হিরণগড়ের ব্যাপারস্যাপার – ৭

কালী পাণ্ডার বাড়ির পিছনের বাগানখানা পেল্লায় বড়। হেসেখেলে বিঘেপাঁচেক তো হবেই, কিছু বেশিও হতে পারে। চিতুর হিসেবনিকেশ খুব পাকা, কালীর মোট বিয়াল্লিশটা ফলন্ত নারকেল গাছ আছে। যে সে নারকেল নয়, মহীশূরের স্পেশাল নারকেল। অবশ্য কালীর বাগানে কড়া পাহারারও বন্দোবস্ত আছে। চারটে দিশি সড়ালে কুকুর, দু’জন দানবাকৃতি লেঠেল হাবু আর পঞ্চা, আর বাড়ির চিলেকোঠা থেকে বন্দুক হাতে চতুর্দিকে নজর রাখে কালী পাণ্ডার খুড়ো, অনিদ্রার রোগী হরি পাণ্ডা। সুতরাং রাতবিরেতে মনুষ্যদেহ নিয়ে এই বাড়িতে ঢোকা অসম্ভব। দিশি সড়ালে কুকুর যে কি জিনিস তা শুধু ভুক্তভোগীরাই জানে। ডোবারম্যান, জার্মান শেফার্ড, অ্যালসেশিয়ান কেউই দিশি সড়ালে কুকুরের কাছে কিছু নয়। আর হরি পাণ্ডার কথা যত কম বলা যায় ততই ভাল। একে তো হরি পাণ্ডার বুকে মায়া-দয়া বলে কিছুই ভগবান দেননি, তার উপর লোকটা নাকি দিনের আলোর চেয়ে রাতের অন্ধকারেই বেশি দেখতে পায়। আর বন্দুকের টিপ? লোকে বলে, হরি পাণ্ডা নাকি দুশো গজ দূর থেকে ছুঁচের ডগায় গেঁথে রাখা একদানা সর্ষেও উড়িয়ে দিতে পারে। বাকি রইল হাবু আর পঞ্চা। তারা হল মতি ওস্তাদ, গেনু ওস্তাদ আর করালী লেঠেলের উপযুক্ত শাগরেদ। লাঠি এত জোরে ঘোরায় যে তা এরোপ্লেনের প্রপেলারের মতো অদৃশ্য হয়ে যায়।

তবে আজকের দিনটা আলাদা। কালী পাণ্ডার একশো পাঁচ বছর বয়সি ঠাকুরদাদা মোহন পাণ্ডা পটল তোলায় বাড়িসুদ্ধু লোক দাহকার্য সারতে গিয়েছে। হাবু আর পঞ্চা আজ সদরের ফটক সামলাতে ব্যস্ত। মাঝরাতে হঠাৎ ভগবানের আশীর্বাদে হুড়মুড়িয়ে বৃষ্টি নামায় কুকুরদেরও ঘরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। চিতু ভালই জানে যে তার মতো অভাজনদের জন্যই মাঝে-মধ্যে ভগবান এরকম সুবর্ণসুযোগ তৈরি করে দেন।

নারকেল ভারী জিনিস, তার উপর মহীশূরের স্পেশাল নারকেল বলে কথা। তাই গাছে উঠে চিতু হিসেব করে মোট বারোটা নারকেল নামাল। বেশি লোভ করে লাভ নেই। এসব বিজ্ঞতা তার ভালই আছে। বড় চোর সে কোনওদিন হতে পারবে কিনা জানে না, তবে সার্থক ছিঁচকে চোর হওয়াও কম কথা নয়! গাছ থেকে নেমে সে ধীরেসুস্থে নারকেলগুলো উঁচু দেওয়াল টপকে ওপাশে ফেলল, তারপর নিজে দেয়ালে উঠে বাইরে লাফ দিয়ে নামল। না-হোক দুশো আড়াইশো টাকায় মাল গস্ত করানো যাবে বলে মনটায় বেশ ফুর্তি হচ্ছিল তার। কিন্তু মাটিতে নেমেই দেখল তিনজন ষন্ডামতো লোক তাকে তিন দিক দিয়ে ঘিরে খুব তীক্ষ্ণচোখে তাকেই দেখছে। শিয়রে বিপদ নিয়েই চিতুকে রোজ বেঁচে থাকতে হয়। তাই বিপদ এলে সে বুঝতেও পারে এক লহমায়। ভয় না পেয়ে চিতু খুব স্বাভাবিক মুখ করে মাথার গামছাটা খুলে মুখ-হাত মুছল। চিতু এটাও বুঝতে পারল যে, এরা হল সেই ধরনের লোক যাদের দেখা সচরাচর পাওয়া যায় না। কারণ এরা খুব উঁচুদরের খেলোয়াড়। টক্কর নেওয়ার কথা ভাবাও পাপ, তাই চিতু খুব বিনয়ের সঙ্গেই বলল, “আজ্ঞে কিছু করেন নাকি কর্তারা?”

সামনের মুখোমুখি লোকটা বেশ অবাক গলায় বলল, “তুই কি চোর নাকি?”

“আজ্ঞে হ্যাঁ, তবে ছোট মাপের চোর।”

“সে তো বুঝতেই পারছি! দেশটার আর উন্নতি হল না! তবে আমাদের এখন একজন চোরকেই দরকার, কারণ চোরেরাই মানুষের হাঁড়ির খবর রাখে! এই গাঁয়েই থাকিস নাকি তুই?”

“যে আজ্ঞে, চার পুরুষের বাস।”

“বেশ-বেশ! এবার যা জানতে চাইছি খুব ভেবেচিন্তে তার জবাব দিবি। চালাকি করলে কিন্তু বিপদ! আমরা খুব ভাল লোক নই!” “যে আজ্ঞে, বুঝতে পেরেছি।”

“এই তো গুডবয়! আমরা গুডবয়দের খুব পছন্দ করি। এখন ভাল করে ভেবে বল তো গত কয়েকদিনের মধ্যে একজন লোক এ গাঁয়ে এসে গা-ঢাকা দিয়ে আছে কিনা! লোকটা বেশ লম্বা, ফরসা, ছিপছিপে জোরালো চেহারা!”

মাথাটাথা চুলকে চিতু বলে, “আজ্ঞে, ব্যাপারটা একটু গোলমেলে। যার কথা বলছেন তেমনধারা একজন লোক আছে বটে, তবে তাকে তো সবাই গোপাল বলে জানত, মাথাপাগলা লোক। পরে দেখা গেল। সে আসলে বিখ্যাত ডন লালু মণ্ডল, এখন আবার শোনা যাচ্ছে তিনিই নাকি এলাকার নতুন এস ডি পি ও মাধব সরকার। আপনারা যাকে খুঁজছেন তিনিই ইনি কিনা, তা বলতে পারব না।”

লোকটা টক করে তার দুই স্যাঙাতের সঙ্গে নিচু গলায় কী যেন কথাবার্তা বলে নিয়ে ফের চিতুর দিকে চেয়ে বলল, “লোকটা কোন বাড়িতে আছে?”

“রমেশ গুণের বাড়িতে। চলুন, নিয়ে যাচ্ছি। তার আগে আমার কেলগুলোর একটা বিলিব্যবস্থা করে নিই?”

লোকটা বজ্রগম্ভীর গলায় বলে, “নারকেলের কথা ভুলে যা। ভাল করে ভেবে বল তো, লোকটার ডান গালে একটা কালো আঁচিল আছে কিনা!”

“তা আর নেই! খুব আছে কর্তা। দিব্যি বড়সড় একটা কালো  আঁচিল চলুন না
, নিজের চোখেই দেখবেন!”

লোকটা যেন একটু ভাবিত হয়ে বলল, “তুই শুধু বাড়িটা চিনিয়ে দে তারপর যা করবার আমরাই করব। আর-একটা কথা মনে রাখিস, আমাদের কথা যদি কারও কানে তুলিস তা হলে তোকে কিন্তু শকুন আর শেয়ালে ছিড়ে খাবে।”

চিতু জিভ কেটে বলে, “পাগল! ওসব কথা মুখে আনাও পাপ! তা লাশ কি আজ রাতেই নামিয়ে দেবেন? সময়টা প্রশস্ত ছিল কিনা, টেস্লোয় ঠান্ডা পেয়ে লোকে নিঃসাড়ে ঘুমোচ্ছে, কেউ কিছু টেরও পাবে না।”

লোকটা চড়াক করে একটা জোরালো টর্চের আলো তার মুখে মেরে বলে, “আমরা লাশ নামাব একথা তোকে কে বলল? আমাদের দেখে তোর খুনি-গুন্ডা বলে মনে হয়?”

চিতু সবেগে মাথা নেড়ে বলে, “আজ্ঞে না কর্তা! তা মনে হবে অন্ধকারেও আপনাদের ভাল লোক বলে চিনতে আমার কোনও অসুবিধেই হয়নি কিনা, আর তাই তো সঙ্গে লেগে রয়েছি।”

“বেশ-বেশ! এখন বল তো, গোপাল নামের লোকটাকে তুই কতটা

আমতা-আমতা করে চিতু বলে, “আজ্ঞে, এই সবে চেনা হতে শুরু হয়েছিল আর কী। এখনও তেমন…”

“লোকটাকে যত কম চিনবি ততই তোর স্বাস্থ্যের পক্ষে ভাল, বুঝলি?”

চিতু সঙ্গে-সঙ্গেই একমত হয়ে বলে, “যে আজ্ঞে।”

“এখন একটা কাজের কথা।”

“আজ্ঞে।”

“তুই তো চোর?”

“যে আজ্ঞে, তবে চুনোপুঁটির খাতে ধরবেন কর্তা। এখনও তেমন মানুষের মতো মানুষ হয়ে উঠতে পারিনি কিনা!”

“তাতেই হবে। এ গাঁয়ে মালদার মহাজন কে-কে আছে বল তো! আমাদের ক্যাশ একটু শর্ট আছে। রাতটা বৃথা যায় কেন?”

“আজ্ঞে, ঠিকই তো! এ তো ন্যায্য কথাই বলেছেন কর্তা। তবে আমার নারকেল আর পেরাসনি সব তো জলেই গেল কর্তা, আমার দিকটাও একটু যদি দেখেন!”

“সে ভেবে দেখব ‘খন।”

গাঁয়ের লোক রাতে একটু তাড়াতাড়িই ঘুমিয়ে পড়ে। তবে যাদের গুরুতর বিষয়কর্ম থাকে তাদের কথা আলাদা। এই যেমন রমাচরণ। সারাদিনের কাজকারবারের খতিয়ান আর হিসেবপত্র মেটাতে-মেটাতে তার অনেক রাত হয়ে যায়। আর কাজকারবারও তো কম নয়! চারপাঁচ রকমের ব্যবসায় অগুনতি লেনদেন মেলানো কি সোজা কাজ? তবে হ্যাঁ, এই একটা কাজ করে সে যা আনন্দ পায় তার কাছে যাত্রাথিয়েটার-সিনেমা বা সিরিয়াল কিছুই লাগে না। হিসেবপত্র নিয়ে বসলে তার আর নাওয়াখাওয়া থাকে না, বাহ্যজ্ঞান লুপ্ত হয়ে যায়। আজও রামাচরণ হিসেবের খাতায় আকণ্ঠ ডুবে ছিল। রাত বারোটা অনেকক্ষণ আগেই বেজে গিয়েছে। হিসেব মেলাতে গিয়ে রমাচরণ দেখল আজ একদিনেই তার প্রায় ষাট হাজার টাকা লাভ হয়েছে। এতে মনটা ফুর্তিতে নাচানাচি করছিল, মুখ রসস্থ, সে চাপা গলায় বলল, “বুঝলি রে ব্রহ্মজ্ঞান, সাধুবাবা কিন্তু জব্বর জিনিসই দিয়েছে! ব্রহ্মজ্ঞ হওয়ার পর থেকেই দেখছি, আয়েপয়ে বেশ বাড়াবাড়ি হচ্ছে!”

একটা হাই তোলার শব্দ হল, তারপর ব্রহ্মজ্ঞান নীরস গলায় বলল, “দূর মশাই, আপনার লাভ হলে আমার কোন কাঁচকলা? আপনি আপনার আয়পয় নিয়ে থাকুন, আমার ঘুম পাচ্ছে।”

“তুই বড্ড কাঠখোট্টা লোক রে ব্রহ্মজ্ঞান! তোর রসকষ নেই!”

ঠিক এই সময়ে বন্ধ জানালার কপাটে ঠুকঠুক করে টোকা দেওয়ার শব্দ হল। ব্যাপারটা নতুন কিছু নয়, রাতবিরেতেও লোকের নানা রকম বিপদআপদ বা ঠেকা দেখা দেয়। তখন লোকে অসময়েও গয়নাগাটি বা থালা-বাসন বন্ধক রেখে রমাচরণের কাছ থেকে টাকা ধার নিয়ে যায়। প্রায় নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার।

রমাচরণ খুব সাবধানে বন্ধ জানালার কপাট একটু ফাঁক করে বলে, “কে রে?”

“আমি চিতু রমাচরণখুড়ো! এই ইনি একটু বিপাকে পড়ে গিয়েছেন কিনা, তাই আমাকে বড্ড ধরে পড়েছেন।”

রমাচরণ রাগ করে বলে, “এই মাঝরাত্তিরে কাকে নিয়ে এসেছিস রে বদমাশ? তোর মতলবটা কী?”

পিছন থেকে এবার একটা লোক মুখ বাড়িয়ে ভারী ভদ্র গলায় “ভয় পাবেন না মশাই, আমি তেমন খারাপ লোক নই। একটু বিপদে পড়েই আপনার কাছে আসা।”

“বিপদ! কীরকম বিপদ?”

“আজ্ঞে এই একটা জিনিস এনেছি, বাঁধা রেখে যদি কিছু টাকা দেন। কাল আমার বোনের বিয়ে, একেবারে শেষ মুহূর্তে বরপক্ষ পঞ্চাশ হাজার টাকা পণ চেয়ে বসায় গলাজলে পড়ে গিয়েছি কিনা!”

“জিনিসটা কী?”

“এই যে, পরখ করে দেখে নিন। একেবারে খাঁটি সাবেকি জিনিস, ” বলে লোকটা একটা বড়সড় কাঠের বাক্স বের করে ডালা খুলে দিল। ভিতরে একটা ঝকঝকে সোনার দুর্গামূর্তি।

জিনিস দেখে রমাচরণের বুক ধকধক করতে লাগল। কিন্তু অনেকদিনের অভ্যাসে তার মুখের কোনও ভাবান্তর হয় না। মুখের নীরস ভাবটা বজায় রেখেই সে তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলে, “সোনা না পেতল?”

“আজ্ঞে খাঁটি সোনা।”

রমাচরণ কষ্টিপাথর বের করে সোনা পরখ করতে গিয়ে দেখে, মূর্তিটা তার জানলার গ্রিলের ফাঁক দিয়ে ভিতরে ঢুকছে না। অগত্যা কষ্টিপাথরটা জানলা গলিয়ে পরীক্ষা করে দেখতে হল। সোনাই বটে। চোখের আন্দাজে অনুমান করল, অন্তত দেড় থেকে দু’কেজি সোনা তো হবেই। রাতবিরেতে সে সাধারণত দরজা খুলে কাউকে ঢোকায় না, কিন্তু এত বড় দাঁও তো আর ছাড়াও যায় না কিনা!

রমাচরণ যখন দরজার হুড়কো খুলছিল তখন হঠাৎ তার নিত্যসঙ্গী ব্রহ্মজ্ঞান ঘুমজড়ানো গলায় বলে উঠল, “ওয়ান পার্সেন্ট ব্রহ্মজ্ঞান দিয়ে আর কত কী হবে? তখনই বলেছিলাম আর একটু টাকা খসিয়ে হান্ড্রেড পার্সেন্টটা গস্ত করে ফেলুন। তা শুনলে তো আমার কথা!”

রমাচরণ উষ্মার সঙ্গে জবাব দেয়, “দ্যাখ ব্রহ্মজ্ঞান, বিষয়বুদ্ধিতে আমার সঙ্গে পাঙ্গা নিতে আসিস না। এই কাজ করে করে চুল পাকিয়ে ফেললুম, আর উনি সেদিনকার ছোকরা আমাকে আজ লেনদেন শেখাতে এলেন! ঘুমোচ্ছিস ঘুমো, সব ব্যাপারে তোর নাক গলানোর দরকার কী?”

হুড়কো খসাতেই জনাতিনেক ষন্ডা হুড়মুড়িয়ে রমাচরণের উপর এসে পড়ল। রমাচরণ কোঁক করে একটা শব্দ করতে পেরেছিল মাত্র, তারপর আর কিছুই তার মনে নেই। উপর্যুপরি কয়েকটা রদ্দা খেয়ে সে সেই যে জমি ধরে নিল, তারপর বারো-তেরো ঘণ্টা সে আর চোখই মেলল না। তার বউ হরিমতীর এমনিতেই ঘুমের জন্য ভারী নামডাক। লোকে বলে যে, হরিমতী ঘুমোলে তার ঘরে এক সঙ্গে দশটা বজ্রপাত দশটা সিংহ গর্জন করুক এবং সেই সঙ্গে দশটা জয়ঢাক বাজুক, তাও হরিমতীর ঘুম টসকাবে না। টসকায়ওনি। শুধু রমাচরণের নিত্যসঙ্গী নিরাকার ব্রহ্মজ্ঞান ভারী বিরক্ত হয়ে আপনমনে স্বগতোক্তি করেছিল, ‘এরা কেন যে সাড়াশব্দ না করে কোনও কাজ করতে পারে না তা বুঝি না বাপু! দিলে তো ঘুমের উপর একবালতি জল ঢেলে!’

এরা যে ভারী কাজের লোক তা চিতু মুগ্ধ বিস্ময়ে লক্ষ করছিল। কী পরিপাটি চতুর হাতে সিন্দুক খুলে ফেলল, কী দক্ষতায় আলমারির গুপ্ত জায়গা বের করে ফেলল, কী বিজ্ঞতায় জলের কলসি বা পুরনো বালিশ ভেদ করে সোনাদানা আবিষ্কার করল তা কহতব্য নয়। না, এদের কাছে তার অনেক কিছু শেখার আছে! চিতু মনে মনে একটা কাঁচা হিসেব করে দেখল, এইসব শ্রদ্ধেয় এবং প্রাতঃস্মরণীয় লুটেরাগণ রমাখুড়োর তবিল থেকে মাত্র আধঘণ্টায় কম করেও বিশ-পঁচিশ লাখের মাল সরিয়েছে। এদের পায়ের ধুলো পুরিয়া করে বিক্রি করা উচিত!

নির্বিঘ্নে কাজকর্ম সেরে রাস্তায় নেমে চিতু মিনমিন করে একবার বখরার কথাটা তুলেছিল, “কর্তারা, আমার টেন পার্সেন্ট কমিশনটা যদি এইবেলা মিটিয়ে দেন তবে হিসেবটা পরিষ্কার থাকে। ডেবিটক্রেডিটেরও আর গরমিল হয় না। কী বলেন কর্তারা? ঠিক বলিনি?”

সর্দারগোছের হোঁৎকা লোকটা গম্ভীর গলায় বলে, “দ্যাখ, ছেলেবেলায় আমার কানে একবার শ্যামাপোকা ঢুকে যাওয়ায় আমি কানে একটু কম শুনি, বুঝলি? আর সেই কারণেই তোর কপালটা মনে হয় বেজায় ভাল, সব কথা শুনতে পেলে কিন্তু তোর বিপদ ছিল!”

সঙ্গে-সঙ্গেই হাওয়া বুঝে নিয়ে চিতু গ্যালগ্যালে হয়ে বলে, “যে আজ্ঞে। তা হলে কর্তা, আমাকে বরং এবার ছুটি দিয়ে দিন, আমার নারকেলগুলো বেওয়ারিশ পড়ে আছে কিনা। দিনের আলো ফুটে গেলে ও আর খুঁজে পাওয়া যাবে না! চারদিকে যা চোর-ছ্যাঁচড়ের উপদ্রব, তা আর কহতব্য নয়!”

“আহা, একদিন না হয় তোর নারকেলে অন্য কেউ নাডু পাকালই, তাতে ক্ষতি কী? নারকেলগুলো তো আর তোর বাবার গাছে ফলেনি! বুঝেছিস তো!”

“যে আজ্ঞে। বুঝেছি। তা হলে বরং এইবেলা রাত থাকতে থাকতেই গোপালবাবুর লাশটা নামিয়ে দিন, আর আমিও বাড়ি গিয়ে চারটে পান্তা নিয়ে বসি!”

লোকটা অবাক হয়ে বলে, “লাশ? কিসের লাশ? কেমন লাশ? কার লাশ? কোথায় লাশ? লাশের কথা বারবার উঠছে কেন বল তো! তুই কি লাশ নামানো দেখতে পছন্দ করিস?”

চিতু মাথা চুলকোতে-চুলকোতে বলে, “আজ্ঞে, ইহজন্মে কি আর এ পাপচোখে ওসব দেখতে পাওয়ার ভাগ্য আমার হবে কর্তা? এই আপনাদের দেখেই যা একটু ভরসা হয়েছিল যে, আজ আমার ভাগ্য খুলতেও পারে। আপনারা যেভাবে গোপালবাবুর তত্ত্বতালাশ নিচ্ছিলেন তাতে মনে হয়েছিল তার লাশ নামাতেই আপনাদের আগমন!”

লোকটা মৃদু-মৃদু মাথা নাড়া দিয়ে বলে, “নাহ, তুই ছ্যাঁচড়া চোর হলেও গবেট নোস দেখছি! তা লাশ একটা নামাতে হবে বটে! তার আসল নাম যেমন গোপাল নয়, তেমনি সে মশা-মাছিও নয়। তার লাশ নামাতে হলে বিস্তর কাঠ-খড় পোড়াতে হবে, বুঝলি! মুশকিল কী জানিস, ওই একটা লাশ নামাতে গিয়ে আরও ক’টা লাশ পড়বে তারও কিছু ঠিক নেই! বুঝেছিস কিছু? তবে ওসব বেশি না বোঝাই ভাল। যতই না বুঝে বুরবকের মতো থাকবি ততই তোর পক্ষে মঙ্গল। ছোটখাট চুরিছ্যাঁচড়ামি করে বেশ তো আছিস, ওসব ভয়ঙ্কর রক্তারক্তি কাণ্ডের মধ্যে জড়িয়ে পড়ার দরকার কি তোর? ছোরাছুরি, পিস্তলবন্দুক, গুলিগোলা, বোমা-পটকা, তরোয়াল-সড়কি, এসব কি স্বাস্থ্যের পক্ষে ভাল রে?”

সঙ্গে-সঙ্গেই একমত হয়ে চিতু বলে, “আজ্ঞে না। ওসব আমার ধাতে তেমন সয় না কর্তা!”

“আমিও তো জানি তুই একজন গুডবয়, আর গুডবয়দের আমরা খুব পছন্দ করি।”