৫
সাধুবাবাকে দেখে বেশ ভয় আর ভক্তি হল রমাচরণের। পেল্লায় চেহারা, আড়েদিঘে যেমন উঁচু তেমনি চওড়াই। সাদা ধপধপে পেল্লায় দাড়ি নাইকুন্ডুলি পর্যন্ত নেমে এসেছে। বিশাল সাদা জটা মাথার উপর চুড়ো করে বাঁধা। গলায় রুদ্রাক্ষের মালা। পরনে গেরুয়া কৌপীন আর একটা রাঙা উড়ুনি। ডান হাতে মস্ত ত্রিশূল আর বাঁ হাতে কমণ্ডলু। চোখে রোষকষায়িত চাউনি, যেন গিলতে আসছে! রমাচরণ একেবারে লম্বা একটা সাষ্টাঙ্গ পেন্নাম করে ফেলল। কাঁপা গলায় বলল, “পেন্নাম হই বাবাজি।”
বাবাজি হুংকার ছাড়লেন, “শুভমস্তু!”
হুংকারটা এমনই ভয়ানক যে, আশীর্বাদ না অভিশাপ তা বোঝা গেল না। তবে সাধু যে বেশ তেজি তা বেশ বোঝা গেল। রমাচরণ মিনমিন করে বলে, “বড় দুঃখ-কষ্টে আছি বাবাজি!”
আবার হুংকার, “কিসের দুঃখ-কষ্ট তোর?”
রমাচরণ একটু আঁতকে উঠে বলল, “আজ্ঞে বাবাজি, আমার তো সব কিছুতেই দুঃখ! খেতে পারি না, রাতে ঘুম হয় না, মনটা সর্বদাই হু হু করে। কোথাও গিয়ে শান্তি পাচ্ছি না যে বাবাজি!”
সাধু এবার সিংহের মতো গাঁক করে উঠে বললেন, “তোর তো ব্রহ্মজ্ঞানের সময় হয়ে গিয়েছে রে ব্যাটা! এবার ব্রহ্মজ্ঞানটা নিয়ে নে।”
রমাচরণ হিসেবি মানুষ। একটু ভেবে বলে, “তা সেটা নিলে ব্যবসাপত্রের কি কোনও সুবিধে হবে বাবাজি?”
সাধুবাবা যে অট্টহাসিটা হাসলেন তাতে যেন চারদিকে একটা ঝড় বয়ে গেল, বজ্রগম্ভীর গলায় বললেন, “বলিস কী রে ব্যাটা? ব্রহ্মযোগ হয়ে গেলে কি আর তোর ব্যবসার চিন্তা? ফুলেফেঁপে ব্যবসায় এমন উন্নতি হবে যে, চারদিকে ধন্যিধন্যি পড়ে যাবে! তখন তোর চারদিকে টাকার বৃষ্টি হবে! টাকার সমুদ্রে ভেসে যাবি। খিদে হবে, ঘুম হবে, কোষ্ঠ পরিষ্কার হবে, সর্বদা আনন্দ আর ফুর্তির ফোয়ারার মধ্যে বসে থাকবি।”
লোভ হচ্ছে বটে, তবে রমাচরণ আগুপিছু না ভেবে ফস করে কিছু কবুল করে না। তাই সে একটু সতর্ক গলায় বলে, “তা বাবাজি, ব্রহ্মজ্ঞানবাবদ দক্ষিণাটা কত দিতে হবে যেন!”
পিলে চমকানো আর-একটা অট্টহাসি হেসে সাধুবাবা বলেন, “ওরে নরাধম, ব্রহ্মজ্ঞান কি ছেলের হাতের মোয়া? ও যে বিরাট ব্যাপার রে! বেশি নয়, এই লাখখানেক টাকা ফেলে দিস, তাতেই কষ্টেসৃষ্টে হয়ে যাবে।”
শুনে রমাচরণের মূর্ছা যাওয়ার জোগাড়। সে ককিয়ে উঠে কাতর গলায় বলে, “তা হলে ব্রহ্মজ্ঞানটা এখন মুলতুবি থাক বাবাজি! আমি গরিব মানুষ, এত পেরে উঠব না।”
এবার যে হুংকার ছাড়লেন সাধুবাবা সেটাকেই বোধ হয় ব্রহ্মনাদ বলে, “পাপিষ্ঠ! ত্রিকালজ্ঞ ঋষির সামনে মিছে কথা বলিস! নরক থেকেও তোকে লাথি মেরে তাড়াবে যে! তোর যে কোটি-কোটি টাকা আছে তা কি একজন ত্রিকালজ্ঞ সাধকের অজানা?”
হুংকার শুনে দু’হাতে দু’কান চেপে ধরে বসে পড়তে হয়েছিল রমাচরণকে। একটু সামলে নিয়ে বলে, “আর বলবেন না বাবাজি, বড্ড লোকসান যাচ্ছে, আদায়উশুল হচ্ছে না তেমন, তার উপর বউয়ের চিকিৎসায় এককাঁড়ি টাকা বেরিয়ে গেল কিনা। কুড়িয়েবাড়িয়ে হাজারখানেক টাকা হয়ে যাবে। তাতে হবে না বাবাজি?”
সাধুবাবা নাক কুঁচকে বললেন, “হাজার টাকা! না কি ভুল শুনলাম! হাজার টাকা বললি নাকি রে?”
কাঁদো কাঁদো হয়ে রমাচরণ বলে, “আজ্ঞে হাজার টাকাই বটে বাবাজি!”
“সস্তা খুঁজিস বলেই তোদের পস্তাতে হয়, বুঝলি? হাজার টাকায় ব্রহ্মজ্ঞান শুনলে যে ত্রিভুবনে ছিছিক্কার পড়ে যাবে! ওরে পাষণ্ড, এ কি হাটেবাজারে বিকোবার জিনিস যে দরাদরি করছিস?”
ব্যবসাটা ভালই বোঝে রমাচরণ। দরাদরি চলবে না মানে! এই মাগ্গি গন্ডার বাজারেও সে তার বাড়ির লক্ষ্মী বা গণেশপুজোয় দু’ টাকা করে দক্ষিণা দেয়। হাত কচলে সে গদগদ কণ্ঠে বলে, “ব্রহ্মজ্ঞান পেলে যদি টাকাপয়সার বান ডেকে যায় তা হলে লাখটাকা তো হাতের ময়লা বাবাজি! একটু সুবিধে হলেই দিয়ে দেব’খন আপনার লাখ টাকা।”
সাধুবাবা গম্ভীর বদনে বলেন, “এসব কাজকারবার কি আর ধারবাকিতে হয় রে পাগল! এ কি মুদিখানার দোকান পেয়েছিস? তবে কথা যখন দিয়েই ফেলেছি তখন তোকে বরং শিশুব্রহ্মজ্ঞানটা দিয়ে যাই। তাতেও হাজার টাকায় লোকসান হবে বটে, তবে কথার খেলাপও তো করতে পারি না।”
“আজ্ঞে শিশুব্রহ্মজ্ঞানটা কি বাবাজি?”
“সেটা একটু ছোট মাপের ব্রহ্মজ্ঞান।”
“তাতে কি কাজ হবে বাবা?”
“ওরে, ওর ঠেলাই অনেকে সামলাতে পারে না! কাজ হবে না মানে?”
“তা হলে বরং সেটাই দিয়ে দেন বাবা, ” এই বলে ট্যাঁক থেকে হাজার টাকা বের করে দিল রমাচরণ। সাধু টাকাটা দু’বার করে গুনে কোমরে গুঁজে রমাচরণের কপালে ডান হাতের বুড়ো আঙুলটা একটু চেপে ধরে রইলেন। রমাচরণ তেমন কিছু টের পেল না, তবে কপালের এই জায়গাটা একটু গরম হল মাত্র।
সাধুবাবা হাতটা সরিয়ে নিয়ে ফের হুংকার দিয়ে বললেন, “যা ব্যাটা, তোর ওয়ান পার্সেন্ট ব্রহ্মজ্ঞান হয়ে গেল। আর চিন্তা নেই, ” বলেই সাধুবাবা একটা বিকট অট্টহাসি হেসে বাতাসে ভুস করে মিলিয়ে গেলেন।
ওই হাসির শব্দেই ঘুম ভেঙে উঠে বসল রমাচরণ। সবে ভোর হয়েছে। ভোরের স্বপ্ন নাকি সত্যি হয়! তা হলে কি ব্রহ্মজ্ঞানটা ফাঁকতালেই হয়ে গেল? ওহ, হাজারটা টাকা জোর বাঁচা বেঁচে গিয়েছে! স্বপ্নে দেওয়া হাজার টাকা তো আর আসল টাকা নয়!
কে যেন খুব কাছ থেকেই বলে উঠল, “তা হলে ব্রহ্মজ্ঞানটাও আসল নয়।”
আশপাশে কাউকে দেখতে না পেয়ে অবাক হয়ে রমাচরণ বলে, “কে? কে রে বেয়াদব?”
“আমি আপনার ব্রহ্মজ্ঞান।”
রমাচরণ আরও একটু অবাক হয়ে বলে, “ব্রহ্মজ্ঞান! বলিস কী রে, ব্রহ্মজ্ঞান কি মুখে-মুখে কথা বলে নাকি? এত সাহস?”
“উচিত কথা বলব মশাই, তাতে ভয়টা কিসের! ভালয় ভালয় সাধুবাবার টাকাটা এইবেলা দিয়ে ফেলুন, নইলে ব্রহ্মজ্ঞান কিন্তু হাপিশ হয়ে যাবে, এই বলে রাখলুম।”
“আহা, আমি কি কখনও কারও টাকা গাপ করেছি রে ব্রহ্মজ্ঞান? তা হলে এসব কথা উঠছে কেন? বাবাজি তো দু’বার করে গুনে কড়কড়ে হাজার টাকা ট্যাঁকে গুঁজলেন!”
“ওটা ভার্চুয়াল টাকা। সাধুবাবা বলে গিয়েছেন, এবার আসল হাজার টাকা দিতে হবে।”
“আহা তা না হয় দিচ্ছি, কিন্তু বাবাজিকে এখন পাব কোথায়? তিনি তো আমার চোখের সামনেই হুস করে গায়েব হয়ে গেলেন!”
“ও টাকা মানি বষ্টুমিকে দিতে হবে। সাধুবাবার হুকুম।”
রমাচরণ বিস্ময়ে হাঁ হয়ে বলে, “মানি বষ্টুমি! তার কি টাকার অভাব? তার দিব্যি পাকা বাড়ি, তিন বিঘে জমি, একাবোকা মানুষ, তার আর টাকার কী দরকার?”
“আপনি তো খুব ঢেঁটিয়া লোক দেখছি মশাই! আপনার সঙ্গে আমার পোষাবে কিনা তা ঠিক বুঝতে পারছি না! আপনিই তো মানি বষ্টুমির অভাব-কষ্টের দিনে তাকে মাত্র পাঁচ হাজার টাকা ঠেকিয়ে জমিবাড়ি সব নিজের নামে লিখিয়ে নিয়েছেন! জমির ফসলের সবটাই তো আপনিই গাপ করেন! সেই পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে না?”
রমাচরণ চমকে উঠে বলে, “তুই এত কথা জানলি কী করে রে ব্রহ্মজ্ঞান?”
“না জানলে আর ব্রহ্মজ্ঞান হলুম কী করে?” “তাও বটে!”
“এবার গা তুলুন। প্রাতঃকৃত্য সেরে নিন। ইষ্টনাম নিয়ে বেরিয়ে পড়ুন। গতকাল থেকে মানি বষ্টুমি উপোস রয়েছে।”
খাট থেকে নামতে-নামতে রমাচরণ বলে, “অত হুড়ো দিসনি তো বাপু! ব্ৰহ্মজ্ঞান নিয়ে তো দেখছি মহা ঝঞ্ঝাটেই পড়া গেল! লোকসানের পাল্লায় পড়ে গেলুম! প্রাতঃকালেই হাজার টাকা ঝাঁক!”
রমাচরণের বউ হরিমতী ওপাশ ফিরে শুয়ে অঘোরে ঘুমোচ্ছিল। কথাবার্তার শব্দেই বোধ হয় ঘুম ভেঙে বলে উঠল, “এই সাতসকালে ফাঁকা ঘরে কার সঙ্গে এত কথা হচ্ছে শুনি! কাউকে তো দেখা যাচ্ছে
রমাচরণ বলে, “আহা, তোমাকে এদিকে কান দিতে হবে না। তুমি ঘুমোও।”
হরিমতী চড়া গলায় বলে, “ঘুমোব মানে? তোমার হয়েছেটা কী? একা-একা কথা বলা তো মাথা খারাপের লক্ষণ!”
“একা-একা নয় গিন্নি, একা-একা নয়, আমি আমার ব্রহ্মজ্ঞানের সঙ্গে কথা কইছিলাম।”
হরিমতী আঁতকে উঠে চিলের মতো চেঁচিয়ে বলে, “ওম্মা গো! কী সর্বনাশ! এই মানুষটার তো মাথাটাই বিগড়ে গিয়েছে দেখছি! এ যে ব্রহ্মজ্ঞানের সঙ্গে কথা কইছে! ওরে, তোরা কে কোথায় আছিস, শিগগির আয়, লোকটাকে দড়িদড়া দিয়ে বাঁধ, নইলে কাকে কামড়ে দেবে, কাকে আঁচড়ে দেবে তার ঠিক কী?”
রমাচরণ মহা ফাঁপরে পড়ে গিয়ে কী একটা বলতে যাচ্ছিল, পাশ থেকে ব্রহ্মজ্ঞান তাড়া দিয়ে বলল, “আর কথা নয়, শিগগির বেরিয়ে পড়ুন! লোকজন এসে পড়লে বিপদে পড়বেন যে! প্রাতঃকৃত্য এখন মুলতুবি থাক, শুধু মানিব্যাগটা নিয়ে দৌড়োন।”
রমাচরণ তাই করল। কোনও রকমে দরজার খিল খুলে একছুটে রাস্তায় পড়েই পাঁইপাঁই করে ছুটতে লাগল। পাশ থেকে ব্রহ্মজ্ঞান বিরক্ত গলায় বলে, “অমন থপথপ করে ছুটলে কী করে হবে?”
রমাচরণ অবাক হয়ে বলে, “থপথপ? বলিস কী রে ব্রহ্মজ্ঞান, আমি তো হরিণের মতো ছুটছি!”
“সে তা হলে বেতো হরিণ।”
“আমি হাঁপাচ্ছি দেখছিস না! সারা গায়ে ঘাম!”
“মাছ-মাংস আর ঘি-মাখন খেয়ে খেয়ে শরীরটার যা হাল করেছেন তা আর কহতব্য নয় মশাই! ওই থলথলে শরীরে কি ব্রহ্মজ্ঞান টিকতে পারে? কী আর করা! নেহাত সাধুবাবা জবরদস্তি ঢুকিয়ে দিলেন বলে!” “এহ, তোর তো বড্ড ফুটুনি দেখছি রে ব্রহ্মজ্ঞান! একজন ব্রহ্মজ্ঞানীর সঙ্গে কী করে কথা কইতে হয় তাও শিখিসনি দেখছি!”
“ঠিক আছে মশাই, ওসব কথা পরে হবে ‘খন, এই যে মানি বষ্টুমির বাড়ি এসে গিয়েছে!”
মানি বষ্টুমি উঠোনে কাঠকুটো জ্বেলে শাকপাতা সেদ্ধ করছিল। সাতসকালে হঠাৎ কড়কড়ে হাজার টাকা পেয়ে ফোকলা মুখে আর হাসি ধরে না, “ও বাবা রমাচরণ, বুড়িটাকে দিলি নাকি টাকাটা? সত্যিই দিলি, নাকি পরে ফেরত চাইবি বাপ?”
রমাচরণ হাঁপাতে হাঁপাতে বলে, “না গো মানিমাসি, ও তোমাকে এমনিই দিলুম। ফেরত দিতে হবে না।”
“ওম্মা গো! এতগুলো টাকা এমনিই দিলি? তোর হাজার বছর পরমায়ু হোক, দুধে-ভাতে থাক, রাজা হ’ বাবা। এই একাবোকা পড়ে থাকি বাবা, কেউ তত্ত্বতালাশও করে না। তবু তুই এই বুড়িটাকে মনে রেখেছিস! বেঁচে থাক বাপ, ধনেপুত্রে লক্ষ্মীলাভ কর।”
মানি বষ্টুমির কথাগুলো কিন্তু মন্দ লাগল না রমাচরণের। বহুকাল তাকে কেউ এত ভাল ভাল কথা কয়নি। সে ভালই জানে, মুখের সামনে না হোক, আড়ালে-আবডালে লোকে তাকে শাপশাপান্ত করে, গালাগাল দেয়, আর মরণকামনাও করে। আজ তাই একটু অন্য রকম শুনে, প্রাতঃকালে হাজার টাকা লোকসান সত্ত্বেও মনটা বেশ ফুরফুরে লাগছে যেন! ব্রহ্মজ্ঞানটা খুব খারাপ ব্যাপার নয় তো! জিনিসটার বেশ জোশ আছে কিন্তু!
বাসি জামাকাপড়েই বটতলায় বসে রোজকার মতোই গায়ে হাওয়া লাগাচ্ছিল রমাচরণ। বাড়ি যাবে বলেই রওনা হয়েছিল সে, কিন্তু ব্ৰহ্মজ্ঞান চাপা গলায় বলল, “হাওয়া বুঝে চলতে শিখুন মশাই। অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না করে যে কাজ করে তাকে বলে অবিমৃশ্যকারী। আপনার বাড়িতে লোকজন সব দড়িদড়া নিয়ে তৈরি হয়ে আছে, গেলেই ঘপ করে ধরে বাঁধাছাঁদা করে চোরকুঠুরিতে ফেলে রাখবে। বুঝেছেন?”
রমাচরণ কাঁদো-কাঁদো হয়ে বলে, “কিন্তু আমার যে এখনও প্রাতঃকৃত্য হয়নি রে ব্রহ্মজ্ঞান!”
“ওসব চেপে বসে থাকুন। প্রাতঃকৃত্যের চেয়ে ঢের বড় বিপদ আপনার জন্য বাড়িতে বসে আছে! একজন ব্রহ্মজ্ঞানী হয়ে অবিবেচকের মতো কাজ করলে কেউ কি আপনাকে আর ব্রহ্মজ্ঞানী বলবে?”
“তাও তো বটে!”
খুব সন্তর্পণে হাত কচলাতে কচলাতে, মুখে বিগলিত হাসি নিয়ে পরান ঘড়াই এসে একটু দূরত্ব বজায় রেখে বসল।
“ইয়ে, তা আজও কি মনটা বিষণ্ণ নাকি রমাবাবু?”
রমাচরণ স্বপ্নোত্থিত গলায় বলে, “কে? কেউ কিছু বললেন?” “আজ্ঞে আমি পরান। বলছিলাম কী, আজও কি মনটা খারাপ যাচ্ছে?”
“ও আপনি!”
“যে আজ্ঞে।”
“আচ্ছা পরানবাবু, আপনি জীবনে কী চান বলুন তো!”
পরান বিগলিত হয়ে বলে, “আজ্ঞে তেমন কিছু নয়, ওই টাকাটা পেলেই হয়ে যায়। তবে সুদটা যদি একটু…”
রমাচরণ মাথা নাড়া দিয়ে বলে, “আরে ওসব ছোটখাট ব্যাপার নয় মশাই, আমি জানতে চাইছিলাম আপনি জীবনে কী চান? ধনদৌলত, সুখশান্তি, দীর্ঘ আয়ু, নাকি ব্রহ্মজ্ঞান?”
পরান চট করে সামলে নিয়ে গদগদ হয়ে বলে, “আজ্ঞে ওসব কি আর আমাদের জন্য? ওসব বড়মানুষদের জন্য। আপনাকে যা মানায় তা কি আর আমাকে মানাবে, বলুন দেখি!”
রমাচরণ তলচক্ষুতে পরানের দিকে চেয়ে বলে, “তা হলে কি আপনি কিছু টের পেয়েছেন? আমি কিন্তু এখনও ব্রহ্মজ্ঞান লাভের কথাটা কারও কাছে ফাঁস করিনি।”
পরান চালাক লোক। দুইয়ে দুইয়ে চার করতে তার বেশি সময় লাগল না। ব্যাপারটা ভাল করে আঁচ করতে কিছুক্ষণ বিগলিত হাসিটা হেসে নিল। তারপর আরও একটু গদগদ হয়ে বলল, “টের আবার পাইনি! ফুল ফুটলে কি আর গন্ধ চেপে রাখা যায়? আজ আসতেআসতে দূর থেকেই যেন মনে হল, বট গাছের তলাটা অন্যসব দিনের মতো তেমন ঝুপসি আর অন্ধকার দেখাচ্ছে না তো! যেন বিয়েবাড়ির মতো আলোটালো জ্বলছে! বটতলায় বিয়েবাড়ি ভেবে একটু ঘাবড়ে গিয়েছিলাম ঠিকই, তারপর কাছে এসে বুঝলাম, এ বিয়েবাড়ির আলো নয়। এ হল অঙ্গজ্যোতি! কিন্তু কার অঙ্গজ্যোতি তা বুঝতে পারছিলাম না, তারপর আপনার দিকে চেয়ে দেখি, আপনার মুখ ব্রহ্মজ্যোতিতে ঝলমল করছে!”
রমাচরণ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, “আমি নিতে চাইনি বুঝলেন, সাধুবাবাজি জোর করেই দিয়ে দিলেন। এখন লোককে মুখ দেখানোই তো মুশকিল, সবাই টের পেয়ে যাবে যে, আমি ব্রহ্মজ্ঞানী।”
পরান প্রায় আর্তনাদ করে ওঠে, “না-না ও কী বলছেন? এ তো আমাদের গৌরবের ব্যাপার যে, আমাদের মধ্যে একজন ব্রহ্মজ্ঞানী আছেন! একথাটা তো ঢোল-শহরত করে লোককে জানানো উচিত!”
ভারী লাজুক মুখ করে রমাচরণ বলে, “না-না, আমি অত প্রচার চাই না। ব্রহ্মজ্ঞানী হয়েছি তো কী হয়েছে? আমি সেই রমাচরণই আছি।”
“আহা, ও তো আপনি বলবেনই, এ তো আপনার বিনয়! তবে আপনি যাই বলুন, সবাই মিলে একটা সেলিব্রেশন না করলেই নয়। এত বড় একটা ঘটনা চেপে যাওয়া ঠিক হবে না!”
“হ্যাঁ, আপনি সেদিন টাকার কথা কী যেন বলছিলেন?”
হাত কচলে পরান ভারী লজ্জার ভঙ্গি করে বলে, , “ব্রহ্মজ্ঞানীর কাছে
টাকাপয়সার কথা বলতে নেই জানি, তবু লজ্জার মাথা খেয়ে বলতে হচ্ছে, ওই পাঁচের মতো পেলেই আমার কাজ উদ্ধার হয়ে যায়।” “হ্যাঁ, ঠিক আছে, তবে সুদটা…”
পাশ থেকে ব্রহ্মজ্ঞান বলে উঠল, “হুঁশিয়ার! সুদখোরের সঙ্গে কিন্তু ব্রহ্মজ্ঞানের সম্পর্ক আদায়-কাঁচকলায়। দুটো একসঙ্গে যায় না। হিসেব করে কথা কইবেন!”
রমাচরণ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, “আর হ্যাঁ, সুদের কথাও বোধ হয় একটা হয়েছিল, তাই না? তবে ওটা আর আপনাকে দিতে হবে না।”
দুই হাতে অদৃশ্য সাবান মাখতে মাখতে পরান বলে, “না মশাই, আপনার যে সত্যিই ব্রহ্মজ্ঞান হয়েছে তাতে আর আমার কোনও সন্দেহই নেই। না, কথাটা পাঁচজনকে না জানালেই নয়।”
রমাচরণ মৃদু প্রতিবাদ করে বলে, “আহা আবার ওসব কেন? থাক না পরানবাবু!”
“বলেন কী মশাই, এত বড় খবর চেপে রাখলে যে আইঢাই হবে, অনিদ্রা হবে, আমাশা হয়ে যাওয়াও বিচিত্র নয়! এ যে বোমা মশাই, এ জিনিস উগরে না দিলে যে ভিতরেই ফেটে যাবে!”
খবরটা হিরণগড়ে রটে যেতে দেরি হল না। লোকে ছুটে এসে রমাচরণের বাড়িতে ভিড় করে ফেলল। কেউ বলছে, “ওরে, আজ কাকভোরে ছোট-বাইরে করতে উঠে জানলা দিয়ে দেখি রাস্তা দিয়ে রমাবাবু হেঁটে যাচ্ছে আর দুটো চোখ দিয়ে জোড়া টর্চবাতির আলো ঠিকরে বেরচ্ছে!”
কেউ বলে, “আরে রমাবাবুর মাথার পিছনে আলোর চাকাটা দেখিসনি? ও বাবা, চাকাটা আবার বনবন করে ঘুরছিল!”
আর-একজন বলে, “ভাই, মিছে বলব না, মাঝরাতে দেখলুম একজন লোক শূন্যের উপর হেঁটে-হেঁটে বাগমারির দিকে যাচ্ছে। এখন বুঝতে পারছি সেটা স্বপ্ন নয়, জলজিয়ন্ত আমাদের রমাবাবু!”
গর্জন পানি এগিয়ে এসে বলে, “নিজের চোখে দেখা বলেই বলছি, আজ ভোরবেলা উঠে একা-একা একটু ঝগড়া প্র্যাকটিস করছিলুম, তখন দেখি আমাদের রমাবাবু রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন আর রাস্তার কুকুর-বিড়ালেরা সব সাষ্টাঙ্গে রমাবাবুকে প্রণাম করছে!” সঙ্গে-সঙ্গেই বাসুলি রায় ফোঁস করে উঠে বলে, “ওসব বাজে কথায় কেউ কান দেবেন না। আমি স্বচক্ষে দেখেছি রমাবাবুকে, এই মাগুর মাছের সাইজের সাদা পোশাক পরা দশ-বারোটা পরি ঘিরে ধরে সঙ্গে-সঙ্গে উড়ে যাচ্ছে।”
কেউ-কেউ অবশ্য জোর গলায় বলল, “আরে ব্রহ্মজ্ঞান না হাতি! গুলগাপ্পি মারার আর জায়গা পায়নি!”
রমেশ গুণ বলে, “আরে দূর-দূর, সুদখোর কখনও বেন্মজ্ঞানী হয় নাকি!”
কালী পাণ্ডা বলে, “বলা যায় না হে, এই কলিযুগে পাপীতাপীদেরই পোয়াবারো কিনা! দশ-বারোটা খুন করার পর মেঘুডাকাত নাকি বোষ্টম হয়ে এখন কৃষ্ণনাম নিয়ে দিন-রাত চোখের জল ফেলছে।”
জহর ঘোষ বেশ হেঁকেই বলে, “ওহে তোমরা সবাই শোনো, রমাচরণ যদি ব্রহ্মজ্ঞানী হয়ে থাকে তা হলে আমিও ভারতবর্ষের রাষ্ট্রপতি!”
হরেন গোঁসাই দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলে, “ব্যাটা আমার বউয়ের তেরো ভরি সোনার গয়না মেরে দিয়ে এখন বেম্মজ্ঞানী দেখাচ্ছে! আকাশে চাঁদসুয্যি যেমন সত্যি ওর নরকবাসও তেমনি সত্যি।”
পরনে গরদের জোড়, গলায় জুঁইয়ের মালা, মুখে অমায়িক হাসি আর বিনয়-বিগলিত ভঙ্গিতে রমাচরণ জোড়হাতে সামনের খোলা বারান্দাটায় বেরিয়ে এসে একটা কাঠের চেয়ারে বসে চিনিমাখানো মিষ্টি গলায় বলল, “আপনারা সবাই আমাকে অভিনন্দন জানাতে এসেছেন বলে আমি কৃতজ্ঞ। এ তো আমার একার গৌরব নয়, এ গৌরব আপনাদেরও।”
যজ্ঞেশ্বরের ঠাকুরমা চোখের জল ফেলতে ফেলতে দুটো টাকা প্রণামী দিয়ে আভূমি পেন্নাম করে ফেলল। দেখাদেখি আরও কয়েকজনও একটাকা-দু’টাকা করে প্রণামী দিতে লাগল। কয়েকজন বলে উঠল, “আমাদের আশীর্বাদ করুন বাবাঠাকুর!”
“নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই, ” বলে বরাভয়ের ভঙ্গিতে ডান হাতটা সবে তুলেছিল রমাচরণ, এমনসময় গুনেনবাবুর বাজখাঁই গলা শোনা গেল, “ওহে রমাচরণ, থামো!”
রমাচরণ চমকে উঠে বলে, “আজ্ঞে!”
“আশীর্বাদ কি হরির লুটের বাতাসা নাকি হে, যে বিলিয়ে দিচ্ছ? তার উপর এ হল বেম্মজ্ঞানীর আশীর্বাদ, ফলবেই কী ফলবে! আশীর্বাদ এখন থেকে আর সস্তা নয়, বুঝলে?”
রমাচরণ তটস্থ হয়ে বলে, “তা কী করতে হবে গুনেনখুড়ো?”
“এক কাজ করো, আশীর্বাদপিছু পাঁচশো টাকা করে দক্ষিণা লাগু করে দাও। শুকনো আশীর্বাদে যে তেমন কাজ হয় না তা আমি ভালই জানি। আশীর্বাদ মজবুত আর ফলন্ত করতে হলে দক্ষিণার মতো জিনিস নেই, বুঝেছ তো!”
রমাচরণ মিইয়ে গিয়ে বিনয়ে মাখো-মাখো হয়ে বলে, “তা অবিশ্যি ঠিক, আর মাথার উপর আপনারা গুরুজনেরা আছেন, আপনার কথা আর ফেলি কী করে! তা হলে বরং তাই হোক।”
পাঁচশো টাকা শুনে ভিড় পাতলা হতে শুরু করল।
গুনেনবাবু হাঁক মারলেন, “ওহে, যারা আশীর্বাদ চাও লাইনে দাঁড়িয়ে যাও। এমন মওকা আর পাবে না।”
কিন্তু কেউ এগোল না। তবে হঠাৎ ভিড় ঠেলে শশব্যস্ত হয়ে গোপাল এসে হাজির, “এই যে রমাচরণবাবু, শুনলুম আপনি ব্রহ্মজ্ঞানী হয়েছেন! ব্রহ্মজ্ঞানীরা তো ত্রিকালজ্ঞ হয় বলে শুনেছি। তা আমার নাম আর পরিচয়টা যদি দয়া করে বলে দেন তা হলে বড্ড উপকার হয়। খুব বেকায়দায় পড়ে গিয়েছি কিনা!”
পাশ থেকে ব্রহ্মজ্ঞান বলল, “খবরদার, ফস করে কিছু কবুল করবেন না যেন!”
পাবলিকের দিক থেকে হাত দিয়ে মুখটা আড়াল করে রমাচরণ বলে, “এটা যে আমার প্রথম কেস রে ব্রহ্মজ্ঞান, এটা ছেড়ে দেওয়া কি ঠিক হবে?”
“এরকম অনেক কেস এখন আসবে মশাই, ভাল চান তো আগড়ম বাগড়ম বলে কাটিয়ে দিতে থাকুন।”
“এহ, তা হলে ব্রহ্মজ্ঞানী হয়ে আমার লাভটা কী হল শুনি?”
“মাত্র ওয়ান পার্সেন্ট ব্রহ্মজ্ঞান নিয়ে কি আর সবজান্তা হওয়া যায় মশাই? মাত্র লাখখানেক টাকা ফেলে দিলেই পূর্ণ ব্রহ্মজ্ঞানটা হয়ে যেত, আর তা হলে এসব খুচরো সমস্যাও থাকত না! নিজের স্বভাবদোষে এমন মোক্ষম সুযোগটা হারালেন তো! কঞ্জুস মক্ষীচুষদের এরকমই অবস্থা হয়।”
“বেশি ফটফট না করে এখন একটা উপায় বলে দে না!”
“লোকের ব্রহ্মজ্ঞান হলে চেপেচুপে রাখে, অমন ভ্যাড়ভ্যাড় করে লোককে বলে বেড়ায় না! আপনি তো দাঁত কেলিয়ে শতখান হয়ে রটিয়ে ফেললেন! এখন আপনিই ঠেলা সামলান।”
গুনেনবাবু হাঁক মেরে বললেন, “ওহে রমাচরণ, তোমার কি সমাধি হয়ে গেল নাকি হে? ব্রহ্মজ্ঞানীদের নিয়ে এই এক মুশকিল, যখন তখন সমাধি হয়ে যায়!”
ব্রহ্মজ্ঞান চাপা গলায় বলে, “এই সুযোগ মশাই! জোর বেঁচে গিয়েছেন! এখন সমাধির ভান করে চোখ বুজে মটকা মেরে থাকুন। খবরদার হাঁচিটাচি দেবেন না, কাশবেন না আর হাই তুলবেন না। সমাধিতে ওসব নিষিদ্ধ, মনে থাকে যেন!”
হাওয়া বুঝে মটকা মারতে এক লহমাও সময় লাগল না রমাচরণের। গুনেনবাবু বারবার ঘড়ি দেখে অবশেষে বললেন, “ওহে গোপাল, রমাচরণ এবেলা আর শরীরে ফিরবে বলে মনে হচ্ছে না। হয়তো ব্রহ্মলোকে গিয়ে মিটিংটিটিং করছে। তুমি বরং কাল সকাল সকাল চলে এসো।”
“যে আজ্ঞে।”
“আমিও বাড়ি যাই, ব্রহ্মজ্ঞানের ফেরে পড়ে এখনও প্রাতঃকৃত্যাদি হয়নি কিনা।”