২য় অধ্যায়
কর্ণের পূর্ববৃত্তান্ত বর্ণন
বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! তপোধনাগ্রগণ্য নারদ যুধিষ্ঠিরকর্তৃক এইরূপ অভিহিত হইয়া কহিলেন, “ধর্মরাজ! আপনি যথার্থ কহিয়াছেন, সংগ্রামস্থলে কর্ণ ও অর্জুনের অসাধ্য কিছুই ছিল না। আমি এক্ষণে কর্ণের পূর্ববৃত্তান্ত কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ করুন। ঐ বৃত্তান্ত দেবগণেরও গোপনীয়। ক্ষত্রিয় গণের সংগ্রামমৃত্যুজনিত স্বর্গলাভ হইবার নিমিত্তই দৈবপ্রভাবে অনূঢ়া[অবিবাহিতা] কুন্তীর গর্ভে কর্ণের জন্ম হয়। কর্ণ বাল্যকালে সূতপুত্রত্ব প্রাপ্ত হইয়া মহাত্মা দ্রোণের নিকট ধনুৰ্বেদ শিক্ষা করেন। ঐ মহাবীর ভীমসেন ও অর্জুনের পরাক্রম, তোমার বুদ্ধি, নকুল ও সহদেবের বিনয়, বাসুদেবের সহিত ধনঞ্জয়ের সখ্যভাব এবং তোমাদিগের প্রতি প্রজাগণের অনুরাগ চিন্তা করিয়া নিরন্তর মনে মনে দগ্ধ হইতেন এবং সেই নিমিত্তই বাল্যকালে রাজা দুর্য্যোধনের সহিত সৌহার্দ্য সংস্থাপন করিয়াছিলেন। তোমরা স্বভাবতঃ সর্বদাই তাঁহার দ্বেষ করিতে। ঐ মহাবীর ধনঞ্জয়কে ধনুর্বেদে অপেক্ষাকৃত নিপুণ নিরীক্ষণ করিয়া একদা নির্জনে দ্রোণাচার্য্যের নিকট গমনপূর্বক কহিলেন, ‘গুরো! আপনি আমাকে মন্ত্রসমবেত ব্রহ্মাস্ত্র প্রদান করুন। অর্জুনের তুল্য যোদ্ধা হইতে আমার নিতান্ত অভিলাষ হইয়াছে। কি পুত্র, কি শিষ্য সকলের প্রতিই আপনার সমান স্নেহ আছে; অতএব. অনুগ্রহ করিয়া আমার এই অভিলাষ পূর্ণ করুন। আপনার প্রসাদে পণ্ডিতেরা যেন আমাকে অকৃতাস্ত্র বলিয়া নির্দেশ করিতে না পারেন।’ তখন অর্জুনপক্ষপাতী দ্রোণাচাৰ্য্য কর্ণের সেই বাক্যশ্রবণে অর্জুনের প্রতি তাঁহার অত্যাচারবাসনা বুঝিতে পারিয়া কহিলেন, ‘কর্ণ! নিত্যব্রতচারী ব্রাহ্মণ বা তপস্বী ও ক্ষত্রিয় ইহারাই ব্রহ্মাস্ত্র জ্ঞাত হইতে পারে, অন্য কাহারও ইহাতে অধিকার নাই।’
“মহাবীর কর্ণ দ্ৰোণকর্তৃক এইরূপ প্রত্যাখ্যাত হইয়া তাঁহাকে যথোচিত সৎকার করিয়া মহেন্দ্ৰপর্বতে পরশুরামের নিকট প্রস্থান করিলেন এবং তাঁহাকে প্রণাম করিয়া আপনাকে ভূগুকুলোদ্ভব ব্রাহ্মণ বলিয়া পরিচয় প্রদানপূর্বক দণ্ডায়মান রহিলেন। তখন পরশুরাম কর্ণকে স্বাগত প্রশ্ন ও নাম জিজ্ঞাসা করিয়া শিষ্যত্বে গ্রহণ করিলেন। এইরূপে মহাবীর কর্ণ পরশুরামকৰ্তৃক অনুগৃহীত হইয়া সেই স্বর্গসদৃশ মহেন্দ্রপর্বতে বাস করিয়া ভার্গবের নিকট বিবিধ অস্ত্রশস্ত্র শিক্ষা করিতে লাগিলেন। ঐ পর্বতে প্রতিনিয়ত গন্ধর্ব, রাক্ষস, যক্ষ ও দেবগণের সমাগম হইত। মহাবীর কর্ণ ক্রমে ক্রমে তাঁহাদিগের অতিশয় প্রিয় হইয়া উঠিলেন।
কর্ণের রথচক্রগ্রাসবিষয়ক অভিশাপ
“একদা সূতপুত্র শরাসন ও খড়্গ ধারণপূর্বক আশ্রমের অনতিদূরবর্তী সমুদ্রতীরে যদৃচ্ছাক্রমে শরনিক্ষেপ করিয়া একাকী পরিভ্রমণ করিতেছিলেন; দৈবাৎ তাঁহার শরাঘাতে এক ব্রহ্মবাদী অগ্নিহোত্র রক্ষক ব্রাহ্মণের হোমধেনু বিনষ্ট হইল। মহাত্মা কর্ণ তদ্দর্শনে নিতান্ত ভীত ও বিষন্ন হইয়া সেই ব্রাহ্মণের নিকট গমনপূর্বক বিনয়সহকারে তাঁহাকে কহিলেন, ভগবন্! আমি মোহবশতঃ আপনার হোমধেনু বিনষ্ট করিয়াছি, আপনি প্রসন্ন হইয়া আমার অপরাধ মার্জনা করুন। দ্বিজবর কর্ণের বাক্যশ্রবণে যারপরনাই কোপাবিষ্ট হইয়া তাঁহাকে ভৎসনা করিয়া কহিলেন, ‘দুরাচার! তুমি আমার বধার্হ[বধ্য]। তোমাকে অবশ্যই দুষ্কর্মের ফলভোগ করিতে হইবে। তুমি যাহার সহিত নিয়ত স্পর্ধা করিয়া থাক এবং যাহাকে পরাজয় করিবার নিমিত্ত সবিশেষ চেষ্টা করিতেছ, তাহারই সহিত যুদ্ধ করিবার সময় পৃথিবী তোমার রথচক্র গ্রাস করিবেন। চক্র ভূগর্ভে প্রবিষ্ট হইলে বিপক্ষ তোমার মস্তকচ্ছেদন করিবে। তুমি যেমন প্রমত্ত হইয়া আমার হোমধেনু নিহত করিয়াছ, তেমনি প্রমত্তাবস্থাতেই শত্রু তোমার মস্তকচ্ছেদন করিয়া ফেলিবে।’ ব্রাহ্মণ এইরূপে শাপ প্রদান করিলে মহাবীর কর্ণ বিবিধ রত্ন ও গোদানদ্বারা তাঁহাকে পরিতুষ্ট করিবার চেষ্টা করিলেন, কিন্তু দ্বিজবর কোনক্রমেই প্রশান্ত না হইয়া তাঁহাকে কহিলেন, ‘কর্ণ! আমার বাক্য কদাচ অন্যথা হইবার নহে। এক্ষণে তুমি এই স্থানে অবস্থান বা অন্যত্র গমন অথবা তোমার আর যাহা ইচ্ছা হয়, তাহাই কর। তখন সূতপুত্র ব্রাহ্মণের বাক্যশ্রবণে নিতান্ত বিষণ্ন হইয়া অধোমুখে শঙ্কিতমনে শাপবিষয় চিন্তা করিতে করিতে পরশুরামের নিকট গমন করিলেন।”