হীরক-রহস্য – ২

দুই

‘ধুরো! এখান থেকে প্রেসিডেন্টের ওপর স্পাইং করবে কীভাবে?’ প্রশ্ন করল ডানা। ‘তুমি না সবসময় একটা কিছু ভেবে নাও। রাতের আলোটার অনেক রকমের ব্যাখ্যা থাকতে পারে।’

‘তাই?’ বলে উঠল কিশোর। ‘যেমন?’

‘হয়তো মনুমেন্টের কোন কিছু ভেঙে গিয়েছিল, তাই ওরা মেরামত করছিল,’ বাতলে দিল ডানা।

‘অত রাতে?’ বলল কিশোর। ‘দিনের বেলার জন্যে অপেক্ষা করতে পারত না?’

ডানা বলে চলল, ‘হয়তো কোন পার্টি চলছিল,’ বলল। ‘কিংবা গুরুত্বপূর্ণ কোন অতিথির জন্যে প্রাইভেট টুর।’

জানালা থেকে জানালায় হেঁটে বেড়াল ওরা। কিশোর আনমনা। অস্বাভাবিক কোন কিছুর জন্য খোলা রেখেছে চোখ। মাথার ওপরে ছাদ। ওপরটা অন্ধকার। দেয়ালগুলো মসৃণ মর্মর পাথরে তৈরি। কোন বাতি দেখল না. ও, না মিটমিটে, না সাধারণ আলো।

‘মনুমেন্টটার উচ্চতা কীভাবে মেপেছিল জানেন আপনি?’ রুবিকে জিজ্ঞেস করল ডানা।

‘উমম, আমি নিশ্চিত নই,’ জবাব দিল রুবি। ‘ডার্লাকে জিজ্ঞেস করো। ও জানতে পারে।’ অবজার্ভেশন ডেস্কের ওপাশে আঙুল দেখাল।

এলিভেটরের দরজার কাছে ছোট্ট এক কাউন্টার। এক মহিলা পার্ক রেঞ্জার মনুমেন্ট বিষয়ে ম্যাপ আর বই বিক্রি করছে। কাউন্টারের ওপরে মুখ খোলা এক প্যাকেট বাদাম রাখা। প্যাকেটের পাশে বাদামের খোসার ছোটখাট এক স্তূপ।

প্রশ্নটা পুনরাবৃত্তি করল ডানা।

ডার্লা নামের মহিলাটি চিবোতে থাকা বাদামটা গিলে নিল। ‘আমার জানা নেই,’ বলল। ‘ভাল প্রশ্ন করেছ। এটা আগে কেউ কখনও আমাকে জিজ্ঞেস করেনি।’

হঠাৎই এলিভেটরের দরজা খুলে গেল।

‘নামছে!’ অন্য এক রেঞ্জার জানাল। ক্লাইভ, একটু আগে ওদেরকে যে টিকিট দেয়।

কিশোর আর ডানা আরও কয়েকজনের সঙ্গে যোগ দিল, অবজার্ভেশন ডেক ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা।

‘স্মৃতিপাথরগুলো দেখতে ভুলবেন না যেন,’ বলল ক্লাইভ। ধীরগতিতে নামছে এলিভেটর। কাঁচের দেয়াল ভেদ করে পাথরগুলো দেখতে পাচ্ছে কিশোর। বেশিরভাগের গায়েই শব্দ কিংবা ছবি খোদাই করা। কিশোর কটা শব্দ বোঝার চেষ্টা করল, কিন্তু চলন্ত এলিভেটরে পড়তে গিয়ে মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করে উঠল ওর।

‘আমাদের সব কটা স্টেট আর অনেক দেশ থেকে পাথরগুলো এসেছিল,’ বলল ক্লাইভ। ‘এমনকী রোম থেকে পোপও একটা পাথর পাঠান।’

‘পাথরগুলো কি দামি?’ এলিভেটরের এক মহিলা জিজ্ঞেস করল।

‘কিছু-কিছু তো বটেই,’ জানাল ক্লাইভ। ‘যেমন আলাস্কা থেকে আসাটা নিরেট যসম পাথর।’

এলিভেটর নিচে নামলে, সবাই বেরিয়ে পড়ল। কিশোর রয়ে গেল।

‘একটা কথা,’ ক্লাইভকে বলল। ‘আমি আর আমার বন্ধু কাল রাতে লনে ক্যাম্পিং করছিলাম, তখন উঁচু জানালাগুলোয় একটা সাদা আলো দেখি। ওটা কীসের আলো জানেন কিছু?’

ক্লাইভ চোখ নামিয়ে কিশোর আর ডানার দিকে চাইল। ‘তখন কটা বাজে মনে আছে?’ জানতে চাইল।

‘দশটা হবে,’ জানাল কিশোর। ‘আলোটা জোরাল ছিল না, কোমল আভার।’

‘ফ্ল্যাশলাইটের মত,’ যোগ করল ডানা।

ভ্রূ কোঁচকাল ক্লাইভ। ভাবছে যেন কিছু।

এক কাজ করো, দশ মিনিট পরে পিকনিক টেবিলে দেখা করো আমার সাথে,’ বলল। ‘তখন ব্রেক আমার, এ নিয়ে আরও কথা বলা যাবে।’

ক্লাইভ এক অফিসে ঢুকল, যেটির দরজায় লেখা-শুধুমাত্র কর্মচারীদের জন্য। কিশোর ভ্রূ উঁচিয়ে চাইল ডানার দিকে।

‘কেমন আজব না?’ বলল। ‘লোকটা নির্ঘাত সাদা আলোর ব্যাপারে কিছু জানে!’ বাইরে গিয়ে, এক ফাঁকা পিকনিক টেবিল খুঁজে নিয়ে বসে রইল রেঞ্জারের অপেক্ষায়।

ওদের সামনে, লনে মনুমেন্টের ছায়া পড়েছে।

‘ওরা হয়তো ছায়া মেপে মনুমেন্টের উচ্চতা বের করেছিল,’ বাতলে দিল ডানা।

‘কিন্তু, ডানা, সূর্য আকাশের ওপরে-নিচে থাকলে ছায়াটাও ছোট-বড় হবে,’ বলল কিশোর। হাসল। ‘পৃথিবী যখন ঘোরে আরকী।’

‘বুঝলাম,’ বলল ডানা।

ঠিক এমনিসময় ক্লাইভ যোগ দিল ওদের সঙ্গে। বসার পর এক বাদামী কাগজের ঠোঙা খুলল।

‘তোমাদের সামনে খাচ্ছি বলে কিছু মনে কোরো না,’ বলল। ‘মাত্র পনেরো মিনিটের ছুটি পাই তো, আর সকালে নাশ্তা করতেও ভুলে গেছি।’

‘কোন সমস্যা নেই,’ বলল কিশোর।

ঠোঙার ভেতর থেকে এক পনিরের স্যাণ্ডউইচ আর এক বোতল জুস বের করল ক্লাইভ। এবার বড়সড় কামড় বসাল স্যাণ্ডউইচে।

তো কাল রাতে তোমরা জানালায় আলো দেখেছ?’ খেতে- খেতে বলল ও।

মাথা ঝাঁকাল কিশোর।

‘হোয়াইট হাউসের লনে স্লিপ-আউট করছিলাম আমরা।’ চিবানো বন্ধ হয়ে গেল ক্লাইভের। মুখের চেহারা পাল্টে গেল। ‘তোমরা হোয়াইট হাউসের লনে ঘুমিয়েছ?’ জিজ্ঞেস করল। হেসে উঠল ডানা।

‘ও সত্যি কথাই বলছে,’ জানাল। ‘প্রেসিডেন্ট আমার খালু।’

‘ও, আচ্ছা, ফার্স্ট লেডির ভাগ্নী হোয়াইট হাউসে বেড়াতে এসেছে স্থানীয় এক পেপারে পড়েছি বৈকি, আর ও তোমার বন্ধু?’ স্যাণ্ডউইচটা তাক করল কিশোরের উদ্দেশে।

‘হ্যাঁ,’ বলল কিশোর। ‘আমার নাম কিশোর। গ্রীনহিলসে থাকি। এখানে চাচার কাছে বেড়াতে এসেছিলাম। ডানা দাওয়াত দিল, তাই হোয়াইট হাউসে থাকা আরকী।’

‘আর আমি ডানা।‘

মাথা ঝাঁকাল ক্লাইভ।

‘আমার নাম ক্লাইভ লয়েড, তবে তোমরা আমাকে ক্লাইভ বলে ডাকতে পারো,’ ঠোঙার ওপর স্যাণ্ডউইচটা রেখে পেপার ন্যাপকিন দিয়ে মুখ মুছল। ‘কাল রাতে সম্ভবত মনুমেন্টের ভেতরে কেউ ছিল। সকালে, মেঝেতে প্লাস্টারের ছোট-ছোট কয়েকটা টুকরো পেয়েছি,’ জানাল ও।

‘কেউ হয়তো স্মৃতিপাথর চুরির চেষ্টা করছিল!’ বলে উঠল কিশোর।

মাথা নাড়ল ক্লাইভ।

‘তা সম্ভব নয়,’ বলল। ‘পাথরগুলো অনেক বড় আর ভারী। তাছাড়া ওগুলো দেয়ালে কংক্রিট করে বসানো।’

গলায় খানিকটা জুস ঢালল ক্লাইভ।

‘আরেকটা ব্যাপার অদ্ভুত লেগেছে আমার,’ মিনিটখানেক পর বলল ও। ‘সকালে আজব এক কিচকিচ শব্দ শুনেছি। বড় কোন পাখির ডাক মনে হয়েছে।’ হেসে উঠল ক্লাইভ। ‘বেশ ভয়ও পেয়েছি,’ জানাল। ‘আমি ভূতে বিশ্বাস করি না। কিন্তু বলা তো যায় না…

দীপ্তিমান আলোটার কথা মনে পড়ল কিশোরের। ওটা ভূত নয়, এবং আঁধারে জ্বলজ্বল করে এমন কোন পাখির কথাও কোনদিন শোনেনি ও।

‘আপনি কী পেয়েছেন দেখতে পারি?’ জিজ্ঞেস করল।

‘হ্যাঁ, নিশ্চয়ই,’ বলল ক্লাইভ। ‘এসো।’

রেঞ্জার তার স্ন্যাকটা ঠোঙায় পুরে, ছেলে-মেয়েদের নিয়ে চলে এল মনুমেন্টের ভেতরে ছোট্ট এক কামরার কাছে। দরজার তালা খুলল। ঘরের মাঝখানে এক ওয়র্কবেঞ্চ, এবং দেয়ালগুলোতে সারি-সারি তাক। তাকগুলোতে রঙের কৌটো, ক্লিনিং সাপ্লাই আর যন্ত্রপাতি রাখা।

বেঞ্চিটার ওপরে ভাঙা প্লাস্টারের ছোটখাট এক পাহাড়। একটা টুকরো তুলে নিল কিশোর। ওটার একপাশ সাদা, অপর পাশটা ধূসর।

‘কোথায় পেয়েছেন এটা?’ জিজ্ঞেস করল।

ছাদের দিকে আঙুল দেখাল ক্লাইভ।

‘ওপরে, কয়েকশো ধাপ সিঁড়ি ভাঙতে হবে। যাবে?’

‘অবশ্যই!’ ডানা এক পায়ে খাড়া।

কিশোর প্লাস্টারের টুকরোটা পকেটে ভরল। ক্লাইভ সিঁড়ির দিকের গেটের তালা খুলল। ওঠার সময় মনুমেন্টের ভেতরের দেয়ালগুলো ওদের বাঁয়ে পড়ল। দেয়ালের উল্টোপাশে এক ধাতব রেইলিং।

ডানা থমকে দাঁড়িয়ে আঁধারে চোখ তুলে চাইল। ‘সব মিলিয়ে কতগুলো সিঁড়ি আছে এখানে?’ শুধাল।

‘আটশো সাতানব্বইটা,’ জানাল ক্লাইভ। ‘আগেকার আমলে, এলিভেটর যখন বসেনি, মানুষজন হেঁটে ওঠার চেষ্টা করত। অনেকেই না পেরে ফিরে যেত।’

ছেলে-মেয়েরা কয়েকশোর মধ্যে প্রথম ধাপগুলো ভাঙল। কাছ থেকে বেশ কিছু স্মৃতিপাথর দেখতে পাচ্ছে ওরা। চার ফিট লম্বা এক পাথরের সামনে থামল কিশোর, ওটার গায়ে মেইন খোদাই করা। স্টেটটার নাম ঘিরে জীব-জন্তু আর গাছপালার ছোট-ছোট ভাস্কর্য।

‘ওটা গ্র্যানিট,’ বলল ক্লাইভ। ‘পাথরগুলো বড় বলেছিলাম না? কিছু ছোট পাথরও আছে। কিন্তু সেগুলোও অন্তত এক ফুট পুরু। ডিনামাইট ছাড়া এখান থেকে পাথর সরানো অসম্ভব!’

উঠে চলেছে ওরা। মিনিট পাঁচেক পরে, থামল।

‘টুকরোগুলো এখানে পড়ে ছিল,’ বলল ক্লাইভ। মেঝে দেখাল আঙুল ইশারায়।

জায়গাটিতে একটা পাথর, ওটায় লেখা-স্টেট অভ ওয়াশিংটন। প্রতিটা অক্ষর কিশোরের হাতের সমান বড়।

‘এটা কী?’ বলে নুয়ে পড়ল ডানা। কুড়িয়ে নিল বাদামের এক খোসা।

‘এটা তো আগে দেখিনি,’ বলল ক্লাইভ।

ডানা ট্র্যাশ ক্যান খুঁজল, পেল না। অগত্যা, খোসাটা পকেটে পুরল।

কিশোর ওয়াশিংটন স্টেটের পাথরটার দিকে চোখ তুলে চাইল।

‘কী বিরাট, বাপ রে!’ বলল।

‘হ্যাঁ, এটা চার ফিট চওড়া আর দু’ফিট উঁচু,’ জানাল ক্লাইভ। পায়ের পাতায় ভর দিয়ে উঁচু হলো কিশোর ভালমত দেখতে।

‘একটা অক্ষরে গোলমাল দেখছি,’ বলল ও। ‘ওয়াশিংটনের ‘O’-টা দেখুন। ওটা কালো, অথচ বাকি অক্ষরগুলো ধূসর।

অক্ষরটা খুঁটিয়ে দেখল ক্লাইভ।

‘আরি,’ বলে উঠল পরক্ষণে, ‘মনে হচ্ছে ‘O’ যেখানে থাকার কথা সেখানে গর্ত হয়ে রয়েছে!’

‘প্লাস্টার হয়তো ওখান থেকেই খসেছে,’ বলল কিশোর। ‘যাই, বসকে ডেকে আনি,’ বলল ক্লাইভ।

ছেলে-মেয়েদেরকে ওখানে রেখে, দুদ্দাড় করে সিঁড়ি ভেঙে নামতে লাগল।

ওয়াশিংটন স্টেট স্মৃতিপাথরটার দিকে চেয়ে রয়েছে কিশোর, এসময় ফিরল ক্লাইভ। হাঁফাচ্ছে ও, ছোট এক মই বয়ে এনেছে। ওর পেছনে আরেকজন পার্ক রেঞ্জার। মাথায় ছোট করে ছাঁটা ধূসর চুল তার, নাকটা খাড়া।

দেয়ালে মইটা ঠেকাল ক্লাইভ।

‘ইনি আমার বস, ডক্টর উড,’ পরিচয় করাল ক্লাইভ। ‘বস, এ হচ্ছে ডানা। ফার্স্ট লেডির বোনঝি। আর ও কিশোর। ডানার বন্ধু।’

কেমন আছ তোমরা?’ বললেন ড. উড। ‘ওয়াশিংটন পাথরটার সমস্যাটা কী বলো তো?’

কিশোর তর্জনী দেখাল ‘O’ অক্ষরটার উদ্দেশে।

চোখ তুলে চাইলেন ড. উড।

‘আশ্চর্য!’ বলে উঠলেন। ‘ক্লাইভ, ওখানে উঠে দেখুন তো।’ মইয়ের শেষ ধাপে উঠল ক্লাইভ।

‘বস, পাথরের ভেতরে গোল করে এক গর্ত কাটা হয়েছে!’ জানাল।