৬
গুড়ুক গুড়ুক হুঁকোর শব্দ পেয়েই মাঝরাতে উঠে বসল গোপাল। “পেন্নাম হই কাকাবাবু! শরীরগতিক সব ভাল তো!”
আর ধ্যাষ্টামো কোরো না তো! শরীর! শরীর বলে কিছু আর আছে নাকি? খানিকটা ধোঁয়াটে জিনিস ছাড়া আর কিছু তো নয় রে বাপু! এর আবার ভাল আর মন্দ!”
গোপাল ভারী অবাক হয়ে বলে, “কেন কাকাবাবু, আপনাদের কি সর্দিকাশি, জ্বরজারি, হাঁটু বা দাঁতের ব্যথা বা বাতব্যাধি হয় না?”
“আহা, তা হবে না কেন? তাও হয়, তবে ওসব ঠিক্ তুমি বুঝবে না, বুঝলে? আমাদের অন্য রকম। না মরলে তুমি ঠিক ঠাহর পাবে না ব্যাপারটা।”
গোপাল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, “আমি তো মরেই আছি কাকাবাবু! যার নিজের নামধাম বিস্মরণ হয়ে গিয়েছে, যে নিজেকেই আর চিনতে পারছে না, যার তিনকূলে কেউ নেই তার বাঁচা আর মরায় তফাত কী বলুন তো! একজন অজ্ঞাতকুলশীলের কি বেঁচে থাকার কোনও মানে আছে?”
“আরে বাপু, এতে এত হাল ছেড়ে দেওয়ার কী হল? পিছুটান না থাকলে তো তুমি মুক্তপুরুষ হে! এমন ভাগ্য কতজনার হয়, একটু ভাবো তো বাপু! যত অপকর্ম, যত পাপতাপ, যত খুনখারাপি, রাহাজানি, চুরিডাকাতি, ঠগবাজি করে এসেছ তার কিছুই আর এখন তোমার নাগাল পাবে না। তারপর ধরো, পাপটাপ করলে মানুষের যে মনস্তাপ হয় তাও তোমার হওয়ার চান্স নেই। তা হলে মন্দটা আছ কী বলো তো! বউ-বাচ্চা নিয়ে উদ্বেগ নেই, সংসারচিন্তা নেই, পুলিশের ভয়ে কাঁটা হয়ে থাকা নেই, ফাঁসির দড়ি চোখের সামনে ভেসে উঠছে না! আর কী চাই হে?”
গোপাল কাঁচুমাচু হয়ে বলে, “কিন্তু কাকাবাবু, আপনিই তো আগের দিন বলেছিলেন যে, আমাকে একজন ভাল লোক বলেই মনে হয় আপনার!”
“আরে সেইটেই তো চিন্তার কারণ! যারা দেখতে ভালমানুষের মতো তারাই বেশি বিপজ্জনক হয় কিনা! দারোগা গদাধর ভঞ্জমশাইও বলছিলেন!”
গোপাল একঢোক হাওয়া গিলে ফেলে বলে, “তিনি কে বলুন তো কাকাবাবু!”
“ওরে বাবা! তিনি একজন ভয়ঙ্কর জবরদস্ত আর দাপুটে দারোগা! এই বছরদুই আগে গত হয়ে এখন আমাদের এইপাশটায় এসে পড়েছেন। তা তোমার কথা শুনে বললেন, ‘ও বাবা, এ তো ডেঞ্জারাস লোক বলে মনে হচ্ছে মশাই! ভালমানুষের মতো দেখতে বদমাশগুলোই আমাকে বেশি নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরিয়েছে কিনা! লোকটাকে একটু জরিপ করে দেখতে হচ্ছে তো!’ তা তিনি তোমাকে চুপিচুপি এসে দেখেও গিয়েছেন। বলেছেন, কুখ্যাত অ্যান্টিসোশ্যাল গ্যাংস্টার লালু মণ্ডলের সঙ্গে তোমার নাকি দারুণ মিল আছে! এমনকী, সুপারি কিলার জগু কৈবর্ত হলেও তিনি আশ্চর্য হবেন না।”
শুকনো গলায় গোপাল বলে, “আজ্ঞে আমিও ঠিক এই ভয়টাই পেয়েছিলাম কিনা কাকাবাবু! কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে নিশ্চয়ই সাপ বেরিয়ে পড়বে! কিন্তু আমি লালু মণ্ডল না জগু কৈবর্ত সেটা যদি উনি একটু মীমাংসা করে দেন তা হলে বড় ভাল হয়।”
দীনেশ গুণ উদ্বেগের গলায় বলেন, “বলো কী হে ছোকরা! তোমার মতো আহাম্মক তো আর দেখিনি! সেধে কেউ জেলের ঘানি টানতে যায় না ফাঁসির দড়ি গলায় পরে? লালু মণ্ডল বা জগু কৈবর্ত হওয়ার মধ্যে কোন সুখটা আছে শুনি? ওসব ভুলে মেরে দিয়ে তো বেঁচে গিয়েছ
গোপাল মাথা নেড়ে বলে, “তা হলেও তো সেটাই আমার আসল পরিচয় কিনা! ভাল-মন্দ যা-ই হোক আমার একটা আইডেন্টিটি তো দরকার।”
“তোমার তো দেখছি গুন্ডা-বদমাশ হওয়ার দিকে বেজায় ঝোঁক! এ তো ভাল কথা নয়! না হে বাপু, তোমার লক্ষণ আমার মোটেই ভাল ঠেকছে না!”
“আজ্ঞে আমারও ওই কথা! নিজেকে আমারও তেমন সুবিধের লোক বলে মনে হচ্ছে না কাকাবাবু! তবে ভাল-মন্দ যা-ই হই, আমি লোকটা আসলে কে সেটা জানতে পারলে আমি এখন হাঁফ ছেড়ে বাঁচি। মুড়ো আছে ল্যাজা নেই, এই অবস্থা নিয়ে কি বেঁচে থাকা যায় বলুন! এ যেন গোঁফ ছাড়া আশু মুখুজ্জে!”
“রোসো বাপু, রোসো। আমাকে একটু ভাবতে দাও, ” বলে কিছুক্ষণ আবার গুড়ুক গুড়ুক হুঁকোটানার শব্দ। তারপর গলাখাঁকারি দিয়ে দীনেশ গুণ বলে, “তা হলে বরং একটা কাজ করো। পুলিশের কাছে সারেন্ডার করে বলো যে, তুমি একজন সাংঘাতিক ক্রিমিনাল, তা হলে তারাই আদাজল খেয়ে তোমার ইতিবৃত্তান্ত খুঁজে বের করে ফেলবে। “
“দূর মশাই! পুলিশের দৌড় তো দেখলুম! আপনার গদাধর ভঞ্জই তো এখনও বুঝে উঠতে পারেননি যে, আমি লালু মণ্ডল না জগু কৈবর্ত! অত বড় জাঁদরেল দারোগাই যখন পারেননি তখন এলেবেলে পুলিশ আর কত কী করতে পারবে?”
“ওহে বাপু, অত হতাশ হয়ে পোড়ো না তো! লালু মণ্ডল আর জগু কৈবর্ত দু’জনেই স্বনামধন্য লোক, বুঝলে? তাদের নামে হুলিয়া রয়েছে কিনা, তাই পুলিশ হন্যে হয়ে তাদের খুঁজছে! এখন তুমি কষ্ট করে যদি বরচড়াইয়ের থানায় গিয়ে বড়বাবুর সামনে হাসি হাসি মুখ করে দাঁড়াতে পার তো সঙ্গে সঙ্গেই পুলিশ তোমাকে চিনতে পেরে জাপটে ধরে গারদে পুরে দেবে, ব্যস, ল্যাঠা চুকে গেল। তুমি আসলে কে তা নিয়ে তোমাকে আর মাথা ঘামাতে হবে না!”
গোপাল একটু ভাবল এবং ভেবেটেবে প্রস্তাবটা তার বেশ পছন্দই হয়ে গেল। বলল, “সেটা মন্দ প্রস্তাব নয় কিন্তু কাকাবাবু!”
“মন্দ নয় মানে? এ হল একেবারে মোক্ষম প্রস্তাব! এবার লক আপে গিয়ে আয়েশ করে থাকতে পারবে, দু’বেলা বিনি পয়সায় খাওয়াদাওয়া, মাথার উপর পাকা ছাদ, আর চাই কী? জামাই আদর আর কাকে বলে!”
দীনেশ গুণ যে তাকে বাড়ি থেকে তাড়াতে পারলে বাঁচে তা বুঝতে গোপালের মোটেই অসুবিধে হল না। অবিশ্যি দীনেশবাবুর দোষও নেই, একজন অজ্ঞাতকুলশীল সন্দেহজনক লোককে বাড়িতে রেখে কেই বা সোয়াস্তিতে থাকতে পারে?
আবছায়া অন্ধকার থেকে দীনেশবাবুর নিশ্চিন্দির গলা শোনা গেল, “তা হলে ওই কথাই রইল। কাল ভারী শুভদিনও আছে, ভোররাতে শুক্ল প্রতিপদ লাগছে কিনা, তুমি বরং ব্রাহ্মমুহূর্তেই বেরিয়ে পোড়ো, বুঝলে?”
“আজ্ঞে জলের মতো পরিষ্কার বুঝেছি কাকাবাবু। আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন, আমি কালকেই সারেন্ডার করছি!”
“দুর্গা! দুর্গা! এখন ভালয় ভালয় তোমারও একটা গতি হোক, আর আমরাও হাঁফ ছেড়ে বাঁচি!”
“যে আজ্ঞে, এ তো ন্যায্য কথাই বলেছেন কাকাবাবু!”
“তা হলে ওই কথাই রইল কিন্তু!”
“সেকথা আর বলতে! সকালেই ফরসা হয়ে যাব ‘খন, আপনি ভাববেন না।”
তা প্রাতঃকালেই রওনা হয়ে পড়ল গোপাল। মনটা ফুরফুরেই লাগছে বটে, এতদিনে তবু যাহোক নিজেকে শনাক্ত করা যাবে। লালু মণ্ডল নামটাও তার অপছন্দ হচ্ছে না, জগু কৈবর্ত হতেও তার আপত্তি নেই। এ যেন ট্রান্সলেশন করার মতো ব্যাপার, গোপাল থেকে লালু মণ্ডলে অনুবাদ হয়ে যেতে একটু হয়তো অসুবিধে হতে পারে তার। লালু নিশ্চয়ই নেশাভাং করে, চুরি-ছিনতাই, খুন-জখম তো তার হাতের পাঁচ অবশ্যই! তা সেসবও তাকে এখন নতুন করে শিখতে হবে! আর জঙ কৈবর্তে অনুবাদ হয়ে গেলে তো আরও সমস্যা, মশা-মাছির মতো মানুষ মারতে হবে! বুক বা হাত কাঁপলে চলবে না। তবে হ্যাঁ, রোজগারপাতি বোধ হয় খারাপ নয়, খুনপ্রতি দুই বা তিন লাখ টাকা তো হবেই, বেশিও হতে পারে। গোপাল এই খুনখারাপির হ্যাপা সামলাতে পারবে কি? হয়তো পারবে। বাংলা থেকে কোনও বাক্য ইংরেজিতে অনুবাদ হয়ে গেলে যেমন সেটা আর বাংলা থাকে না, তেমনি গোপাল থেকে জগু কৈবর্তে অনুবাদ হয়ে গেলে সে-ও আর গোপাল থাকছে না। যাই হোক, গোপালকে এখন টাটা বাই বাই জানানোর সময় হয়েছে। এখন গোপালের ভিতর থেকে আসল মানুষটা হামাগুড়ি দিয়ে বেরিয়ে আসুক।
এইসব গুরুতর কথা ভাবতে ভাবতে ভারী আনমনা হয়ে পড়ায় সে লক্ষ করেনি যে, চিতু তার পিছু পিছু আসছে। বটতলা ছাড়িয়ে ডুমুরিয়ার রাস্তায় পড়তেই চিতু তার নাগাল পেয়ে পাশাপাশি হাঁটা ধরে বলল, “গোপালদাদা যে! চললেন কোথায়?”
গোপাল হাসি-হাসি মুখ করে বলে, “থানায় যাচ্ছি হে, আজ যে আমি সারেন্ডার করব!”
চোখ গোল গোল করে চিতু বলে, “সারেন্ডার করবেন! সে কী! কেন গোপালদাদা, আপনি করেছেনটা কী?”
গোপাল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, “সারেন্ডার না করে উপায় কী বলো! আমি যে আসলে কুখ্যাত অ্যান্টিসোশ্যাল গ্যাংস্টার লালু মণ্ডল তা জানাজানি হয়ে গিয়েছে যে!”
চিতু চোখ কপালে তুলে আর্তনাদ করে বলে, “বলেন কী দাদা! আপনিই লালু মণ্ডল? আমি যে সেই ছেলেবেলা থেকে লালু মণ্ডল হওয়ার স্বপ্ন বুকে নিয়ে বড় হয়েছি! আমার ধ্যানজ্ঞানই যে লালু মণ্ডল! আমার হিরো! আপনিই সেই তিনি?” বলতে-বলতে চিতু হাউহাউ করে কেঁদে উবু হয়ে গোপালের পা জড়িয়ে ধরল।
লালু মণ্ডলের যে এত নামডাক, এরকম সাংঘাতিক ইমেজ সেটা বটে জানা ছিল না গোপালের। সে ফাঁপরে পড়ে বলল, “আহা, করো কী, করো কী ভাই চিতু?”
চিতু হাপুস নয়নে কাঁদতে কাঁদতে বলে, “না ওস্তাদ, আমাকে মানুষ করে না দিয়ে গেলে আপনি কিছুতেই সারেন্ডার করতে পারবেন না! এই আমি আপনার পা জড়িয়ে ধরে পড়ে রইলুম!”
নিজের এহেন খ্যাতি দেখে গোপালের চোখে জল আসার উপক্রম। নিজেকে কষ্টে সামাল দিয়ে তথাগতের মতো উদাত্ত কণ্ঠে সে বলে, “আমাকে আটকে রাখে এমন জেলখানা কি আজও তৈরি হয়েছে রে মূর্খ? আবার আসিব, আবার হাসিব, আবার খেলিব ধরণীপরে! বুঝলে কিছু?”
চোখের জল মুছে একগাল হাসল চিতু, “বুঝেছি ওস্তাদ! আপনার জেল থেকে পালানোর নানা রোমহর্ষক গল্প শুনেই তো বড় হয়েছি কিনা! তা হলে শ্রীচরণে ঠাঁই দিলেন তো ওস্তাদ! চিতুকে বিস্মরণ হবেন না তো!”
“আরে না।”
“তা হলে চলুন আপনাকে থানা পর্যন্ত এগিয়ে দিই, আপনার হাওয়া-বাতাস গায়ে লাগলেও পুণ্যি। ওহ, কত কী শেখার আছে আপনার কাছে!” বলে হঠাৎ দুটো টাকা বের করে গোপালের পায়ের কাছে রেখে একটা প্রণাম ঠুকে ফেলল।
গোপাল অবাক হয়ে বলে, “ওটা কী হল হে, টাকা কিসের?” ভারী লাজুক হেসে চিতু বলে, “আজ্ঞে ওটা গুরুদক্ষিণা। বড্ড কম হয়ে গেল ওস্তাদ, কী করব, পকেটে মোটে দু’টাকাই ছিল কিনা!”
“আরে না, এখনই দক্ষিণা কিসের! ওসব পরে হবে ‘খন। হুট করে কী আর গুরুবরণ হয়, অনেক ফ্যাঁকড়া আছে রে ভাই, দিনক্ষণ দেখা আছে, পুজোপাঠ আছে, যজ্ঞটজ্ঞও আছে বলে শুনেছি। টাকাটা বরং তুলে রাখো ভায়া, তোমার কাছেই জমা থাক।”
“তা না হয় রাখছি, কিন্তু আপনাকে কিছুতেই ছাড়ছি না ওস্তাদ!”
দু’জনে আবার হাঁটা ধরল। পাশে-পাশে বিগলিত মুখে হাঁটতেহাঁটতে চিতু বলে, “ওহ, আজ কার মুখ দেখে যে ঘুম থেকে উঠেছি! এমন ভাগ্য যে আমার কোনওদিন হবে তা স্বপ্নেও ভাবিনি। লোকে ছিঁচকে চোর বলে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে, নাক সিঁটকোয়, হ্যাটা করে, এসব আর সহ্য হচ্ছে না ওস্তাদ! এবার মানুষের মতো মানুষ হতে হবে। তাই কিনা বলুন!”
“তা তো বটেই।”
“আপনাকে যখন একবার পেয়ে গিয়েছি তখন আর চিন্তা কী? এবার লোককে দেখিয়ে দেব চিতু কী জিনিস!”
“হবে, হবে। সব হবে।”
“ওহ, আজ থানায় যা কাণ্ডটা হবে তা ভাবতেই আমার গায়ে কাঁটা দিচ্ছে ওস্তাদ। লালু মণ্ডলকে সশরীরে সামনে দেখে সবাই কেঁপেকেঁপে মূর্ছা না যায়! তার উপর আজ নাকি এলাকার নতুন এস ডি পি ও সাহেব সারপ্রাইজ ভিজিট দিতে আসছেন। রগড় যা জমবে না, ” বলে খুব খিকখিক করে হাসতে থাকে চিতু।
রগড়টা কী জমবে তা বুঝতে পারছিল না গোপাল, তবে সে আর কথাও বাড়াল না।
দুপুরের আগেই দু’জনে বরচড়াইয়ের ফাঁড়িতে পৌঁছে গেল। হঠাৎ চিতু হাঁটায় ব্রেক মেরে বটতলার কাছেই দাঁড়িয়ে পড়ল, বলল, “ওস্তাদ, এর বেশি এগোনো আমার পক্ষে ঠিক হবে না, বুঝলেন না? আজকাল ছোটখাট কেসেও লোকে নালিশ ঠুকে দেয় কিনা! কানাঘুষো শুনেছি এ যাবৎ দুশো সাঁইত্রিশখানা এফ আই আর জমা হয়েছে আমার নামে। দেখতে পেলেই লকআপে পুরে দেবে। তাতে অবিশ্যি ভালই হত, । বসে আপনার কাছে হাতেখড়িটা হয়ে যেত। কিন্তু গুরুতর খবর আছে যে, মনোরঞ্জন বিশ্বাসের গদিতে আজ বিকেলে এক লাখ বিশ হাজার টাকা আদায় জমা পড়বে। এ সুযোগ তো ছেড়ে দেওয়া যায় না, দেখি কপাল ঠুকে আপনার আশীর্বাদে যদি বিড়ালের ভাগ্যে শিকে ছেঁড়ে! তাই এ যাত্রায় আর হাজতবাস হল না। একটু আশীর্বাদ করবেন ওস্তাদ।”
বরাভয়ের ভঙ্গিতে হাতের তেলো দেখিয়ে গোপাল বলে, “খুব বাড়বাড়ন্ত হোক তোমার, দশজনের একজন হয়ে ওঠো!”
গোপনে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে গেল গোপালের, কাল পর্যন্ত সে ভদ্রলোক ছিল বটে, কিন্তু আজ থেকে সে তো এদের দলেরই একজন! গ্যাংস্টার লালু মণ্ডল কিংবা সুপারি কিলার জগু কৈবর্ত! নতুন ইমেজ, নতুন জীবন, নতুন আইডেন্টিটিতে আত্মপ্রকাশ ঘটতে চলেছে তার। মনে তেমন আনন্দ হচ্ছে না বটে, কিন্তু নতুন করে নিজেকে আবিষ্কার করতেই হবে, তারপর সেই নতুন গোপালকে বরণও করে নিতে হবে তাকে। এ যে তার নবজন্ম, তার রেজারেকশন, তার নির্মোক বিমোচন!
থানার ফটক দিয়ে একটু ভয়ে-ভয়ে ঢোকার সময় হঠাৎ দু’দিকের দু’জন সেপাই খটাখট করে বুটের শব্দ তুলে অ্যাটেনশন হয়ে লম্বা স্যালুট মারল তাকে। গোপাল ভারী অবাক হল। হ্যাঁ, সে শুনেছে বটে যে, আজকাল গ্যাংস্টার বা ডনদের বাজার বেশ ভাল, গ্ল্যামার বা ক্যারিশমাও কম নয় এবং টি আর পি-ও বেশ হাই, তবু সেটা যে এতটাই ভাল তা তার জানা ছিল না! গর্বে তার ভিতরটা মকমক করতে লাগল। গ্যাংস্টারকে পুলিশও যখন স্যালুট মারছে তখন আর ভয়টা কিসের? সে বুক চিতিয়ে, মাথা উঁচুতে তুলে, গটগট করে হেঁটে গিয়ে থানার খোলা বারান্দায় উঠে পড়ল। এখানেও দরজার দু’দিকে দু’জন পুলিশ আগে থেকেই কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল, তাকে দেখেই তারাও খটাখট বুটের শব্দ তুলে স্যালুট মেরে বসল, তারপর সসম্মানে দরজার পরদা সরিয়ে তাকে ভিতরে ঢোকার পথ করে দিল। গোপাল ভারী আত্মতৃপ্তির হাসি হাসল। এরকমই তো হওয়ার কথা, আজকাল তো ডন বা গ্যাংস্টারকে হিরো বানিয়ে সিনেমাও হচ্ছে কিনা! এখন ধন্দ হল সে আসলে কে, লালু মণ্ডল না জগু কৈবর্ত? তা, সেই ধন্দের অবসান হতেও দেরি নেই। উত্তেজনায় তার গা বেশ গরম হয়ে গেল।
ভিতরে ঢুকতেই লম্বা-চওড়া চেহারার বড়বাবু তড়াক করে লাফিয়ে উঠে স্যালুট মেরে গদগদ কণ্ঠে বলে ওঠেন, “আসুন স্যার, আসুন স্যার, কী সৌভাগ্য আমাদের!”
একজন সেপাই তাড়াতাড়ি একটা ফরসা তোয়ালে দিয়ে ঢাকা রিভলভিং চেয়ার এগিয়ে দিয়ে “বসুন স্যার, বসুন স্যার, ” বলে খুব খাতির করতে লাগল। অনেকটা হেঁটে আসায় একটু পরিশ্রম হয়েছে বটে, তাই বিনা আপত্তিতে বসে পড়ল গোপাল।
বড়বাবু হাত কচলাতে কচলাতে কিছুক্ষণ হেহ হেহ করে নিয়ে বলেন, “স্যার, আগে কি ডাবের জলটা খেয়ে নেবেন? তারপর লস্যি, কোল্ড ড্রিংক, চা, কফি সব আছে। আর স্যার, তারপর মোহন তেওয়ারির সামোসা, শশী ময়রার কচুরি, নবকান্ত হালুইকরের মাখাসন্দেশ, সরভাজা, ছানাপোড়া আর রসকদম্ব। একটু পিত্তদমন না করলেই নয় স্যার!”
ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারছিল না গোপাল। না, গ্যাংস্টারদের আজকাল যে খাতির হয়েছে তা তার অজানা নয়, কিন্তু তা বলে এতটা আদর-আপ্যায়ন যেন কেমন-কেমন লাগছে! এ যে বড্ড বাড়াবাড়ি! তাই সে সাবধান হয়ে গম্ভীর মুখে শুধু একটা সংক্ষিপ্ত ‘হুঁ’ দিল।
গোপাল ডাবের জলটা শেষ করার পর বড়বাবু তেমনি হাত কচলাতে-কচলাতে বললেন, “হেহ হেহ, স্যার, আপনি যে আজ ইনকগনিটো সারপ্রাইজ ভিজিটে আসবেন তা আমার জানাই ছিল। আমাদের খাতাপত্র সব রেডি আছে স্যার, কোনও ব্যাকলগ নেই। আপনি টিফিনটা করে নিন, তারপর যে ফাইল চাইবেন তাই দেখানো হবে স্যার!”
ভারী হতাশ হয়ে সন্তর্পণে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল গোপাল। এরা যে তাকে নতুন এস ডি পি ও বলে ধরে নিয়েছে তাতে আর কোনও সন্দেহ নেই। এবং সেই সঙ্গে এটাও প্রমাণ হয়ে গেল যে, সে আর ইহজন্মে লালু মণ্ডল বা জগু কৈবর্ততে অনুবাদ হয়ে যেতে পারছে না। হরেদরে সেই গোপাল হয়েই থাকতে হচ্ছে তাকে। কিন্তু এর পর দীনেশ গুণকে মুখ দেখানোই যে মুশকিল হয়ে যাবে তার!
সকাল থেকে কিছু খাওয়া হয়নি বলে পেট কুঁইকুঁই করছিল বটে। তাই গোপাল শিঙাড়া-কচুরি-মিষ্টি কিছুই ফেলল না। তারপর একখানা তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে বেশ কর্তৃত্বের গলায় বলল, “আজ আর ফাইলটাইল দেখার সময় নেই, আরও কয়েকটা থানা ভিজিট করতে হবে কিনা! উঠি।”
বড়বাবু ভারী বিগলিত হয়ে বললেন, “তা তো বটেই স্যার, তা তো বটেই! তা হলে স্যার, আমাদের থানার জিপটা আপনাকে এগিয়ে দিয়ে আসুক?”
গোপাল বোকা নয়, জিপ নিলে যে তার হালহদিশ ফাঁস হয়ে যাবে এটা সে জানে। তাই গম্ভীর গলায় বলল, “আরে না। জিপ নিলে আর সারপ্রাইজ থাকবে না।”
বিস্তর স্যালুট নিতে-নিতে সে বেরিয়ে এল। তারপর হনহন করে হাঁটা ধরতেই বটতলা থেকে দৌড়ে এল চিতু, বড়-বড় চোখ, সেই চোখে অপার বিস্ময় আর অবিশ্বাস। হাঁপাতে হাঁপাতে এসে দড়াম করে পড়ে গোপালের দু’ পা জড়িয়ে ধরে হাঁউমাউ করে বলে উঠল, “স্যার, আমাকে ক্ষমা করে দিন স্যার। আপনিই যে এস ডি পি ও, তা বুঝতে পারিনি স্যার! কী সব উলটোপালটা বলে ফেলেছি স্যার! আমি সত্যিই কিন্তু ছুরি-ছিনতাইয়ের মধ্যে নেই স্যার!”
গোপাল প্রসন্নমুখে বলল, “আচ্ছা ঠিক আছে, ঠিক আছে! ওসব কথা আমিও মনে রাখিনি। তুমি যা করছ করো, শুধু আমার কানে কোনো নালিশ না উঠলেই হল।”
– আজ্ঞে স্যার, আজ থেকেই গুডবয় হয়ে যাচ্ছি স্যার, আপনি
মনটা খারাপই লাগছে গোপালের, সেই তীরে এসে তরী ডুবল। সে তো লালু মণ্ডল বা জগু কৈবর্ত হতে তৈরিই ছিল! কিন্তু ভাগ্যের ফেরে এযাত্রাও ফস্কে গেল। এখন নতুন করে নিজেকে আবার গোরুখোঁজা করে খুঁজতে হবে, এটাই যা মুশকিল। কিন্তু নিজেকে খুঁজে পাওয়া কি চাট্টিখানি কথা? নাম নেই, ধাম নেই, চেনাজানা নেই, খুঁজলেই হল? কেউ বলছে সে হল হরেন ঘোষের জামাই বগলাপতি, কেউ বলছে সে হল অ্যান্টিসোশ্যাল লালু মণ্ডল, না হলে সুপারি কিলার জগু কৈবর্ত বটেই, আবার এখন তাকে এস ডি পি ও সাহেবও হতে হচ্ছে! কিন্তু আসলে সে কে, তা কি কেউ দয়া করে বলে দেবে?
হিরণগড়ে পা দিতেই হইহই পড়ে গেল গোপালকে নিয়ে।
গর্জন পানি রীতিমতো গর্জন ছেড়ে বলল, “ওহে কালী পাণ্ডা, তামাকে বলেছিলুম কিনা যে আমাদের গোপালবাবুকে যা বুঝছ তা নয়, ভিতরে অন্য গল্প আছে, বলেছিলুম কিনা?”
বাসুলি রায় বিষাক্ত চোখে গর্জনের দিকে চেয়ে বলে, “ওহ, এ গাঁয়ে দেখছি সবজান্তার অভাব নেই! গোপাল যে আসলে গোপাল নয় কথা এ গাঁয়ের গোরু-ছাগলও জানে।”
রমাচরণ ভারী মাখো-মাখো গলায় বলে, “আরে ব্রহ্মজ্ঞ হওয়ার পর থেকেই আমার দিব্যদৃষ্টিতে সবই তো পরিষ্কার ধরা পড়ে যাচ্ছে হে! কিছুই আর লুকিয়ে থাকতে পারছে না। তা গোপাল যে আসলে এস ডিপি ও মাধব সরকার, সে তো আমি সেই কবে থেকেই জানি। কিন্তু উনি ছদ্মবেশে গা-ঢাকা দিয়ে আছেন বলে ব্যাপারটা আমি আর ফাঁস করিনি। তাই না পরানবাবু?”
পরান ঘড়াই সবে হাওলাতের টাকাটা পেয়েছে, সে বিগলিত মুখে বলে, “আজ্ঞে, সে আর বলতে! এই তো গত বেস্পতিবার সন্ধের সময় আপনি ধ্যান থেকে জেগে হঠাৎ বলে উঠলেন, ‘আরে তাই তো! মুখটা যে চেনা-চেনা লাগছে! এ তো গোপাল নয় রে বাপু! এ যে এস ডি পি ও মাধব সরকার!’ তা আমি চমকে উঠে বললুম, ‘রমাবাবু, কার কথা অইছেন, কে মাধব সরকার?’ তা আপনি ঠোঁটে আঙুল দিয়ে বললেন, চুপ-চুপ! এসব গুহ্যকথা মনে-মনেই কইতে হয় মশাই, সর্বনাশ হয়ে
গুনেনবাবু তাঁর বাজখাঁই গলা সবার উপরে তুলে বললেন, “ওহে বাপু, তোমাদের আক্কেলেরও বলিহারি যাই! দেখছ এলাকার দণ্ডমুণ্ডের কর্তা তোমাদের সামনে এসে হাজির হয়েছেন, কোথায় তাকে আদরআপ্যায়ন করবে, খাতির-যত্ন করবে, না নিজেদের বাহাদুরি দেখাতে সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়লে! ওহে, এ গাঁয়ের একটা ঐতিহ্যও তো আছে, নাকি? হিরণগড় বরাবর মানীকে মান দিয়ে এসেছে, গুণীকে সম্মান জানিয়েছে, রাজাগজাকে ভজনা করে এসেছে। তা সেসবের পাট কি তুলে দিয়েছ নাকি হে? যাও, দৌড়ে গিয়ে মালাটালা নিয়ে এসো, পাখা দিয়ে বাতাস করো, মেয়েরা উলু আর শঙ্খধ্বনি করুক, ঢোল-শহরত করে পাঁচজনকে জানাও যে, আজ আমাদের কত বড় আনন্দের দিন, কত সৌভাগ্যে আজ হিরণগড়ের প্রাচীন অন্ধকার কেটে মুক্তিসূর্যের উদয় হয়েছে! এ যে কত বড় ঐতিহাসিক ঘটনা তা কি তোমরা এখনও বুঝতে পারছ না?”
“হ্যাঁ-হ্যাঁ, তাই তো, তাই তো, ” বলে সবাই ছোটাছুটি শুরু করে দিল। মাঝরাতে দীনেশ গুণ উদয় হতেই গোপাল ভারী বিরক্ত হয়ে বলে উঠল, “আচ্ছা মশাই, ভূতপ্রেতদের জেনারেল নলেজ এত কম হয় কেন বলুন তো! আপনার দেওয়া সবক’টা খবরই তো দেখছি ভুল!”
দীনেশ তামাক খাওয়া থামিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বলে, “তা তুমি যে এত সেয়ানা লোক তা কে জানত বাপু? ঝানু পুলিশ অফিসাররা অবধি তোমাকে লালু মণ্ডল বলে চিনতে পারল না, এ তো তাজ্জব ব্যাপার হে!”
গোপাল ফুঁসে উঠে বলে, “কারণ আমি মোটেই লালু মণ্ডল নই!” “আহা, লালু মণ্ডল নও তো কী হয়েছে! হাতের কাছে জগু কৈবর্তও
তো রয়েছে! জগু কৈবর্ত বলেও তো শনাক্ত করতে পারত! নাকি?”
গোপাল রেগে গিয়ে গলা বেশ উপরে তুলে বলে, “লালু মণ্ডল নই বলে কি আমাকে জগু কৈবর্তই হতে হবে নাকি মশাই? এ তো দেখছি মামাবাড়ির আবদার!”
দীনেশ গুণ বেশ ঠান্ডা গলাতেই বলে, “আহা, লালু বা জগু না হলেই বা কী, তাই বলেই তো তুমি আর ভাল লোক নও! গদাধরবাবু তো বৃত্তান্ত শুনে মাথায় হাত দিয়ে বসেই পড়লেন। বললেন, মশাই, জীবনে বহু ক্রিমিনাল ঘেঁটে এয়েছি, কিন্তু আপনার ওই গোপালের মতো এরকম ধুরন্ধর ক্রিমিনাল কখনও দেখিনি! লালু মণ্ডল বলে কেউ চিনতে পারল না, জগু কৈবর্ত বলেও ধরা খেল না, তার উপর এস ডি পি ও মাধব সরকার বনে বুক ফুলিয়ে সরকার বাহাদুরের টাকায় শিঙাড়া-কচুরি-মিঠাইমণ্ডা খেয়ে ঢেঁকুর তুলে পুলিশের কুর্নিশ আদায় করে বেরিয়ে এল! না দীনেশবাবু, এহেন ক্রিমিনালের সঙ্গে পাঙ্গা না নিতে যাওয়াই ভাল। এ তো দিনকে রাত করতে পারে মশাই!”
গোপাল ভারী অসন্তুষ্ট হয়ে বলে, “ক্রিমিনালকে ভয় পায় এ আবার কেমন পুলিশ মশাই? এরকম পুলিশকে তো চাকরি থেকে বরখাস্ত করা উচিত!”
“ওহ, তুমি নকল এস ডি পি ও হয়ে তো ধরাকে সরা দেখতে লেগেছ হে! গদাধর ভঞ্জকে বরখাস্ত করবে এমন উপরওয়ালা এখনও জন্মায়নি, বুঝলে?”
ফুঁসে উঠে গোপালও সপাটে বলে, “আমিই যে আসল এস ডি পি ও মাধব সরকার নই, তা কী করে বুঝলেন? আমাকে অন্তত একডজন পুলিশ অফিসার মাধব সরকার বলে স্যালুট ঠুকেছে, সে কি এমনিএমনি মশাই? আমার তো এখন ঘোরতর সন্দেহ হচ্ছে যে, আমিই মাধব সরকার! কালই অফিসে গিয়ে সুপিরিয়র অফিসার সম্পর্কে আনলফুল কথা বলার জন্য গদাধর ভঞ্জকে সাসপেনশন লেটার পাঠাব।”
দীনেশ গুণ একটু মিইয়ে গিয়ে বলে, “আহা, চটছ কেন? কথাটা যে আমারও মনে হয়নি তা নয়। গদাধরবাবু না হয় একটা ভুল করেই ফেলেছেন, তা বলে তাঁর চাকরি খাওয়াটা কি ঠিক হবে হে? ঠিক আছে, আমি না হয় তাঁকে ডাকছি, তিনি তোমার কাছে বরং মাপ চেয়ে নিন।”
বলতে না-বলতেই একটু মোটা গলায় কে যেন ভারী বিনয়ের সঙ্গে বলে উঠল, “হেঁহ হেঁহ স্যার, বড্ড ভুল হয়ে গিয়েছিল স্যার, আপনি এলাকায় নতুন এসেছেন বলে ঠিক বুঝতে পারিনি স্যার! আমার নমস্কার নিন স্যার, আমিই গদাধর ভঞ্জ। আর এরকম ভুল হবে না স্যার। সাসপেন্ড হয়ে গেলে বউ-বাচ্চা নিয়ে যে পথে বসতে হবে স্যার!”
গোপাল একটা বড় করে শ্বাস ফেলে বলে, “আরে, ভয় পাচ্ছেন কেন? ভয় পাওয়া কি আপনাকে মানায় মশাই? আপনার তো চাকরিই নেই, তার আবার সাসপেনশন কিসের?”
গদাধর কাঁদো-কাঁদো হয়ে বলে, “চাকরি নেই স্যার?”
“আরে, চাকরি কী করে থাকবে? চাকরি রাখতে গেলে কতগুলো এসেনসিয়াল রিকোয়্যারমেন্টস আছে যে! আপনার কি সেসব আছে?”
“কী চাই স্যার বলুন! দু’দিনের মধ্যে জোগাড় করে ফেলব!” “ব্যাপারটা অত সোজা নয় গদাধরবাবু! চাকরি রাখতে গেলে মিনিমাম একটা এগজ়িসট্যান্সেরও দরকার হয় যে!”
“তা স্যার, আমার কিসের কমতি আছে বলুন! আমি তো একজন হাট্টাগাট্টা লোক!”
গোপাল সমবেদনার সঙ্গে মাথা নাড়া দিয়ে বলে, “আর কিছু না হোক খুব কম করে ধরলেও একটা বডি তো অন্তত লাগে মশাই! নাকি? তা আপনার তো সেই ভাইটাল জিনিসটাই নেই! হাওয়াকে তো আর চাকরি দেওয়া যায় না, কী বলেন! কিন্তু আপনার শরীর কই?”
এইবার গদাধর ভুল বুঝতে পেরে ভারী অনুতপ্ত হয়ে বলে, “ওহ, তাই তো স্যার, তাই তো! বড্ড ভুল হয়ে গিয়েছে স্যার! আজ্ঞে, ওই সাসপেনশনের কথা শুনে এমন ঘাবড়ে গিয়েছিলাম যে, মারা যাওয়ার কথাটা মাথা থেকে একদম বেরিয়ে গিয়েছিল! সবে দু’বছর হল মরেছি তো, তাই মরাটা ঠিক হজম হয়নি এখনও! বডিটাই যে চলে গিয়েছে সেটা সব সময় খেয়াল থাকে না! তবে এখন থেকে সিরিয়াসলি মরার ব্যাপারটা প্র্যাকটিস করতে হবে স্যার। আর এরকম ভুল হবে না, কথা দিচ্ছি স্যার। গরিবকে একটু মনে রাখবেন।”
“আর-একটা কথা বলে রাখছি, আমি কস্মিনকালেও আপনার উপরওয়ালা ছিলাম না, আজও নই, বুঝলেন?”
লোকটা ভারী গদগদ হয়ে বলে, “কী যে বলেন স্যার! উপরওয়ালা নন মানে? বাপ রে! আপনি যে মস্ত মাপের অফিসার তা কি আর জানি না স্যার! শুধু এই অধমকে একটু মনে রাখবেন স্যার, তা হলেই হবে।”
দীনেশ গুণ এতক্ষণ খুব মন দিয়ে তামাক খেয়ে যাচ্ছিল, এবার গলাখাঁকারি দিয়ে বলল, “তা হলে তুমিই এস ডি পি ও মাধব সরকার তো? পরে আবার কথার গড়বড় কোরো না যেন!”
গোপাল অবাক হয়ে বলে, “আমি কি আপনাকে বলেছি যে আমিই নিকষ্যি মাধব সরকার? আমি শুধু যুক্তি দিয়ে দেখিয়েছি, আমি মাধব সরকার হলেও হতে পারি। অন্তত মাধব সরকার হতে আমার তেমন আপত্তি নেই!”
“আরে ওই হল, আসলে তুমি ঠারেঠোরে জানাতে চাইছ যে তুমি একজন কেষ্টবিষ্টু।”
“কেন কাকাবাবু, আমার তো লালু মণ্ডল বা জগু কৈবর্ত হতেও আপত্তি ছিল না। আমার তো অত বাছাবাছি নেই!”
“আহা, তারাও কি কম কেষ্টবিষ্টু নাকি হে বাপু? তাদের মাথার দাম তো শুনি দশ লাখে উঠেছে! মাধব সরকার বা লালু অথবা জগু যাই হও না কেন, লোকে তোমাকে কেষ্টবিষ্টুর খাতেই ধরবে। একজন কেষ্টবিষ্ট হওয়া ছাড়া তোমার তো উপায় দেখছি না হে!”