৩য় অধ্যায়
উৎপাতকসূচক বিবিধ উপদ্ৰব
“হে মহারাজ! গর্দ্দভসকল গোগর্ভে জন্মগ্রহণ করিতেছে; পুত্রেরা জননীর সহিত বিহার করিতে প্ৰবৃত্ত হইতেছে; অরণ্যমধ্যে পাদপদল [বৃক্ষসমূহ] আকালিক [অকালজাত—যখন যাহার কাল নহে, এইরূপ] ফলকুসুম প্রসব করিতেছে; গর্ভিণীগণ অতি ভীষণ সন্তানসকল উৎপাদন করিতেছে; শৃগাল ও কুকুরসকল পক্ষিগণের সহিত একত্র আহার করিতেছে; দ্ৰংষ্ট্র [দন্তায়ুধ-শূকরাদি], বিষাণ[শৃঙ্গ]শৈলী, অশিবসূচক [অমঙ্গলজ্ঞাপক] নানাবিধ পশুসকল উৎপন্ন হইয়া অমঙ্গলধ্বনি করিতেছে; তাহাদের মধ্যে কাহার তিন শৃঙ্গ, কাহার চারি নেত্র, কাহার পাঁচ চরণ, কাহার দুই মেঢ্র [পুংচিহ্ন], কাহার দুই মস্তক, কাহার দুই পুচ্ছ, কাহার তিন চরণ, কাহার চারি দন্ত, কাহার বা আস্য[মুখ]দেশ নিতান্ত বিবৃত[ব্যাদিত— হাঁ করা]পরিদৃশ্যমান হইতেছে; তার্ক্ষ্য [গরুড়পক্ষী] সকল শৃঙ্গবিশিষ্ট দৃষ্টিগোচর হইতেছে; ব্ৰহ্মবাদিগণের সহধর্ম্মিণীরা গরুড়পাখী ও ময়ূরসমূহ প্রসব করিতেছে দেখা যাইতেছে। তোমার রাজধানীতে বৈনতেয় [গরুড়] ময়ূরসকল প্রসব করিতেছে; বড়বা [ঘোটকী] হইতে গোবৎস, কুকুর হইতে শৃগাল ও মৃগবিশেষ হইতে কুকুর উৎপন্ন হইতেছে; শুকপক্ষিসকল অশুভবাক্য প্রয়োগ করিতেছে; কোন স্ত্রী এককালে চারি-পাঁচ কন্যা প্রসব করিতেছে; তাহারা জন্মগ্রহণ করিবামাত্র নৃত্য, গীত ও হাস্য করিতে প্ৰবৃত্ত হইতেছে, নীচবংশোদ্ভব কাণ [একচক্ষুহীন —কানা], কুব্জ [কুঁজো], প্রভৃতি বিকলাঙ্গ [বিকৃত দেহ] সকল মহদভয় প্রদর্শন করিয়া নৃত্যগীত ও হাস্য করিতেছে এবং কালপ্রেরিত [কালনিয়ন্ত্রিত] হইয়া সশস্ত্ৰ প্ৰতিমাসকল চিত্ৰিত করিতেছে; শিশুসকল দণ্ড হস্তে করিয়া পরস্পরের প্রতি ধাবমান হইতেছে ও যুদ্ধার্থী হইয়া কৃত্রিম নগরীসকল মদিত করিতেছে; পাদপসমূহে উৎপল [পদ্মফুল] ও কুমুদ [কুমুদপুষ্প-মুঁদী] সকল উৎপন্ন হইতেছে; সমতীরণ প্রবলবেগে গমন করিতেছে; ধূলিজাল নিবৃত্ত হইতেছে না, অনবরত ভূমিকম্প হইতেছে; রাহু সূৰ্য্যসন্নিধানে গমন করিতেছে; কেতু চিত্ৰনক্ষত্ৰ আক্রমণ করিয়া অবস্থিত আছে; ইহাতে যে কুরুকুল ক্ষয় হইবে, তাহা সম্যক উপলক্ষিত হইতেছে; মহাঘোর ধূমকেতু পুষ্যানক্ষত্র আক্রমণ করিয়া অবস্থান করিতেছে; উহা-উভয়পক্ষীয় সৈন্যগণের অনিষ্ট সাধন করিবে।
“মঙ্গল বক্র হইয়া মঘানক্ষত্রে ও বৃহস্পতি শ্রবণানক্ষত্রে অবস্থিত আছেন; শনি উত্তরভাদ্রপদনক্ষত্ৰ আক্রমণ করিয়া পীড়ন করিতেছে; শুক্র পূর্ব্বভাদ্রপদনক্ষত্রে আরোহণ করিয়া শোভাপ্রাপ্ত হইতেছেন এবং ইতস্ততঃ পরিভ্রমণ করিয়া উপগ্রহের সহিত উত্তরভাদ্রপদনক্ষত্ৰকে নিরীক্ষণ করিতেছে; দ্বিতীয় উপগ্রহ কেতু সধূম পাবকের ন্যায় প্রজ্বলিত হইয়া ইন্দ্ৰসম্বন্ধী তেজস্বী জ্যেষ্ঠানিক্ষত্ৰকে আক্রমণ করিয়া অবস্থিত আছে; ধ্রুবনক্ষত্র প্ৰজ্বলিত হইয়া বামপার্শ্বে প্রবর্ত্তিত হইতেছে; চন্দ্ৰসূৰ্য্য রোহিণীকে পীড়ন করিতেছেন; ক্রূরগ্রহ, চিত্রা ও স্বাতীনক্ষত্রের মধ্যভাগে অবস্থান করিতেছে; অনলসঙ্কাশ [অগ্নিতুল্য প্রভাবশালী] মঙ্গলগ্রহ বারংবার বক্ৰীভূত হইয়া বৃহস্পতিসমাক্রান্ত শ্রবণানক্ষত্ৰকে আবৃত করিয়া অবস্থিত আছেন। সময়ানুসারে সর্ব্বশস্যপ্ৰসবিনী পৃথিবী সর্ব্বপ্রকার শস্যদ্বারা সমাচ্ছন্ন হইয়াছে, তন্মধ্যে সর্ব্বশস্যের প্রধান যব পঞ্চশীর্ষশালী [এক-একটি যবের গাছে পাঁচটি শীষ] ও ধান্য শতশীৰ্ষসম্পন্ন [একটি ধানের গাছ একশত শীষ যুক্ত] দৃষ্ট হইতেছে; বৎসসকল দুগ্ধ পান করিলে পর আপীন [পালানের বাঁট] হইতে শোণিতাক্ষরণ হইতেছে; শরাসন [ধনুক] হইতে সহসা অগ্নিশিখা নিৰ্গত ও খড়্গসমূহ অতিমাত্র প্রভাযুক্ত হইতেছে; শস্ত্রসমুদয় যেন সংগ্রাম সমুপস্থিত হইয়াছে, ইহা নিশ্চয়ই প্রদর্শন করিতেছে; শস্ত্ৰ [শস্ত্ৰ-খড়গাদি-যাহা ক্ষেপণীয় নহে], সলিল, কবচ ও ধ্বজের অগ্নিবর্ণপ্ৰভা দৃষ্ট হইতেছে। এক্ষণে বোধহয়, নিশ্চয়ই অতি ভয়ঙ্কর ক্ষয় সমুপস্থিত হইবে।
“যখন পাণ্ডবগণের সহিত কৌরবদিগের ঘোরতর যুদ্ধ ঘটিবে, তখন অবনীমণ্ডল শোণিতময় আবর্ত্তসম্পন্ন [জলঘূর্ণীর ন্যায়] ও ধ্বজস্বরূপ ভেলাসমাচ্ছন্ন [ধ্বজসমূহ সাগরের ভেলার ন্যায় ভাসিয়া বেড়াইবে] হইবে। প্রজুলিতাস্যবিবর [যাহাদের মুখমধ্যে অগ্নি প্রজ্বলিত হয় এইরূপ] মৃগপক্ষিগণ মহৎ ভয় ও অনিষ্ট সূচনা করিয়া চতুর্দ্দিকে চীৎকার করিতেছে; একপক্ষ, একচক্ষু, একচরণসম্পন্ন শকুনিগণ রজনীতে নভোমণ্ডলে সমুত্থিত হইয়া ক্রোধভরে যেন রুধির বমন করিয়াই ভয়ঙ্কর কণ্ঠস্বর করিতেছে। শস্ত্রসমুদয় যেন প্রজ্বলিত হইয়া উঠিতেছে, উদারপ্রকৃতি সপ্তর্ষিমণ্ডলের প্রভাপুঞ্জ সমাচ্ছন্ন হইতেছে।
“বিশাখার সমীপস্থ সংবৎসরস্থায়ী বৃহস্পতি ও শনৈশ্চর প্রজ্বলিত হইতেছে; ধূলিরাশিদ্বারা দিঙ্মণ্ডল শ্ৰীভ্রষ্ট হইয়াছে; উৎপাতজনক ভয়ঙ্কর মেঘমণ্ডলী রজনীতে শোণিতবৰ্ষণ করিতেছে; সমীর ধূমকেতুকে আশ্রয় করিয়া অনবরত সঞ্চরণ ও বিষম ভাবী যুদ্ধের সূচনা করিতেছে; পাপগ্রহভয়োৎপাদন করিয়া পূর্ব্বাষাঢ়া, পূর্ব্বভাদ্রপদ ও পূর্ব্বফল্গুনীনক্ষত্রের মস্তকে নিপতিত হইতেছে। কখনো এক পক্ষের মধ্যে এক দিবস তিথিক্ষয়-ত্ৰহস্পর্শ হইলে প্রতিপদ হইতে গণনা করিলে চতুর্দ্দশ দিবসে, তাহা না হইলে পঞ্চদশ দিবসে এবং কখনো বা একদিন তিথি বৃদ্ধি হইলে ষোড়শ দিবসে পূর্ণিমা বা অমাবস্যায় চন্দ্র বা সূৰ্য্যগ্রহণ হইয়া থাকে। কিন্তু এক মাসের মধ্যে শুক্ল-কৃষ্ণ উভয় পক্ষেই দুই দিবস করিয়া তিথিক্ষয় হইতেছে যে, প্রতিপদ হইতে ত্ৰয়োদশ দিবসে পূর্ণিমা বা অমাবস্যাতে চন্দ্ৰ-সূর্য্যগ্রহণ হয়, ইহা কখনো দেখা যায় না; কিন্তু সম্প্রতি তাহা হইতেছে; অতএব এই সকল অবলোকন করিয়া বোধ হয়, সমুদয় প্ৰজাক্ষয় হইবে।
“রাক্ষসেরা রুধিরে মুখবিবর পরিপূর্ণ করিয়াছে, তথাপি তৃপ্তি লাভ করিতেছে না; শোণিতোদকপূর্ণ [১] ফেনায়মান [২] মহানদীসকল প্রতিকূল [৩] প্রবাহিত হইতেছে [১-৪: রক্তমিশ্ৰিত জল—রক্তযোগে জাত লালবৰ্ণ জলে পূর্ণ বড় বড় নদীসকল বিপরীত গতিতে চলিতেছে। নদীজলের বেগ অপেক্ষা রক্তের বেগ বেশী বলিয়া তাহার প্রতিঘাতে ক্ষুভিত ও ফেনাযুক্ত হইয়া জল উল্টাদিকে গমন করে; দেশ ভাষায় ইহাকে “জোয়ার-ভাঁটা” বা “রায়ভাঁটা” বলে।]; কূপসকল বৃষভের ন্যায় ক্রীড়া করিতেছে [অতিবেগে প্রবাহিত বায়ু কৃপমধ্যে প্রবেশ করিয়া গুম গুম শব্দ করায় বৃষভের ধ্বনির ন্যায় শ্রুত হইতেছে] অশনিপ্ৰভাসম্পন্ন [বিদ্যুৎকান্তিযুক্ত] ঘোরতর নিৰ্ঘোষসহকৃত [শব্দসমন্বিত] উল্কাসকল নিপতিত হইতেছে। অদ্য রজনী প্ৰভাত হইলে তোমার দুর্নীতির ফল প্রাপ্ত হইবে। মহর্ষিগণ পরস্পর কথোপকথন সময়ে কহিয়াছেন, মেদিনী সহস্ৰ সহস্র মহীপালগণের শোণিত পান করিবে। নিবিড় [ঘন—গাঢ়] অন্ধকার উল্কার সহিত নিঃসৃত হইয়া চতুর্দ্দিকে ব্যাপ্ত হইতেছে; কৈলাস, মন্দর ও হিমালয়পর্ব্বত হইতে সহস্ৰ সহস্ৰ মহাশব্দ সমুত্থিত হইতেছে; আকাশচর প্রাণীসকল নিপতিত হইতেছে; ভূমিকম্প উপস্থিত হইলে চারি মহাসাগর উচ্ছলিত হইয়া বসুন্ধরাকে বিচলিত করিয়া যেন বেলাভূমি [তটস্থল—তীর] অতিক্রম করিতেছে, সমীরণ মহীরুহগণ [বৃক্ষগণ] উন্মূলিত করিয়া কৰ্কর বর্ষণপূর্ব্বক প্রবলবেগে বাহিত [প্রবাহিত] হইতেছে; অশনিসমাহত [বৰ্জদ্বারা আহত], বায়ুভগ্ন বৃক্ষ ও চৈত্যসকল গ্রাম ও নগর মধ্যে নিপতিত হইতেছে; ব্ৰাহ্মণাহুত হুতাশন বামাবর্ত্ত হইয়া [ব্ৰাহ্মাণগণের প্রদত্ত আহুতিদ্বারা অগ্নি বামদিকে ফিরিয়া আহুতি গ্রহণে বিমুখ] নীল, লোহিত ও পীত বর্ণ ধারণ করিতেছে এবং তাহা হইতে ভয়ঙ্কর শব্দসহকারে দুৰ্গন্ধ নিৰ্গত হইতেছে; স্পর্শ, গন্ধ ও রসসমুদয় বিপরীত হইয়াছে; ধ্বজসকল মুহুর্ম্মুহুঃ কম্পিত হইয়া ধূম পরিত্যাগ করিতেছে; ভেরী [জয়ঢাক] ও পটহসকল অঙ্গার বর্ষণ করিতেছে, বায়স[কাক]সকল অত্যুন্নত বৃক্ষাগ্রভাগে আরোহণ ও মণ্ডলাকারে উপবেশন করিয়া অতিশয় অশিবসূচক [অমঙ্গল নির্দেশক] চীৎকার করিতেছে; তাহাদিগের মধ্যে কতকগুলি পাক্কা-পক্কা [কাকের অব্যক্ত শব্দ] বলিয়া বারংবার ধ্বনি করিয়া মহীপালগণের বিনাশার্থ ধ্বজাগ্রে বিলীন হইতেছে; দুষ্ট হস্তিসকল কম্পিত্যকলেবরে মলমূত্র পরিত্যাগ করিতেছে; তুরঙ্গমগণ দীনভাব অবলম্বন করিয়া রহিয়াছে; করিসকল অনবরত স্বেদজল বিসর্জ্জন করিতেছে। হে ধৃতরাষ্ট্র! তুমি এই সকল চিন্তা করিয়া এরূপ ইতিকর্ত্তব্যতা [ইহাই কর্ত্তব্য’, এইরূপ নিশ্চয়তা] অবধারণ কর, যাহাতে এই লোকসমুদয় বিনষ্ট না হয়।”
যুদ্ধনিবৃত্তির অনুরোধে ধৃতরাষ্ট্রের অশ্রদ্ধা
মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র মহর্ষি বেদব্যাসের বাক্য শ্রবণ করিয়া কহিলেন, “ভগবন! লোকক্ষয় হইবে, ইহা অদৃষ্ট নির্দ্দিষ্টই আছে। ভূপালগণ ক্ষত্রিয়ধর্ম্মানুসারে সমরে কলেবর পরিত্যাগ করিয়া বীরলোকে গমনপূর্ব্বক সুখভোগ করবেন এবং ইহলোকে মহীয়সী কীর্ত্তি [অত্যুত্তম খ্যাতি] ও পরলোকে দীর্ঘকাল মহাসুখ প্রাপ্ত হইবেন, তাহাতে সন্দেহ নাই।” তখন কবীন্দ্ৰ [ত্রিকালদর্শী] ব্যাসদেব ধৃতরাষ্ট্রবাক্যে অনুমোদন করিয়া মুহূর্ত্তকাল চিন্তা করিয়া কহিলেন, “হে মহারাজ! কাল বিশ্বসংহার করিয়াই পুনরায় লোকসমুদয় সৃষ্টি করিয়া থাকে; কোন বস্তুই নিত্য নহে। তুমি এই অনিষ্ট-নিবারণে সমর্থ; অতএব এক্ষণে, কৌরব, পাণ্ডব, সম্বন্ধী ও সুহৃদগণকে ধর্ম্মপথে প্রবর্ত্তিত কর। জ্ঞাতিবধ করা নিতান্ত নীচকাৰ্য্য ; অতএব তুমি তাহা সম্পাদন করিয়া আমার অপ্রিয়ানুষ্ঠান করিও না; বধ অতি অপ্ৰশস্ত ও অহিতকর বলিয়া বেদে নির্দ্দিষ্ট হইয়াছে। কাল তোমার পুত্ররূপে জন্ম পরিগ্রহ করিয়াছে। যে ব্যক্তি স্বকীয় দেহস্বরূপ কুলধর্ম্মকে বিনষ্ট করে, সেই ধর্ম্ম পুনরায় তাহাকে সংহার করিয়া থাকে। তুমি সমর্থ হইয়াও ইতিকর্ত্তব্যতাবধারণে অক্ষম, সুতরাং কুল ও অন্যান্য মহীপালগণের বিনাশসাধনের নিমিত্ত কালদ্বারা কুপথে নীত হইতেছ; স্বয়ং [অমঙ্গল নিজেই তোমার রাজ্যরূপ ধারণ করিয়া দেখা দিয়াছে] অনর্থ তোমার রাজ্যরূপ পরিগ্রহ করিয়াছে । অন্যদ্বারা এককালে তোমার ধর্ম্মলোপ হইয়াছে; এক্ষণে তুমি পুত্ৰগণকে ধর্ম্মোপদেশ প্রদান কর। যে রাজ্যের নিমিত্ত পাপগ্ৰস্ত হইয়াছ, সেই রাজ্যদ্বারা যশ, ধর্ম্ম ও কীর্ত্তি স্থাপন কর; তাহা হইলে নিঃসন্দেহে তোমার স্বর্গলাভ হইবে। এক্ষণে পাণ্ডবগণ রাজ্যলাভ ও কৌরবেরা সুখ ভোগ করুক।”
তখন রাাজা ধৃতরাষ্ট্র তাঁহার বাক্যে উপেক্ষা প্রদর্শন করিয়া কহিতে লাগিলেন, “হে মহর্ষে। আমি আপনার ন্যায় স্থিতি [রক্ষা] ও বিনাশ সম্যক বিদিত হইয়াছি। সমুদয় লোকই স্বাৰ্থসাধনে বিমোহিত, আমিও সেই লোকমধ্যে পরিগণিত। আপনার প্রভাবের তুলনা নাই। আপনি আমাদের একমাত্র গতি ও উপদেষ্টা। এই নিমিত্ত আমরা আপনাকে প্ৰসন্ন করিতেছি, হে মহার্ষে! পুত্ৰসকল আমার বশীভুত নয়; অতএব আমার মতে আপনিই তাহাদিগের প্রতি অনুগ্রহ প্রদর্শন করুন। আপনি ধর্ম্মপ্রবৃত্তি যশ ও ভরতবংশের মহতী কীর্ত্তিস্বরূপ; আপনি কৌরব ও পাণ্ডবগণের মহামান্য ও পিতামহ।”
ব্যাসকর্ত্তৃক যুদ্ধজয়লক্ষণবর্ণন
ব্যাস কহিলেন, “হে ধৃতরাষ্ট্র! তুমি আপনার অভিলাষ প্রকাশ কর; আমি তোমার সমগ্ৰ সংশয় নিবারণ করিব।” ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, “ভগবান! যে সকল ব্যক্তি বিজয় লাভ করিবে, সংগ্রামকালে তাহাদিগের পক্ষে যেসমস্ত শুভলক্ষণ লক্ষিত হইয়া থাকে, তাহা কীর্ত্তন করুন, শ্রবণ করিতে আমার নিতান্ত অভিলাষ। হইতেছে।” ব্যাস কহিলেন, “হে ধৃতরাষ্ট্র! হুতাশন বিমলপ্ৰভাসম্পন্ন [উজ্জ্বল দীপ্তিযুক্তা], ধূমশূন্য ও দক্ষিণাবর্ত্ত [দক্ষিণদিকে প্রদীপ্ত হইয়া আহুতিভুক] হয়; শিখা উৰ্দ্ধে গমন করে; আহুতির অতি পবিত্ৰ গন্ধ নিৰ্গত হইতে থাকে, ইহাই ভাবী জয়ের নির্দ্দিষ্ট লক্ষণ। শঙ্খ ও মৃদঙ্গসকল অতি গভীর শব্দে বাদিত এবং চন্দ্ৰসূৰ্য্য বিশুদ্ধ রশ্মিসম্পন্ন হয়; ইহাই ভাবী জয়ের নির্দ্দিষ্ট লক্ষণ। যাহারা প্রস্থিত বা গমনে অভিলাষী হয়, তাহাদের পক্ষে বায়সমুখনিঃসৃত বাক্য একান্ত প্রিয়তর হইয়া থাকে। বায়সেরা পশ্চাদ্ভাগে শব্দ করিয়া গমনোন্মুখ ব্যক্তিদিগকে ত্বরান্বিত এবং সম্মুখে শব্দ করিয়া নিবারিত করে। ব্ৰাহ্মণেরা কহেন, যখন শকুনি [শকুন], রাজহংস [রাজহাঁস], শুক, ক্ৰৌঞ্চ [চক্ৰবাক] ও শতপত্র দক্ষিণাভিমুখ হয়, তখন রণস্থলে নিশ্চয়ই জললাভ হইয়া থাকে। যাহাদিগের সৈন্য অলঙ্কার, কবচ, কেতু [পতাকাদির চিহ্ন], সিংহনাদ ও অশ্বের হ্রেষারবদ্বারা পরম সুশোভিত ও নিতান্ত দুর্নিরীক্ষ্য হয়, তাহারাই জয়লাভ করে, তাহাতে সন্দেহ নাই। যাহাদিগের যোদ্ধৃগণের বাক্য প্ৰহৃষ্ট [আনন্দযুক্ত] ও বলবীৰ্য্যে অক্ষীণ [অকাতর] আছে এবং মাল্যদান [মালাসমূহ] কদাচ ম্লান হয় না, তাহারাই সমরসাগর উত্তীর্ণ হইতে সমর্থ হয়।
যাহারা পরসৈন্য প্রবিষ্ট হইয়া ‘বিনষ্ট করিয়াছি, বিনষ্ট করিয়াছি।” এই বাক্যে বলিতে থাকে এবং যাহারা পরসৈন্যে প্রবেশাভিলাষী হইয়া ‘হত হইয়াছে, হত হইয়াছে’ এই বাক্য কহিতে থাকে, তাহাদিগের নিশ্চয় জয়লাভ হয়। যুদ্ধ করিও না, বিনষ্ট হইবে,” এই বাক্য অমঙ্গলজনক; এই দুৰ্য্যোধনাদি কৌরবদিগের মধ্যেই শ্রুত হইতেছে। শব্দ, রূপ, রস, স্পর্শ ও গন্ধ অবিকৃত থাকিলেই শুভ হয়; যোদ্ধৃগণ সতত প্রফুল্লচিত্তে অবস্থান করে, ইহাই জয়লক্ষণ। সমীরণ অনুকূল হইয়া সঞ্চরণ, মেঘসকল অনুকুল বর্ষণ ও পক্ষিকুল অনুকূল ধ্বনি করিলে এবং ইন্দ্ৰধনু অনুকূল হইয়া উদিত হইলে শুভ হয়। হে ধৃতরাষ্ট্র! এই সকল জয়লাভের লক্ষণ, ইহার বিপরীতই মৃত্যুর কারণ হইয়া থাকে।
“সেনা অল্প বা অধিক হউক, একমাত্ৰ হৰ্ষই যোদ্ধৃগণের গুণ ও জয়লক্ষণ বলিয়া নির্দ্দিষ্ট হয়। একজন সেনা শত্রুশিরে ভিন্নকলেবর হইলে হতাশাবশতঃ অতি বিপুল সৈন্যও নির্জ্জিত হয়; সমস্ত সৈন্য পরাজিত হইলে, মহাবল পরাক্রান্ত যোদ্ধাসকলও বিজিত হইয়া থাকে। তখন পলায়মান সৈন্যগণ বেগগামী জলপ্রবাহ ও অতিশয় ভীত মৃগযুথের [পশুদলের] ন্যায় নিতান্ত অপ্রতিনিবাৰ্য্য [অনিবাৰ্য্য—ফিরাইয়া আনার অযোগ্য] হইয়া উঠে; এইরূপ গোলযোগ উপস্থিত হইলে তাহাদিগকে একত্র সমবেত করা অসাধ্য। সৈন্যগণকে ভীত ও পলায়িত দেখিলে অতিশয় ভয়বৃদ্ধি হইয়া থাকে। সেনাসকল ভগ্ন হইয়া দিগদিগন্তে পলায়ন করিলে মহাবলপরাক্রান্ত ব্যক্তিও চতুরঙ্গবল[অশ্ব, হস্তী, রথ ও পদাতি, এই চারিপ্রকার অঙ্গে গঠিত সৈন্য]সমভিব্যাহারে তাহাদিগকে সংস্থাপিত করিতে সমর্থ হয় না। শত্ৰুগণকর্ত্তৃক প্রার্থিত সন্ধি বা ধনদানদ্বারা পরিতোষিত হইয়া জয়লাভ করা শ্রেষ্ঠ উপায়; ভেদদ্বারা জয়লাভ করা মধ্যম উপায় ও যুদ্ধদ্বারা জয়লাভ করা জঘন্য উপায় বলিয়া পরিগণিত হইয়া থাকে। সৈন্যগণমধ্যে বিশৃঙ্খলা উপস্থিত হওয়া মহৎ দোষ ও বিনাশের কারণ বলিয়া কীর্ত্তিত হয়; পরস্পরের প্রভাবজ্ঞ [সামর্থ্যবিৎ], হর্ষযুক্ত, স্ত্রীসম্ভোগপরাত্মখ [স্ত্রীসহবাসে বিমুখ], কৃতনিশ্চয় [সত্যসঙ্কল্প কর্ত্তব্যে দৃঢ়] বীরপুরুষ পঞ্চাশৎসঙ্খ্যক [পঞ্চাশ জন] হইলেও মহতী সেনাকে পরাজয় করিতে পারে। বলিতে কি, ঈদৃশ গুণশালী সমরে দৃঢ়ব্ৰত [অটল উদ্যমী], ছয় বা সাতজন বীরপুরুষও বিজয় লাভ করিতে সমর্থ হয়। দেখ, বিনতাতনয় গরুড় মহতী সেনার বিনাশ এক ব্যক্তির সাধ্য বিবেচনা করিয়া সময়ে বহু সেনার সমবায় প্রশংসা করেন না। হে রাজন! বহুল বল [বহু সৈন্য] সংগ্ৰহ করিলেই যে নিশ্চয় জয়লাভ হয়, উহার নিশ্চয় কি? অতএব এ বিষয়ে দৈবই বলবান।”