হীরক-রহস্য – ৫

পাঁচ

ডানা বানরটাকে কোলে নিয়ে মেঝেতে বসেছে।

‘বুঝলাম না,’ বলল।

ডানার পাশে ধপ করে বসল কিশোর।

‘একটু আগে, তোমার রুমে ও ওয়াশিংটন শব্দটার ওপরে থাবা মারছিল, তাই তো?’ প্রশ্ন করল।

ডানা মাথা ঝাঁকাল।

‘আর এখন মূর্তির নিচে ওয়াশিংটন লেখা নামটা থাবড়াচ্ছিল,’ বলে চলল কিশোর। ‘চারপাশে এত প্রেসিডেন্ট থাকতে ও শুধু ওয়াশিংটনকেই বেছে নিল কেন?’

ফ্যালফ্যাল করে কিশোরের দিকে চেয়ে রইল ডানা।

‘এর সাথে রহস্যের কী সম্পর্ক?’ জিজ্ঞেস করল।

‘ডানা, মনুমেন্টের কোন্ পাথরটায় গর্ত পাওয়া গেছে?’ কিশোরের প্রশ্ন।

‘ওয়াশিংটন স্টেটেরটায়,’ বলল ও। ‘ওহ, খোদা!’

‘আমি কী ভাবছি বলি,’ বলল কিশোর, হাত বুলিয়ে আদর করল ওয়াশিংটনকে। ‘কেউ কাল রাতে চুরি করে মনুমেন্টে ঢুকিয়ে দেয় এই বানরটাকে। আমরা যেটা দেখেছি সেটা নিশ্চয়ই কোন ফ্ল্যাশলাইটের আলো।’

‘মানলাম,’ বলল ডানা।

‘সেই মানুষটা ওয়াশিংটনকে ট্রেইনিং দিয়েছে কীভাবে ওয়াশিংটন স্টেট স্মৃতিপাথরের ‘O’ অক্ষরটায় আঘাত করতে হবে,’ কথার খেই ধরল কিশোর। ‘O’ অক্ষরটায় হিট করতেই ভেঙে গর্ত হয়ে যায়। ক্লাইভ আমাদেরকে ওই পলকা, ভাঙা প্লাস্টারগুলোই দেখিয়েছিল।’

‘এতটুকু একটা বানরের কিল-ঘুষিতে পাথরে গর্ত হলো কীভাবে?’ প্রশ্ন ডানার

‘আগেই হয়তো কোন কায়দা করে রেখেছিল ওর মালিক, ‘ ব্যাখ্যা দিল কিশোর। ফলে বানরটার তেমন কষ্ট হয়নি।’

‘হায়, খোদা!’ বলে উঠল ডানা। ‘কিন্তু কেউ অমন একটা কাজ করতে যাবে কেন?’

‘গর্তটার ভেতরে নিশ্চয়ই মূল্যবান কিছু লুকানো ছিল!’ বলল কিশোর। ‘প্রশিক্ষিত বানর দিয়ে যেটা গোপনে সরানোর মত দামি।’

‘যেমন? সোনা? টাকা? দামি পাথর?’ চোখ চকচক করছে ডানার।

শ্রাগ করল কিশোর। ওর কোন ধারণা নেই কী লুকানো ছিল গতটায়।

‘কে ট্রেইনিং দিয়েছে ওকে তা-ই ভাবছি,’ বলে চলল কিশোর।

‘বানরকে ট্রেইনিং দেয়া চাট্টিখানি কথা নয়,’ বলল ডানা। ওয়াশিংটনের সরু বাহুজোড়ায় হাত বোলাল। ঝট করে ডান হাতটা টেনে নিল বানরটা।

‘কী রে, কী হলো?’ বানরটাকে জিজ্ঞেস করল ডানা। ‘ব্যথা পাচ্ছিস?’

কিশোর আর ডানা বাহুটা পরখ করতে যেতেই আবারও সাঁত করে হাত সরিয়ে নিল ওয়াশিংটন। রীতিমত থরথর করে কাঁপছে। ‘হয়তো মূর্তিটায় হিট করতে গিয়ে চোট পেয়েছে ও,’ বাতলে – দিল কিশোর।

‘ওকে কোন ভেটের কাছে নিলে কেমন হয়?’ ডানা জানতে চাইল।

‘খুব ভাল হয়,’ বলল কিশোর। ‘কিন্তু বানরের চিকিৎসক পাব কোথায়?’

‘সোজা,’ বলল ডানা। কিশোরের কাঁধ জড়িয়ে ধরল এক বাহু দিয়ে। ‘ন্যাশনাল যু-তে, এই ডি. সি.-তেই।’

হাসল কিশোর ওর দিকে চেয়ে।

‘মাঝে-মাঝে বুদ্ধি ঝিলিক মারে তোমার মাথায়!’ প্রশংসা করে বলল।

‘তারমানে অন্য সময় আমি হাবা?’ অভিমানের সুরে বলল ডানা।

‘আরে না,’ হেসে বলল কিশোর। ‘বুদ্ধির ঢেঁকি!’

ওরা ওয়াশিংটনকে আবারও ডানার কামরায় নিয়ে এল। ডানা চিড়িয়াখানায় ফোন করে বানরের চিকিৎসকের খোঁজ করল।

অপর প্রান্তের শ্রোতাকে জানাল এক স্পাইডার মাংকির জখমী বাহু দেখাতে চায়।

‘আমার নাম ডানা,’ বলল। ‘প্রেসিডেন্ট রিচার্ডসন আমার খালু।’

একটু পরে, রিসিভার রাখল ও। মুখে চওড়া হাসি।

‘আমাদের জন্যে মেইন গেটে অপেক্ষা করবেন ডাক্তার গোমেজ,’ জানাল।

‘ওয়াশিংটনকে ওখানে নেব কীভাবে?’ প্রশ্ন কিশোরের। ‘মেট্রো ট্রেইনে বানর নিয়ে উঠতে দেবে?’

‘হুম, চিন্তার কথাই,’ বলল ডানা।

‘এক কাজ করি,’ বলল কিশোর। ব্যাকপ্যাকের ওপরের অংশটার চেইন খুলল ও। ‘একটা পুরানো কাপড় দাও।’ ডানা খুঁজে পেতে একটা সোয়েটশার্ট দিতেই ওটা ভেতরে ভাঁজ করে বিছিয়ে ওয়াশিংটনকে ঢুকিয়ে দিল কিশোর।

বানরটা গুটিসুটি মেরে শুয়ে চোখ বুজল।

‘ওর পছন্দ হয়েছে জায়গাটা!’ বলল কিশোর।

‘হয়তো জন্মস্থানের কথা মনে পড়েছে,’ বাতলে দিল ডানা। মেট্রো ট্রেইনে চাপল ছেলে-মেয়েরা, চিড়িয়াখানার স্টপে নামল। চিড়িয়াখানা হাঁটা পথে দশ মিনিট।…

এত দূর থেকেও বুনো জীব-জন্তু আর গাছপালার বিচিত্র গন্ধ নাকে আসছে।

এক গাছের নিচে অপেক্ষা করছিলেন শর্টস আর ট্রপিকাল শার্ট পরা এক দীর্ঘদেহী লোক। তাঁর গলায় রঙবেরঙের পুঁতি দিয়ে গাঁথা এক ভারী মালা। ভদ্রলোকের কালো চামড়ার বিপরীতে ঝিকমিক করছে কণ্ঠহারটা

কিশোর আর ডানা এগিয়ে গেল লোকটির দিকে।

‘হাই, আমি কিশোর, আর ও ডানা, জানাল কিশোর।

‘আর আমি ডাক্তার গোমেজ,’ বললেন তিনি। ‘তোমাদের খুদে বন্ধু কোথায়?’

ব্যাকপ্যাক খুলল কিশোর। সোয়েটশার্টের ওপরে ঘুমিয়ে কাদা ওয়াশিংটন।

‘বাহ্,’ বললেন ড. গোমেজ। ‘আমার অফিসে চলো।’ হাতিদের বেড়ার পাশ কাটাল ওরা। দেয়ালের ওপর দিয়ে লম্বা এক শুঁড় উদয় হতেই হেসে ফেলল ডানা।

মাংকি হাউসের কাছে, ছোট, সাদা এক বাড়িতে ড. গোমেজের অফিস। সামনের ধাপগুলোর দিকে চলে যাওয়া ছোট্ট পথটির দু’পাশে ফুল গাছের সারি। বারান্দায় দুটো রকিং চেয়ার, একগাদা লতা-পাতা আর ফুলের টবের মাঝে।

ড. গোমেজ দরজাটা মেলে ধরলেন, এবং ওরা ভেতরে ঢুকল।

‘এক্সামিনিং টেবিলে ব্যাকপ্যাকটা রাখো,’ বললেন ড. গোমেজ।

এবার প্যাক থেকে আলগোছে বের করে আনলেন ওয়াশিংটনকে, নামিয়ে রাখলেন টেবিলের ওপর। বানরটা চোখ পিটপিটিয়ে হাই তুলল।

‘এই পিচ্চি বানরগুলো কিন্তু চুরি-চামারির ওস্তাদ,’ বললেন ড. গোমেজ। ‘দেখতে যতই নিরীহ মনে হোক না কেন। এরা পাখির বাসা থেকে ডিম চুরি করে। চকচকে জিনিস পেলেই হলো, স্রেফ গায়েব করে দেয়, কাজেই প্রেসিডেন্টকে বোলো ওঁর জিনিসপত্র যেন সাবধানে রাখেন!’

ড. গোমেজ ওয়াশিংটনের চোখ-মুখ পরীক্ষা করলেন। এরপর কান, আঙুল, পায়ের পাতা এবং এমনকী লম্বা লেজটাও। শরীরের তাপমাত্রা নিয়ে, স্টেথোস্কোপ দিয়ে হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন শুনলেন।

‘বাহ্, বাবাজীর স্বাস্থ্য তো দেখি চমৎকার,’ খোশমেজাজে বললেন ড. গোমেজ। ‘কোন্ হাতটায় যেন সমস্যা বলছিলে?’

‘ডান হাত,’ জানাল ডানা।

ড. গোমেজ বাহুটা স্পর্শ করতেই ওয়াশিংটন ওটা ঝটিতি টেনে নিল।

‘এক্স-রে করতে হবে,’ বললেন ড. গোমেজ।

তিনি ওয়াশিংটনকে এক্স-রে টেবিলে নিয়ে ছবি তুললেন। একটু পরেই, এক্স-রে নিরীখ করতে লাগলেন। এক হাড়ে সামান্য চিড় ধরা পড়েছে, দেখালেন আঙুল দিয়ে।

‘ওটা আলনা বোন, এখানে ফ্র্যাকচার আছে,’ বললেন ড. গোমেজ। ‘হাড়টা সেট করা হয়েছে, তবে এখনও পুরোপুরি সারেনি। পশু চিকিৎসক ওকে ভাল চিকিৎসাই দিয়েছে। এই হাত দিয়ে কোন কিছুতে হিট করেছিল নাকি?’

ছেলে-মেয়েরা তাঁকে সংক্ষেপে জানাল কীভাবে ওয়াশিংটন মনুমেন্টের ভেতরে খুঁজে পায় বানরটিকে। ওয়াশিংটন যে ছবি আর মূর্তিতে আঘাত করে তাও বলল।

‘তাই নাকি?’ সব শুনে বলে উঠলেন ড. গোমেজ।

‘আশা করি তোমরা রহস্যটার কিনারা করতে পারবে, তবে একটু খেয়াল রেখো, ও যেন হাতটা পুরো না সারা পর্যন্ত শান্ত থাকে।

হঠাৎই একটা চিন্তা খেলে গেল কিশোরের মাথায়।

‘ওয়াশিংটনের যিনি চিকিৎসা করেছিলেন সেই ভেটের সাথে কি যোগাযোগ করা যায়?’

ওর দিকে চাইলেন ড. গোমেজ।

‘খুব দরকার?’ প্রশ্ন করলেন।

কিশোর তাঁকে জানাল, ওয়াশিংটনকে প্রশিক্ষণ দিয়ে, স্মৃতিপাথরের গোপন গর্ত কে খুঁজে বের করায় তার নামটা জানতে চায় ওরা।

‘রহস্য আমিও ভালবাসি!’ বললেন ড. গোমেজ, হেঁটে গেলেন ডেস্কের কাছে। তিনি কম্পিউটার অন করলে কিশোর আর ডানা চেয়ে রইল। ‘খুব সম্ভব স্থানীয় কোন ভেট হবে,’ কটা কমাণ্ড টাইপ করার সময় নিচু কণ্ঠে বললেন। ‘যেসব অদ্ভুত প্রাণীর চিকিৎসা দেয়া হয় তাদের রেকর্ড রাখি আমরা, যেমন বানর, তোতা এবং সাপ।’

ক’মিনিট পরে, চেয়ারের পিঠে হেলান দিলেন ডাক্তার।

‘হ্যাঁ, ভেটের নাম জিয়া মার্টিনা। ভদ্রমহিলাকে আমি ভাল মতই চিনি।’

‘উনি ওয়াশিংটনের বাহু ঠিক করেছিলেন?’ ডানা জবাব চাইল।

ড. গোমেজ মাথা ঝাঁকালেন।

‘প্রায় দশ সপ্তাহ আগে। ফোন করব ওঁকে?’

‘করলে তো খুবই ভাল হয়!’ বলে উঠল কিশোর।

ড. গোমেজ পকেট থেকে মোবাইল বের করে একটা নম্বরে ফোন করলেন।

’হ্যালো, জিয়া? ডক্টর গোমেজ বলছি। ক’মাস আগে এক স্পাইডার মাংকির ডান আলনা সেট করেছিলেন মনে পড়ে? ভেরি গুড। মালিকের নামটা কি বলতে পারবেন?’ ছেলে-মেয়েদের উদ্দেশে চোখ টিপলেন ড. গোমেজ। ‘ধন্যবাদ, জিয়া,’ বলে, মোবাইল অফ করলেন।

‘এইচ. ডাম তোমাদের বানরটার মালিক,’ জানালেন। ‘মানে ডাম নামটা টোকা আছে আরকী ডক্টর মার্টিনের খাতায়। মালিকের সাথে তাঁর সরাসরি সাক্ষাৎ হয়নি।’

ড. গোমেজকে ধন্যবাদ জানাল ছেলে-মেয়েরা। তারপর কিশোরের ব্যাকপ্যাকে ওয়াশিংটনকে পুরে, চিড়িয়াখানার এক্সিট অভিমুখে চলল।

‘এখন?’ ডানার জিজ্ঞাসা। ‘এই ডাম কে জানি না আমরা, শুধু জানি এই লোক অথবা মহিলা সম্ভবত ওয়াশিংটনকে ট্রেইন করে মনুমেন্টে নিয়ে যায়।’

‘অনেক কিছুই জানার বাকি আমাদের,’ বলল কিশোর। যেমন পাথরটায় কেউ ড্রিল করে গর্ত করল কীভাবে? কিংবা কী লুকিয়েছিল ভেতরে? এবং কখন?’

‘ওয়াশিংটন মনুমেন্টে পাথরটা কবে লাগানো হয় জানতে পারলে হত,’ বলল ডানা।

‘মনুমেন্ট তৈরি হয়ে যাওয়ার পরে,’ বলল কিশোর। পুস্তিকায় পড়েছিল মনে আছে।

‘কেউ পাথরে ড্রিল করে গর্ত বানাল কেন, প্লাস্টার দিয়েই বা ঢাকল কেন, তারপর কেনই বা বানরটাকে ওটা ভেঙে ভেতরের জিনিস বের করতে শেখাল?’ প্রশ্ন করল ডানা। ‘মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝলাম না।’

‘গর্তটা যে করেছে আর বানরটাকে যে ট্রেইনিং দিয়েছে তারা আলাদা মানুষ হলে ঠিকই অর্থ খুঁজে পাওয়া যায়,’ বলল কিশোর। ‘যে গর্তটা করেছিল সে হয়তো অন্যজন খুঁজে পাবে এই আশায় ভেতরে কিছু লুকিয়ে রেখেছিল। মানে ডামের মত কারও কথা বলছি আরকী।’

‘কিন্তু গর্তটা ড্রিল করল কখন?’ ডানা জিজ্ঞেস করল। ‘বহু আগে? নাকি অল্প আগে? দেয়ালে পাথরটা ঠিক কখন বসানো হয় জানা দরকার।’

‘জানা যাবে,’ বলল কিশোর। ‘লাইব্রেরি অভ কংগ্রেসে যেতে পারি আমরা। ওয়াশিংটনের সমস্ত ইতিহাস রাখা আছে ওখানে।’