হীরক-রহস্য – ১

এক

স্লিপিং ব্যাগের ভেতর আরেকটু গুটিসুটি মেরে আরাম করে শুল কিশোর। বান্ধবী ডানার সঙ্গে হোয়াইট হাউসের লনে ক্যাম্প আউট করছে ও। তরতাজা ঘাস আর গোলাপঝাড়ের সুঘ্রাণ পাচ্ছে। উঁচু বেড়াঝোপের ওপাশ থেকে পেনসিলভেনিয়া অ্যাভিনিউয়ের যানবাহনের গুঞ্জনধ্বনি কানে আসছে। ঝোপ-ঝাড়ে নাচছে জোনাকীর দল।

ডানার খালা ফ্লোরিনাকে বিয়ে করেছেন মার্কিন রাষ্ট্রপতি। সেই সুবাদে ডানা বেড়াতে এসেছে হোয়াইট হাউসে। কিশোরকেও আমন্ত্রণ জানিয়েছে। ও তখন হিরু চাচার সঙ্গে ওয়াশিংটনেই ছিল। তাই প্রস্তাবটা লুফে নিয়েছে।

‘আচ্ছা, ওয়াশিংটন মনুমেন্টে লাল-সাদা আলো ঝলকায় কেন?’ প্রশ্ন করল ডানা। ক’ফিট দূরে নিজের স্লিপিং ব্যাগে উঠে বসেছে ও।

‘শুধু তো লাল আলো, বলল কিশোর। ‘মনে হয় প্লেন যেন ধাক্কা না খায় তাই লাগিয়েছে।’ গড়ান দিয়ে উঁচু মনুমেন্টটির উদ্দেশে চাইল ও। রাতের আকাশের পটভূমিতে সাদাটে দেখাচ্ছে ওটাকে। চূড়ায় লাল বাতি জ্বলছে-নিভছে।

‘কিশোর, ওগুলো লাল আর সাদা,’ বলে, তর্জনী দেখাল ডানা। ‘দেখো।’

‘লাল, ডানা-’ কথা থেমে গেল কিশোরের।

আরি, ডানা তো ঠিকই বলেছে। লাল বাতি ঝলসাচ্ছে, কিন্তু মনুমেন্টের মাথায়, জানালাগুলোয় সাদা আলোও তো দেখা যাচ্ছে। সাদা আলোটা নড়েচড়ে বেড়াচ্ছে যেন। কখনও উজ্জ্বল। কখনওবা ম্লান আভার মত।

‘মনে হচ্ছে ফ্ল্যাশলাইট নিয়ে কেউ চলাফেরা করছে,’ বলল ডানা।

মাথা নাড়ল কিশোর।

‘মনুমেন্ট তো রাতে বন্ধ থাকে, বলল, হাঁচড়েপাঁচড়ে বেরিয়ে এল স্লিপিং ব্যাগ থেকে, বেড়াঝোপের উদ্দেশে হেঁটে গেল।

‘কেউ আছে ওখানে,’ জোর গলায় বলল ডানা।

সাদা আলোটা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখল কিশোর। ওটা যেন এক জানালা থেকে অন্য জানালায় সরে সরে যাচ্ছে।

‘চলো দেখিগে কী ওটা!’ বলে উঠল কিশোর। ওর ফ্ল্যাশলাইটটা তুলে নিল।

‘এখন?’ প্রশ্ন করল ডানা। পায়ে স্নিকার গলাতে-গলাতে উঠে দাঁড়াচ্ছে ও।

কিশোরের অসীম কৌতূহল। বিশেষ করে, অদ্ভুত যে কোন বিষয়ে ওর আগ্রহের সীমা নেই-যেমন ওই নাচুনে সাদা আলো। কিন্তু রাতের বেলা শহরে ঘুরে বেড়িয়েছে জানলে ফ্লোরিনা আন্টি ওদেরকে আস্ত রাখবেন না। অগত্যা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, ফ্ল্যাশলাইট নেভাল ও।

‘কাল আমরা কোন একটা টুরে গিয়ে মনুমেন্টের ভেতরে তদন্ত করব,’ বলল কিশোর।

‘কী তদন্ত?’ ডানার প্রশ্ন।

‘ভূ-উউউউত,’ ফিসফিসে কণ্ঠে বলে, স্লিপিং ব্যাগে ঢুকে পড়ল কিশোর।

পরদিন নাশ্তার পরে, ওয়াশিংটন মনুমেন্টে হেঁটে গেল কিশোর আর ডানা। এক বুথে সাইন দেখল: বিনামূল্যে টুরের টিকিট পাওয়া যায়। নটার টুরের জন্য দুটো টিকিট চাইল কিশোর। ধূসর উর্দি পরা এক পার্ক রেঞ্জার ওকে টিকিট আর একটা পুস্তিকা দিল। তার নেম ট্যাগে লেখা: ক্লাইভ।

মনুমেন্টটির দিকে চোখ তুলে চাইল ডানা।

‘ওয়াও, এটা কত উঁচু হতে পারে?’ প্রশ্ন করল।

পুস্তিকাটা দেখল কিশোর। ওয়াশিংটন মনুমেন্ট নিয়ে একগুচ্ছ তথ্য রয়েছে ওটায়।

‘পাঁচশো পঞ্চান্ন ফিট,’ জানাল, ‘পাঁচ ইঞ্চি।’

ওরা জানল কীভাবে?’ জিজ্ঞেস করল ডানা। ‘মানে, মাপল কীভাবে? এত বড় রুলার পেল কোথায়?!’

শ্রাগ করল কিশোর।

‘জানি না। ভেতরে ঢুকে জিজ্ঞেস করব,’ বলল।

নটার সময়, আরেকজন পার্ক রেঞ্জার মনুমেন্টের ভিত্তিমূলের দরজাটা খুলে দিল।

‘হাই, আমার নাম রুবি,’ জানাল। ‘আমি আজ আপনাদের টুর গাইড।’ টিকিট নিয়ে, ছোট্ট দলটিকে নেতৃত্ব দিয়ে এলিভেটরের দিকে চলল।

‘আমি ভেবেছিলাম সিঁড়ি ভাঙতে হবে বুঝি,’ এলিভেটরের জন্য অপেক্ষার সময় পার্ক রেঞ্জারকে বলল ডানা।

মুচকি হাসল রুবি।

‘এখন আর সিঁড়ি ভাঙতে হয় না,’ বলল ও। ‘প্রায় নয়শোটা ধাপ। উনিশশো সত্তরের দিকে যে কোন একটা বেছে নেয়া যেত। হয় সিঁড়ি নয়তো এলিভেটর। কিন্তু কিছু মানুষের অভ্যাস খারাপ, তারা মেমোরিয়াল স্টোন ভেঙে নিয়ে যেত. স্যুভনিয়ার হিসেবে। তাই এখন আর এলিভেটর ছাড়া গতি নেই।’

‘মেমোরিয়াল স্টোন কী?’ এক দর্শক জিজ্ঞেস করল।

‘স্মৃতিপ্রস্তর। মনুমেন্টটা যখন বানানো হয় অনেক দেশ আমাদেরকে প্রকাণ্ড সব পাথর পাঠায় ভেতরে রাখার জন্যে,‘ রেঞ্জার ব্যাখ্যা দিল। ‘আমাদের অঙ্গরাজ্যগুলোও পাথর পাঠিয়েছে। মোট একশো বিরানব্বইটা মেমোরিয়াল স্টোন আছে এখানে। এলিভেটরে করে নেমে আসার সময় দেখতে পাবেন ওগুলো।

এলিভেটরের দরজা খুলে যেতেই সবাই পা রাখল ভেতরে। ‘ওঠাটা তাড়াতাড়ি, বলল রুবি। ‘কিন্তু নামাটা আস্তে, আপনারা যাতে পাথরগুলো দেখতে পান।’

দরজাটা লেগে গেল। এলিভেটরটা সাঁ করে উঠে যেতেই ঝাঁকি খেল কিশোর। মিনিটখানেক পরে, দরজাটা খুলে গেল আবারও।

‘এটা অবজার্ভেশন ডেক,’ বলল রুবি। ‘মাত্র সত্তর সেকেণ্ডে পাঁচশো ফিট উঠেছেন আপনারা! ভাবুন তো! সবাই এখন ভিউ দেখুন। দশ মিনিট পর নামব আমরা।’

দর্শনার্থীরা হেঁটে গিয়ে জানালাগুলোয় দাঁড়াল, ওয়াশিংটন ডি. সি. দেখা যায় এখান থেকে। উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব, পশ্চিম-সবদিকেই জানালা। ছবির মত সুন্দর বাড়ি-ঘর, রাস্তা-ঘাট আর পার্কগুলোর দৃষ্টিনন্দন দৃশ্য দেখা যায় জানালাগুলো থেকে। খুদে খুদে গাড়ি আর বাস পোকা-মাকড়ের মত ছোটাছুটি করছে।

চলাচলরত মানুষজনকে মনে হচ্ছে যেন পিঁপড়ে।

উত্তুরে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে কিশোর।

‘ডানা, দেখো!’ হোয়াইট হাউসের সামনের লনটার উদ্দেশে আঙুল দেখাল। ‘আমরা কাল রাতে ওখানে ছিলাম। অদ্ভুত আলোটা নিশ্চয়ই এই জানালা দিয়েই আসছিল!’

‘হুম,’ বলল ডানা। ‘গতরাতে কেউ ওখানে থাকলে হয়তো লনে আমাদেরকে দেখেছে।’

ডানার দিকে ঝট করে চাইল কিশোর।

‘এটা তো ভাবিনি,’ বলল। অবজার্ভেশন ডেস্কের চারপাশে চাইল।

এদের কেউ কি কাল রাতে গোপনে ওখানে ঘোরাঘুরি করছিল ফ্ল্যাশলাইট নিয়ে? তার কাছে

টেলিস্কোপ কিংবা বিনোকিউলার

ছিল? হোয়াইট হাউসের ওপর নজরদারি করছিল না তো?

‘ডানা!’ হিসিয়ে উঠল কিশোর। ‘কেউ হয়তো এখানে উঠেছিল প্রেসিডেন্টের ওপর স্পাইং করতে!’