হিরণগড়ের ব্যাপারস্যাপার – ৮

ট্যাবি কুকুর হিসেবে যে খুব বীর তা নয়, তবে অন্য সব কুকুরের মতোই সে খুবই প্রভুভক্ত। মনিবের বিপদের আঁচ পেলে সে চেঁচায় এবং চেঁচিয়ে পাড়া মাত করে দেয়।

মাঝরাতে ট্যাবির চেঁচানি শুনে বাঘু ঘুম ভেঙে বিছানায় উঠে বসল। বাড়িতে চোর এল নাকি? কিন্তু তাদের বাড়িতে চোর আসার কথা তো নয় কারণ হিরণগড়ের সবাই জানে যে, তারা নিতান্তই গরিব। তা হলে ট্যাবি চেঁচায় কেন? উঠে আলো জ্বেলে সে দেখল ট্যাবি ভয়ের চোটে তলায় ঢুকে সেখান থেকে উত্তরের জানলার দিকে মুখ করে ঘেউঘেউ করছে! কিন্তু জানালার বাইরে কাউকে দেখা যাচ্ছে না তো!

বাঘু ট্যাবিকে কোলে তুলে নিয়ে একটু আদর করে বলে, “তুই এত ভীতু কেন বল তো! কী দেখে ভয় পেয়েছিস?”

বাইরে থেকে খুব ক্ষীণ কণ্ঠে কে যেন বলল, “আমাকে দেখে!” আবছা অন্ধকারে বাইরে কাউকে দেখতে পেল না বাঘু। একটু এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কে আপনি?”

ক্ষীণ গলাটা ফের বলল, “আমি নীলু। তোমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি। তুমি কুকুরটাকে অন্য ঘরে রেখে এসো। জান তো আমি কুকুরকে ভীষণ ভয় পাই!”

অবাক হয়ে বাঘু বলে, “এত রাতে দেখা করতে এসেছ কেন? কী  হয়েছে
?”

—বলছি। আগে কুকুর…”

—ঠিক আছে, ” বলে বাঘু পাশের ভাণ্ডারঘরে ট্যাবিকে ছেড়ে দিয়ে পাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে দিল। এসে দেখল জানলার বাইরে নীলু হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে।

বাঘু বলল, “দাঁড়াও, দরজা খুলে দিচ্ছি, তুমি ভিতরে এসে বোসো।”

নীলু জোরে মাথা নাড়া দিয়ে বলে, “না-না, দরজা খুলতে হবে না! আমি বাইরে থেকেই ক’টা কথা বলে চলে যাব।”

“দূর! তাই কি হয়? তুমি আমার বন্ধু আর এই প্রথম আমাদের বাড়িতে এলে!”

“রাতদুপুরে কেউ কি বন্ধুর বাড়ি যায়? আমি এসেছি একটা জরুরি কথা তোমাকে বলতে। বলেই চলে যাব।”

“কিন্তু অন্ধকারে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকবে? ওদিকটায় তো জঙ্গল, সাপখোপ আছে!”

“ওতে আমার কিছু হবে না। আমি তো জঙ্গলেই সারাদিন ঘুরে বেড়াই। আমাকে সাপে কামড়ায় না।”

“তোমার তো এত সাহস, তা হলে তুমি আমাদের কুকুরটাকে ভয় পাও কেন? ট্যাবি তো কাউকে কামড়ায় না!”

“কী জানি বাবা, আমার শুধু কুকুরকেই কেন যে এত ভয়! আমার যখন পাঁচ বছর বয়স তখন একবার আমাকে একটা কুকুর কামড়েছিল আর ডাক্তার আমার পেটে চোদ্দোটা ইঞ্জেকশন দিয়েছিল, এটা খুব মনে আছে। বোধ হয় সেই জন্যই এত ভয়।”

“ঠিক আছে নীলু, তোমাকে ঘরে ঢুকতে হবে না, বাইরে থেকেই বলো কী এমন জরুরি কথা!”

“তোমাদের গাঁয়ে দয়াল রায় বলে কে আছেন বলো তো!”

বাঘু একটু ভেবে নিয়ে বলে, “দয়াল রায়? না তো, এই নামের কেউ এই গাঁয়ে থাকেন না!”

“ভাল করে ভেবে দেখো তো!”

“ভেবে দেখার কিছু নেই, এই গাঁয়ে আমাদের সাতপুরুষের বাস, সবাইকেই চিনি। এখানে দয়াল রায় বলে কেউ নেই। কিন্তু তুমি তাঁকে খুঁজছ কেন?”

নীলু মাথা নেড়ে বলে, “আমি খুঁজছি না, কিন্তু কিছু লোক খুঁজছে, আর তারা মোটেই ভাল লোক নয়।”

“কারা দয়াল রায়কে খুঁজছে বলো তো! আর তাতেই বা আমাদের কী যায় আসে?”

“তাতে তোমাদের যায় আসে বলেই তো আমি এই নিশুতি রাতে তোমার ছে ছুটে এসেছি! তুমি আমার বন্ধু না হলে কি আসতুম! আজ রাতে দয়াল রায়কে খুন করা হবে যে!”

“খুন! ওরে বাবা! কিন্তু দয়াল রায়টা কে? আমি তো কিচ্ছু বুঝতে পারছি না!”

“আর খুনটা করা হবে তোমাদের বাড়ি থেকে!”

আকাশ থেকে পড়ে বাঘু কাঁপা গলায় বলে, “আমাদের বাড়ি থেকে?”

“হ্যাঁ তো! একটু আগেই জঙ্গলের মধ্যে বসে চারটে লোক শলাপরামর্শ করছিল। তাদের একজনের নাম হল চিতু। চিতু নামের কাউকে চেন?”

“একজন চিতু আছে বটে, কিন্তু সবাই জানে যে, সে একজন ছিঁচকে চোর!”

“এ সে-ই হবে। বাকি তিনজনের একজনের নাম দীনু, একজনের নাম হেলা আর একজনের নাম পান্টা। এরা কি তোমার চেনা?”

“না তো! দীনবন্ধুজ্যাঠামশাইকে অনেকে দীনুজ্যাঠা বলে ডাকে বটে, কিন্তু তিনি তো বুড়োমানুষ আর খুব নিরীহ লোক।”

“না, এই দীনু সে নয়। এর চেহারা কুস্তিগিরের মতো, বয়সও কম আর খুনির মতো চোখ। এরা দয়াল রায় নামে একজনকে খুন করতেই হিরণগড়ে এসেছে।”

বাঘু উত্তেজিত হয়ে বলে, “কী মুশকিল! এখানে যে ও নামের কেউ থাকেই না!”

“সে তো আমার জানার কথা নয়। আমি যা শুনেছি তাই বললাম। তবে ওদের কথাবার্তা শুনে বুঝলাম যাকে ওরা খুন করতে এসেছে সে-ও নাকি একজন ভয়ঙ্কর লোক, তাই ওরা নানা ফন্দিফিকির আঁটছিল। শেষে চিতুই ওদের পরামর্শ দিল যে, নীলমণি মান্নার বাড়ি থেকে গুলি চালিয়ে দয়াল রায়কে খুন করা সহজ হবে। নীলমণি মান্না যে তোমার বাবার নাম তা আমি জানি। তাই দেরি না করে ছুট্টে চলে এসেছি!”

বাঘু গভীর চিন্তায় পড়ে গেল। সব ঘটনারই একটা প্যাটার্ন বা ছক থাকে। এই ঘটনারও আছে নিশ্চয়ই, তবে কী সেটা, তা বোঝা যাচ্ছে না। তাদের বাড়ি থেকে গুলি করে দয়াল রায়কে যদি খুন করা হয় তা হলে দয়াল রায় নামের মানুষটি নিশ্চয়ই বাঘুদের বাড়ির আশপাশেই থাকেন! কিন্তু এ নামের কেউ তো এখানে নেই! তা হলে ছকটা তো মিলছে না! হঠাৎ সে চমকে উঠে বলে, “নীলু, ওরা কি দয়াল রায়ের চেহারা কেমন, তা নিয়ে কিছু বলেছে?”

“না তো! শুধু দীনু নামের লোকটা বলছিল, দয়াল যদি কিছু আঁচ করতে পারে তা হলে কিন্তু আমাদের সবক’টাকে নিকেশ করে ছাড়বে, কথাটা মনে রেখো সবাই! দয়াল মিন্‌স ডেঞ্জার!”

বাঘু বড় বড় চোখ করে নীলুর দিকে চেয়ে বলে, “আর কিছু মনে করতে পার না?”

নীলু একটু চুপ করে ভাবল, তারপর বলল, “তেমন কিছু নয়। তবে একটা সোনার দুর্গামূর্তি নিয়ে কী যেন কথা হচ্ছিল। সেটা রাসপুরের সতু ঘোষের কাছে পৌঁছে দিতে হবে। আমার মনে হয়েছিল ওই দুর্গামূর্তির সঙ্গে বোধ হয় দয়াল রায়েরও একটা সম্পর্ক আছে।”

বাঘু একটু ভেবে নিয়ে বলল, “দেখো নীলু, আমাদের পাশের বাড়িতে গোপালবাবু নামে একজন কিছুদিন হল আছেন। তাঁর স্মৃতিভ্রংশ হয়েছে। নামধাম কিছুই মনে নেই। কিন্তু তিনি কোনও ভয়ঙ্কর লোক নন। খুব শান্তশিষ্ট মানুষ। তিনি দয়াল রায় বলে তো আমার মনে হয় না। খুনিরা ভুল করে তাঁকেই দয়াল রায় বলে ভাবেনি তো!”

“তা তো আমি জানি না। আমি শুধু তোমার কথা ভেবেই সাবধান করতে এসেছি। ওদের কাছে পিস্তল-বন্দুক আছে, তাই তোমরা সাবধান থেকো। বরং মা-বাবাকে নিয়ে বাইরে কোথাও গিয়ে লুকিয়ে থাকো।”

আজকাল নিয়মিতই রোজ মাঝরাতে দীনেশ গুণ উদয় হচ্ছে। তার জন্য তৈরিই থাকে গোপাল। আজও ছিল। দীনেশ গুণ আজ প্রথমে অনেকক্ষণ কথাটথা কইল না, শুধু গুডুকগুড়ুক তামাক খেয়ে গেল। তারপর এক সময় হুঁকো থামিয়ে ঘড়ঘড়ে গলায় বলে উঠল, “তোমার তো ডঙ্কা বেজে গেল হে!”

গোপাল একটু থতমত খেয়ে বলে, “তা সেটা কখন বাজল কাকাবাবু? টের পেলাম না তো!”

“আহা, রোসো বাপু, রোসো! টের পাবে না মানে? খুব পাবে, হাড়ে হাড়ে টের পাবে! তেনারা যে সব এসে গিয়েছেন, সে খবর কি রাখো?”

গোপাল অবাক হয়ে বলে, “কারা এসে গিয়েছেন কাকাবাবু? তাঁরা কি এই মাঝরাত্তিরে বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন নাকি? ছি ছি, আগে বলবেন তো! যাই, গিয়ে বরং তাঁদের ঘরে এনে বসাই!”

দীনেশ গুণ বিষঢালা গলায় বলে, “আর ধ্যাষ্টামো কোরো না তো! তারা তো আর বরযাত্রী হয়ে আসেনি যে খাতির-তোয়াজ করতে হবে! আর তারা বাইরেও দাঁড়িয়ে নেই। জঙ্গলে বসে গুরুতর শলাপরামর্শ করতে ব্যস্ত। তারা তো আর তোমার মতো নিষ্কর্মা নয় হে! সময়মতো তারা ঠিকই এসে বর্গীর মতো হানা দেবে। অমন আহাম্মকের মতো দাঁত বের করে হাসছ কেন বলো তো!

“আসলে কী হয় জানেন কাকাবাবু, মাথাটা সাদা হয়ে যাওয়ার পর থেকেই আমি যেন কেমন ভ্যাবলা হয়ে গিয়েছি। কোন কথায় হাসতে হয় আর কোন কথায় গোমড়া মুখ করতে হয় সেটা ঠিক ঠাহর পাই না।”

“এখন বাজে কথা রেখে কাজের কথায় এসো তো বাপু! কুঁজো হয়ে খাটের তলা থেকে কালো রংয়ের লোহার তোরঙ্গটা বের করো তো! দেখো, এই নিশুত রাতে যেন বেশি সাড়াশব্দ না হয়। তোমার গায়েগতরে তো বেশ জোেরবল আছে, তোরঙ্গটা ঘেঁষটে না এনে বরং আলগা করে তুলে আনো। পারবে না? না-পারবেই বা কেন, দু’বেলা গান্ডেপিন্ডে আমার ছেলের ঘাড় ভেঙে তো কম ভালমন্দ গিলছ না! গতরে গত্তি কি কিছু কম লাগছে!”

“যে আজ্ঞে। কথাটা তো ন্যায্যই বলেছেন! এটুকু ফাইফরমাশ না খাটলে এই ঋণ কি শোধ হবে?”

গোপাল নিচু হয়ে ভারী তোরঙ্গটা দু’হাতে আলগা করে বের করে আনল। বলল, “এই মাঝরাতে তোরঙ্গ দিয়ে কী হবে কাকাবাবু? তোরঙ্গ নিয়ে কি কাশীবাসী হতে চললেন নাকি?”

“কাশীবাসী হলেই বা কী? তোরঙ্গ দিয়ে আমার কোন লবডঙ্কাটা হবে? আমার কি এখন শান্তিপুরী ধুতি আর গরদের পাঞ্জাবি পরে গঙ্গার ধারে হাওয়া খাওয়ার অবস্থা আছে? ফাজিল কোথাকার!”

গোপাল ভারী অপ্রস্তুত হয়ে বলে, “তাও তো বটে! এদিকটা ভেবে দেখিনি কিনা!”

“আর বিটলেমি না করে তোরঙ্গর তালাটা খুলে ফেলো।”

“যে আজ্ঞে। তবে চাবি ছাড়া তালা খোলার এলেম যে আমার নেই কাকাবাবু! চাবি কোথায়?”

“আ মোলো যা! পুরনো তালার চাবি কে কবে খুঁজে পেয়েছে বলো তো! এক কাজ করো, হাত-আয়নাটার পাশের কুলুঙ্গিতে আমার বউয়ের চুলের কাঁটা বা কুরুশকাঠি বা ওইরকমই কিছু আছে বোধ হয়। ওই দিয়ে খুলে ফেলো। এসব তো তোমার কাছে জলভাত, তাই না!”

হঠাৎ ঘরের মধ্যে এক মহিলাকণ্ঠ খনখন করে উঠে বলল, “খবরদার! ওসব আমার যত্ন করে রাখা জিনিস, বাইরের লোক হাত দিলে কিন্তু কুরুক্ষেত্র হয়ে যাবে!”

দীনেশ গুণ মিইয়ে গিয়ে মিনমিনে গলায় বলে, “আহা, ওসব আর তোমার কোন কাজে লাগবে শুনি!”

নারীকণ্ঠটি ঝাঁঝালো হয়ে বলে, “মেয়েদের সেন্টিমেন্ট তুমি আবার কবে বুঝেছ? স্বার্থপর কোথাকার!”

বিপদ বুঝে গোপাল গলায় মধু মাখিয়ে নিয়ে বলে, “মা ঠাকরুন, একটা পেরেকটেরেক হলেও চলবে, আছে তেমন কিছু?”

নারীকণ্ঠটি এবার নরম হয়ে বলে, “তা আছে বাছা, আলমারির তলায় একটা জুতোর বাক্স আছে, তাতে পাবে।”

তা পাওয়াও গেল। আর আশ্চর্যের বিষয়, তা দিয়ে তোরঙ্গর তালাটা খুলতে তার লহমাও লাগল না। এ বিদ্যে যে তার মধ্যে ঘাপটি মেরে আছে, তা এতদিন টেরই পায়নি গোপাল!

অদৃশ্য দীনেশ গুণ এবার বলল, “তোরঙ্গর উপর দিকের কাঁথাকানি সরিয়ে নীচে হাত ঢোকালেই একটা পিস্তল পেয়ে যাবে। ওতে গুলি ভরাই আছে। তবে পুরনো জিনিস তো, ঘোড়াটা টিপলে জিনিসটা ফেটেফুটেও যেতে পারে কিন্তু!”

গোপাল ককিয়ে উঠে বলে, “ওরে সর্বনাশ! বন্দুক-পিস্তল যে আমি জীবনে ছুঁইনি কাকাবাবু!”

দীনেশ গুণ ভারী বিরক্ত হয়ে তেতো গলায় বলে, “একজন হদ্দমুদ্দ জোয়ান পুরুষমানুষ হয়ে অমন ছিঁচকাঁদুনে স্বভাব কেন তোমার? সব সময় নাকি কান্না কাঁদলে কি চলবে? ডঙ্কা তো তা হলে বাজবেই! এখন বীরের মতো পিস্তলটা বাগিয়ে ধরে তৈরি হও তো! তারা যে এল বলে! দয়াল রায়ের লাশ না নামিয়ে আজ যে তারা ফিরবে না, তা আমি নিজের কানে শুনে এসেছি, বুঝলে! লাশ নামাতে না পারলে রাসপুরের ভয়ঙ্কর সতু ঘোষ তাদের জ্যান্ত পুঁতে ফেলবে যে!”

কিছুই বুঝতে না পেরে গোপাল কাঁদো কাঁদো হয়ে জিজ্ঞেস করল, “কথাটা একটু বাংলায় বলবেন কি কাকাবাবু? কিছুই যে মাথায় সেঁধোল না! কে দয়াল রায়, কে সতু ঘোষ, কে কার লাশ নামাবে আর আমিই বা পিস্তল বাগিয়ে কী করব, সব যে ঘেঁটে ঘোল হয়ে যাচ্ছে মশাই!”

দীনেশ গুণ এবার গলা একটু নামিয়ে বলে, “অত উতলা হোয়ো না, সব কথা কি আর বাংলা করে বলা যায়! কিছু কথা সাঁটে বুঝে নিতে হয়! ধরো, আমি যদি বলি তুমিই দয়াল রায়, রাসপুরের বিখ্যাত রায়বাড়ির অধস্তন চতুর্দশতম পুরুষ আর একমাত্র ওয়ারিশ, তা হলে কি তোমার বিশ্বাস হবে?”

মাথা নেড়ে গোপাল বলে, “না মশাই, গত কয়েকদিন এত মানুষের রোল আমাকে প্লে করতে হয়েছে যে, আর আমার কিছুই বিশ্বাস হচ্ছে

“সেই জন্যই তো বলছি, বেশি বুঝে কাজ কী তোমার? আপাতত পিস্তলটা বাগিয়ে ধরে বসে থাকো, তারপর হাঙ্গামা-হুজ্জত লেগে গেলে তখন দেখা যাবে।”

“একটা কথা ছিল কাকাবাবু। দয়াল রায় নামটা কেমন যেন একটু চেনা-চেনা লাগছে মশাই!”

“আহা চেনা-চেনা তো লাগবেই! শত হলেও পিতৃদত্ত নাম তো, চেনা-চেনা না লেগে উপায় আছে?”

গোপাল অবাক হয়ে বলে, “আপনি কি বলতে চান আমিই দয়াল রায়?”

“জোরজুলুম নেই, নিজেকে দয়াল রায় বলে ভাবতে না চাইলে ভেবো না। তবে রাসপুরের লাঠিবাজ, কুস্তিগির, বন্দুকবাজ দয়াল রায়কে সবাই সমঝে চলে বলে শোনা যায়। এও কানাঘুষো শোনা যাচ্ছে যে, রায়বাড়ির পাঁচশো বছরের পুরনো দুর্গামূর্তি চুরি যাওয়ায় দয়াল রায় রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে তার জ্ঞাতিশত্রু সতু ঘোষকে খুঁজতে বেরিয়ে নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছে। আর সতু ঘোষ নিজের প্রাণ আর দুর্গামূর্তি বাঁচাতে ভাড়াটে খুনি লেলিয়ে দিয়েছে দয়াল রায়কে নিকেশ করে নিষ্কণ্টক হতে! এবার তুমি তোমার অঙ্ক নিজেই কষে নাও বাপু। আমি কিন্তু যথাসাধ্য বাংলাতেই বললুম!”

গোপাল গম্ভীর হয়ে বলে, “না কাকাবাবু, আপনি যে ভাষায় কথা কইলেন সেটা হটেনটটদের ভাষা। আমার কিছুই বোধগম্য হল না।”

দীনেশ গুণ খিঁচিয়ে উঠে বলে, “আর বোধগম্য হয়ে কাজও নেই। দয়াল রায়ের ভয়ে সতু ঘোষ পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে এবং হা হয়রান হয়ে পড়েছে। এবার সে একটা হেস্তনেস্ত করতে চায়। তাই দীনু, হেলা আর পান্টা নামে তিনজন ভারী উঁচুদরের খেলোয়াড় দয়াল রায়কে নিকেশ করতে মাঠে নেমে পড়েছে। এরা বেশ ট্যালেন্টেড লোক হে! এবার তৈরি থাকো। যখন প্রাণ নিয়ে টানাটানি হবে তখন হটেনটট ভাষাও দিব্যি বাংলার মতো বুঝতে পারবে! এবার পিস্তলটা দয়া করে বের করো।”

“যে আজ্ঞে। আপনি গুরুজন মানুষ, তার উপর অন্নদাতা, আদেশ না মেনে তো উপায় নেই! তবে আগেই বলে রাখছি, পিস্তলটিস্তল আমি কিন্তু কোনওদিন চোখেও দেখিনি।”

“আর কত ভণ্ডামি করবে হে? বন্দুক-পিস্তল আর লাঠিসড়কি ঘেঁটেই তুমি বড় হয়েছ। দরকার হলে গোটা রাসপুর তার সাক্ষী দেবে।”

“আমি! কাকাবাবু কী যে বলেন!”

“আহা তুমি না হলেও দয়াল রায় তো বটে। একই কথা। আরও শুনবে হাসির কথা? দয়াল রায়ের স্মৃতিভ্রংশ হওয়ার বৃত্তান্ত শুনলে রামগরুড়ের ছানাও হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাবে!”

“তা না হয় সেটাই বলুন। বন্দুক-পিস্তল ধরার আগে না হয় শেষ হাসিটা হেসেই নিলুম।”

“সে আর বোলো না। বরচড়াইয়ের কাঁঠাল যে জগদ্বিখ্যাত, তা জান তো? অত বড় আর সুস্বাদু কাঁঠাল ভূভারতে পাবে না। সেদিন সকালে বরচড়াইয়ের হাটের কাছ বরাবর বড় রাস্তায় যখন একটা জাঁকালো রকমের মোটরবাইকে চেপে দয়াল রায় সতু ঘোষকে তাড়া করে যাচ্ছিল তখন বরচড়াইয়ের সেই বিখ্যাত পেল্লায় এক কাঁঠাল তার মাথায় ভেঙে পড়ে। কাঁঠালটা গাছপাকা হওয়ায় দয়াল রায়ের বড় রকমের চোট বা রক্তপাতও হয়নি ঠিকই, তবে অভিঘাত বলেও তো একটা কথা আছে! সেই অভিঘাতেই দয়াল তার বেবাক হিস্ট্রি ভুলে গিয়ে শুধু জিয়োগ্রাফিটুকু নিয়ে বেঁচে আছে!” .

“কিন্তু আমার তো ঘটনাটা শুনে মোটেই হাসি পেল না কাকাবাবু!”

“তা পাবে কেন, নিজে আছাড় খেলে কি কেউ হাসে? অন্যকে আছাড় খেতে দেখলে তবে হাসে। বুঝলে কিছু?”

“বুঝব না কেন? খুব বুঝেছি। আপনি দেখছি আমাকে দয়াল রায় না বানিয়েই ছাড়বেন না!”

“এবার কি পিস্তলটা বের করবে হে বাচাল ছোকরা? তাদের আসার যে সময় হয়ে এল!”

“যে আজ্ঞে, ” বলে তোরঙ্গ ঘেঁটে পিস্তলটা বের করে এনে গোপাল বলল, “এ যে দিব্যি ভারিক্কি জিনিস মশাই! অন্ধকারে ঠিক ঠাহর হচ্ছে না, এটা কি পুরনো আমলের জার্মান মাউজ়ার নাকি কাকাবাবু?”

দীনেশ গুণ খ্যাঁক করে উঠে বলে, “তবে এতক্ষণ ন্যাকামি করছিলে কেন, ‘আঁমি বঁন্দুক-পিঁস্তল চিনি না কাঁকাঁবাঁকুঁ?’ শুধু চেনই না, বন্দুকপিস্তলের তো তুমি একজন পাকা জহুরি হে!”

ঠিক এই সময়ে হঠাৎ একটা তীব্র শিস দেওয়ার শব্দ হল আর

একটা নীলচে আগুনের ছটার সঙ্গে জানলা দিয়ে গুলিটা এসে ঘরের দেওয়ালের চাপড়া খসিয়ে বিঁধে গেল।

গোপাল চট করে নিচু হয়ে বসে পড়ে বলল, “ওদের বন্দুকে সাইলেন্সার লাগানো আছে দেখছি!”

দীনেশ গুণ ব্যস্ত হয়ে বলে, “আহা, এখন ওসব দেখার দরকার নেই হে, পালটা গুলি চালাও।”

একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে গোপাল বলে, “সেটা এথিক্যাল হবে না। কাকাবাবু। ও-বাড়িতে একটা বাচ্চা ছেলে আর তার মা-বাবা থাকে। সেটা মনে রাখবেন।”

“তাও তো বটে! নীলমণি, তার বউ আর বাঘুর কথা ভুলেই গিয়েছিলাম বটে। ওরা সেই কারণেই বোধ হয় ও বাড়িটা বেছে নিয়েছে, যাতে তুমি পালটা গুলি না চালাতে পার। তা হলে এখন করবেটা কী?”

গোপাল একটু হেসে বলল, “আপনার দলেই নাম লেখাতে হে বলে মনে হচ্ছে কাকাবাবু! মরার পর আপনি তো বেশ তোফা আ দেখছি!”

“এখন কি রসিকতা করার সময়? তুমিও মনে রেখো যে, বাড়িতেও আমার ছেলে আর বউমা রয়েছেন। তাঁদের কিছু হলে ত হবে? গুলিগোলা তো আর ভাল জিনিস নয় রে বাপু!”

“তা বটে। দাঁড়ান, দেখছি কী করা যায়।”

একটু বিরতির পর হঠাৎ ওপাশ থেকে উপর্যুপরি অন্তত ডজনদুয়েক জোরালো গুলি এসে ঘরটাকে লন্ডভন্ড করে দিল। চারদিক ধোঁয়ায় ধোঁয়াক্কার!

এই গুলিবৃষ্টির মধ্যেই একটা ছায়ামূৰ্তি লম্বা একটা লাঠি হাতে ঘ থেকে বেরিয়ে গেল।

বাঘুর ঘরে চারজন ছায়ামূর্তির একজন চাপা গলায় বলল, “মাটা বোধ হয় লটকে গিয়েছে রে দীনু!”

দীনু নামের হোঁৎকা লোকটা বলল, “দয়াল একজন ঘুঘু লোক। কিছু বলা যায় না, কাছে গিয়ে লাশ দেখে তবে প্রত্যয় হবে।”

চিতু এদের কাণ্ড দেখে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিল। হ্যাঁ, রুস্তম হতে হয়। তো এরকম! সে গদগদ হয়ে বলে, “আজ্ঞে, ওই জানলা বরাবরই গোপালবাবুর বিছানা, যা গুলি চালিয়েছেন কর্তা, গোপাল এতক্ষণে তালগোল পাকিয়ে পড়ে আছে।”

শক্তপোক্ত চেহারার হেলা বলে, “যদি নিয্যস নাও মরে থাকে তো বাকি কাজটা সামনাসামনি ফিনিশ করতে আর কতক্ষণ লাগবে!”

দীনু কবজির ঘড়িটা দেখে নিয়ে বলে, “ওরে বাবা, সাড়ে তিনটে বাজে! চল, চল, কাজ হাসিল করে পাতলা হয়ে যেতে হবে।”

নিঃসাড়ে চারজন বাঘুদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে বাগানের পাঁচিলটা ডিঙিয়ে রমেশ গুণের বাড়ির বাগানে নেমে পড়ল। তারপরই চারজনকে থমকে দাঁড়িয়ে পড়তে হল। কারণ, তাদের সামনে তাদেরই যমদূত খুব শান্তভাবে বুকে হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছে।

লড়াইটড়াই আর বিশেষ হল না। এমনকী, লোকটা লাঠিটা অবধি ছুঁল না। তার দু’খানা হাতে যে গোখরোর ছোবল ছিল তা চারজনের কেউই বুঝতে পারেনি। মোট চারটে রদ্দাই বরাদ্দ ছিল চারজনের জন্য। তারা নিতান্তই গুডবয়ের মতো রদ্দা খেয়ে ঘাসের উপর শুয়ে পড়ল সংজ্ঞা হারিয়ে। টু শব্দটিও করার সময় পেল না।

সকালবেলাটায় পুলিশ আর জনতায় ছয়লাপ হয়ে গেল রমেশ গুণের বাড়ি। লোকে লোকারণ্য। সামনের চত্বরে একটা কাঠের টেবিলের উপর সোনার দুর্গামূর্তিটা রাখা। থানার বড়বাবু সেটা ভাল করে নিরখপরখ করার পর বললেন, “শুনেছিলাম বটে রাসপুর রায়বাড়ির দুর্গামূর্তির কথা। দু’চোখে দুটো হিরে, নাকছাবিতে নীলা, কানে মুক্তোর দুল, হাতের বালায় পোখরাজ, কয়েক কোটি টাকা দামের জিনিস! আজ দেখে চক্ষু সার্থক হল।”

এর পরই বড়বাবু গোপালের দিকে চেয়ে হাসিমুখে বললেন, “ও মশাই, এই কয়েকদিন আমাদের সবাইকেই তো অনেক ঘোল খাওয়ালেন! এবার বলুন তো আপনি আসলে কে! গোপাল না দয়াল?” গোপাল একটু হাসল মাত্র। কিছু বলল না।

-সমাপ্ত-