পন্নগাধম তক্ষক বিনা অপরাধে আপনার পিতার প্রাণসংহার করিয়া কি দুষ্কর্ম্ম করিয়াছে, একবার স্থিরচিত্তে ভাবিয়া দেখুন। কাশ্যপ বিষ চিকিৎসা দ্বারা রাজর্ষিবংশরক্ষক দেবতানুভব মহারাজ পরীক্ষিতের প্রাণরক্ষা করিতে আসিতেছিলেন, পথিমধ্যে পাপাধম তক্ষক পরিচয় পাইয়া তাঁহাকে নিবৃত্ত করে। অতএব মহারাজ! অবিলম্বে সর্পসত্রের অনুষ্ঠান করিয়া ঐ পাপাত্মাকে প্রদীপ্ত হুতাশনে আহুতি প্রদান করুন, তাহা হইলে আপনার পিতার বৈরনির্যাতন এবং আমারও অভীষ্টসাধন হইবে সন্দেহ নাই। মহারাজ! আমি গুরুদক্ষিণা আহরণ করিতে গিয়াছিলাম, ঐ পাপিষ্ঠ পথিমধ্যে আমার যথেষ্ট বিঘ্ন অনুষ্ঠান করিয়াছিল।”
রাজা জনমেজয় তাহা শ্রবণ করিয়া তক্ষকের প্রতি অত্যন্ত কোপাবিষ্ট হইলেন। যেমন ঘৃত-সংযোগে অগ্নি প্রজ্বলিত হইয়া উঠে, উতঙ্কের বাক্যে রাজার রোষানলও সেইরূপ উদ্দীপ্ত হইয়া উঠিল। তখন রাজা জনমেজয় অতিশয় দুঃখিত হইয়া উতঙ্ক-সমক্ষে পিতার স্বর্গপ্রাপ্তির নিমিত্ত স্বীয় অমাত্যবর্গকে বারংবার জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলেন এবং উতঙ্কমুখে পিতৃবধবৃত্তান্ত শ্রবণ করিয়া অবধি শোকে ও দুঃখে নিতান্ত আক্রান্ত ও একান্ত অভিভূত হইলেন।
পৌষ্যপর্ব্বাধ্যায় সমাপ্ত।